#সৃজা
পর্বঃ৬
লেখিকাঃআরুনীয়া চৌধুরী
সাফওয়ানের এমন বাচ্চা বাচ্চা কথা শুনে হাসবে না কাদঁবে তা বুঝতে পারছেনা সৃজা।এর মাঝেই সাফওয়ান বিছানায় বসে সৃজার কোমর আকড়ে নিজের কোলে বসিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।
সৃজার কানের কাছে মুখটা রেখে শত ভালোবাসার বাণী শোনাচ্ছে ওকে
“বিলিভ মি আমি তোমাকেই প্রথম মন থেকে চেয়েছি।আমার প্রথম শয্যাসাথি থেকে শুরু এ পর্যন্ত যত মেয়ের সাথে আমি সেক্স করেছি সব তাদের ইচ্ছেতে ছিলো।আমি কখনো কাউকে জোড় করিনি।ওরা হয়তো টাকার লোভে আমার পেছনে ঘুরতো।আমিও তাদের সায় দিয়েছি এটা অবশ্য আমার দোষ।” কথাগুলো শুনে সৃজার মনের অবস্থা কি হচ্ছে এটা সে এবং তার সৃষ্টিকর্তা ভালো জানে।
অনেকক্ষণ এভাবেই রইলো দুজন।ঘরে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে।মাঝে মাঝে নীরবতা মনকে প্রচন্ড শান্তি দেয়।
সৃজার অস্ফুট কান্নার জল হাতে লাগতেই হকচকিয়ে উঠলো সাফওয়ান।বারবার জিজ্ঞেস করলো কাদঁছে কেনো।সৃজা কান্নামাখা স্বরেই বললো
“আমি সহ্য করতে পারিনা এই ব্যাপার গুলো।আমার স্বামীর শরীরে কেনো অন্য মেয়ের ছোঁয়া থাকবে।আপনি কেনো বোঝেন না আপনার অবচেতন মনের কথাগুলো আমায় বড্ড পোড়ায়।ভিতর থেকে আমাকে দূর্বল করে দেয়।আমি একটা স্বাভাবিক জীবন চেয়েছিলাম।সেটা না দিতে পারলো আমার বাবা আর না দিতে পারলেন আপনি।আমি তো কোনো অন্যায় করিনি তবে শাস্তি কেনো পেতে হচ্ছে।ভেতরে ভেতরে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি।”
সাফওয়ান আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সৃজার কাধে মুখটা রেখে বললো
“এই তুমি কাঁদছো কেনো??প্লিজ কাঁদে না হানি।আই প্রমিজ আর কোনো মেয়ের কাছে যাবোনা।কক্ষনো না।এই যে তোমাকে ছুঁয়ে বললাম।”কথাগুলো বিড়বিড় করে বলতে বলতেই ঘুমিয়ে পরলো সে।সৃজার কাধে তার ঘুমন্ত ভারি নিঃশ্বাস আছড়ে পরছে।
সাফওয়ানের কোর্ট-টাই খুলে তাকে শুইয়ে দিলো সৃজা।তারপর নিজেও গুটিসুটি মেরে তার পাশে শুয়ে রইলো।সাফওয়ানের মুখটার দিকে তাকিয়ে তার মনে হলো হয়তো এই সম্পর্কটা একটা সুযোগ ডিজার্ভ করে।আর যাই হোক নেশার ঘোরে মানুষ মিথ্যে বলে না এটা সে জানে।নিজের মনকে তার জন্যই প্রস্তুত করার ভাবনার মাঝেই ঘুমিয়ে পরলো সে।
অনেকদিন পর আজ শান্তির ঘুম দিচ্ছে সৃজা।সাতটা বাজার পরও সে স্বামীর বুকের সাথে লেপ্টে ঘুমিয়ে আছে।এসির ঠান্ডা তাকে ঠেলে দিচ্ছে সাফওয়ানের উষ্ণতার মাঝে স্থান নিতে।
নয়টার দিকে আধো চোখ মেলে সাফওয়ান বোঝার চেষ্টা করলো সে কোথায় আছে।মাথায় হাত চেপে কতক্ষণ বসে রইলো।পরক্ষণেই কোনো নারীদেহের স্পর্শ বুঝতেই সে ফিরে তাকালো সৃজার ঘুমন্ত মুখটার দিকে।কাপড় এলোমেলো তার।সৃজা তাকে এই প্রথম নিজে থেকে জড়িয়ে ধরে আছে ।বুকটা প্রশান্তিতে ভরে উঠলো সাফওয়ানের।সূর্যের আলোটা চোখে পরতেই সেটা আড়াল করার জন্য উঠতে চাইলো।কিন্তু সৃজা উঠতে দিলো না তার হাতের বাধন আরো শক্ত হলো।অর্থাৎ সৃজা জেগে আছে।অনেকটাই অবাক হলো সাফওয়ান।
