সৃজা” পর্ব – ১২

0
1268

#সৃজা
পর্বঃ১২
লেখিকাঃআরুনীয়া চৌধুরী

বিকেল ৫টার দিকে টিউলিপের দাদা-দাদী আসলো।ওনাদের দেখলে মনে হবে নিউ ম্যারিড কাপল।কারণ আসার পর থেকে টিউলিপের দাদা ওর দাদীর হাত একবারের জন্যও ছাড়েনি।কারণটা বোঝা গেলো না।টিউলিপের দাদীর আচরণ দেখে যা বোঝা গেলো উনি খুবই স্ট্রীক্ট মহিলা।নিজের স্বামীকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরায়।ইস্ বেচারা।পোশাকেও তার আধুনিকতা রয়েছে।

টিউলিপ তার দাদীর কাছে এসেছে ঠিকই তবে চুপ করে আছে।কিছু বলছে না।তারা ওর কাছে নতুন মানুষ।ওর মনে সংকোচ কাজ করছে।নিজের দাদীও পর হয়ে যায় যদিনা সবসময় যোগাযোগ থাকে।উনারা এতোদিন শুধু ফোনে মাঝে মাঝে টিউলিপকে দেখেছে।কিন্তু আজ সরাসরি দেখে দুজনেই কেঁদে দিবে মনে হচ্ছে। বিশেষ করে ওর দাদী টিউলিপকে জড়িয়ে ধরে বিলাপ করলেন কিছুক্ষণ। যদিও তিনি যথেষ্ট আধুনিক একজন মহিলা। বিদেশি সংস্কৃতির মধ্যে থাকলেও বাংলার সংস্কৃতি অজান্তেই অনুসরণ করে।এটা বোধ হয় সকল বাঙালীর ক্ষেত্রেই এক।

আমিতো নিজের দেশকে ছেড়ে যাওয়ার চিন্তাও করি না।হুট করে কবে বোধদয় হলো আমার দেশ আমার মায়ের মতো তাকে ছেড়ে যাবোনা।দেশের জন্য কিছু করার ইচ্ছা ছিলো ব্যাপক।যদিও ইচ্ছাটা এখনো আছে।

তাদের একজন মেয়েও আছে সে নাকি রাতে আসবে।এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি কোন বন্ধুর বাসায় গেছে।জানি না সে কেমন হবে।

আমাকে দেখে পাশে বসতে বললেন।আমি সালাম দিলাম।মহিলা খুবই সুন্দরী।মুখের রগটাও ভেসে উঠেছে তার ধবধবে সাদা চামড়ার উপর।আমাকে দেখে বললেন

“বাহ্ বেশ সুন্দরী মেয়ে এনেছেন দেখছি বেয়ান।”বলতে বলতে একটা স্বর্ণের চেইন আমার গলায় পরিয়ে দিলেন।বললেন

“বিয়ের উপহার হিসেবে কিছু দিতে পারিনি তাই এখন দিলাম।তা তোমার নাম কি?”

আমি বললাম” সৃজা।”

” তোমার বাবা কি করে?নিশ্চয় ঢাকার কোনো বড় বিজনেসম্যান।”

“জ্বী না আমার বাবা গ্রামে থাকে উনি চেয়ারম্যান।গ্রামে মাছের আড়ত আছে।আমাদের ফসলি জমিও আছে।”

“ওহ্ আই সি।তা বেয়ান আমার মেয়ে কম ছিলো কোথায়? শুধু একটু শ্যাম বর্ণের।এছাড়া আমাদের তো টাকার অভাব নেই।আপনাদের মতো নেই তবে কম তো নেই।” আমাকে পাশে বসিয়েই আম্মার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললেন তিনি।আমাকে সরাসরি অপমান করলেন তিনি।কিন্তু এ মুহূর্তে কিছু বলতেও ইচ্ছে করছে না।অপমানে শুধু মাথাটা নিচু করে রাখলাম।

আম্মা একবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন

“সৃজা তুমি উপরে যাও।পড়া রেখে এখানে বসে থাকার দরকার নেই।চৌধুরী বাড়ির বউ এতোটা সস্তা নয়,যে কেউ অপমান করবে আর তাকেও সহ্য করতে হবে।”

