সূর্য ডোবার আগে পর্ব-৫

0
1607

#সূর্য_ডোবার_আগে
পর্ব-৫
লেখিকা ~ #সুমন্দ্রামিত্র
কঠোরভাবে প্রাপ্তমনষ্কদের জন্য।
.
.

নাহ্ …. বৃষ্টিটা আজ আর থামবে না মনে হচ্ছে! সকালের ওই এপিসোডটার পর পিহুও নিজের ঘরে দরজা ভিজিয়ে বসে আছে, দুপুরের খাবারের সময়ও বেরোয় নি। আজ আর পিহুর ট্রেনিং হলো না। খাওয়ার টেবিলে অভিমন্যু অপেক্ষা করছে দেখে গভর্নেস দিদি বলে গেলেন পিহু আজ ঘরেই খাবে, অভিমন্যু যেন খেয়ে নেয়।

শ্বেতপাথরের বড়ো টেবিলটার এককোনে ক্যাসারোল থেকে নিজের মত খাবার বাড়তে থাকল অভিমন্যু। এ বাড়িতে কোন মহিলা নেই, শরিকি আত্মীয় স্বজন আছেন, তাদের রান্না আলাদা, ঢোকা বেড়োনোর জায়গা আলাদা। অভিমন্যু না থাকলে হয়তো সেই শরিকি মাসি পিসিরা কখনো সখনো পিহুকে দেখতে আসে, না হলে এদিকের এত বড় বাড়িটায় পিহু একাই থাকে। যদিও আয়া সেন্টার থেকে তিনবেলার আয়া আসে পিহুর কাজকর্ম করে দিতে, ঘরের কাজের জন্য ঠিকে ঝি আছে আর আছেন গভর্নেস, নীলিমাদেবী। এ বাড়ির কর্ত্রী, অভিমন্যু আর পিহুর মা মারা যাওয়ার থেকে নীলিমাদেবীই পিহুকে মানুষ করেছেন বলতে গেলে। অভিমন্যু তখন কলেজে পড়তো….. সেই রুরকীতে। ওর দাদুই দেখাশোনা করে মাঝবয়সী বিধবা নীলিমাদেবীকে রেখেছিলেন পিহুর কেয়ার নেওয়ার জন্য। বারণ করেছিলেন অভিমন্যুকে ফিরে আসতে। পিহু তখন নয় বছরের। নীলিমাদেবী পিহুর লেখাপড়া থেকে শুরু করে খাওয়াদাওয়া, সব ভার নিয়ে নেন। হুইলচেয়ারে বসেই পিহুকে উনি শিখিয়েছেন সেলাই মেশিন চালাতে, জামাকাপড় ডিজাইন করতে। ছুটিছাটায় বাড়ি এসে অভিমন্যু আড়াল থেকে শুনেছে নীলিমাদেবী পিহুকে বোঝাচ্ছে “তোমার পা দুটো অচল, কিন্তু হাতদুটো তো সচল, সেগুলো ব্যবহার কর। যতদিন তুমি নিজেকে প্রতিবন্ধী মনে করবে, আশেপাশের সবাই ততো তোমাকে করুণা করবে, আর সেই করুণা ধীরে ধীরে একদিন বিরক্তিতে পরিণত হবে। তুমি কি সবার বিরক্তির পাত্রী হয়ে বেঁচে থাকতে চাও?” মাথার দুদিকে ঘাড় নেড়েছিল পিহু আর দরজার আড়াল থেকে রাগে জ্বলে উঠেছিল অভিমন্যু। দাদুর কাছে গিয়ে ফেটে পড়েছিল — এখনই তাড়াও ওই মহিলাকে, পিহুকে ভুলভাল শিক্ষা দিচ্ছেন উনি।

৬২’র ভারত চীন যুদ্ধের এয়ারফোর্স অফিসার, নাতিকে শান্ত করেছিলেন। বুঝিয়েছিলেন —“পিহু তোমার বোন হলে তুমি এত রিয়্যাক্ট করছো কিন্তু গড়িয়াহাটের ট্র্যাফিক সিগন্যালে ক্রাচ হাতে দাঁড়িয়ে থাকা ওই বেলুনওলাকে দেখে তোমার করুণা হয় না?”

চোখ ফেটে জল চলে এসেছিল অভিমন্যুর। কোনরকমে বলতে পেরেছিল “তুমি পিহুর সাথে একটা বেলুনওলার তুলনা করতে পারলে?”

