#সেঁজুতি(পর্ব_১৭)
#লেখা_সুমাইয়া_আক্তার_মনি
সেঁজুতি চোখমুখে মেঘের রাজ্য নামিয়ে বসে আছে। কতক্ষণ ফোনকল দিচ্ছিলো তবুও রিসিভ করেনি সাওন। যখন কল ব্যাক করলো তখন অভিমান করে কল কেটে দিলো সেঁজুতি। অথচ একবারের জন্যও সাওন কল ব্যাক করলো না। বাজে লোক একজন! হাহ! কখনোই ভালো-মন্দের খেয়াল রাখেনি। সবসময় ধমক দিয়েছে আর মা-বোনের পক্ষপাতিত্ব করেছে। মনে হয়, সেঁজুতি নিজ থেকে হেঁটে হেঁটে সাওনদের বাড়িতে গিয়ে উঠেছিল। মাঝেমাঝে দয়া দেখাতে আসতো সাওন। সেঁজুতি না খেয়ে থাকতে পারে না, সেসবের খেয়াল রাখতো। পরম যত্নে সেঁজুতির মাথা সাওনের বুকে রেখে আহ্লাদীস্বরে বাবুই বাবুই বলে ডাকতো৷ তখন মনে হতো, কত ভালোবাসা যেন সাওনের মধ্যে লুকিয়ে আছে। যা বুঝাতে পারছে না অথবা বুঝাতে চাচ্ছে না সেঁজুতিকে। তাহলে অতিরিক্ত ভালোবাসায় ছন্নছাড়া হয়ে যাবে। এসব ভেবে ভেবে কপোলের পানি গড়িয়ে পরছে সেঁজুতির। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে পানি মুছে চুপচাপ বসে আছে।
.
.
.
পা দু’টোর দিকে তাকিয়ে দেখলো, কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে। পায়ের চামড়ার অবস্থা খুবই করুণ। আশিক ছোট, ওর ব্যথাতো এর থেকেও বেশি ছিল! ভাবতেই শরীর শিউরে উঠছে সেঁজুতির। যোগাযোগ করার কোনো ব্যবস্থা নেই। সকালে সাওনের কাছে জিজ্ঞেস করার পরে বলেছিল, ভালো আছে এখন। তাহলে আর দুশ্চিন্তা করছে না সেঁজুতি।
ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। সাওন কল দিয়েছে। এবারে অভিমানের পাল্লা ভারী হয়ে গেল সেঁজুতির। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নামের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ফোন বন্ধ করে ফেললো। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরছে ফোনের স্ক্রিনের উপরে। এবারেও হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে পানি মুছলো। না! এই ঝর্ণার ধারা বাঁধা মানছে না। ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। স্রোতস্বিনী নদীর মতো।
চোখেমুখে পানির ছিটে দিয়ে চোখের পানি আড়াল করে ফেললো। লুকিয়ে ফেললো স্বচ্ছ পানির ভাজে৷
সেঁজুতির ভাই বাসায় এসে তার সহধর্মিণীর নাম ধরে ডাকলো। সেঁজুতির ভাবি রান্নাঘর থেকে তড়িঘড়ি করে তার সম্মুখে দাঁড়ালো। সেঁজুতির ভাই ফুচকা আর চকলেট তুলে দিলেন। সেঁজুতির ভাবি ভ্রু কুঁচকে বলল,“ এই ভরদুপুরে এসব এনেছো? চকলেট পরেও খাওয়া যাবে কিন্তু ফুচকা! কথাটি এক ভ্রু নাচিয়ে বললো সেঁজুতির ভাবি।
সেঁজুতির ভাই শান্ত ভাবে বললো,“ ফুচকা খাওয়ার জন্য মেয়েদের সময় মেইনটেইন করতে হয়?”
সেঁজুতির ভাবি বললো,“ হ্যাঁ। তোমার বোন সকাল থেকে কিছু খেলে তো, সময় মেইনটেইনের কথা বলতাম না৷ খালি পেটে এসব খাবে! যদি এখন খেয়েও থাকে তাহলে দুপুরে খাবে কখন?”
