সৃজা” পর্ব – ১৫

0
1196

#সৃজা
পর্বঃ১৫
লেখিকাঃআরুনীয়া চৌধুরী

জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করলো সৃজা।অনতিদূরে ডাক্তারের সাথে কথা বলছে সাফওয়ান।ঘৃণায় মুখটা উল্টোদিকে ফেরালো সে।

ডাক্তার চলে যেতেই সৃজার কাছাকাছি বসলো সাফওয়ান।সাথে সাথেই নিজের দূর্বল শরীর নিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করলো।যতটুকু শক্তি শরীরে আছে তা দিয়েই নিজেকে টেনে দূরে সরালো।যেনো কোনো নোংরা জিনিস আচমকা তার পাশে এসেছে।আর সে পালানোর চেষ্টা করছে।সাফওয়ান সবটাই লক্ষ্য করলো।মুখ থেকে আওয়াজ বের হলো তার

“এখন কেমন লাগছে?তুমি ঠিক করে খাওয়া-দাওয়া করোনি কেনো এই কদিন?”

তার কন্ঠ একেবারেই স্বাভাবিক।কোনো অনুশোচনা নেই সে কন্ঠে।তবে জলের ন্যায় কোমল সে কন্ঠ। অন্যসময় হলে হয়তো যেকোনো স্ত্রীর ন্যায় সৃজাও স্বামীর কথায় আবেগে আপ্লুত হতো।কিন্তু এসময় কথাগুলো শুনে সৃজার ঘেন্না হচ্ছে।কি মাটি দিয়ে তৈরি এ লোক।এমন ব্যবহার করছে যেনো সবকিছু স্বাভাবিক।

এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলো সৃজার দিকে।সৃজা সাথে সাথে প্রচন্ড শান্ত ভঙ্গিতে গ্লাসটি ছুড়ে মারলো।মুহূর্তে ঝনঝন আওয়াজ করে ভেঙে গেলো সেটি।সাফওয়ান এবারও শান্ত ভঙ্গিতে আরেকটা গ্লাসে পানি ঢেলে দিলো।সৃজার কাছে এগোতেই সাফওয়ানের কলার আকড়ে ধরলো দুহাতে।প্রচন্ড আক্রোশের সাথে তার অবসাদগ্রস্ত চোখগুলো সাফওয়ানের চোখে নিবদ্ধ করলো।

“আপনি কি ভেবেছেন নিজেকে?এরকম লুতুপুতু মার্কা কথা বললে আমি সবকিছু ভুলে যাবো?আমি ভুলে যাবো মাঝরাতে আমার স্বামী নিজ স্ত্রীকে ঘরে রেখে পরনারীর কাছে গিয়েছিলো?নাকি ভুলে যাবো মৃদু আলোতে তাদের রাসলীলার কাহিনি?এই কোনটা ভুলে যাবো বলুনতো?” একদমে কথাগুলো বলে হাতটা শিথিল হয়ে সাফওয়ানকে এক ধাক্কা দিলো সে।

অন্যসময় হলে হয়তো সাফওয়ান ওই হাতের মালিককে আস্ত রাখতোনা যে তার কলার ধরে কথা বলে।কিন্তু আজ পরিস্থিতিটা ভিন্ন।রাগ লাগলেও নিজের হাত দুটোকে মুঠোয় করে শান্ত করার প্রয়াস চালাচ্ছে মনকে।শান্ত গলায় বললো

“তুমি ভুল বুঝেছো।লেট মি এক্সপ্লেইন জান…

কথাগুলো বলতে বলতে সৃজার মুখটা ধরার চেষ্টা করলো।কিন্তু সৃজা নিজেকে গুটিয়ে নিলো।দেয়ালের সাথে লেগে বললো

” আমাকে ছোঁবেননা।আপনার ওই নোংরা হাতের স্পর্শ পেলে আমি নিজেকে খুন করে ফেলবো।ওই হাত দিয়ে আপনি কত মেয়েকে বাজে ভাবে স্পর্শ করেছেন কে জানে?আমাকে দয়া করে ছুঁবেন না আপনি।”

