সেই তো এলে তুমি পর্ব_১১

0
1052

#সেই_তো_এলে_তুমি
#পর্ব_১১
#Saji_Afroz

সাজুগুজু করে বাড়ির বাইরে বেরুচ্ছে তায়শা। তাকে আঁটকে আলিয়া খাতুন জানতে চাইলেন, সে কোথায় যাচ্ছে।
তায়শা বলল, বান্ধবীর সাথে দেখা করতে।
-বান্ধবীর সাথে দেখা করতে না কি আর কিছু?
.
তায়শা কোনো জবাব না দিয়ে বাড়ির বাইরে বেরুই। সে মূলত বুশরা কে খুঁজতে বের হয়েছে। নিখিল কে সে ফোনে পাচ্ছে না। হয়তো নিখিল ব্লক করেছে তাকে। তাই সে কোনো দোকান থেকে নিখিল কে ফোন করার সিদ্ধান্ত নেয়। বাসায় এটা সে করতে চাইছে না। যদি আলিয়া খাতুন জানে তো তার খবর হয়ে যাবে।
একটি দোকানের নাম্বার থেকে নিখিল কে ফোন করে তায়শা। সে রিসিভ করতেই তায়শা বলল, বুশরা আপি কোথায়?
.
তায়শার কণ্ঠ চিনতে ভুল করলো না নিখিল। তবে সে তায়শা কে সত্যটা বলল না। বরং সে অবাক হওয়ার ভান করে বলল, বিয়ের দিন-ই তো তাকে দিয়ে আসলাম।
-এরপর সেও চলে গেছে।
-তা আমি কী করব?
-তুমি নিশ্চয় বলতে পারবে সে কোথায়?
-আমি জানি না।
.
এই বলে নিখিল ফোন কেটে দেয়। তায়শা কে চিন্তিত রাখতে তার বেশ মজাই লাগছে।
এদিকে কপালে চিন্তার ভাজ পড়ে তায়শার। বুশরার হাতে গোনা কয়েকজন বান্ধবী আছে। যাদের সাথে পড়াশোনার সূত্রে পরিচয়। হতে পারে এদের কারো বাসায় সে আছে। এছাড়া আর কেউ এই শহরে তার আপন নেই। একমাত্র নওয়াজ ছাড়া। নওয়াজও এখন দেশে নেই। হতে পারে বান্ধবীদের মাঝে কারো বাসায় সে আছে। কয়েকজনের বাসা চিনলেও ফোন নাম্বার তায়শার কাছে নেই। তায়শা ভাবলো, একজনের বাসায় গিয়ে হয়তো বাকি দের ফোন নাম্বার জোগাড় করা সম্ভব। এই ভেবে সে রিকশা ঠিক করে নেয়। যেকোনোভাবে বুশরা কে তার খুঁজে বের করতে হবে। মেয়েটা নিশ্চয় অনেক কষ্ট পাচ্ছে!
.
.
-আপনার জন্য একটা চাকরি জোগাড় করেছি আমি।
.
বুশরা খুশি হয়ে নিহিরের কাছে জানতে চাইলো, কীসের চাকরী?
-আমার মা এর দেখাশোনা করা। সারাক্ষণ তার সাথে থেকে তার সাথে গল্প করা। অন্য কোনো কাজ নয়। ওসবের জন্য মানুষ আছে।
.
বুশরা খানিকটা চমকে যায়। এটাও কোনো কাজ হলো! সে কিছু বলার আগে নিহির বলল, আমি আপনাকে অহেতুক কাজটার অফার করছি মনে করবেন না। আমার মা আপনাকে অনেক পছন্দ করেছে। তিনি আপনাকে তার সাথে রাখতে চান। এইজন্যই প্রস্তাব টা দেওয়া। এতে করে মোটা অংকের টাকাও আপনি পাবেন। সাথে থাকা খাওয়া ফ্রি।
.
বুশরা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। সে কী বলবে ভেবে পায় না। নিহির বলল, আগে আপনার মতামত জেনে নিই। এরপর বাসার সবাইকে জানাব।
-আমার একটু সময় প্রয়োজন।
-আজকের দিনটা সময় নিন।
.
এই বলে নিহির বেরুই। তার কিছু কাজ আছে যা সারতে হবে।
.
