#সৃজা
পর্বঃ১৩
লেখিকাঃআরুনীয়া চৌধুরী
ক্ষনেক বাদে নিচ থেকে ডাক এলো টিউলিপ কেক কাটবে,তাকে খুজছে।অগত্যা নিজের মাকে রেখে ছোট মায়ের কাছে যেতে পা বাড়ালো সৃজা।
সিড়ি দিয়ে নামার সময় কতগুলো উৎসুক চোখ তার দিকে চেয়ে রইলো।সাধারণের মাঝেও অসাধারণ সে।সৃজার চলনে প্রকাশ পাচ্ছে সে এ বাড়ির রাণী,আর রাণীর অপেক্ষায় সবাই দাড়িয়ে রয়েছে।নিজ মনে নামছিলো সৃজা।যখন সামনে তাকালো তখন এতোগুলো মানুষের দৃষ্টি দেখে কিছুটা হকচকিয়ে গেলো।অনুষ্ঠানে আসা বেশিরভাগ মহিলাদের শরীরেই শোভা পাচ্ছে ভারী ভারী গহনা।অথচ সবচেয়ে ধনী পরিবারের বউ সৃজার গায়ে হালকা গহনা তারা অনেকেই হজম করতে পারলো না।
তবুও সৃজা যেনো দ্যুতি ছড়াচ্ছে চারপাশে।সৃজার সৌন্দর্য যেনো অনুষ্ঠানে আসা প্রত্যেকটা মেয়েকে মনে মনে বলতে বাধ্য করলো হায়্ এ রূপ যদি আমার হতো।কতগুলো অসন্তুষ্ট চোখও তাকে দেখে অবাক হতে বাধ্য হলো।
টিউলিপ কেক কেটে ফেলেছে কিন্তু কারো মুখেই দিচ্ছে না।সবাই তাকে আদর করে কত কিছু বলছে।আমাকে দেখে তার ঠোঁট প্রসারিত হলো।দেখেই হাতের কেকের বাড়িয়ে দিয়ে বললো
“হা করো ডল মাম্মা।”
অনেকেই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।অনেকটাই আশ্চর্যের ব্যাপার এটা তাদের কাছে।আমি তার পাশে গিয়ে হাটুগেড়ে বসলাম
“টিউলিপ সোনার জন্মদিন আজ তাই প্রথম কেকটা তার মাম্মাকে খাওয়াবে,ডল মাম্মাকে পরে খাওয়াবে।”
টিউলিপ বললো
“মাম্মা তো প্রতিবারই খায় এবার তুমি প্রথমে খাবে।” সানিয়াও সৃজাকে চোখের ইশারায় খেতে বললো।একটা ভাইয়ের বউ তার,বড় আদরের, প্রকাশ না করলেও।সানিয়ার আচরণে তা ঠিকই প্রকাশ পায়।অগত্যা কিছু অপরিচিত মানুষের গোলগোল চোখের ভিরে তাকে কেকটা মুখে দিতে হলো।সৃজা কি জানতো এতো মানুষের ভীরে তার বাবা নামক মানুষটার চোখ জুরিয়ে গেলো দৃশ্যটি দেখে।
টিউলিপের দাদী বললো
“বাব্বাহ্ মামানীর সাথে ভাগ্নীর ভালোই ভাব হলো।এতো করে বললাম আমরা প্রথমবার তার জন্মদিনে আছি যেনো আমাকে প্রথম কেকটা মুখে দেয়।নাহ্ সে তো তার ডল মাম্মার জন্য অপেক্ষা করছিলো।”বলে একটা নকল হাসি উপহার দিলো।
কেক কাটা হয়ে গেলেই সৃজা টিউলিপকে নিয়ে গেলো।ওর ড্রেস বদলানো দরকার এই পরিবেশে এটা পরে ও হাঁপিয়ে গেছে।সানিয়াকে বলে টিউলিপকে সাথে করে নিয়ে গেলো।ওদের একসাথে দেখলে সানিয়ার মনটা প্রশান্তি পায়।সে নিজের মেয়েকে যে আনন্দটা দিতে পারছেনা,সেটা সৃজা ঠিকই দ্বিগুণ করে দিচ্ছে।কিভাবে শোধ করবে সে এ ঋণ!!