সৃজার কথাগুলো শুনে মনে হচ্ছিলো কোন ধর্ষককে বলছে তাকে না ছুঁতে।এবার সাফওয়ান নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হলো।সৃজার দুই বাহু ধরে বললো

“এবার তুমি অতিরিক্ত বলছো।আমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে তোমাকে ছোঁয়ার।তুমি আমার ওয়াইফ ভুলে যাবেনা।”

সৃজা একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো।

“ওহ্ তাই বুঝি আমি আপনার ওয়াইফ।তা এই ওয়াইফকে রেখে মাঝরাতে অন্য মেয়ের ঘরে যাওয়ার সময় মনে ছিলো না কথাটা।” সাফওয়ান ভড়কে গেলো কথাটা শুনে।সৃজাকে ছেড়ে দিলো।

“আপনার ব্যবহার বলে দিচ্ছে আমি যে ঘৃণ্য দৃশ্যটা দেখেছি সেটা সত্যি।”

“তুমি কিন্তু…..

সাফওয়ানের কথার মাঝেই দরজায় নক হলো।নিজেকে স্বাভাবিক করে সৃজার দিকে একবার তাকিয়ে দরজাটা খুলে দিলো সাফওয়ান।সৃজার মা এসেছে।তাকে দেখে কপট হাসি দিয়ে রুম ত্যাগ করলো সে।

সৃজার উদ্ভ্রান্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে মায়ের মনটা ধ্বক করে এলো।এসেই সৃজার মাথাটা মায়ের আকাশ সমান প্রশস্ত বুকে জড়িয়ে ধরলো।সৃজাও দুহাতে আঁকড়ে ধরলো মাকে।মাথায় হাত বুলাতে বুলাতেই প্রশ্ন করলো

” কি হয়েছে মা?জামাইর সাথে কিছু হইছে?জামাইরেতো ভালোই দেখলাম।”

কতক্ষণ শান্ত রইলো সৃজা।কি বলবে তার মাকে?তার স্বামী চরিত্রহীন!ঘরে স্ত্রী রেখে মাঝরাতে অন্য মেয়ের দরজায় কড়া নাড়ে।এটা শুনলেতো মরেই যাবে সে।তখন কি হবে সৃজার?মা ছাড়াতো কেউ তাকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসে না।স্বামী ভালোবাসে প্রপার্টির জন্য, শাশুড়ী ভালোবাসে ছেলের জন্য, ননদ ভালোবাসে ভাইয়ের জন্য, কিন্তু মা সেতো কারো জন্য না নিজের জন্য সৃজাকে ভালোবাসে।এই মাকে কিভাবে বলবে নিজের চরিত্রহীন স্বামীর কথা।

নিজেকে গুছিয়ে নিলো সৃজা।ভাঙা গলায় বললো

“আমি তোমাদের সাথে যেতে চাই,কতদিন গ্রাম দেখা হয় না।কিন্তু তোমার জামাই মানছেনা।তাই মন খারাপ ছিলো।”

“পাগল মেয়ে তাই বলে এভাবে কাঁদবি।জামাই তোকে কত পছন্দ করে ভাব তাহলে।জামাইর মনে কখনো কষ্ট দিস না মা।তাহলে পাপ হবে।”

সৃজা মনে মনে বললো,তোমাদের জামাই যে আমাকে প্রতি মুহূর্তে ক্ষত-বিক্ষত করছে তার পাপ হবে না।কিন্তু মুখে বললো

“উনি না বললেও তোমাদের সাথে যাবো মা।আমার শাশুড়ী বললেই হবে।”

মা আর সৃজাকে থামালো না।তারও তো ইচ্ছে মেয়েকে কদিন নিজের কাছে রাখার।

শাশুড়ীর দরজায় কড়া নাড়লো সৃজা।বউমাকে দেখে হাসি মুখে ঘরে এনে বসালেন তিনি।শত হোক তার একমাত্র ছেলের বউ।এই মেয়েটাকে তিনি অনেকদিন হলো ভালোবেসে ফেলেছে।বলতে গেলে চোখে হারায়।মেয়েটার মায়াবী মুখ দেখলেই তার মনটা ভরে যায়।মনে হয় স্বর্গের একটা হুড় আছে তার ঘরে।হুরের জ্যোতিতে তার ঘরের বাকি অন্ধকার দূর হয়ে গেছে।কিন্তু মনের কথা সৃজাকে বুঝতে দেয় না।পাছে শাশুড়ীর মতো ভয় যদি না পায়।