.
বুশরার বেশ কয়েকটা বান্ধবীর বাসায় গিয়ে খোঁজ নিয়েছে তায়শা। অনেককেই ফোন করেও খবর নিয়েছে। কোথাও বুশরা নেই। তায়শা আরও বেশি চিন্তিত হয়ে পড়ে। এত বড়ো একটা শহরে কোথায় আছে তার বোনটা! এই ভাবতে ভাবতে এক জৈনক ব্যক্তির সাথে ধাক্কা লাগে তার। সে মাটিতে পড়ে যায়। তায়শা রাগে গিজগিজ করতে করতে বলল, দেখে চলতে পারেন না?
.
লোকটা এতটায় তাড়াহুড়োয় ছিলেন যে তায়শার কোনো কথা না শুনেই দ্রুত হেঁটে চলে যান। তায়শা চেঁচিয়ে বলল, আরেহ! অন্তত আমাকে উঠতে তো সাহায্য করবেন?
.
কেউ একজন তায়শার দিকে হাতটা বাড়িয়ে দেয়। তায়শা তার দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে যায়। এটা তো সেই ছেলেটি, যাকে একদিন গাড়ি নিয়ে তাদের মহল্লায় দেখেছিল তায়শা। সেও হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।
এত ঝামেলায় ভালো লাগার মানুষটির কথা ভুলেও গিয়েছিল নিহির। আজ হঠাৎ এভাবে তার দেখা পাবে ভাবেনি। মেয়েটিকে দেখে ঈদের চাঁদ দেখার মতো আনন্দ হচ্ছে তার। ভাগ্যিস তার দরকারি কাজটা এদিকেই ছিল!
কিন্তু তাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। নিহির বলল, আপনি ঠিক আছেন?
-জি আছি।
.
তায়শা ঘেমে ভিজে একাকার হয়ে গেছে। তাকে এভাবে দেখতে ভালো লাগছে না নিহিরের। তাই সে বলল, আপনাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। কিছু মনে না করলে পাশের রেস্টুরেন্ট টায় বসি? না মানে ঠান্ডা কিছু খেলে ভালো লাগবে আপনার।
.
এমনকিছু হবে আশা করেনি তায়শা। সেও বেশ খুশি হয়ে যায়। সে হেসে বলল, মন্দ হয়না।
.
দু’জনে একত্রে রেস্টুরেন্টে এসে বসলো। তায়শা বলল, আমি আপনাকে একবার দেখেছিলাম। তাই আপনার সাথে বসতে রাজি হয়েছি। নতুবা কখনো হতাম না।
-আমিও তাই!
.
খাবারের অর্ডার দিয়ে নিহির তার নাম জানতে চাইলো। নামের কথা শুনে তায়শা কাশতে শুরু করে। কারণ পুরো মহল্লায় তার নামে বদনাম হচ্ছে। সবার মুখে এক কথা, তায়শা একটা লোভী! তাই সে নিজের ডাক নাম লুকিয়ে আসল নামটাই বলল নিহির কে।
-তাহরিমা।
-বাহ বেশ সুন্দর নাম।
.
দু’জনের মধ্যে কথোপকথন চলতে থাকে। এক পর্যায়ে নিহিরই তার কাছে ফোন নাম্বার চায়। তায়শাও দেয়।
এত তাড়াতাড়ি যে এসব হয়ে যাবে এটা যেন দু’জনেরই ধারণার বাইরে ছিল!
.
.
বুশরা নিজের রুমে বসে আসে। নিখিল এসে দরজায় কড়া নাড়ে। তাকে দেখে ভেতরে আসতে বলল বুশরা। নিখিল এসে বলল, একটা চাকরির ব্যবস্থা করেছি আপনার।
-কী চাকরি?
-পাশেই একটা স্কুল আছে। খুব বেশি স্টুডেন্ট নেই। তাদের পড়াবেন। স্যালারি যদিও বেশি ভালো না। কিন্তু এর চেয়ে ভালো চাকরি আর পাবেন কই?
-এখান থেকে বেরুলে আমাকে একটা বাসা নিয়ে থাকতে হবে। ওই টাকা দিয়ে আমি আমি বাসা ভাড়া দেব না কি খাব?