ধীর শান্ত গলায় দাদু সেদিন হয়তো জীবনের সবচেয়ে বড়ো শিক্ষা দিয়েছিলেন নাতিকে। পাশে বসিয়ে বলেছিলেন — মনটা শক্ত করো দাদুভাই আর বাস্তবটা মেনে নিতে শেখো। কাল তুমি থাকবে না, আমি থাকবো না। পিহুকে একা বাঁচতে হবে এ পৃথিবীতে। আর তার জন্য ওকে আত্মনির্ভর হতে হবে। এত ডাক্তার দেখিয়েও পিহুর শারীরিক প্রতিবন্ধতা ঠিক করা গেল না কিন্তু মানসিকভাবে তো ওকে দুর্বল করে দেওয়া যায় না।ওকে নিজের মত বাঁচতে দাও, একটা স্বাভাবিক মানুষের মত বাঁচতে দাও। পা নেই তো কি আছে, হাত দিয়েই পিহু একটা স্বাভাবিক মানুষের মতো বাঁচবে। ওকে লেখাপড়া শিখতে হবে, চাকরি না করুক – শিল্পী হোক, তুমি আমি ছাড়াও পিহুর নিজের ভালোলাগাটা আবিষ্কার করতে হবে। পিহুর মনের জোর তৈরী করার জন্য নীলিমা পারফেক্ট চয়েজ। বিয়ের একমাসের মাথায় ওর স্বামী শহীদ হয়েছিল, তারপরও মেয়েটার মনের জোর দেখেছো? শ্বশুড়বাড়ির সব অধিকার ছেড়ে দিয়ে একা যুদ্ধ করছে মেয়েটা, সংসারে টিঁকে থাকার জন্য আর সেই মা দুর্গাকে তুমি তাড়িয়ে দিতে বলছো?

 

চুপ করে শুনে গিয়েছিলো অভিমন্যু। আজ আট বছর পর মনে হয়, দাদু ঠিকই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। নীলিমাদেবী না থাকলে পিহু এ বাড়িতে একা থাকতে পারতো না। অভিমন্যুও পারতো না পিহুকে এ বাড়িতে একা রেখে বছরের পর বছর বর্ডারে পরে থাকতে। নাহ্! সকালে বুনির সাথে একটু রূঢ়ভাবেই কথা বলেছে ও। বিকেলেই পিহুকে একটু ঘুরিয়ে আনতে হবে, আর নীলিমাদেবীকেও। ভাত শেষ করে পিহুর ঘরের দিকে এগোলো অভিমন্যু।

*****************************__**************************

ফ্লোরে ঢুকেই ঝড়ের গতিতে সব কাজ সারতে লাগলো তিন্নি, সায়কের সাথে নীচে চা খেতে গিয়ে প্রায় মিনিট চল্লিশেক সময় নষ্ট হয়েছে, মেকআপ দিতে হবে। আগের দিনের ফাংশনাল রিকোয়ারমেন্টগুলো দেখতে দেখতেই রঞ্জনবাবুর মেসেজ ঢুকলো তিন্নির ফোনে, একগ্লাস চা আর তিনটি ট্যাবলেটের ছবি। বাপমেয়ের এই খুনসুটিগুলিই তিন্নির মুখে হাসি ফোটায়। কাজ করতে করতে কখন বেলা দুটো পেরিয়ে গেছে ওর খেয়ালও হয় নি। মার সাথে রাগারাগিতে আজ টিফিনটাও নিয়ে আসা হয় নি! হঠাৎ তিন্নির মনে হল, ও সত্যিই খুব বোকা। এই যে অফিসে মিথিলেশ, বাকি কলীগদের ব্যাঁকা নজর সহ্য করেও মুখ বুজে কাজ করে যাচ্ছে, বাবা ছাড়া ওই কষ্টগুলো আর কে বোঝে। আজ একটু বিদ্রোহ করতে ইচ্ছে হল তিন্নির। ঠিক করলো, আজকে ক্যান্টিন থেকেই ভারী কিছু কিনে খাবে। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। কম্পিউটারটা লক করে ফ্লোর থেকে বেরোবে দরজার মুখোমুখি সায়কের সাথে দেখা। অবাক হয়ে সায়ক বললো

—- কোথায় চললি আবার?

— খিদে খিদে পাচ্ছে, দেখি ক্যান্টিনে কি পাওয়া যায়।

— দুটো বেজে গেছে যে! অফিস ক্যান্টিন তো বন্ধ!

