সৃজা পর্বঃ২৪

0
1120

#সৃজা
পর্বঃ২৪
লেখিকাঃআরুনীয়া চৌধুরী

বাড়ির নিচতলায় হলরুমের মতো জায়গাটায় সবাই বসে আছে।বিশেষ করে নানু ও বসে আছে।তিনি এখন মোটামুটি সুস্থ।সোফায় জায়গা না হওয়ায় কিছু লোক এক্সট্রা চেয়ার নিয়েও বসেছে।তবে বাচ্চারা নেই এখানে।আশ্চর্যের ব্যাপার সাফওয়ান ও নেই।তানভীর ভাইয়া একপাশে দাড়িয়ে আছে।বড় মামা আমাকে দেখে বললেন

“ওই তো এসেছে বউমা।হ্যা এখন বলো কি বলতে চাও।” ষাটোর্ধ লোকটির চোখ চিকচিক করছে।হয়তো তানভীর ভাইয়ার থেকে আশানুরূপ কিছু শুনতে চাচ্ছে।নীরবতা ভেঙে তানভীর ভাইয়া বললেন

“সব ভেবে দেখলাম আমার বিয়ে করা উচিৎ।…

সবার মুখেই হাসি ফুটলো।বড় মামী কথা কেড়ে নিয়ে বললো

“জানতাম,আমার ছেলে আমার কথা ফেলতেই পারে না।আমি মেয়ে দেখেছি বাবা।তোর যাকে পছন্দ তাকেই বিয়ে করবি।”

তুলিকে হাক দিয়ে বললেন

“এই তুলি যা আমার ড্রয়ার থেকে ছবিগুলো নিয়ে আয়।”

তানভীর ভাইয়া থমথমে মুখে বললেন

“আমার মেয়ে পছন্দ করা আছে।আর ওকে ছাড়া আমি কাউকে জীবনসঙ্গী করতে পারবোনা।”বড় মামী অবাক হলেন।তার ছেলের মুখে তো কখনো কোনো মেয়ের কথা শুনেননি।তাহলে কার কথা বলছে সে।তারপরও খুশি হলেন,ছেলে বিয়ে করবে এটাই অনেক।

বড় মামা খুশি হয়েছে কিনা বোঝা গেলো না।তবে তিনি জানেন ছেলের জেদ সম্পর্কে যাকে বলবে তার সাথেই বিয়ে হবে।মুখটা গম্ভীর করে বললেন

” মেয়ের নাম বলো আমরা প্রস্তাব নিয়ে যাই।তোমার বিয়ের জন্য তোমার ছোট ভাইয়ের বিয়ে আটকে আছে।যত তারাতাড়ি সম্ভব বিয়েটা সেড়ে ফেলতে চাই।”

তানভীর ভাইয়া অকপটে বললেন “ইটস সানিয়া।”

হলরুমে ছোট খাটো একটা ভূমিকম্প হলো।সবাই চমকে তার দিকে তাকালো।শুধু নিশ্চুপ ছিলাম আমি আর আমার শ্বশুরমশায়।ইমরান চৌধুরীকে দেখে মনে হলো তিনি জানতেন এমনটাই হবে।

আম্মা চমকালেও তিনি যে খুশি হয়েছেন তা বোঝা যাচ্ছে।তার চোখ চকচক করছে।এতোদিন মেয়েটা মায়ের কাছে থাকলেও তার মা তাকে প্রতিটা মুহূর্তে শুধু কঠোর হতে দেখেছে।টিউলিপের বাবার মৃত্যুর পর মেয়েটার মুখ দেখলেই সাফিয়া বেগমের বুকটা ধ্বক করে উঠতো।বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হতো তার।তানভীরের কথায় তিনি যারপরনাই খুশি হয়েছেন এমন ভদ্র,নম্র ছেলেই তো চেয়েছিলেন তিনি।যে সানিয়ার জীবনটা গুছিয়ে দিবে।সাফিয়া বেগম স্বামীকে মৃদু স্বরে বললেন

“একি আমি ঠিক শুনলাম।” ইমরান চৌধুরী স্বাভাবিক মুখেই বললেন

“হ্যা ঠিক শুনেছো।তানভীর আমাকে আগেই এ ব্যাপারে জানিয়েছে।তবে আমার মেয়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছুই হবে না।”

সাফিয়া বেগম যেন উত্তরটা শুনে নিভে গেলেন।মনের মধ্যে যে ক্ষীণ আশার দ্বীপ জলেছিল সেটা নিভু নিভু প্রায়।যদি সানিয়া রাজী না হয়?এরকম হীরের টুকরো ছেলে তো আর পাবেনা।

বড় মামী সহসা কিছু বলতে পারলেন না তবে মিনমিন করে আওড়ালো
“ও তো বিবাহিত বাবা,তার উপর ওর মেয়েও আছে।”

“আমি সব জানি মা।বিয়ের পর টিউলিপ আমার পরিচয় পাবে।”
বড় মামীর মুখটা দেখার মতো।তবে তিনি খুবই ক্ষুব্ধ। ছেলের জেদের কারণে চুপ করে রয়েছে।বড় মামা বললেন

