সৃজা” পর্ব – ১৪

0
1149

#সৃজা
পর্বঃ১৪
লেখিকাঃআরুনীয়া চৌধুরী

এতো জটিলতা কেনো সবকিছুতে।সৃজা বুঝতে পারছেনা তার জীবনের মোড় কোথায় এসে দাড়িয়েছে।আজকের দিনের এতোগুলো ঘটনা তার মস্তিষ্কে জ্যাম সৃষ্টি করেছে সে কোনোটা নিয়েই ঠিকভাবে ভাবতে পারছেনা।এখন তার এসব ভাবনা থেকে ক্ষনিকের মুক্তি দরকার।

এখন প্রায় গভীর রাত।এ শহরের প্রত্যেকটা মানুষ ঘুমিয়ে পরেছে।সৃজার চোখের ঘুম সাফওয়ানকে দেখেই হারিয়ে গেছে।সে বুঝতে পারছে প্রণয় নামক এ সম্পর্কে সাফওয়ানের মনের সাথেও তার মনের প্রণয় ঘটেছে।এতোদিন তা প্রচ্ছন্ন থাকলেও এখন তা স্পষ্ট।তবে ভালোবাসি কথাটা সে কখনোই হয়তো বলতে পারবেনা।

সাফওয়ান তাকে দ্বিতীয়বার গভীরভাবে ছোঁয়ার সময় প্রথমবার বলেছিলো সে সৃজাকে ভালোবাসে।তখন উত্তর দেয়ার মতো মন সৃজার ছিলো না।কিন্তু আজ ইচ্ছে করছে কোনো এক বৃষ্টির দিনে ভিজতে ভিজতে চিৎকার করে বলবে সাফওয়ানকে সে মন দিয়েছে।

বাতায়ন ভেদ করে চাঁদের আলোর দিকে নজর গেলো সৃজার।উঠে গিয়ে বারান্দার রেলিং ধরে দাড়ালো।যতটুকু চোখ যায় কুকুর ছাড়া কোনো প্রাণীর অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে না।দাড়োয়ান দুজনও বসে বসে ঝিমুচ্ছে।

গেটের বাগানবিলাস গাছটা হালকা দেখা যাচ্ছে। ল্যাম্প পোস্টের আলোতে ফুলগুলোকে আদুরে লাগছে তার কাছে।

সৃজার ইচ্ছে করছে সাফওয়ানের সাথে নিশি ভ্রমণ করতে।কিন্তু তা হয়তো সম্ভব না।সম্ভব হলেও সে একা বেরোতে পারবেনা,তার সাথে দুজন লোক অবশ্যই থাকবে।শ্বশুরমশায় তার ছেলেকে এক্সট্রা প্রটেকশনে রাখে।টাকা বেশি থাকলে যা হয়।মনের স্বাধীনতা মেনে নেয়া যায় না তখন।

যার টাকা যত বেশি তার শত্রু তত বেশি।সৃজা কোনোদিনই এতো টাকা চায়নি।বিয়ের আগে নিজ বাবাকে দেখেছে শুধু টাকার পেছনে ছুটতে,বিয়ের পর স্বামী,শ্বশুর সবাইকে দেখছে।বাবার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন ছিলো।উল্টা পাল্টা ব্যবসার কারণেই এতোদিন দূরে ছিলো বাবা নামক প্রণীটা থেকে।কিন্তু আজ মায়ের কাছে শুনেছে তার বাবা পাল্টে গেছে।এতো ব্যস্ততার ভীরে এই কথাটা তাকে শান্তি দিয়েছে।

সৃজা একমনে বাইরের রুপালি চাঁদটার দিকে তাকিয়ে আছে।চাঁদটার জ্যোৎস্নায় অবগাহন করছে তার অন্তরাত্মা।কতদিন হলো গ্রামের জ্যোৎস্না দেখা হয় না।গ্রামের জ্যোৎস্না আর শহরের জ্যোৎস্না আলাদা তার কাছে।গ্রামে কত সুন্দর মাটির মাতাল করা ঘ্রাণ পাওয়া যায় আর শহরে তার ছিটেফোঁটাও পাওয়া যায়না।গ্রাম আর শহরের এসব পার্থক্যগুলো তার মনে গভীর চিন্তা জাগ্রত করে।

কত মায়া পেছনে ফেলে এসেছে সৃজা।ভাবলেই তার দৃষ্টি পাল্টে যায়।আজ বাবার কথাগুলো সৃজার মনে দাগ কেটেছে।সে ও তো এমন একটি দিনের আশা করেছিলো কতকাল।তার বাবা তাকে বুকে নিবে।দিদি এই দৃশ্য দেখলে হয়তো সবচেয়ে বেশি খুশি হতো।আজ দিদিরও কথাও খুব মনে পরছে।বাবার সাথে তার সম্পর্ক এতোটাই খারাপ ছিলো যে বিয়ের পর আর যোগাযোগ হয় না বেশি।শুধু সৃজার মায়ের সাথে মাঝে মাঝে কথা হয়।তখন নাকি সৃজার কথা বলে কাঁদে।