থমকে গেল তিন্নি! একটা দিনই ভাবলো একটু জমিয়ে লাঞ্চ করবে আর সেদিনই ক্যান্টিন বন্ধ!! ওর মখের অবস্থা দেখে হয়তো মায়া হলো সায়কের। নরম গলায় বললো — আমি অর্ডার করে দিই কিছু অনলাইনে? আধাঘন্টায় চলে আসবে!

— নাহ্ থাক!

পায়ে পায়ে আবার নিজের কিউবিকলে ফিরে গেল তিন্নি।

.

.

আমেরিকার ক্লায়েন্টদের সাথে একঘন্টার একটা লম্বা কনফারেন্স কল শেষ করে মিটিং রুম থেকে নিজের ডেস্কে ফিরে এসে তিন্নি অবাক হয়ে গেল। একটা মাঝারি সাইজের কেকের স্লাইস, জিমজ্যাম বিস্কুটের একটা প্যাকেট, লে-জর চিপস আর একটা কোল্ডড্রিঙ্কের ক্যান। মনটা একটু ভিজে এলো তিন্নির, পাক্কা সায়কের কাজ। ওর ডেস্কে গিয়ে সোজা চার্জ করলো তিন্নি

— কি হলো এটা??

মন দিয়ে রিপোর্ট দেখছিল সায়ক, চোখ না ফিরিয়েই বললো — কোনটা কি হল?

চোখ পাকিয়ে তিন্নি বললো — আমার ডেস্কে তুই রেখেছিস খাবারগুলো!

আগের মতই কম্পিউটার স্ক্রীনে চোখ এঁটে সায়ক বললো — প্রুফ কই?

ওর ঠোঁটের কোনার খুনসুটির হালকা হাসিটা ক্রমশ তিন্নির মুখেও সংক্রামিত হলো। কি ভেবে প্যাকেটগুলো নিয়ে সায়কের ডেস্কে ফিরে এসে বললো —- চল একসাথেই খাই!

বাচ্চা ছেলের মত খুশি হয়ে উঠলো সায়ক, চিপসের প্যাকেট খোলার আওয়াজে নিঃশব্দ ওডিসিতে আরও তিন চারটে ক্ষুধার্ত মুখ জেগে উঠলো “আমাকেও দে, আমারেও দে”। সবার সাথে ওই সামান্য খাবার ভাগ করে খেতে খেতে তিন্নির মনে হলো কর্পোরেট অফিস কি সত্যিই অতটা খারাপ? তিন্নি যেভাবে অফিসে কারোর সাথে কথা না বলে মুখ বুজে শুধু নিজের কাজ নিয়ে পড়ে থাকে তাতে তো ওকে নিয়ে আলোচনা হওয়াই স্বাভাবিক! মনে মনে ঠিক করলো তিন্নি, এবার থেকে সবার সাথেই টুকটাক কথা বলবে, আর তারই সাথে, আজকেই বাবার সাথে কথা বলবে নর্থ বেঙ্গলে ঘুরতে যাওয়া নিয়ে।

****************************__**************************
.
.
.

দুপুরের খাওয়া শেষে পিহুর ঘরের দিকে যেতে যেতেই মাউথ অরগ্যানের মিষ্টি একটা সুর শুনতে পেল অভিমন্যু। কে বাজাচ্ছে এত সুন্দর? পিহু না নীলিমাদেবী?দরজা ঠেলে ঢুকতে গিয়েও থমকে গেল অভিমন্যু, সুরটা শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করে তারপর পিহুর ঘরে ঢুকলো একটা নক করে।

—- ভারী সুন্দর তো।

হাসিতে জ্বলজ্বল করে উঠলো পিহুর দুর্বলক্লিষ্ট মুখটা। সোতুৎসাহে বলে উঠলো — ভালো হয়েছে দাদাভাই? গভর্নেস দিদি শিখিয়েছে। তারপরই পিহুর মনে পড়ে গেল দাদাভাইয়ের সাথে তো ওর ঝগড়া হয়েছে! মুখ গোঁজ করে বসে রইলো পিহু, নীলিমাদেবী হালকা হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

অভিমন্যু হাঁটু গেড়ে বসলো পিহুর হুইলচেয়ারের সামনে, জোর করে ওর মুখটা তুলে বললো —- এখনো রাগ কমে নি বোনু? আচ্ছা সরি, এই কান ধরছি।

পিহুর তবু রাগ যায় না। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো — আমার কাছে কেন এলি? যা না, তোর দেশের কাজ কর।

— করবো তো, তবে বোনুসোনা যে আমার লিস্টে সেকেন্ড, তাকে টাইম দিতে হবে না? আর এই যে সুন্দর মাউথঅরগ্যান বাজাতে শিখলি তার প্রাইজ নিবি না?