তবে আজ সৃজার মুখটা দেখে মনে আশংকা জাগলো আবার কোনো ঝামেলা হয়নি তো?নিজের মনকে শান্তনা দিয়ে জিজ্ঞেস করলো

“কিছু বলবে?তোমার মুখটা এমন শুকনো লাগছে কেনো?”

আজ কোনো সিনক্রিয়েট করতে চায় না সৃজা।বাড়িতে কম-বেশি আত্মীয়-স্বজন আছে তাদের।তাছাড়া সে চায় আগে বাবা-মাকে বিষয়টা বুঝিয়ে বলবে।তারপর যা হওয়ার হবে।মাথাটা নিচু করে শান্ত স্বরে শাশুড়ীকে বললো

“কিছু হয়নি আম্মা।আমি বাবা-মায়ের সাথে গ্রামে যেতে চাচ্ছি।আপনার অনুমতি নিতে আসলাম।”

“ভালোকথা সৃজা।আমিও এটা চাইছিলাম।কদিন ঘুরে আসো ভালো লাগবে।তবে তাড়াতাড়ি এসে পরবে তোমার পড়াশোনা আছেতো।” কিন্তু মনে মনে বললো,তুমি ছাড়া এ ঘর শূন্য হয়ে যাবে মা,বেশিদিন কোথাও থেকো না।তুমি এ ঘরের লক্ষ্মী, লক্ষ্মীকে বেশিদিন ঘর ছেড়ে থাকতে হয় না।

শাশুড়ীর অনুমতি নিয়ে সৃজা চলে গেলো গোছ-গাছ করতে।ভেবে নিলো এ বাড়ির কিছু নিবে না।শুধু বাবার বাড়ি থেকে যে শাড়ি কটা দিয়েছিলো সেগুলো লাগেজে ভরে নিলো।কতগুলো বই নিলো।

বাবার আনা গতকালের তাতের শাড়িটা পরলো সৃজা।গায়ের গয়নাগুলো খুলে রাখলো ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে।বাড়ি থেকে যে পাতলা হার আর দুল দিয়েছিলো সেগুলোই পরলো।দুল পরার সময় সাফওয়ানের আগমন ঘটলো।কতক্ষণ দরজার সামনে দাড়িয়েই নিজের অপরূপ সুন্দরী বউয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো সে।এগিয়ে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের উপর নিজের হ্যান্ড ওয়াচটা খুলে রাখলো।

সৃজা একবারো তার দিকে তাকালো না।সাফওয়ান ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখলো সৃজা লাগেজ হাতে রুম থেকে বের হচ্ছে।কতক্ষণ বোঝার চেষ্টা করলো কি হচ্ছে। তার মস্তিষ্ক যখন সিগনাল দিলো বউ কোথাও যাচ্ছে।তৎক্ষনাৎ তরিৎ বেগে সৃজার হাত টেনে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো সাফওয়ান।

আচমকা আক্রমণে সৃজা মোটেও ঘাবড়ালো না।শান্ত হয়ে বসলো বিছানার এক পাশে।সাফওয়ান অশান্ত হয়ে বললো

“কোথায় যাচ্ছো তুমি?লাগেজ কেনো তোমার সাথে।আর এসব কি কম দামী শাড়ি পরেছো।তোমারতো নতুন শাড়ির অভাব নেই।খোলো এটা।” শেষের কথাটা বলে সৃজার কাধে সেইফটিন দিয়ে আটকানো আচলটা খোলার চেষ্টা করলো।

সৃজা শক্ত হাতে সাফওয়ানের হাতটা ছাড়িয়ে নিলো।অর্থাৎ সে শাড়িটা খুলবে না

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here