তবে আশ্চর্যের ব্যাপার এলিজা এখানে ছিলো না।সাফওয়ান ও নেই এলিজাও নেই। বিক্ষিপ্ত মনকে শান্তনা দিলো সৃজা হয়তো বিষয়টা কাকতালীয়।
মেহমান বিদেয় হতে অনেক দেরি। আমি আর নিচে থাকলাম না।মায়ের কাছে এলাম।একা ছিলো এতক্ষণ। এটা স্বাভাবিক। মা অপরিচিত জায়গায় সহজে মানিয়ে নিতে পারেনা।কিন্তু আমাকে ঠিকই শেখাতো অপরিচিত জনদের মাঝে মানিয়ে নেয়া।শ্বশুর বাড়িতে সবার কথা শুনে চলতে।তবে অন্যায়ের সাথে আপোষ তিনি করলেও আমি সহজে করতে পারিনা।
মাকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম।একদম বাচ্চাদের মতো হয়ে গেছে তিনি।বয়স হলে বোধহয় সব পরিবর্তন হয়ে যায়।দিদির সাথেও বেশি দেখা হয় না মায়ের।একমাত্র দিদির সাথে সব শেয়ার করতাম আমি।বিয়ের পর দিদিও চলে গেলো মালয়েশিয়া বরের কাছে।দিদি চায় মা তাদের সাথে থাকুক কিন্তু স্বামীর মায়া ছেড়ে এই মহামানবী যেতে চান না।মা ঘুমিয়ে পরেছে।আমি চলে যাচ্ছিলাম। কিন্তু বাবাকে দেখে থেমে গেলাম।আমাকে বসতে বললেন।বিনা সংকোচে এই প্রথম আমি তার কথা মানলাম।নীরবতা ভেঙে তিনি বললেন
“কেমন আছো মা?”
সৃজা কিছুটা রুক্ষ স্বরে বললো
“ভালো।”
মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেলো। কিছুটা থেমে বললেন
” হয়তো আমি জীবনে অনেক অন্যায় করেছি,তোর মাকেও কষ্ট দিয়েছি।এখনও দেই।আমার মতো খারাপ স্বামী,খারাপ পিতা দুটো নেই মা।”বলতে বলতে তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো।
কিছুই বললাম না।মাথা নিচু করে চুপ করে রইলাম।আজ এতোদিন পর এসব কেনো বলছে বাবা।তবে কি উনি শেষ বয়সে এসে নিজের ভুল বুঝতে পারছে।আর সব মানুষের ক্ষেত্রেও এটা হয়,জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে নিজের ভুলগুলো মনে পরে।কিন্তু হায়্!তখন কিছুই করার থাকেনা।
“আমি জীবনে অনেক পাপ করলেও তোমাদের সে পাপ ছুঁতে পারেনি।তবে তোমরা আমার পাপের সাথে সাথে আমাকেও ঘৃণা করলে।আমারই দোষ ছিলো।এই বিয়েতে তুমি রাজী ছিলে না কিন্তু আমারও বেশি উপায় ছিলো না।তাছাড়া জামাই এর মা আমার কোনো এক ভালো কাজের প্রতিদান স্বরূপ তোমাকে এ বাড়ির বউ করেছে।আমি বিয়ের আগেই জানতাম এ বাড়ির যত সম্পত্তি আছে তার অধিকাংশ সাফওয়ান চৌধুরীর বউয়ের নামে হবে।”
কথাটা শুনে চকিত হয়ে বাবা দিকে তাকালাম।তিনি আমাকে আশ্বস্ত করলেন।তারপর আবার বললেন
“এই সম্পত্তির জন্য হলেও তোমাকে এরা কখনো অবহেলা করবেনা।এখন তোমার প্রশ্ন থাকতেই পারে তোমাকে কেনো তারা বউ করলো?”
