সেই তো এলে তুমি পর্ব_১০

0
995

#সেই_তো_এলে_তুমি
#পর্ব_১০
#Saji_Afroz

সেনোয়ারা বেগম বাগানে হেঁটে হেঁটে কফি পান করছেন। হঠাৎ নিহিরের গাড়ি দেখতে পেয়ে সেদিকে যান তিনি। এই সময়ে নিহির বাড়িতে কেনো এসেছে!
গাড়ি থেকে কেবল নিহির নামলো না। লাগেজ হাতে নামলো বুশরাও। তিনি ভ্রু কুচকে জানতে চাইলেন, ওকে নিয়ে এলে যে?
-আসলে যেখানে ইন্টারভিউ দিতে এসেছিল ওখানে একটা সমস্যা হয়েছে। দিতে পারেনি। তাই নিয়ে এসেছি। ক’দিন ওকে সময় দিই। চাকরি খুঁজে নিক। বন্ধু অনুরোধ করলো এখানে যেহেতু নতুন সে, কিছুদিন আমাদের সাথে রাখতে।
-ওহ।
.
ইচ্ছে করেই কথা বাড়ালেন না সেনোয়ারা বেগম। কারণ তিনি জানেন, ছেলে বড়ো হয়ে গেছে এখন কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। অহেতুক বাইরের কারও সামনে তিনি তর্কে যেতে চান না। কিন্তু মাত্র কয়েকটা দিন-ই এই মেয়েকে এখানে সহ্য করবেন তিনি। এটা ভেবে নিয়ে বললেন, ভেতরে যাও।
.
নিহিরের সাথে ভেতরে প্রবেশ করে বুশরা। আসার পথে শপিং এ গিয়েছিল তারা। অবশ্য নিহিরই তাকে নিয়ে গিয়েছিল। কিছু শপিং করে একটা লাগেজে এসব নিয়ে এসেছে।
নিহির বলল, আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন। দুপুর হয়ে গেছে। ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং এ খেতে আসুন।
-জি আচ্ছা।
.
বুশরা গোসল সেরে ডাইনিং এ আসলো। নিহির উপস্থিত রয়েছে এখানে। সেনোয়ারা বেগম প্লেটে খাবার বাড়ছেন। বুশরা কে দেখে ভ্রু কুচকে বলল, তুমি?
.
নিহির জবাব দিলো, আমি খেতে আসতে বলেছিলাম।
-আমি তার রুমে খাবার পাঠিয়ে দেব ভেবেছিলাম। এসেই যখন গেছে বসে পড়ুক। পরের বার থেকে আসার প্রয়োজন নেই। রুমে পাঠিয়ে দেব।
.
বুশরা বলল, সমস্যা হলে আমি চলে যাই।
-আসলে বাইরের মানুষের সাথে খাবার খেতে অভ্যস্থ নই আমরা।
.
বুশরা মাথা নিচু করে চলে যায়। নিহির বলল, রুমে পাঠানো ঝামেলার কাজ।
এখানে খেয়ে নিলেই পারতো।
-কাজের লোক রেখেছি কেনো? তারা নিয়ে যাবে। তুমি খাওয়া শুরু করো।
-নিখিল কই?
-এখনো উঠেনি সে।
.
নিখিল অনেক আগেই উঠেছে ঘুম থেকে। কিন্তু বের হয়নি। শুয়ে বসে দিন পার করে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল তার। তবে মনে হয় আর সম্ভব না। খিদে পেয়েছে ভীষণ। খেয়ে আসা যাক। এই ভেবে সে দরজা খুলে বেরুই। দেখলো তাদের বাসায় কাজ করা এক মহিলা অর্থ্যাৎ মায়া খালা ট্রে তে খাবার সাজিয়ে এদিকে আসছেন।
নিখিল প্রায় রুমে বসেই খাবার সেরে নেয়। কিন্তু তাকে জানাতে হয় সে ঘুম থেকে উঠেছে। আজ তো জানায়নি। তারপরেও খাবার চলে আসছে!
কিন্তু মায়া খালা নিখিলের দিকে না তাকিয়ে তাকে পার হয়ে চলে যেতে থাকে।
নিখিল তাকে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, খাবার নিচ্ছ কোথায়?
-নতুন আপামনির জন্য।
-নতুন আপামনি?
-বড়ো সাহেবের বন্ধুর বোন।
-ওহ!
.
কথা না বাড়িয়ে নিখিল রান্নাঘরে প্রবেশ করে৷ উপস্থিত থাকা একজন কে তার জন্য খাবার দিয়ে আসতে বলে রুমে। এরপর আবার সে রুমে চলে যায়।
এদিকে নিহির খেতে খেতে নিখিলের কথা চিন্তা করে। সে এখনো ঘুম থেকে উঠেনি তাকে কিছু জানানো হয়নি। বুশরা এই বাড়িতে উঠেছে এটা জানার পর সে হয়তো রেগে যাবে। কারণ বুশরা হলো তায়শার বোন। এমনিতেই নিখিল নিহিরের উপরে রাগান্বিত। এখন কী যে হবে!
.
.
