#সেই_সন্ধ্যা
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_১৩
.
স্নিগ্ধর কথা শুনে নিজেকে যেমন অপরাধী মনে হচ্ছে আর ঘৃণা হচ্ছে নিজের প্রতি! ঠিক তেমনি মনের ভেতরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার একটা জেদ কাজ করছে আফির। মলিন হেসে স্নিগ্ধর কথায় মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায় আফি। সকাল গালে হাত দিয়ে বসে এক ধ্যানে স্নিগ্ধর দিকে তাকিয়ে আছে। স্নিগ্ধ তা খেয়াল করে হালকা গলা খাঁকারি দিয়ে আফিকে বললো,
-“গুড।”
-“আচ্ছা ভাইয়া তাহলে এখন আমি উঠি।”
-“ঠিক আছে। মিস বিকাল আপনি একটু থাকুন।”
সকাল ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ উঁচু করে জিজ্ঞেস করলো,
-“কেন?”
-“একটু দরকার আছে তাই।
-“আচ্ছা। আফি তুই যা আমি আসছি একটু পরে।”
-“ওকে।”
আফি কেবিন থেকে বের হতেই স্নিগ্ধ ভালো ভাবে নিজের শরীরটা চেয়ারে হেলিয়ে দিল। সকাল স্নিগ্ধকে একবার ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করে জিজ্ঞেস করলো,
-“আপনি ঠিক আছেন তো ডাক্তার সাহেব?”
স্নিগ্ধ অবাক হয়ে সকালের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“কেন?”
-“না মানে চেহারা দেখে মনে হচ্ছে আপনি কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তিত। যার ফলে আপনার চেহারায় ক্লান্তির ছাপ রয়েছে।”
স্নিগ্ধ থতমত খেয়ে বললো,
-“নাহ তেমন কিছু না। আসলে কাজের প্রেশার একটু বেশি পরছে। তাই এমন লাগছে হয়তো।”
-“ওহ আচ্ছা। খেয়েছেন এই পর্যন্ত কিছু?”
-“না সময় পাই নি।”
-“কয়টা বাজে দেখেছেন আপনি? আর আপনি এখনো কিছু খান নি!”
-“চিন্তা করো না। আমি এখন হসপিটালে যাবো। সেখানেই কিছু খেয়ে নিবো।”
-“আপনাকে বিশ্বাস হচ্ছে না। আমি ক্যানটিন থেকে কিছু অর্ডার করে দিয়ে যেতে বলছি। চুপচাপ খেয়ে নিবেন আপনি। আর হ্যা! একটাও কথা বলবেন না এর বিরূদ্ধে।”
-“তুমি আমাকে অর্ডার করছো?”
-“জ্বি। কারন এখন আপনি ক্লাসে নেই যে আপনাকে কিছু বলতে পারবো না।”
-“আচ্ছা বাবা ঠিক আছে। কুল!”
-“গুড বয়। বসে থাকুন এখানে। আমি খাবার দিয়ে যেতে বলছি।”
-“তুমি আসবে না!”
-“কেন! আমাকে দিয়ে কি করবেন?”
স্নিগ্ধ থতমত খেয়ে বললো,
-“না মানে একসাথে লাঞ্চ করবে আমার সাথে?”
সকাল কিছুটা অবাক হয়ে মুচকি হেসে বললো,
-“চলুন।”
স্নিগ্ধ হালকা হেসে খুশি হয়ে বললো,
-“চলো।”
পরশ ক্যানটিনে সকালের জন্য অপেক্ষা করতে করতে অস্থির হয়ে উঠেছে। আফিকে ক্যানটিনে ঢুকতে দেখে এক প্রকার দৌড়েই আফির কাছে গেল পরশ। আফি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“কি হয়েছে?”
-“সকাল কোথায়?”
-“স্নিগ্ধ স্যারের সাথে আছে।”
-“কেন?”
-“সকাল একটা জরুরি বিষয়ে কথা বলছে উনার সাথে।”
-“তাহলে তুমি চলে এলে কেন?”
-“কারন আমার ভালো লাগছিল না। এমনিতেও স্নিগ্ধ স্যার সকালের কিছু হতে দিবে না। উনারা খুব ভালো বন্ধু।”
এবার যেন পরশ একটু স্বস্তি পেলো। স্নিগ্ধ আর সকাল শুধু বন্ধু। কথাটা শোনার পরপরই ওর অস্থির মনটা শান্ত হয়ে গেল। জোরে একটা নিশ্বাস নিয়ে হাসিমুখে আফিকে টেনে নিয়ে চেয়ারে বসিয়ে দিল পরশ। আফি কিছুটা রাগী ভাবে বললো,
-“আমার পারমিশন ছাড়া আর কখনো আমাকে ছোঁয়ার চেষ্টাও করবে না।”
-“আচ্ছা তুমি এমন কেন?”
