সৃজা” পর্ব – ১১

0
1201

#সৃজা
পর্বঃ১১
লেখিকাঃআরুনীয়া চৌধুরী

স্টাডি রুমে গেলাম।সার্ভেন্ট পরিস্কার করছে রুম।এ বাড়ির সব ঝকঝকে তকতকে থাকা চাই।আমার শাশুড়ীমা খুবই নিট এন্ড ক্লিন মানুষ উনি ময়লা একদম পছন্দ করে না।ভুলে যদি কোথাও অপরিষ্কার থাকে তাহলে সার্ভেন্টদের সেদিন রক্ষে নেই।

ইশারায় বললো”ম্যাম ফাইভ মিনিটস।”

ডাইনিংয়ে টিউলিপকে খাওয়ানো হচ্ছে।অন্যদিন হলে সে পুরো বাড়ি দৌড়ে এটা সেটা ভেঙে তারপর খাবার খায়।কিন্তু আজ ভদ্র মেয়ের মতো খাচ্ছে কারণ তার মাম্মা বাসায়।মাকে টিউলিপ ভালোবাসা থেকে ভয় পায়।সে জানে তার মা তাকে প্রচুর ভালোবাসে।আর মা যেটা বলে সেটা শুনে চলা তার উচিত। তবে শুধু মায়ের সামনে।চুপিচুপি সে অনেক কিছুই করে।যা করে সবই সৃজাকে বলে।এতটুকু একটা পুতুল সৃজার।সৃজা এই মেয়েটার মায়ায় সবার আগে জরিয়েছে।

রুমে এসে পরলাম।মায়ের সাথে দুদিন আগে কথা হয়েছিলো।মাকে ফোন দেয়া দরকার।দুবার রিং হলো কিন্তু ধরলোনা হয়তো বিজি আছে।মাকে এসব জানাবো না।তাহলে শুধু শুধু চিন্তা করবে।মায়েরা সবসময়ই সন্তানদের নিয়ে চিন্তা করে সে যত বড় হোক না কেনো।বরং সন্তান বড় হলে চিন্তা আরো বাড়ে তাদের।

ফোনটা নিয়ে বারান্দায় দাড়ালাম।আজ অনেকগুলো বেলি ফুল হয়েছে।আমি আসার পরদিন আম্মা এই গাছটা বারান্দায় লাগিয়েছে।হয়তো তার ধারণা আমার বেলি ফুল পছন্দ।আমার কি ফুল পছন্দ সেটা আমি নিজেই জানিনা।কারণ যখন যে ফুলটা আমার চোখের সামনে থাকে সেটাই ভালো লাগে।এইযে যেমন এখন আমার পছন্দের ফুল বেলি।

দূর থেকে দেখতে পেলাম সাফওয়ান বাড়িতে ঢুকছে।রোদ লেগে তার মুখটা লাল হয়ে গেছে।অতিরিক্ত ফর্সা মানুষদের এমন হয়।আমার মাঝে মাঝে মনে হয় সে আমার থেকেও ফর্সা।তার হাটায় আলাদা একটা গাম্ভীর্য আছে।ঠিক আমার শ্বশুরমশায়ের মতো।এতোদিন পর আমি তার হাঁটা-চলাও খেয়াল করলাম।

“এক কাপ কফি নিয়ে আসো তোমার হাতের।”

“আপনি বসুন আমি যাবো আর আসবো।”

কফি নিয়ে রুমে এসে দেখি উনি ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত।কি আশ্চর্য সারাদিন শুধু কাজ আর কাজ।আমাকে টেনে পাশে বসালেন।ল্যাপটপটা সরিয়ে রাখলেন।

“আমার বউটা এ দুদিন কি করেছে?মমের কাছে শুনলাম তুমি নাকি সেন্সলেস হয়ে গেছিলে।কেনো?আমিতো জানতাম সৃজা একটা বাঘিনী।”

রাগ করে বললাম”বাঘিনীদের কি মন নেই নাকি।আমারতো আরকারো মতো হাজারটা গার্লফ্রেন্ড নেই আছে শুধু একটা জামাই।”

সাফওয়ান বুঝতে পারলো তাকে খোঁচা মেরে কথাটা বলেছে।কিন্তু পাত্তা দিলো না এতে।সৃজার হাতের আঙ্গুলগুলো নাড়াচাড়া করতে লাগলো।