একবার আম্মার দিকে তাকিয়ে আমি চলে গেলাম।যেতে যেতেই শুনলাম

“বেয়ান আপনারা এসেছেন অতিথি হিসেবে যথেষ্ট সম্মান পাবেন।তাই বলে আমার বাড়ির বউকে অপমান করার অধিকার আপনার নেই।আর রইলো আপনার মেয়ে চৌধুরী বাড়ির বউ হতে সৌন্দর্য বা টাকার কোনো প্রয়োজন নেই দরকার যোগ্যতা।আর আপনার মেয়ের যোগ্যতা কতটুকু এটা আপনি ভালো জানেন।”

মুখটা কাচুমাচু করে তিনি বললেন

“আমাদের রুমটা দেখিয়ে দেন বেয়ান।ক্লান্ত লাগছে।” এমনভাবে বললেন যেনো ওনাকে কিছু বলাই হয়নি।

টিউলিপের দাদীর একটা কথা আমার মাথায় ঘুরছে ওনার মেয়ে।এ মেয়ের সাথে আবার সাফওয়ানের কিছু ছিলো নাকি।মাথায় প্রেশার নিলাম না। পড়তে হবে।হয়তো অনুষ্ঠানের কিছুদিন পড়াশোনা হবেনা।কিন্তু ভর্তি পরীক্ষাও খুব কাছাকাছি।

রাতে আম্মার সাথে ডিনারের আয়োজন করার সময় সাফওয়ান এলো ওর সাথে একটা মেয়ে এলো।মেয়েটা খুবই মডার্ণ। অফ স্লিভ টপস আর হোয়াইট জিন্স পরে আছে।আবার সাফওয়ানের হাতও ধরে রেখেছে।আমার চোখটা তাদের হাতের দিকেই আগে গেলো।সাফওয়ান আমার চোখ অনুসরণ করে হাতটা ছোটানোর চেষ্টা করলো।তবে মেয়েটা ছাড়ছেনা।

টিউলিপের দাদীর দিকে গিয়ে বললো

“মাম্মী আমি বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি।এখন ঘুমাবো।আমার রুম কোনটা।”

তাহলে এই সে।আমি আর অপেক্ষা করলাম না।বেলাল্লাপনার একটা সীমা আছে।সবার সামনে দিয়েই একবার সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে গটগট করে উপরে উঠে এলাম।

অসহ্য লাগছে সবকিছু। আমার জীবনটাই কেনো এমন।আর ওই লোকটা কেনো বোঝে না আমার এসব অসহ্য লাগে।রাগে ফোনটা ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় ছুড়ে মারলাম।বিকট শব্দ করে আয়নাটা ভেঙে গেলো।

সাফওয়ান নক করছে দরজায়।আজ দরজা খুলবো না থাক বাইরে।

“সৃজা ওপেন দ্য ডোর।লেট মি এক্সপ্লেইন প্লিজ হানি।”

“রাখুন আপনার হানি।আজ আপনার এ রুমে জায়গা নেই।কি বলেছিলেন আমায় অন্য মেয়েকে ছুবেননা।তাহলে ওই মেয়ের হাত ধরা কি ছিলো।?”

“আমি বুঝিয়ে বলছি।তুমি দরজা খুলো।মানুষের সামনে এভাবে সিনক্রিয়েট করো না।আর এটা ওদের ওই দেশের সংস্কৃতি। ওরা ছেলে-মেয়ে হাত ধরাতে কিছু মনে করে না।এটা স্বাভাবিক তাদের কাছে।আর ওর সাথে আমার কিছু নেই।সত্যি বলছি।”

মনটা তবুও বিক্ষিপ্ত হয়ে রয়েছে।দরজা খুললাম না।বিছানায় এসে শুয়ে পরলাম।সাফওয়ান কতক্ষণ নক করলো।পরে আর আওয়াজ পেলাম না।ঘুমিয়ে গেলাম।আমার এখন শান্তি দরকার।কাল কত মানুষকে সামলাতে হবে কে জানে।হয়তো টিউলিপের দাদীর মতো আরো কেউ আসবে অনুষ্ঠানে।তাদের কথাও তো ভাবতে হবে আমাকে।আমিতো এখন কারো মেয়ে নই কারো বউ।