“তুমি যা বলছো ভেবে বলছো?এ ব্যাপারে সানিয়ার মত নেয়াও জরুরী।”বড় মামী মামাকে দিকে তাকিয়ে রেগেই বললেন
” একটা বিবাহিত মেয়েকে আমার ছেলের বউ করবে তুমি।”মামা থামিয়ে দিলেন তাকে।বললেন

“তুমি চুপ করো।বিবাহিত বলে কি মেয়েটা মানুষ না?বড় মামী বিরবির করে বললেন বোনের মেয়ের প্রতি বেশিই দরদ।তবে কথাগুলো কেউ শুনতে পেলো না।সকলকে থামিয়ে বড় মামা নানুর দিকে তাকালেন
” আম্মা আপনি বলেন কি করব?আপনার কথাই এখনো এ বাড়ির শেষ কথা।”

নানু কিছুটা ঠিক হয়ে বসলেন।তারপর গলাটা পরিষ্কার করে বললেন
“আমার বড় নাতীকে আমি চিনি সে যা বলে তাই করবে।তবে যা সে সম্মান ক্ষুইয়ে করবে আমি চাই সেটা সম্মানের সাথেই করা হোক।তবে তার আগে আমার নাতনীরও মতামত নেয়া দরকার।কোথায় সে?”

তানভীর ভাইয়া আমাকে ইশারা করলেন বুবুকে নিয়ে আসতে।উত্তেজনায় আমার পা চলছেই না।তাড়াতাড়ি করে বুবুর রুমে গেলাম।হঠাৎ করে রুমে ঢোকায় বুবু কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো।আজ একটা থ্রি-পিস পরেছে সানিয়া।দেখে মনেই হচ্ছে না সে এক বাচ্চার মা।সৃজা খুশিখুশি মুখে বললো
“নিচে চলো বুবু।তোমাকে ডাকছে।আর একটা অনুরোধ প্লিজ রাজী হয়ে যেও।”সানিয়া বিনিময়ে একটা মুচকি হাসি দিলো।
সিঁড়ির মাথায় এসে দাড়াতেই সকলের দৃষ্টি সানিয়ার উপর পরলো।নানু বললেন
” দিদিভাই আমার পাশে এসে বসো।”সানিয়া তার পাশে গিয়ে বসলো।

“আমি যা বলবো ঠিক করে শুনবে তারপর নিজের মত দিবে।তানভীর দাদুভাই তোমাকে বিয়ে করতে চায়।ছেলে হিসেবে সে লাখে একটা।কিন্তু সে শুধু তোমাকেই বিয়ে করবে বলছে।গত চার বছর কম মেয়ে দেখা হয়নি তার জন্য।সে শুধু এড়িয়ে গেছে।” কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন তিনি।তারপর আবারো বললেন

“বিয়ের আগে তোমাদের সম্পর্কটার ব্যাপারে আর কেউ না জানলেও আমি জানতাম।তানবীর দাদুভাই আমার কাছে আগেই তোমাকে চেয়েছিল।কিন্তু তুমি হুট করে ওর ওপর রাগ করে বিয়েটা করে ফেললে।তাই কিছু করারও ছিল না আমাদের।”

এই কথাগুলো শুনে যেনো মানুষগুলো আরো একবার অবাক হলো।তাইতো সানিয়াকে চায় তানভীর।এবার সবটা পানির মতো পরিষ্কার ঝকঝকে মনে হলো সবার কাছে।

“এবার বলো তোমার কি মত?তুমি চাইলে সময়ও নিতে পারো।”

তানভীর ভাইয়া নানুকে থামিয়ে দিয়ে বললো
“ও কি বলবে।আমি যা বলবো ও তাই করবে।কি রে বল তুই রাজী।শুধু মাথা নাড়ালেই হবে।তাহলেই সবাই বুঝে যাবে।”

তানভীরের সাথে যে সানিয়ার সম্পর্ক কতটা গভীর ছিল তা তার চোখের আকুলতাই প্রকাশ করছে।সে সানিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।আর মনে প্রাণে চাইছে রাজী বলে দে।
সানিয়ার মন তখন দোটানায় ভুগছে।এই মানুষটাকে তো সে সত্যিই ভালোবাসে।অভিমান করেই তো কতকিছু হয়ে গেলো।এখন নাহয় তার কথাই সই।তানভীরের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে সানিয়া বললো
“আমি রাজী।আপনারা বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারেন।তবে কোনো আয়োজন হবে না।”তানভীরের মুখে হাসি ফুটলো।তানভীর ভাই সবার দিকে তাকিয়ে বললেন