“আচ্ছা বলুনতো আমাদের কোম্পানির জুসে সমস্যা কোথায় ছিলো?যদিও কিছুটা শুনেছি নিউজে তবুও আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই।”

“ওটা আমাদের কোম্পানির জুস ছিলো না।তবে লোগো এবং অন্যান্য সকল দিক দিয়ে আমাদের কোম্পানির মতোই ছিলো।আর কোম্পানির এই কনফিডেনসিয়াল জিনিসগুলো গোপনে চুরি হতো।এতে কোম্পানির কিছু লোক জড়িত ছিলো।যেহেতু আমাদের কোম্পানির মতোই সকল বিষয়ে হুবুহু মিল ছিলো তাই ওরা ভেবেছিলো আমাদের কোম্পানির জুস খেয়েই অসুস্থ হয়েছে বাচ্চারা।প্রাথমিকভাবে আমাকে এর দায়ভার নিতে হবে এটাই নিয়ম।প্রকৃত সমস্যা তারা খুজে বের করতে পারেনি।তাই আসল অপরাধী খুঁজে বের করতে সমস্যা হয়েছে।”

“আপনি পালিয়ে গেলেন কেনো?এখানে থেকেও তো সমস্যার সমাধান করতে পারতেন।”

“তোমার এটাও জানা দরকার।আমাদের কোম্পানির রেপুটেশন বজায় রাখতেই যেতে হলো।যদি আমাকে পুলিশ স্টেশনে যেতে হতো তাহলে এ পরিবারের সম্মানহানি ঘটতো।আর এখন আসল অপরাধী ধরা পরার পর নিউজ চ্যানেল গুলোই বলবে আমি বিজনেস ট্রীপে বাইরে ছিলাম।সিম্পল।”

“এতোকিছু ভাবতে হয় আপনাদের?”

“বিজনেস করতে হলে এসব ভাবতেই হয়।আরো অনেক কিছু জানতে পারবে ধীরে ধীরে।”

“তাহলে আপনি ফোনে কার কথা বলছিলেন?কে আপনার পিছু লেগেছে?”

“আছে এক বাস্টার্ড। এসব তুমি বুঝবেনা। বিজনেসে শত্রুতা থাকবেই।তুমি নিজের পড়ায় মনোযোগ দাও।”প্রথম কথাটা মুখটাকে বিকৃত করে বললেও শেষেরদিকে স্বাভাবিকভাবেই বললো।”

মামার বিষয়টা আমার জানতে ইচ্ছে করছে।প্রশ্নটা দমিয়ে না রেখে করেই ফেললাম

“মামা এ বাসায় আসুক বাবা এটা চায় না কেনো?”

“তোমাকে এটা কে বললো?আর এ ব্যাপারটা বোধ হয় মম তোমাকে ভালো বলতে পারবে।আমি আর তোমার কোনো প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিনা।তোমাকে আদর করতে চাই এখন।”

লজ্জায় সৃজার মুখ লাল হয়ে গেলো।

“তুমি এতো লজ্জা কোথায় পাও।সবসময় আমি কাছে আসলেই লাল হয়ে যাও।তবে তোমাকে এভাবে দেখতে আমার অন্যরকম ফিলিংস হয়।সাফওয়ান নিজ অর্ধাঙ্গিনীর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো পূর্বে যেসব মেয়ের সাথে তার সম্পর্ক ছিলো তারা কেউই কখনো লজ্জা পায়নি।উল্টো তারাই সাফওয়ান না চাইলেও ওর টাকার লোভে পায়ের কাছে পরে থাকতো।তবে এই মুহূর্তে মনে পরে শুধুই আফসোস হচ্ছে।তার জীবনে সৃজার মতো আলো ছিলো কিন্তু সে এর পূর্বেই অন্ধকারে ডুব দিয়েছিলো।সে অন্ধকার দূরে ঠেলেই সৃজার আগমন।

সৃজার গালে সাফওয়ানের ট্রীম করা দাড়ির ছোঁয়া লাগছে।সৃজা এখন সাফওয়ানে উরুর উপর তার গলা জড়িয়ে বসে আছে।সৃজার কোমরটাকে আরেকটু কাছে টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো সাফওয়ান।কপালে কপাল ঠেকিয়ে কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো সৃজার গোলাপি ঠোঁটগুলোর দিকে।কিন্তু সৃজার এখন অস্থির লাগছে।পরিবেশ হালকা করার জন্য বললো