যখন বুঝতে পারলো সৃজা তাকে আপন করে নিয়েছে তখন সমস্ত সংকোচ ঠেলে তাকে কোলে নিয়ে নিজের রুমের দিকে রওয়ানা দিলো সাফওয়ান।
“এবার থেকে যত রাগারাগী হোক না কেনো দিনশেষে আমি তোমাকে এই রুমেই চাই হানি।”সৃজা লজ্জার মাথা খেয়ে সাফওয়ানের বুকে মুখ লুকালো।
সদ্য প্রস্ফুটিত বেলি ফুলের ন্যায় লাগছে সৃজাকে।একটু আগেই সে স্নান সেড়ে বারান্দায় দাড়ালো।সাফওয়ান পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরলো।এই মুহূর্তে ওদের দেখলে সবাই বলতে বাধ্য হবে রাজযোটক।
সৃজার মুখটা ঘুড়িয়ে নিজের অধর দিয়ে তার অধর জোরা আকড়ে ধরলো সাফওয়ান।সৃজা এই প্রথম তাকে নিজ থেকে সাড়া দিচ্ছে।সৃজার এক হাত রেলিংয়ের উপর আরেকহাত সাফওয়ানের গালে।
সাফওয়ান আজ দেরি করে অফিসে গেছে।ও যাওয়ার পরপরই টিউলিপ রুমে ঢুকলো হাতে একটা পুতুল নিয়ে।
“টিউলিপের নতুন পুতুলটাতো ভারি মিস্টি।কে দিলো এটা টিউলিপ ফুলটাকে।এখনতো টিউলিপ আমাকে ভুলেই যাবে।” বলেই দুষ্টুমি করে কান্না শুরু করলো সৃজা।
টিউলিপ এই কান্নাটাকে সত্যি মনে করেই সৃজার কোলে গিয়ে বসে ছোট ছোট হাতগুলো দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো
“নো, নো নো,আমার পুতুল মাম্মাকে কখনোই ভুলবোনা আমি।এটাতো কথা বলতে পারেনা কিন্তু তুমি তো কথা বলতে পারো।তাই টিউলিপের বেস্ট ডল হলো পুতুল মাম্মা।”
সৃজা বললো”ঠিক তো?”
“পিংকি প্রমিজ।”সৃজার কনিষ্ঠ আঙ্গুলটা টিউলিপের কনিষ্ঠ আঙ্গুল স্পর্শ করলো।
আজ সৃজার শিক্ষক আসবে তার অপেক্ষাই করছে সৃজা স্টাডি রুমে।যদিও তিনি চারটায় আসবে।সৃজা তিনটা থেকেই পরিপাটি হয়ে বসে আছে।মন দিয়ে পড়ার চেষ্টা করছে।আবার নতুন টীচারের কথা ভেবে নার্ভাস হয়ে যাচ্ছে।যদি উনি আবুল স্যারের মতো হয়।আবুল স্যার তাদের ক্লাসে গণিত নিতো।প্রায় প্রতিদিন তিনি কাউকে না কাউকে বেধর আঘাত করতেন।এমনকি ক্লাসের একজন দোষ করলে উনি সবাইকে বেত্রাঘাত করতেন।জীবনে প্রথমবার সে আবুল স্যারের হাতে মার খেয়েছিল।সেটা এখনো ভুলেনি সে।তার ফোলা ফোলা হাত দুটো দেখে মা সেদিন কেঁদেই দিয়েছিলো।সৃজার বাবা এটা জানতে পেরে আবুল স্যারকে স্কুল ছাড়া করেছিলো।
স্যার আসলেন তবে ঠিক চারটা পাঁচ মিনিটে।সৃজা তাকে সালাম দিলো।স্যারকে দেখতে অনেকটা পুরোনো যুগের নায়কদের মতো।চুলগুলো একটু বড় বড়।একটা কমলা রঙের শার্ট পরে এসেছে।গায়ের রং শ্যামলা।চেহেরায় একটা গাম্ভীর্য রয়েছে।নামটা তার রাহীন হাসান।তিনি বুয়েটের ছাত্র।
স্যার আসার দশ মিনিট পরেই সাফওয়ান কল দিলো।স্যার রিসিভ করার অনুমতি দিলো।
“কি করছে আমার জানটা??”