-শুরুতেই এতকিছুর আশা করলে তো হয় না।
-প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানোর আশা তো করা যায়।
.
নিখিল ভেবেছিল বুশরা সহজেই রাজি হয়ে যাবে। সে আগ্রহ না দেখাতে নিখিল বিরক্ত হয়। আর কিছু না বলে চুপচাপ বেরিয়ে যায়।
একটু আগে নিহির যদি তাকে ওই প্রস্তাব টা না দিতো তাহলে নিশ্চয় সে রাজি হয়ে যেত নিখিলের প্রস্তাবে। কিন্তু সে নিহিরের প্রস্তাবকেই প্রাধান্য দিতে চায়। কেননা এই শহরে একা একটা মেয়ে কীভাবে কোথায় থাকবে সে! তার চেয়ে এখানে অনেকটা ভালোই তো আছে। হ্যাঁ, সমস্যা নিখিল ও সেনোয়ারা বেগম। তাদের নিহির সামলে নেবে। অন্তত নওয়াজ দেশে না আসা অবধি এখানেই থাকাটাই নিরাপদ।
নওয়াজের কথা মনে পড়তেই বুকটা হাহাকার করে উঠে বুশরার। অনেকটা সময় তার সাথে কথা হয় না! নওয়াজের ফোন নাম্বারও মনে নেই তার।
তায়শা ও নাফিশার নাম্বারও মনে নেই বুশরার। কেবল বাড়ির টেলিফোনটির নাম্বার মুখস্থ করেছিল সে ছোটবেলায়। সেটাই মনে আছে।
বুশরা ভাবে সেটিতে একবার ফোন দেওয়া যাক। যদি তায়শা বা নাফিশা কেউ রিসিভ করে তবে নওয়াজের নাম্বার নেওয়া যাবে। কিন্তু কীভাবে ফোন দেবে সে?
হঠাৎ মনে হলো ড্রয়িংরুমে একটি টেলিফোন দেখতে পেয়েছিল সে। সেটি থেকে না-হয় ফোন দেবে। এই ভেবে নিচে নেমে আসে বুশরা। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো কেউ নেই। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বাড়ির নাম্বারে ডায়াল করে বুশরা। কিন্তু আফসোস! রিসিভ করলো আলিয়া খাতুন। তিনি ওপাশ থেকে বারবার ‘কে কে’ বলে যাচ্ছেন। তার কণ্ঠস্বর শুনে বুশরা কিছু বলল না। ফোনের লাইন কেটে দিলো সে। ভাগ্যটায় খারাপ তার। নওয়াজ নিশ্চয় চিন্তিত হয়ে আছে তার জন্যে!
.
.
দু’দিন কেটে যায়। এই দু’দিনে নিহিরের খুব কমই দেখা পেয়েছে বুশরা। এমনকি সে তার সিদ্ধান্ত টুকুও জানাতে পারেনি নিহির কে। এদিকে সেনোয়ারা বেগম বুশরার উপরে বিরক্ত। বাড়িতে এক যুবতী মেয়ের উপস্থিতি তার ভালো লাগছে না। আজ কিছুটা বিরক্ত নিয়েই তিনি খাবার টেবিলে বুশরা কে বললেন, কোনো ব্যবস্থা হলো তোমার? ক’দিন হতে চললো এখানে আছ?
.
তার প্রশ্নে নিহিরের ঘোর কাটে। এই দু’দিনে ফোনে সে তাহরিমা কে এতবেশি সময় দিয়েছিল যে, বাসায় কী চলছে তা মাথা থেকেই চলে গিয়েছিল। নিহির কেশে বুশরা কে বলল, আপনি আমাকে কিছু জানালেন না?
-আপনি সুযোগ কোথায় দিলেন?
-দুঃখিত আমি ব্যস্ত ছিলাম।
-আমি আপনার প্রস্তাবে রাজি।
.
সেনোয়ারা বেগম ও নিখিল একে অপরের দিকে তাকায়। তারা ভেবেছে অন্যকিছু! সেনোয়ারা বেগম নিহির কে বললেন, এতবড় একটা ডিসিশন আমাদের ছাড়া তুমি নাও কীভাবে? তোমার মা না হয় কিছু বুঝেন না। আমি তো বুঝি।
-আমি আপনাকে জানাতেই চাচ্ছিলাম।
-আর কবে? ফুলসজ্জার পরে?