ঘুম গভীর হতেই বুঝতে পারলাম কারো উষ্ণ নিঃশ্বাস আমার গলায় পরছে।আমার অস্বস্তি হচ্ছে কিন্তু চোখ দুটো খুলতে ইচ্ছে করছেনা।

সকালে ঘুম ভেঙে দেখলাম সাফওয়ান আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে।আজও আমার শাড়ির আঁচলটা ওর শরীরের নিচে।নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম।এতে হাতের বন্ধন আরো গভীর হলো।আমি এবার চেঁচিয়ে বললাম

“এই আমাকে ছাড়ুন।যান ওই মেয়ের কাছে যান।আমার কাছে আসবেন না।”

“এবার কিন্তু বেশি হচ্ছে সৃ।আমি গতকালই তোমাকে বলেছি আমি এলিজাকে ধরিনি উল্টো ও নিজে থেকে আমার হাত ধরেছে।আর তুমি নিজেও দেখেছো এটা আমি ছাড়ানোর চেষ্টা করেছি।”

“তবুও ধরবেন না আমায়।আমার অসহ্য লাগছে আপনার কথা।”

সাফওয়ানের ছোঁয়া আরো গভীর হলো।যত হোক পুরুষ সে এবং যুগ যুগ ধরে পুরুষের চেহারা পাল্টালেও তাদের কিছু বৈশিষ্ট্য একই থাকে।তেমন সাফওয়ানও অন্য পুরুষের মতো স্ত্রীর উপেক্ষাকে পাত্তা দিলো না। সে তার উল্টোটাই করছে।এবার সৃজার সহনীয় পর্যায় অতিক্রম করছে।সে ব্যথা পাচ্ছে।এটা সাফওয়ানের বোধগম্য হচ্ছে না।সে নিজের কাজে ব্যস্ত।

সৃজা মুখ দিয়ে আওয়াজ বের করার চেষ্টা করলো কিন্তু সাফওয়ান দিলো না।একসময় সাফওয়ান নিজেই বুঝতে পারলো সে তার বউকে কষ্ট দিচ্ছে।নিজে থেকেই উঠে গেলো সে।সৃজা বিছানায় অর্ধ-উলঙ্গ অবস্থায় কাতরাচ্ছে।তার চোখের পানি আর শরীরের কাঁপুনি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সাফওয়ান।

পরক্ষণেই সৃজাকে জড়িয়ে ধরলো সে।সৃজার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো

“এই মেয়ে তুমি কেনো বুঝো না তোমার জন্য সবকিছু ছেড়েছি আমি।তুমি রাগ করো কেনো এতো।আমাকে বোঝার চেষ্টা করো।”

সৃজা মিনমিন করে বললো

“আপনিও তো আমাকে বোঝেন না।” তার চোখের পানি সাফওয়ানের বুক ভিজিয়ে দিচ্ছে।সাফওয়ান তা বুঝতে পারছে।এই একটা জিনিস তার পছন্দ না।কিন্তু তার বউটা অনেক কাঁদে।সে বুঝে পায়না এই মেয়ের চোখে এতো জল থাকে কিভাবে।

“চলো ফ্রেশ হবে।আজ বাড়িতে অনুষ্ঠান। আজ প্লিজ কোনো সিনক্রিয়েট করো না।” সৃজাকে কোলে করে ওয়াশরুমে নিয়ে গেলো।সৃজাও চুপ রইলো।

সাফওয়ান আর সৃজা একসাথেই নিচে নামলো।এলিজা দৌড়ে আসলো সাফওয়ানের হাত ধরার আগেই সাফওয়ান খুব জোরে বললো

“এলিজা প্লিজ আমার হাত ধরবেনা।ব্রিটিশ কালচার এখানে ফলো করবেনা।এন্ড মিট মাই ওয়াইফ সৃজা।” সৃজার হাতটা ধরে বললো।