নিখিলের খাওয়া শেষ। সে হাত ধুয়ে নেয়। খেয়াল করে মায়া খালা সেই রুম থেকে এটো প্লেট বাটি নিয়ে যাচ্ছে। সাথে নিখিলের গুলোও নিয়েও বেরুই। আচমকা এক মেয়েলি কণ্ঠ মায়াকে থামিয়ে বলল, আমাকে এক বোতল পানি দিয়ে যাবেন? আসলে আমার ঘনঘন পানি খাওয়ার অভ্যেস আছে।
-আচ্ছা।
.
মেয়েটির কণ্ঠ শুনে বেশ পরিচিত মনেহয় নিখিলের কাছে। সে রুম থেকে বেরুই। তখন মেয়েটি নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। পেছন থেকে তাকে দেখে তার পিছু নেয় নিখিল। তার রুমের কাছাকাছি আসতেই বলল, শুনুন?
.
বুশরা পেছনে ফিরে তাকায়। তাকে দেখে যেন আকাশ থেকে পড়লো নিখিল। সে অবাক হয়ে বলল, আপনি?
.
বুশরা খেয়াল করলো সিড়ি বেয়ে উপরে উঠছেন সেনোয়ারা বেগম। নিখিল এখনো কিছু জানেনা। সে চেঁচামেচি করলে বুশরার একমাত্র আশ্রয়স্থলও হাত ছাড়া হয়ে যাবে।
তাই সে নিখিলের মুখ চেপে ধরে তাকে টেনে নিজের রুমে প্রবেশ করিয়ে দরজাটা আঁটকে দেয়। নিখিল তার হাত সরিয়ে বলল, কী করছেন টা কী?
-হুশ! আপনার মা আসছেন এদিকে।
.
সেনোয়ারা বেগম দেখতে এসেছেন নিখিল ঘুম থেকে উঠেছে কি না। রুম খালি দেখে তিনি ভাবলেন, সে হয়তো ওয়াশরুমে।
.
নিখিল ফিসফিসিয়ে বলল, আপনি এখানে কেনো?
-কাল বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল আমায়। পরে আপনার ভাই রাস্তায় পেয়ে এখানে নিয়ে আসে আমাকে।
-বাড়ি থেকে বের করে দিলে কী আর যাওয়া যায় না? আমাদের বাসায় পড়ে থাকার মানে কী?
-যাওয়া যায় না। আমি অন্য কোথাও চলে যাব। যতদিন না একটা ব্যবস্থা করতে পারছি ততদিন এখানেই থাকব।
-বাহ! এক বোন ফোনে ভালোবাসার অভিনয় করে উপহারসামগ্রী নিতো। আরেকবোন একেবারে বাসায় চলে এসেছে। কী? এতবড়ো বাসা দেখে যেতে মন চায়ছে না?
.
বুশরা নিজেকে সামলিয়ে বলল, যা খুশি ভাবতে পারেন।
-মা কে বলে এখুনি আপনার ব্যবস্থা করছি।
-এতে করে উনি আপনাদের দুই ভাই এর কাণ্ডও জেনে যাবে। এত কোন মহৎ কাজ আপনারা করেছেন?
.
নিখিল কিছু বলল না। দরজা খুলে আশেপাশে দেখলো কেউ আছে কি না। এরপর চুপচাপ বেরিয়ে গেল সেই রুম ছেড়ে। তার ভাই এর উপরে প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। তায়শার বোনের জায়গা এখানে হতে পারে না!
.
.
নিখিল রেগেমেগে নিহিরের রুমে আসে। তাকে দেখে নিহির বলল, উঠেছিস? তোকে একটা কথা বলার ছিল।
-কাজটা করার আগে তো বলোনি। এখন কেনো বলছ?
-তুই জেনেছিস?
-হু। কেনো আনলে ওই সাপের বোনকে এখানে?
-নিখিল রাগ করিস না। সে চলে যাবে। এখন যাওয়ার জায়গা নেই বলে এখানে এসেছে।
.
দুই ভাই এর মাঝে এই নিয়ে তর্ক হয়।
খালেকুজ্জামান এসে তাদের থামিয়ে বললেন, সর্বনাশ হয়ে গেছে। আর তোমরা এখানে ঝগড়া করো?
-কী হয়েছে?
-ফাহমিদা আপারে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পুরা বাড়িতে খুঁজে দেখেছি আমরা।
.
নিহির ও নিখিল একে অপরের দিকে তাকায়। নিহির বলল, মা গেল কোথায়!
-ভাইয়া দ্রুত চল বাইরে খুঁজে আসি। নিশ্চয় আছেন আশেপাশে কোথাও।
.
.