সেঁজুতির ভাই একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললো,“ দুজনে শুরু করো, দেখবা সবকিছু উধাও। তারপরে ভাতের সময়ে তাও উধাও। ”
কথাটি বলে দাঁত চেপে ধরলো। সেঁজুতির ভাবি কটমট করে তাকালে সেঁজুতির ভাই হাসতে হাসতে চলে যায় ; যাওয়ার সময়ে বলে সেঁজুতির জন্য খাবার নিয়ে যেতে।
সেঁজুতির ভাবিও কথামতো স্যান্ডউইচ নিয়ে গেল। সাথে ফুচকাও।
সেঁজুতির রুমের সামনে গিয়ে দরজায় ঠোকা দিলো সেঁজুতির ভাই। তড়িঘড়ি করে মুখমণ্ডল মুছে দরজা খুলে মৃদ্যু হাসি দেয় সেঁজুতি। সেঁজুতির ভাই, বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেও হেসে দেয়। ভেতরে গিয়ে খাটে বসে বললো, “সকালে উপোস কেন?”
সেঁজুতি আমতা-আমতা করে বললো,“ক্ষুধা ছিল না।”
সেঁজুতির ভাই শক্ত গলায় বললো,“ পেটে পরশপাথর নিয়ে ঘুরো? যে সব স্বর্ণ হয়ে গিয়েছে তাই কোনো ক্ষুধা নেই। ”
ভাইয়ের কথা শুনে চুপ হয়ে যায় সেঁজুতি। সেঁজুতির ভাবি আসলে করুণভাবে তাকালে, ভাবিও কিছু বলে না। সেঁজুতির ভাই নিজ দায়িত্বে বোনকে খাওয়াচ্ছেন। তার খাওয়ানের উপায় হল, ধমক। ধমক দিয়ে দিয়ে সেঁজুতিকে খাওয়াতেন, সেই ছোটোবেলা থেকে। আজ তার বোন খুব বড় হয়ে গিয়েছে, শ্বশুর বাড়িতে সংসার করছে। আগেরমতো আবদার করে না, ভাইয়া এটা নিয়ে আসবা ওটা নিয়ে আসবা।
পুরনো দিনগুলোর কথা মনে পরলেও কিছুই করার নেই, সময় তার নিজ গতিতে চলতে থাকবে। কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া সবকিছুই পুরনো হয়ে যাচ্ছে।
সেঁজুতির ভাবি ফুচকা তৈরি করে সামনে রাখলেন। দুজনে খাওয়ার প্রতিযোগিতা চালিয়ে যাচ্ছে। সেঁজুতির ভাই শান্ত মাথায় হা হয়ে দেখছে আর হাসছে। তার হাসি দেখে ভ্রু কুঁচকে দুজনেই তাকিয়ে নিজেরাও হেসে দেয়।
চকলেট বক্সগুলো সেঁজুতির পাশে জমা করে রেখে দুজনেই চলে আসলো।
সেঁজুতির ভাবি রান্নাঘরে এসে চমকে গেল। শাশুড়ি রান্নার প্রায় অর্ধেকটা শেষ করে ফেলেছে। শুধু সিদ্ধ হওয়ার অপেক্ষা। তাহলেই রান্না শেষ।
সেঁজুতির ভাবি শক্ত গলায় বললো,“ মা! আপনি আসছেন কেন?”
সেঁজুতির মা মৃদ্যু হেসে বললো,“ শুয়ে-বসে দিন কাটে! মাঝেমাঝে একটু-আধটু রাঁধতে হয়। তাছাড়া সেঁজুতিও এসেছে, কতদিন নিজের হাতের রান্না খাওয়াইনি। সেঁজুতি ভাবি হেসে বললো,“ হয়েছে বাহানা খুঁজতে হবে না এখন। আমি দেখে নিচ্ছি।”
ছেলেবউয়ের সাথে কথায়, কাজে না পেরে চুপচাপ চলে আসে সেঁজুতির মা।
.
.