.
নিহির মাথা নিচু করে বলল, মানে?
-তুমি এই মেয়েটিকে বিয়ের প্রস্তাব আমার থেকে পরামর্শ না নিয়েই দিয়ে দিয়েছ!
.
এইবার হেসে ফেললো নিহির। হাসতে হাসতেই বলল, তাকে আমি বিয়ে করব কেনো?
-মানে? মাত্রই বললে প্রস্তাবের কথা।
-আরেহ সেটা তো তাকে আমি অন্য প্রস্তাব দিয়েছি।
-কী?
-মা এর দেখাশোনা করার। দেখোনা মা ওর সাথে কতটা হাসিখুশি তে থাকে।
.
সেনোয়ারা বেগম যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। তারপরেও এই বিষয়টিও তার পছন্দ হলো না। তিনি বললেন, এতদিন কী আপা চলেননি? উনার জন্য লোক তো আছেই। নতুন কাউকে কী প্রয়োজন?
-তাদের তো আর তিনি পছন্দ করেন না সেভাবে, যেভাবে বুশরা কে করেন।
.
সেনোয়ারা বেগম খাওয়া থেকে উঠতে উঠতে বললেন, যা খুশি করো তোমরা।
.
তিনি চলে যান। বুশরাও উঠে পড়ে। নিখিল নিহিরকে বলল, ওর বোন আমার জীবন টা শেষ করে দিয়েছে। এখন ও তোমাকে ফাঁদে ফেলছে না তো?
.
বুশরা তার হাত ঘড়িটা টেবিলে রেখে এসেছিল। এটি নিতে সে ফিরে আসে। কিন্তু ভাইদের কথোপকথন শুনে থেমে যায় সে।
নিহির বলল, তুই বোকা বলে ওমন একটা মেয়ের প্রেমে পড়েছিলি। আমি ওতো বোকা নই। তাছাড়া বুশরার মতো মেয়ে আমার চয়েজের তালিকাতেই পড়েনা।
-আচ্ছা! কেমন মেয়ে পড়ে?
-অতি সুন্দরী, স্মার্ট, আমাদের সাথে মানানসই হবে এমন।
-বুশরা কেমন?
-তাকে যে কাজটার জন্য রেখেছি সে তারই যোগ্য। এছাড়া আর কোনোরকম না।
.
বুশরা আর সেদিকে গেল না। নিজের রুমে ফিরে আসে সে। নিহিরের কথায় কষ্ট পেলেও কোনো প্রতিক্রিয়া বুশরা করেনি। কারণ বিপদে সবকিছু মেনে নিতে হয়। এই বাড়িতে সে মনোয়ারা বেগমের জন্য থাকবে। আর তার কাজটি সে নিষ্ঠার সাথে করবে। এটিই তার প্রতিজ্ঞা এখন। বাকিসব কিছু মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চায়। একটা নিরাপদ স্থানে সে আছে এটাই বেশি তার জন্য।
.
.
এদিকে নওয়াজকে দেখে ভুত দেখার মতো চমকে উঠে তার পরিবার। তার মা তো কেঁদেই ফেললেন। সবাই নানা প্রশ্ন ছুড়ে দেয় নওয়াজ কে। পরিবারের সাথে খানিকটা সময় বসে সে তার রুমে আসে। রুমের জানালা খুলে দেয় নওয়াজ। পাশেই বুশরার বাড়ি। তার রুমের পাশে রয়েছে ওই বাড়ির একটি বারান্দা। যেখানে বুশরা দাঁড়িয়ে টবে লাগানো গাছগুলোর পরিচর্যা করতো আর ইশারায় নওয়াজের সাথে কথা বলতো। কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে নওয়াজ। যদি বুশরার দেখা পাওয়া যায়! কিন্তু পেল না। বুশরা তো আর জানেনা সে দেশে এসেছে। জানলে সেও কী তার মা এর মতোই কেঁদে দেবে? না কি জড়তা ঝেড়ে তাকে একটাবার কাছে টেনে নিয়ে বলবে, ভালোবাসি তোমাকে অনেক!
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here