ওয়াশরুমে পানির আওয়াজ বন্ধ হলো। সাফওয়ান এখনি বের হবে।গুটিগুটি পায়ে তার সামনে গিয়ে দাড়ালাম।হাত থেকে তোয়ালেটা নিয়ে মাথা মুছে দিলাম।সেও ভদ্রলোকের মতো সৃজার কোমর আকড়ে বসে আছে।সৃজার অর্ধ শরীর সাফওয়ানের দখলে।সাফওয়ানের শীতল হাতের স্পর্শ কোমরে পিঠে পেয়ে ক্ষানিক বাদে বাদে কেপে কেপে উঠছে সে।

এসময় তার এবং সৃজার কারোরই কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না।মাঝে মাঝে নীরবতা প্রগাঢ় শান্তি দেয় মনে।

সময় বহমান।সময়ের তাড়া বোঝাতে ঘড়ির টিকটিক আওয়াজ তাদের কানে এসে লাগছে।সাফওয়ান নীরবতা ভেঙে বললো

“তুমি ঘুমিয়ে পরো আমার কিছু কাজ আছে,আজ কমপ্লিট না করলেই নয়।এই কদিন শুধু ঝামেলার মধ্যে থাকতে হবে।আমাদের কোম্পানিকে আবারো আগের অবস্থানে আনতে হবে।তবেই শান্তি।”

কথার পিঠে আর কিছু বলার ইচ্ছে হলোনা সৃজার।শান্ত মেয়ের মতো শাড়িটা পাল্টে থ্রি-পিছ পরলো।এতক্ষণ সে শাড়িটা পরে ছিলো।সাফওয়ান তাকে দেখবে,কিছু বলবে সে আশায়।কিন্তু না মহারাজ কাজে ব্যস্ত।

মুখটা গোমরা করে বিছানায় ঘাপটি মেরে বসে আছে সৃজা আর সাফওয়ান ফাইল দেখছে।সৃজার মাথায় সবকিছুই এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।একসময় ওইভাবেই ঘুমিয়ে পরলো। তার মাথাটা পরে যাওয়ার আগেই সাফওয়ান ঠিক করে শুইয়ে দিলো।

মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলো সৃজার।সাফওয়ানের হাত না ধরলে ইদানিং তার ঘুম হয়না।হাতরে হাত ধরার জন্য খুজতেই বুঝতে পারলো সে রুমে নেই।নিজ চেতনাকে সজাগ করে সে ওয়াশরুম দেখলো,নেই।বারান্দায় গেলো সেখানেও নেই।অশান্ত মনের বাজে চিন্তাগুলো প্রশ্রয় দিয়ে নিচে নামলো সে।তার পা যেনো চলছেনা।যদি সে যা ভাবে তা সত্যি হয়।তাহলে কি করবে সৃজা।এতো দ্বিধান্বিত সে জীবনের কোনো প্রহরে হয়নি।আজ এই রাতের শেষ প্রহরে এসে জীবনটাকে তুচ্ছ মনে হচ্ছে।

গেস্ট রুমের দিকে পা বাড়ালো সৃজা।তার পা টা যেনো কেউ আটকে রাখছে।মন বলছে সে যেটা সন্দেহ করছে সেটা যেনো না হয়।

রুমের কাছাকাছি আসতেই তার কাছে কিছু পরিষ্কার শব্দ পৌঁছালো

“এতো প্রপার্টি সৃজার নামে বলেই তো তুমি তাকে এতো ভালোবাসো আমি জানি সেটা।কিন্তু আমিতো এখন আছি, ওর কাছে তোমায় যেতে হবে না।আমরা আগে যেরকম ছিলাম সেরকমই থাকবো।তোমার বডিটা আমার সবচেয়ে পছন্দ।শুধু ছুঁতে ইচ্ছে করে।আমি তোমাকে অনেক সুখী করবো সাফওয়ান।ওই মেয়েতো অশিক্ষিত……

বেস যতটুকু শোনার নয় ততটুকুই তার কর্ণগোচর হলো এর পরের কথাগুলো আর শুনতে পেলো না।তার ইন্দ্রীয় কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।এলিজার রুমের ডীম লাইটের আলোতে সৃজা স্পষ্ট দেখতে পেলো এক মানবী তার স্বামীকে জড়িয়ে ধরে আছে।শরীরের বাকী শক্তিটুকুও ফুরিয়ে ফেললো সে।

জ্ঞান হারানোর আগে শুধু একটা ফ্লাওয়ার বাসকে আকড়ে ধরতে চেয়েছিলো সে।সেটাও তার সমতালে মেঝেতে লুটিয়ে পরলো।আর কিছু মনে নেই তার।

দরজার বাইরে বিকট আওয়াজ শুনে এতক্ষণ ছাড়াতে চাওয়া এলিজার হাতটা আরো জোরে টান মেরে ছুটিয়ে চলে এলো সাফওয়ান।এলিজাও তার পিছু পিছু এলো।

মেঝেতে সৃজার ভূপাতিত তনুটা দেখে তার মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে এলো।এক অজানা আশঙ্কায় বুকটা ধ্বক করে উঠলো।নিজেকে এখন অপরাধী মনে হচ্ছে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here