বাড়িতে গিয়ে ঘরের পরিবেশ পুরো থমথমে দেখে অবাক হয়ে যায় সাওন। হৈ-হুল্লোড় ছাড়া খুব কম দেখেছে। আজকে সবাই নীরবতা পালন করছে। সাওন চুপচাপ রুমে যাচ্ছিল৷ আনোয়ারা বেগম ডেকে বললেন,“ বাবা খেয়ে নে আগে। উপোস থাকলে শরীর খারাপ হবে। ”
সাওন ছোট করে বললো,“ খেয়েছি।”
আনোয়ারা বেগম অবাক হয়ে বললেন,“কোথায়?”
সাওন বললো,“রেস্টুরেন্ট ছাড়া আর কোথায় খাবো!”
সাওনের কথা শুনে আনোয়ারা বেগম আর কিছু বললেন না। সাওন বিরক্তিকর একটা ভাব নিয়ে রুমে চলে গেল। বারবার সেঁজুতির ফোনে কল দিচ্ছে, বারবারই সুইচ অফ বলছে৷ একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। কিছুক্ষণ পরে আবারও সেঁজুতির ফোনে কল দিলো। এবারেও আগেরমতোই। হারে হারে শিক্ষা পাচ্ছে এবার, অকারণে বউয়ের গায়ে হাত তুললে যা হয় আরকি!
সেঁজুতির ফোনে কয়েকটা মেসেজ দিলো। মনে মনে ঠিকই ভেবে নিয়েছে, রিপ্লাই পাবে না এ-মেসেজের। তবুও আশা ছাড়ছে না। খুব শীঘ্রই সবকিছু সামলাতে হবে, তারপরে সেঁজুতিকে নিয়ে আসবে। না হলে কোন মুখ নিয়ে ওর পরিবারের কাছে দাঁড়াবে! সেঁজুতির সামনেই বা কীভাবে দাঁড়াবে! প্রথম থেকে যদি সবকিছু যাচাই করতো তাহলে হয়তো আজ সেঁজুতির পরিবারের মতোই সবকিছু ঠিক থাকতো। সবাই একসাথে মিলেমিশে থাকতো। কিন্তু ‘ভাগ্যের লিখন না যায় খণ্ডন ‘ এই প্রবাদটিকে মনেপ্রাণে মানছে সাওন। ওর কপালে যা ছিল তাই হয়েছে। এখনও কপালে যা লেখা আছে, তাই হবে। হোক ভালো কিংবা মন্দ।
চোখ বন্ধ করে ঠোঁট চেপে, নাক দিয়ে জোরেজোরে নিঃশ্বাস নিলো। কপোলে পানি বয়ে যাচ্ছে, ঝর্ণার মতো। বন্ধ চোখ দিয়ে অনায়াসেই পানি ঝড়ছে। কোনো বাঁধা দিচ্ছে না। বোবা কান্না যে খুব কঠিন ব্যপার, যে কাঁদে সে বুঝে। দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। তবুও কান্না থামে না, যতক্ষণ না পর্যন্ত শব্দ করে কাঁদতে পারে।
সাওন একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে উঠে বসলো। ছোট থেকেই কাঁদেনি, এখন বড় হয়ে কাঁদবে! যতই মনকে বুঝাচ্ছে ততই বোবা কান্না ক্রমশ বেড়ে চলছে।
জীবনে শান্তি নামক কিছুই নেই। না হলে ওর কাছে ধরা দিতো এতদিনে। নিজ পরিবারের মানুষের জন্যই যদি এমন অশান্তি লেগে থাকে, তাহলে শান্তি নামক শব্দটির দেখা মিলবে কীভাবে!
সমস্ত মাথাটা ভার হয়ে আছে। মনে হচ্ছে, পঞ্চাশ কেজি চালের দুটো বস্তা ওর মাথায় দিয়ে বসে আছে। তড়িঘড়ি করে গোসল করলো, এই আশায় যেন মাথাব্যথাটা চলে যায়।
.