রাগটা একটু একটু করে হাসিতে ফিরতে ফিরতেই পিহু বললো —আমি কিন্তু চকোলেট খাবো না!

হেসে ফেললো অভিমন্যু। — আচ্ছা চকোলেট খেতে হবে না। বেড়াতে যাবি বিকেলবেলায়?

যেটুকু রাগ ছিল সেটুকুও গলে জল হয়ে গেল পিহুর। আনন্দের চোটে অভিমন্যুর গলা জড়িয়ে ধরে বললো — সত্যি বলছিস দাদাভাই??

— তা নয়তো কি। সাড়ে চারটেয় বেরোবো। এখান থেকে গাড়ি নিয়ে সোজা মোহরকুন্জ যাবো, ওখানে ফুচকা খাবো। তারপর ভিক্টোরিয়া ময়দানের চারপাশে এক চক্কর কেটে বিদ্যাসাগর সেতু দিয় কোনা এক্সপ্রেসে একটা ছোট্ট লং ড্রাইভ তারপর পার্কস্ট্রীটে ডিনার করে বাড়ি। পছন্দ?

— খুব পছন্দ। অভিমন্যুর গলা জড়িয়ে ধরলো পিহু। একটু কিন্তু কিন্তু করে বললো— নীলিমা আন্টিকেও বল না রে দাদাভাই?

মৃদু হাসলো অভিমন্যু — আচ্ছা বলিস।

— ইউ আর দ্য বেস্ট দাদাভাই।

চকাশ করে একটা হামি দিল পিহু, হাসতে গিয়েও অভিমন্যুর বুকের ভেতরটা কেমন টনটনিয়ে উঠলো! সত্যি কত অল্পে খুশি হয়ে যায় পিহু! এই সরলতা যেন কোনোদিন পিহুর ক্ষতির কারণ না হয়। নাহ্, এখনই একবার নতুন খবর পাওয়া ফিজিওথেরাপিস্টকে ফোন করতে হবে। বোনুর গালে একটা হামি খেয়ে পিহুর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল অভিমন্যু।

****************************__***************************

.

.

.

ট্রেনের ওভারহেডে তার পড়ে সেদিন রাতে অনেক লেটে বাড়ি ঢুকলো তিন্নি। কাদা প্যাচাপ্যাচে পাগুলো উঠোনের কলতলায় ধুতে ধুতেই ভাস্বতীদেবী এলেন বারান্দায় কর্কশস্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন — এত রাত কেন হলো? কার সাথে আড্ডা মারছিলি? খুব বাড় বেড়েছে তাই না?

জবাব না দিয়ে অফিসের ব্যাগটা নামিয়ে সোজা বাথরুমে ঢুকে গেল তিন্নি। মুখ হাত পা ভালো করে ধুয়ে ঘন্টাখানেক পর বেরিয়ে দেখলো ভাস্বতীদেবী টিভির সামনে বসে গেছেন, তিন্নির দিকে খেয়াল নেই। পা টিপে টিপে রান্নাঘরে ঢুকে একবাটি মুড়ি বার করলো তিন্নি, সাথে চানাচুরের কৌটোটা নিয়ে পা টিপে টিপে চলে গেল মা-বাবার শোওয়ার ঘরে, অনেক কথা জমে আছে বাবার সাথে। সরল বৌমার ওপর জাঁদরেল কুটিল শ্বাশুড়ির অত্যাচার দেখতে দেখতে ভাস্বতীদেবী তখন হারিয়ে গেছেন সিনেজগতের দুনিয়ায়।

বাবার ঘরে ঢুকলো তিন্নি, সঞ্চয়িতা নিয়ে রঞ্জনবাবু বসে আছেন একটা টেবিলের পাশে, চারপাশে এলেমেলো কিছু কাগজ। তিন্নির পায়ের আওয়াজ পেয়ে পিছনে না ঘুরেই বললেন — এসে গেছিস মা? আজ এত দেরী হলো?