এলিজা কিছুটা মনোক্ষুণ্ণ হলো।খুটিয়ে খুটিয়ে কতক্ষণ সৃজাকে দেখলো।একজন নববধুর সকল ছাপই রয়েছে তার চেহারায়।মেয়েটা তার থেকে বেশি সুন্দরী।ভেবেই মুখটা বিকৃত করেই বললো

“আমি জানি।” তারপরই আবার নিজের স্থানে ফিরে গেলো।

সৃজা ওর ব্যবহারে অবাক হলেও সাফওয়ানের কথায় বুকের ভারটা নেমে গেলো তার।

সৃজা আজ একটা নীল শাড়ি পরলো।শাশুড়ীর দেয়া চুড়িগুলোর সাথে মিলিয়ে হিরের একটা লকেট আর কানে ছোট দুল পরলো।সাফওয়ানের ব্যস্ততার মাঝে একবার রুমে আসলো কাপর বদলাতে।সৃজাকে দেখে সে কিছুটা থমকালো।তারপর কাছে এসে পিঠ আর পেটের দিকটা দেখিয়ে বললো

“এখানে দুইটা সেইফটিপিন লাগাও।শাড়ি পরতে শেখোনি তুমি।আগের গুলাতো ঠিক ছিলো।এটার ব্লাউজ এমন কেনো?”

সাফওয়ানের মুখটা দেখে সৃজার হাসি পেলেও আটকে রেখে বোঝালো সেইফটিপিন লাগিয়েই বাইরে যাবে।

টিউলিপকে প্রিন্সেস ড্রেস পরানো হয়েছে।তার মাথার মুকুটটা অনেক দামী।এটা নিয়েই আশেপাশে কানা-ঘুষা হচ্ছে।আমি আর সাফওয়ান একসাথে নিচে নামলাম।আমার শ্বশুরমশায় তার সমবয়সী কিছু মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো।

“মিট মাই ডটার-ইন-ল সৃজা।চৌধুরী গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রির ৫১℅ মালিকানা যার নামে।”কথাটা শোনা মাত্র আমি চকিত শ্বশুরমশায়ের দিকে তাকালাম।তিনি স্বাভাবিকভাবেই কথা বলছেন।আম্মাও পাশে ছিলেন।তাকে দেখে মনে হলো তিনি আগে থেকেই জানতেন এ ব্যাপারটা।

আমি নিজেকে ধাতস্থ করে তাদের সাথে কথা বললাম।তবে প্রচন্ড জড়তা কাজ করছিলো।ওনারা একসময় সাফওয়ানকে ডেকে বললেন

” ইয়াং মেন একবার মিসেসের সাথে দাড়াও, আমরাও দেখি তোমাদের একসাথে কতটা মানায়।”

সাফওয়ান আমার পাশে এসে দাড়ালো।তাদের কুশল জিজ্ঞেস করলো।কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে তিনিও এ ব্যাপারটা জানতেন।তবে আমি জানিনা কেনো।আর এতো সম্পত্তি আমার নামেই কেনো।সব উত্তর পাবো আম্মার কাছে।

কতক্ষণ পর আমার কাঙ্ক্ষিত মানুষ মাকে দেখতে পেলাম।মা এসেছে। তার গায়ে এতো গয়না দেখে আমি অবাক হলাম।হয়তো আমার ধনী শ্বশুর বাড়ির কথা ভেবেই নিজের অনিচ্ছা স্বত্তেও এগুলো পরেছে।বাবাকে দেখেও মনটা কিছুটা নরম হলো।যতই হোক বাবা তো বাবাই।মাকে নিয়ে আমার রুমে গেলাম।মাতো এসব দেখে অবাক।বারবার আমায় বললেন আমার কপালে এ সুখ যেনো স্থায়ী হয় হে আল্লাহ্।মাকে জড়িয়ে ধরে রইলাম কতক্ষণ। সাফওয়ান এসে মায়ের সাথে দেখা করে গেলো।তার ব্যবহারে মা খুবই খুশি।

অনুষ্ঠানের মাঝপথে সাফওয়ান জরুরী কাজে বাইরে গেলো।সৃজাকে বলে গেলো আসতে দেরি হবে।ডিনার করে ঘুমিয়ে পরতে।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here