বাংলাদেশে আসবে নওয়াজ। এটা সে জানায়নি বুশরাকে শুধুমাত্র সারপ্রাইজ দেবে বলে। আজ রাতেই তার ফ্লাইট। চেষ্টা করেছিল তায়শার বিয়েতে আসার জন্য। কিন্তু সম্ভব হয়ে উঠেনি। তায়শার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর থেকে বুশরার কোনো ফোন আসেনি এখনো। সে কী এখনো ব্যস্ত? হয়তোবা। কেননা বিয়ের পরেও কাজ শেষ হয়না। বরং বাড়ে। যেমন আজ তারা হয়তো তায়শাকে দেখতে যাবে। তাই মনেহয় নাস্তা বানাতে ব্যস্ত। হতেই পারে! এই ভেবে আর নাফিশাকেও ফোন দেয় না নওয়াজ। অবশ্য সে খুব বেশি দরকার না হলে নিজ থেকে তাদের ফোন দেয় না। কারণ বুশরার নিষেধ আছে। সে চায়না তার জন্য বোনদের কোনো অসুবিধা হোক। তাই সুবিধা অসুবিধা বুঝে নিজেই ফোন দেয়। আজও দেবে নিশ্চয়। এই ভেবে প্যাকিং এর কাজে মন দেয় নওয়াজ। বুশরার জন্য এইবার অনেক কিছু নিয়েছে সে। এসবই প্যাকিং করা হচ্ছে এখন। বুশরা এসব দেখলে নিশ্চিত অনেক খুশিই হবে।
.
.
ফাহমিদা বেগমকে সবাই খুঁজতে থাকে। সেনোয়ারা বেগম খেয়াল করলেন, বুশরাও নেই বাসায়। তিনি উত্তেজিত হয়ে বললেন, নিশ্চয় ওই মেয়ে ভাবীকে কিডন্যাপ করেছে। অপরিচিত একটা মেয়েকে বাড়িতে জায়গা দেওয়ার আগে একবার ভাবলে না নিহির। এইবার মজা বোঝো।
.
নিহির ভয় পেয়ে যায়। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এমন করলো না তো বুশরা?
সে দারোয়ান কে ডাকায়। দারোয়ান জানায় সে কিছু সময়ের জন্য ওয়াশরুমে অবস্থান করছিল। তখন গেছে কী না তা বলতে পারবে না। এইবার বাধ্য হয়ে নিহির সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখতে শুরু করে। দেখলো তার মা ছাদে চলে যাচ্ছে। এতটুকু দেখেই নিহির ছাদে ছুটে যায়। ছাদে যে তিনি যেতে পারেন এটা কারও মাথায় আসেনি। তার পিছু নেয় সকলে। ছাদে এসে সকলে অবাক হয়ে যায়। তারা দেখলো রেলিং এর উপর থেকে তাকে গল্প শুনিয়ে নিচে নামাচ্ছে বুশরা।
তারা সেদিকে এগিয়ে গেল না। এতে যদি ফাহমিদা বেগম ভয় পেয়ে যান!
বুশরা তাকে নিচে নামিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল, আর কখনো এমনটা করবেন না। ঠিক আছে?
-তুমি গল্প বলা বন্ধ কেনো করলে? আমাকে গল্প শোনালে এমন করব না।
.
এইবার সবাই ছুটে আসে। সবাইকে দেখে তিনি বুশরাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন। নিহির বলল, আপনি এখানে?
-আমি উনাকে উপরে আসতে দেখে এসেছি। আসলে আমি শুনেছি উনি মানসিকভাবে অসুস্থ। তাই আরকি…
-ধন্যবাদ। নিচে চলুন।
.
ফাহমিদা বেগমের রুমে এসে দেখলো তারা, তার ভাতের প্লেটে সব খাবার রয়ে গেছে। তিনি কিছুই খাননি। মায়া বলল, কিছুই খান না। কয়েকদিন খাওয়ার পর যখন খিদে পায় তখন তিনি খান শুধু।
.
ফাহমিদা বললেন, ও যদি গল্প শোনায় তবে আমি খাব।
.
বুশরা হেসে বলল, আমি খাইয়ে দিই? গল্পও শোনাব। তবে সবটা খেতে হবে।
.
তিনি রাজি হলে বুশরা তাকে খাইয়ে দিতে শুরু করে। আশ্চর্যভাবে তিনি সবটা খেয়েও ফেলেন।
বুশরা তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বেরুই। নিখিল ও সেনোয়ারা বেগম নিজেদের রুমে চলে যান। নিহির তাকে আবারও ধন্যবাদ জানায়।
বুশরাও নিজের রুমে ফিরে যায়। নিহির মা এর পাশে এসে বসে। তার চোখ দু’টো ছলছল করছে। আজ বুশরা না থাকলে খারাপ কিছু হতে পারতো।
ফাহমিদা বললেন, তোমার চোখে পানি?
-তুমি এত দুষ্টুমি করো তাই।
ফাহমিদা হেসে বললেন, ও কত ভালো গল্প বলে। প্রতিদিন যদি এইভাবে গল্প বলে আমি কোনো দুষ্টুমি করব না। আর ওই সেনোয়ারাও আমায় আর বকতে পারবে না, তোমার চোখেও পানি আসবে না।
ওকে বলবে প্রতিদিন আমায় গল্প শোনাতে?
-হু।
.
নিহির মৃদু হাসে। বুশরার জন্য সে চাকরি জোগাড় করে ফেলেছে। এর চেয়ে ভালো চাকরি তার জন্য হতেই পারে না!
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here