“এখন স্যার এসেছে পড়ছি পরে কথা বলবো।”
“সেজন্যই তো ফোন দিলাম।স্যারকে ফোনটা দাও।”সৃজা ইতস্তত করে ফোনটা স্যারের হাতে দিলো।
কিছুক্ষণ কথা বলে ফোনটা সৃজার কাছে ফেরত দিলো।কি কথা হলো যদিও সৃজা বুঝতে পারেনি।জিজ্ঞেস করতেও ইচ্ছে করছে না।
প্রথমদিনেই অনেক পড়া দিয়ে গেলো রাহীন স্যার।স্যার যাওয়ার পরপরই সেগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছে সে।সাফওয়ান এসে দেখলো সৃজা রুমে নেই।ফ্রেশ হয়ে স্টাডি রুমের সামনে যেয়ে সে দাড়ালো।দেখলো সৃজা মনোযোগ দিয়ে পড়ছে।সামনের চুলগুলো এই সুযোগে সৃজার চোখে মুখে ছড়িয়ে আছে।সাফওয়ান প্রায় আধা ঘন্টা দাড়িয়ে থেকেও তার মনোযোগ আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হলো।
হঠাৎই শূন্যে ভাসায় সৃজা হকচকিয়ে গেলো।বুঝতে বাকি রইলো না সাফওয়ান তাকে কোলে তুলে নিয়েছে।সৃজা কোলে থেকেই বললো
“আরে আরে কি করছেন।আর আপনি কখন আসলেন।সার্ভেন্টকে বলে দিয়েছিলাম তো আপনি আসলে আমাকে ডেকে দিতে।”
“অনেক সময় হলো আমি এসেছি কিন্তু তোমার মনোযোগ বইয়ে ছিলো তাই আমাকে দেখতে পাওনি।আর পড়া সব আমি না থাকলে করবে।আমি যতক্ষণ বাসায় থাকবো ততক্ষণ আমার চোখের সামনে থাকবে।এখন চলো খাবে।আমার খিদে পেয়েছে।”
সকালে খুব ভোরে উঠে সৃজা পড়তে বসলো।সাফওয়ান এখনো ঘুমাচ্ছে।তাকে আটটায় ডেকে দেয়ার জন্য ঘড়িতে এলার্ম সেট করে রেখেছে সৃজা।কিন্তু তার আগেই নিজের পাশে সৃজাকে না পেয়ে ঘুম ভেঙে গেলো সাফওয়ানের।সার্ভেন্টকে কফি দিতে বলে স্টাডি রুমে গেলো সে।এই মেয়েটা এতো পড়ে কেনো।কই সে তো লন্ডন থেকেও এতো পড়তো না।যদিও তার সারাদিন ভার্সিটিতেই কাটতো।
“ব্রেকফাস্ট করেছো।”
“না।”কথাটা বলেই বুঝতে পারলো প্রশ্নকর্তা সাফওয়ান।
ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলো এখনো আটটা বাজেনি কিন্তু এর আগেই উনি উঠে গেছে।সাফওয়ান এসে সৃজার পাশে একটা চেয়ারে বসলো তারপর সৃজাকেও টেনে তার কোলে বসালো।সৃজার কানে ঠোঁট ছুইয়ে বললো
“এবার পড়ো।আমি দেখবো।তোমাকে পড়তে দেখতে আমার ভালো লাগে।”হুট করেই লজ্জা গ্রাস করলো সৃজাকে।গালে খানিকটা লাল আভা ছড়িয়ে পরলো।সাফওয়ানের ঘুম ঘুম কন্ঠ তার মারাত্মক ভালো লাগে।সাফওয়ান তা বুঝতে পারলো।সৃজার এই লাল আভার কপোল তাকে সবসময় মুগ্ধ করে।
” চলুন অফিসের জন্য রেডি হবেন।এখন পড়া থাক।আপনি অফিসে গেলে আবার পড়তে বসবো।”
সাফওয়ানের অফিসে যাওয়ার আগে প্রায় সবকিছুই সৃজা গুছিয়ে দেয়।সাফওয়ান এখন তার সামনে দাড়িয়ে আছে আর সৃজা ড্রেসিং টেবিলের উপর বসে তার টাই বেঁধে দিচ্ছে।সৃজাকে নানাভাবে জালানোর পাশাপাশি তাকে বারবার বলছে সময় মতো খেয়ে নিতে।পড়ার জন্য যেনো খাওয়ায় অবহেলা না হয়।সৃজা তার কথায় মুগ্ধ হচ্ছে এটা কি সে জানে?শেষে কপালে গভীরভাবে অধর ছুঁইয়ে সে প্রস্থান করার পূর্বে বলে গেলো
“বুবুর ব্যাপারটা নিয়ে বেশি মাথা ঘামিয়ো না।কোনো প্রশ্ন থাকলে আমি আসলে করবে।মাকে বা বুবুকে জিজ্ঞেস করবেনা এ ব্যাপারে।”
সৃজা হ্যা বোধক মাথা নাড়ালো।
আজ টিউলিপের মাম্মা অফিস যায়নি।যে মেয়ে নিজের ভাইয়ের বিয়েতেও থাকে না এতো ব্যস্ত বলে।সে নাকি আজ অফিস যায়নি।এটা সৃজাকে ভাবাচ্ছে।যদিও সাফওয়ান বলে গেছে এর উত্তর সে পরে পাবে।তবে মানব মনতো অস্থির হবেই।সকাল থেকে বুবু নিজের রুমে বন্ধ করে রেখেছে।নাস্তা করার সময়ও টেবিলে দেখা যায়নি।এ নিয়ে বাসার কেউ কিছু বলেও নি।
চলবে…..
৫ম পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1227356354446056/