নিজের রুমে চুপচাপ শুয়ে আছে সাওন। দুলাভাই, বোন, আনোয়ারা বেগম সবাই ডেকে গিয়েছেন একএক করে ; কারো কথাই গায়ে মাখেনি সাওন। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। আনোয়ারা বেগম সাওনের পাশে বসে বললো,“ তুই অসুস্থ হয়ে যাবি, বাবা। ”
সাওন চোখ খুলে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,“ আমার চিন্তা করছো, তাও তুমি অথবা তোমরা! কাউকে তো কোনোদিন দেখিনি।”
আনোয়ারা বেগম বললেন,“ এমন কথা বলছিস কেন?”
সাওন দাঁতে দাঁত চেপে বললো,“ কী বলেছি? ঘরে মেহমান আছে, তাই দয়া করে এখান থেকে চলে যাও। তাছাড়া, যখন মানইজ্জত রক্ষা করতে হবে তখন ডেকে দিয়ো আমায়।”
আনোয়ারা বেগম বললেন,“ মানইজ্জত রক্ষা মানে?”
সাওন বলল,“ মেহমানদের সাথে একত্রে হাসিমুখে থাকতে হবে, খেতে হবে এটাই তো! যখন গোছানো হবে ডেকে দিয়ো চলে যাবো। কিন্তু আপাতত একটু শান্তি দাও। ”
আনোয়ারা বেগম ভালো-মন্দ কিছু না বলে চুপচাপ বেরিয়ে গেল। সাওন একটা নিঃশ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো।
আশিক চুপচাপ এসে সাওনের পাশে বসে রইলো সেদিনের মতো। আজকে ভয় পেয়ে আছে, গতকাল সেঁজুতিকে থাপ্পড় দেওয়াটা নিজ চোখে দেখেছিল। আজকে ওর মাকে ওর বাবা মেরেছে এটাও দেখেছে। বাচ্চা ছেলে। এসব এত সহজেই নিতে পারে না। সাওন কারো চোখ খুলে দেখে, ওর পাশেই চুপচাপ বসে আছে আশিক।
শান্তভাবে বললো,“ ব্যথা কমেছে মামা?”
জবাবে আশিক মাথা নাড়ালো। সাওন ধীর কণ্ঠে বললো,“ সারাক্ষণ দুষ্টুমি করো কেন? এখন দেখেছো তো, দুষ্টুমি করলে ব্যথা পাওয়া যায়। ”
আশিক কণ্ঠস্বর ছোট করে বললো,“ তুমি রাগ করো কেন, সারাক্ষণ? এর জন্য আজকে মামীও চলে গেছে। ”
আশিকের কথা শুনে চুপ হয়ে যায় সাওন। আশিক চুপচাপ বসে আছে। সাওন আশিককে কোলে বসিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বললো,“ খেয়েছো?”
আশিক মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে।
সাওন শান্ত ভাবে জিজ্ঞেস করলো, “মন খারাপ কেন?”
আশিক বললো,“ আজকে আব্বু আর আম্মু মারামারি করেছে। ”
আশিকের কথা শুনে হকচকিয়ে গেল সাওন। তড়িঘড়ি করে জিজ্ঞেস করলো,“ তুমি দুষ্টুমি করেছো?”
আশিক মন খারাপ করে বললো,“ আমি কিছু করিনি। তবুও আমার জন্য ঝগড়া করেছে তারা। ”
আশিকের কথা শুনে সাওন চুপ হয়ে গেল। এই ভরা বাড়িতে এমন কাণ্ড! মানইজ্জত হয়তো কিছুই থাকবে না।
আশিক বললো,“ মামী কবে আসবে?”
এবারেও আশিকের কথায় চুপ হয়ে যায় সাওন। আশিক চুপচাপ মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, উত্তরের আশায়।
সাওন সান্ত্বনা দিয়ে বলল,“ কিছুদিন পরে আসবে। ”
আশিক চুপচাপ বললো,“ এবারে আমি মামীর কাছে যাবো না। আম্মু আর খালামনি নিষেধ করেছে।”
সাওন দাঁতে দাঁত চেপে বললো,“ নিষেধ করেছে কেন?”
আশিক বললো,“ জানি না। ”
#চলবে