মুড়ির বাটিটা বাবার সামনে নামিয়ে দিয়ে চানাচুরের কৌটো থেকে বাদামগুলো খুঁটে খঁটে খেতে লাগলো তিন্নি, এটা ওর ছোটোবেলাকার স্বভাব। নরমদৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রঞ্জনবাবু বললেন

— খুব খিদে পেয়ে গেছে না? মা কে বল, খাবার দিয়ে দেবে!

চানাচুর খেতে খেতে তিন্নি বললো — ভাই ফিরুক, সবাই একসাথে খাবো। কাল তো ছুটি।

মৃদু হাসলেন রঞ্জনবাবু। বইটা মুড়ে রেখে বললেন — তারপর? আজ অফিসে কি হল শুনি?

মুড়ি খেতে খেতে তরতর করে তিন্নি বলে গেল অফিসে আজ সারাদিন কি কি হয়েছে, টাইমট্রাকিংয়ের নতুন সিস্টেম চালু হওয়া থেকে শুরু করে অফিসে সবার সাথে আজ চিপস ভাগ করে খাওয়া সব। তিন্নির বন্ধু বলতে একমাত্র বাবা, ছোটো থেকে স্কুল-কলেজে যাই ঘটতো , বাড়িতে এসে বাবাকে না বলা অবধি শান্তি হতো না তিন্নি। এখন নিয়মিত অফিস করেও সে স্বভাব বদলায় নি। রঞ্জনবাবু চুপ করে শুনে যান, তিন্নির ওপর কোনো মতামত চাপিয়ে দেন না, বাবা মেয়ের মধ্যে কোনো জেনারেশন গ্যাপ নেই। তাও অফিসে নতুন সিস্টেমের কথা শুনে উনিও চুপ করে গেলেন! একটু ভেবে বললেন — এমনটা হলে তো আর তুই ডেইলি প্যাসেন্জারি করতে পারবি না রে মা! অফিসের কাছেই বাড়িভাড়া করে থাকতে হবে যে!

মাথা নীচু করে তিন্নি বললো — আমি ম্যানেজ করে নেবো বাবা, তুমি চিন্তা করো না। আর, মা আ্যলাউই করবে না আমি বাড়ি ছেড়ে থাকলে।

মাথা নেড়ে রঞ্জনবাবু বললেন — না রে মা। দিনকাল ভালো নয়, অত রাতে ফেরা কলকাতা থেকে ….. কবে কি হবে কেউ কি আগে থেকে বলতে পারে! এই যে প্রতিদিন তিনঘন্টা লাগে যাতায়াতে, আমার কম চিন্তা হয় বল? বুকটা ধুকপুক করে যতক্ষন না তুই অফিস ঢুকে মেসেজ করিস, আবার রাত্রে ফেরা নিয়েও সেই একই টেনশন! আরও রাত হলে…. না না, এর থেকে ভালো, তুই কলকাতায় পেয়িং গেস্টে থাক, তোর মা’কে আমি বুঝিয়ে নেবো। কটা দিন সময় দে আমায়, দেখছি কি ভাবে কথাটা বলা যায়!

সায়কও এই কথাটাই বলছিলো কিন্তু তিন্নি সেটা রঞ্জনবাবুকে জানালো না… যদি বাবা ভুল বোঝেন? যদি মনে করেন সায়কের কথায় নেচে তিন্নি এ প্রসঙ্গ তুলেছে বা সায়কের সাথে তিন্নির কোনো সম্পর্ক আছে? নখ খুঁটতে খুঁটতে তিন্নি বললো — আর একটা কথা ছিল বাবা।

— তোর সেই বেড়াতে যাওয়া নিয়ে?

অবাক হয়ে মুখ তুলে চাইলো তিন্নি —কি করে বুঝলে? তোমার মনে আছে??

মিটিমিটি হেসে রঞ্জনবাবু বললেন — মা রে, চুলগুলো কি আমার এমনি এমনি পাকলো? কাল রোববার, মা’কে বল। আর আমি পারমিশন দিচ্ছি, তোর মা কিচ্ছু করতে পারবে না!

মুড়ির বাটি ফেলে বাবার গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো তিন্নি সেই ছোটবেলার মতো। মেয়ের চুলগুলো ঘেঁটে দিতে দিতে রঞ্জনবাবু বললেন — পাগল মেয়ে একটা। নে এবার একটা কবিতা শোনা দেখি? কতদিন তোর আবৃত্তি শুনি নি!