আমার দৃষ্টি বাবা পরতে পারলেন বোধহয়।বললেন
“সাফওয়ানের দাদা মৃত্যুর আগে উইল করে গেছেন সাফওয়ানের সম্পত্তি বিয়ের পর তার বউয়ের নামে হবে।আর তাই এ বাড়ির বউ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তারা অনেক সতর্ক ছিলো।আমাদের গ্রামে নতুন প্রজেক্টের জন্য জমি দেখতে গিয়েছিলো তারা।সেদিন তাদের গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলাম।পরিচয় হওয়ার পর তোকে দেখেছিলো সাফওয়ানের মা।সে থেকে ওনার ইচ্ছা তোকে এ বাড়ির বউ করবে।”
আমি শুধু অবাক হচ্ছি বাবার কথা শুনে।আবারও বললেন
“সেদিন আমার খুশি দেখে কে।আমার মেয়ের রাজ কপাল।সাথে সাথে রাজী হয়ে যাই।অথচ তোর অপদার্থ বাবা মেয়ের অনুমতিই নিলো না।” বলতে বলতে তার চোখ চিকচিক করে উঠলো।
“কিন্তু এখন আমি খুশি,আমার মেয়ে সত্যিই রাজরাণী।” কথাটা বলে একটু দম নিলেন।বুকে হাত দিয়ে বললেন
“একবার আমায় জড়িয়ে ধরবি মা?তোর এই স্বার্থপর বাবাটাকে ক্ষমা করে দিস।”
এতো আকুলতা সৃজার চোখের জলে প্রকাশ পেলো।ছুটে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম।সত্যিই তো বাবা যা করেছেন তা আমার সুখের জন্য। কোন বাবা না চায় তার মেয়ে সুখী হোক।আমার এতোদিনের শূন্যস্থানটা আজ পূরণ হয়ে গেলো।মায়ের কাছে শুনেছি বাবা এখন অনেক বদলে গেছে।সব ব্যবসা প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন।কিন্তু হুট করে এ পরিবর্তনের কারণ নিয়ে আর ভাবলাম না।
রাত এখন ১ঃ৩০টা,এখনো সাফওয়ান এলো না।কতবার ফোন দিয়েছি বন্ধ বলছে।এবার চিন্তা হচ্ছে।এর ক্ষাণিক বাদেই বাইরে আওয়াজ শুনলাম।নিচে নেমে দেখলাম বাড়ির প্রায় অনেকই হলরুমে,সাফওয়ান ও রয়েছে।সবাই মনোযোগ দিয়ে খবর শুনছে।
কিছু কথা আমার কানে এলো….এই মাত্র পাওয়া খবর শহরের অন্যতম ব্যবসায়ী জারিফ আহসানকে চোরাচালান ও ভেজাল পণ্য উৎপাদনের দায়ে আটক করেছে পুলিশ।………….
এর মাঝেই সাফওয়ান বলে উঠলো এরপর আর কোনো বাস্টার্ড এর সাহস হবে না সাফওয়ান চৌধুরীর পেছনে লাগার।তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে উনি রেগেও আছেন আবার সেই সাথে কপট খুশিও।আমার শ্বশুর মশায় বললেন
“নিজেকে কন্ট্রোল করো।আর ভাষা সংযত করো।যাই করো না কেনো এ বাড়ির সম্মান যেনো এক চুলও না যায়,সেদিকে খেয়াল রাখবে।যাও রুমে যাও বউমা এখনো জেগে আছে।”
সাফওয়ান আসার জন্য পিছু ফিরতেই আমাকে দেখতে পেলো।বললো
“তুমি এতো রাতে জেগে আছো কেনো?ঘুমিয়ে পরতে বলেছিলাম।” এগিয়ে এসে সবার সামনেই হাতটা ধরে রুমে নিয়ে এলেন।কিছু না বলেই ফ্রেশ হতে গেলেন।
চলবে……