” আমি চাই আগামিকালই বিয়েটা হোক।সানিয়ার কথামতো কোনো আয়োজন হবেনা।ও আমার জীবনসঙ্গী হবে এতেই আমি খুশি।”
মেয়ের মুখে ইতিবাচক উত্তর শুনে যেনো সানিয়ার মা এবং বাবা চাঁদ হাতে পেলো।ইমরান চৌধুরী বুকে জড়িয়ে ধরলেন তানভীর ভাইকে।চোখের কোনটা নিঃশব্দে মুছে উপরে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালেন।সাফিয়া চৌধুরী ব্যস্ত হয়ে গেলেন তার হাতে সময় কম।মেয়ের গয়নাগুলো অন্তত কাউকে দিয়ে আনতে হবে।তিনিও ব্যস্তসমস্ত হয়ে মেয়ের মাথায় একটা চুমু খেয়ে উপরে চলে গেলেন।

এই আনন্দের মুহূর্তে সৃজা মিষ্টি নিয়ে এলো।বড় মামীর মুখটা শুধু মলিন।আর সবার মুখেই হাসি।সৃজা সেটা খেয়াল করলেও তার মাঝে ক্ষীন আশা আছে সময়ের সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে।তার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তীর বিষয় টিউলিপ বাবা ডাকতে পারবে কাউকে।সবাইকে থামিয়ে তানভীর ভাইয়া বললো

“আমি টিউলিপকে এডপ্ট নিবো।এবং কালই সব লিগ্যালি সাইন করবো।আশা করি কারো আপত্তি নেই।আর আপত্তি থাকলেও আমার সিদ্ধান্তে আমি অটল।”
সানিয়া হয়তো এটা জানত।সে এ ব্যাপারে কিছুই বললো না।সানিয়া জানে সে তার বহু আকাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে পাচ্ছে।তার সব সিদ্ধান্তই চিরকাল বেদবাক্য সানিয়ার জন্য।এই মুহূর্তে সানিয়া খুব করে ভাইটাকে মিস করছে।কোথায় সে?

সৃজার দিকে এগিয়ে গেলো সানিয়া।সৃজা খুশিতে তাকে জড়িয়ে ধরলো।আত্মহারা হয়ে সে বলেই ফেললো
“আমি খুব খুশি বুবু।” সানিয়াও মুচকি হাসি ফেরত দিলো।হয়তো এতোদিনের মেকি খোলস থেকে সে বেরিয়ে আসার রাস্তা পেয়েছে।

“সাফী কোথায়?ওকে দেখছি না কেনো?” সৃজা থতমত হয়ে গেলো।সেটাই তো এই খুশির দিনে তিনি কোথায়।সকালে যে বের হলো আর তো আসেনি।সৃজা আশ্বাস দিয়ে বললো
“তুমি ভেবো না বুবু।তোমার ভাই হয়তো ব্যস্ত আছে।আমার বিশ্বাস উনিই সবচেয়ে বেশি খুশি হবে।”

সাফওয়ান এলো একেবারে রাতে।বাড়িতে আজ অন্যরকম পরিবেশ বিরাজ করছে।কেমন আনন্দের আমেজ। দেরি না করে নিজের রুমে গেলো সাফওয়ান।সৃজা রুমে নেই।সেদিকে না তাকিয়ে আগে ফ্রেশ হতে গেলো।ফিরে এসেও সৃজাকে দেখল না।রুম থেকে বেরিয়ে এলো।এ রুম ও রুম করে খোজ লাগাল।নোভাদের রুমের সামনে এসেই থমকে গেল।

সৃজা তখন নোভাদের রুমে।দুবোন তাকে ধরেছে কাল কি পরবে তা ঠিক করে দিতে।গত দু ঘন্টা যাবত এটাই হচ্ছে।কাবার্ডের সব জামা কাপর বিছানায় নামানো তারপরও ঠিক করতে পারছেনা কোনটা পরবে।সৃজা অধৈর্য হয়ে মুখে হাত দিয়ে বসে আছে।এর মধ্যে দরজার দিকে চোখ গেলো।একি সাফওয়ান দাড়িয়ে আছে।কখন এলো উনি।সৃজা উঠে দাড়ালো
“আমি আসছি।তোমরা রাত ভরে ঠিক করো কোনটা পরবে।”
নোভা জাপটে ধরলো সৃজার হাত

“না বউমনি যেয়ো না।আগে জামা চয়েজ করে দাও।নাহলে কাল দেখবে একটা ফকিন্নি মার্কা জামা পরে আছি।”

সৃজা দরজার দিকে ইশারা করল।সেদিকে তাকিয়ে এমনি হাত ছেড়ে দিল নোভা।নাতাশা বললো

“তুমি যাও বউমনি। কালকেও ঠিক করে দিতে পারবে।”

হায় আল্লাহ এই মেয়ে বলে কি।সৃজা বেরিয়ে আসার আগেই সাফওয়ান ওদের ইশারা করে বললো

“নিজেদের জিনিস নিজেরা চয়েজ করবে এরপর থেকে।” সৃজার দিকে তাকিয়ে বললো

“তুমি রুমে চলো।”

নোভা আর নাতাশার মুখটা চুপসে গেলো।তার মাথা নাড়িয়ে হ্যা বললো।

সৃজাও অনুগত স্ত্রীর মতো সাফওয়ানের পিছু পিছু এলো।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here