টেবিলের ওপর পড়ে থাকা সঞ্চয়িতার পাতা উল্টে তিন্নি পড়তে শুরু করলো

কবিবর, কবে কোন্ বিস্মৃত বরষে
কোন্ পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে
লিখেছিলে মেঘদূত! মেঘমন্দ্র শ্লোক
বিশ্বের বিরহী যত সকলের শোক
রাখিয়াছে আপন আঁধার স্তরে স্তরে
সঘনসংগীতমাঝে পুঞ্জীভূত করে।
সেদিন সে উজ্জয়িনীপ্রাসাদশিখরে
কী না জানি ঘনঘটা, বিদ্যুৎ-উৎসব,
উদ্দামপবনবেগ গুরুগুরু রব।

 

মেয়ের সাথে গলা মেলালেন রঞ্জনবাবু। উদগত কন্ঠে পাঠ করতে লাগলেন

ভারতের পূর্বশেষে
আমি বসে আজি; যে শ্যামল বঙ্গদেশে
জয়দেব কবি, আর এক বর্ষাদিনে
দেখেছিলা দিগন্তের তমালবিপিনে
শ্যামচ্ছায়া, পূর্ণ মেঘে মেদুর অম্বর।
আজি অন্ধকার দিবা, বৃষ্টি ঝরঝর্,
দুরন্ত পবন অতি, আক্রমণে তার
অরণ্য উদ্যতবাহু করে হাহাকার।

 

টিভির সিরিয়াল বন্ধ করে দরজার ওপাশে এসে দাঁড়িয়েছেন ভাস্বতীদেবী। তিন্নি কখন বাথরুম থেকে বেরোলো? একবার কাছে এসে বসলো না, খাবারও চাইলো না, নিজেই নিয়ে নিলো? বাবা-মেয়ের সমবেত আবৃত্তিতে বুকের ভেতরটা চিনচিন করে উঠলো ওঁনার, কেন বারে বারে মনে হয় এ বাড়িতে এই দুই উচ্চশিক্ষিত কালচারাল বাপ-বেটির মধ্যে উনি আর ওঁনার মিডিওকার ছেলে শুভ বড়োই ব্রাত্য?

 

ক্রমশঃ

© সুমন্দ্রা মিত্র। ভালো লাগলে নামসহ শেয়ার করবেন।

*************************__******************************

বি.দ্র-এখন থেকে সপ্তাহে চারদিন – মঙ্গল, বৃহষ্পতি, শনি এবং রবিবারগুলোয় #সুর্য_ডোবার_আগে মেনপেজে পোস্ট হবে। পরবর্তী পর্ব বৃহষ্পতিবার দুপুর দুটোয়-

সকল পর্বের লিঙ্ক~
Video Teaser
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145475543838322/?vh=e&d=n
Part 1
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145129087206301/?d=n
Part 2
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145859077133302/?d=n
Part 3
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/146221053763771/?d=n
Part 4
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/146595433726333/?d=n
Part 5
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/147293876989822/?d=n
Part 6
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148075966911613/?d=n
Part 7
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148530310199512/?d=n
Part 8
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148951006824109/?d=n
Part 9
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/149405760111967/?d=n
Part 10
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/150313546687855/?d=n
Part 11
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/151106323275244/?d=n
art 12
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/151923336526876/?d=n
Part 13
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/152353663150510/?d=n
Part 14
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/154065792979297/?d=n
Part 15
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/156163186102891/?d=n
Part 16
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/157132182672658/?extid=QdVQFGSjLzQUsE31&d=n
Part 17
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/157444422641434/?extid=fI3jIc0PCiYXDa0N&d=n
Part 18
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/158095955909614/?extid=1E2JOZfMCmqscBoi&d=n
Part 19
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/158831902502686/?extid=R8zo6L2l274CIQ7r&d=n
Part 20
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/159626782423198/?extid=0e8jrLLhsuLqgsQX&d=n
Part 21
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/160047349047808/?extid=e9DIdFXAkqxTg77U&d=n
Part 22
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/160963752289501/?extid=EgYDh0z3hVr5TCBY&d=n
Part 23
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/161833698869173/?extid=gRK0HHMoLW0bu0gK&d=n
Part 24
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/162740122111864/?extid=KIR9o3zetBHgH9mt&d=n
Part 25
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/163061178746425/?extid=fhzBxEjnlA7n6Ulu&d=n
Part 26
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/163695728682970/?extid=tm0Y81ykORQhpsq9&d=n
Part 27
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/164305438621999/?extid=WsYE2BjXkYvPmqyF&d=n

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here