“আম্মা বললো কয়েকদিন পর টিউলিপের জন্মদিন। এবার নাকি বড় করে অনুষ্ঠান করবে।”

“হ্যা, এবার তো পাঁচ বছর হলো।ওর নিজেরও ভালো লাগবে।সারাদিনতো একা থাকে।”কপালে কপাল ঠেকিয়েই বললো।তার উষ্ণ নিঃশ্বাস সৃজার কপোল ছুঁয়ে যাচ্ছে।

“একা কোথায় আমিতো আছি।”মুখটা তুলে সাফওয়ানের দিকে অদ্ভুতভাবে তাকালো।যেনো সে ভুল কথা বলেছে।

” ভাবছি টিউলিপের একটা সঙ্গী আনা দরকার আমাদের কি বলো?” সৃজার দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হাসি দিলো।

সৃজা প্রথমে কিছুক্ষণ বুঝতে পারলোনা সাফওয়ানের কথার মানে।বুঝতে পেরে লজ্জা না পেয়ে উল্টা বললো

“প্লিজ এতো তাড়াতাড়ি না অন্তত দু বছর পর।”

কোন মেয়ে না চায় মা হতে, সৃজাও চায় তবে পড়াটার কথা ভেবে মনে হলো বাচ্চাতো পরেও নেয়া যাবে।এখন বাচ্চা নিলে পড়াশোনায় এক বছর গ্যাপ তার মানে সেটা রিকোবার করতে আরো সমস্যা হবে।কিন্তু সৃজা চায় একজন আদর্শ মা হতে।তার জন্য তো নিজেকে উপযুক্ত করতে হবে।

সৃজার মুখের দিকে তাকিয়ে সাফওয়ান হেসে দিলো।বললো

“আরে বোকা আমিতো এমনি বললাম।তুমি এখনো অনেক ছোট,তাছাড়া তোমার পড়াশোনা বাকি আছে।”

সৃজা খুশি হয়ে সাফওয়ানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। সাফওয়ানও তার মাথায় হাত বুলিয়ে জড়িয়ে ধরলো।প্রিয় মানুষটার ছোঁয়ায় এতো সুখ সাফওয়ান আগে কখনো পায়নি।কই কতো মেয়েইতো তাকে সঙ্গ দিয়েছে এরকম তো শান্তি পায়নি।

 

আজ টিউলিপের দাদা-দাদী আসবে।তারাও লন্ডনে থাকে।বিয়ের পর বুবু সেখানেই ছিলো তাদের সাথে।টিউলিপও তার দাদ-দাদীর কাছেই জন্মেছে। অর্থাৎ জন্মসূত্রে সে ব্রিটিশ নাগরিক।

তবে তাদের সাথে এ বাড়ির সম্পর্ক বেশি ভালো না।এর একটা কারণ হলো দুলাভাই মারা যাওয়ার পর ওনারাও বুবুকে দায়ী করেছে।এমনকি এমন দুঃসময়ে বুবুর পাশেও দাড়ায়নি।দুলাভাইয়ের লাশ ছুঁতেও না করেছিল টিউলিপের দাদী।তবে এখন অনেকটা স্বাভাবিক।

কারণ শোক আর রাগে মানুষ অনেক আঘাতের কথাই বলে ফেলে।রাগের সময় বলা কথাগুলো মানুষ না ভুললেও শোকের সময় বলা কথাগুলো তারা ভুলে যেতে চায়।না ভুললেতো জীবন স্বাভাবিক হবেনা।আর আমরা সবাই স্বাভাবিক জীবন চাই।

 

পুরোনো ক্ষত ঠিক না হলেও টিউলিপকে নিজেদের কাছে রাখতে তাদের সাথে এ বাড়ির সম্পর্ক আছে।আর টিউলিপের প্রতিও তাদের অধিকার আছে।তাই ওর জন্মদিনে তারাই আগে আসবে।

সবাইকে মোটামুটি ইনভাইট করা হয়েছে।বাবা মাকেও বলা হয়েছে। এবার হয়তো মাকে দেখতে পাবো।অনেকদিন হলো দেখি না।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here