-“আমি এমনই। আমি যাচ্ছি এখান থেকে। তোমার সাথে বসতে আমার ভালো লাগছে না।”
-“আমারও কোনো ইচ্ছে নেই তোমার সাথে বসার। আমার শুধু একটু হেল্প লাগতো তাই….”
-“অন্য কাউকে খুঁজে নাও।”
এবার পরশ কিছুটা রেগে বললো,
-“তুমি কি জানো তুমি অনেক অহংকারী?”
-“হ্যা জানি। তবে যারা আমাকে বুঝতে পারে না বা বুঝতে চায় না শুধু তাদের কাছেই আমি অহংকারী। জাস্ট লাইক ইউ।”
-“তুমি কোনো মিস্ট্রি না যে তোমাকে বুঝতে হবে।”
-“সেজন্যই তোমার কাছে আমি অহংকারী। নাউ লেট মি গো।”
-“তো যাও। তোমাকে ধরে কে রেখেছে?”
-“যাবো তো অবশ্যই। কিন্তু তার আগে আমার হাতটা ছাড়ো। নাহলে তোমাকে নিয়েই যেতে হবে। যার বিন্দু মাত্র ইচ্ছেও আমার নেই।”
পরশ এক ঝটকায় আফির হাত ছেড়ে আফির দিকে রক্তিম চোখে তাকালো। আফি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে উঠে চলে গেল ক্যানটিন থেকে।
সকাল চোখ দু’টো গোল গোল করে টেবিলের দিকে তাকিয়ে আছে। স্নিগ্ধ সকালের তাকানোর ভঙ্গি দেখে তখন থেকে হেসেই যাচ্ছে। সকাল কিছু বলা বাদ দিয়ে স্নিগ্ধকে দেখছে। ছেলেটা অসম্ভব সুন্দর। তার সৌন্দর্যের রহস্য হলো তার দাঁড়ির কাটিং। যা যে কোনো মেয়েকে আকর্ষিত করবে নিজের দিকে। স্নিগ্ধ সকালকে এভাবে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অন্য দিকে ঘুরে মুচকি হাসলো। আবারও সকালের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“এবার খাওয়া শুরু করা যাক!”
-“হ্যা, কিন্তু এত খাবার কেন অর্ডার করেছেন আপনি?”
-“সবগুলো থেকে অল্প অল্প করে খাও। এমনিতেই তো চিকনা। তোমার ওজন খুব হলে ৪০ থেকে ৪২ হবে।”
-“হয়েছে। চিকন হতেও কপাল লাগে বুঝলেন?”
-“হ্যা বুঝেছি। এবার খাওয়া শুরু করো।”
সকাল সবগুলো খাবার থেকে একটু একটু করে খেলো। স্নিগ্ধও একটু একটু করে সবগুলোই খেলো। কিন্তু তারপরও অনেক খাবার রয়ে গেছে। সকাল একজন ওয়েটারকে ডেকে বেচে যাওয়া খাবার গুলো প্যাকেট করে দিতে বললো। স্নিগ্ধ অবাক হয়ে গেল সকালের কথায়। ওয়েটার সকালের কথামতো খাবারগুলো নিয়ে যাওয়ার পরপরই স্নিগ্ধ জিজ্ঞেস করলো,
-“এই খাবারগুলো কি করবে?”
-“দেখতে থাকুন কি করি।”
খাবারগুলো প্যাকিং করে নিয়ে বিল দিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে কিছুদূর এগিয়ে যেতেই রাস্তার পাশে কিছু বাচ্চাদের দেখতে পেলো। সাথে কিছু ভিক্ষুকও আছে। সকাল তাদের কাছে গিয়ে সবার ভেতরে খাবার প্যাকেটগুলো ভাগ করে দিল। কিছু টাকাও দিল তাদের। স্নিগ্ধ একপাশে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে সকালকে দেখছে। এই মেয়েটা ওকে প্রতিনিয়ত নীলামের কথা মনে করিয়ে দেয়। নীলামও এমন ছিল। স্নিগ্ধ সকালের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভেসে উঠলো চোখের সামনে কিছু পুরোনো স্মৃতি।
-“এই নীলাম তুমি এই শীতে এত রাতে ঘুরার জন্য বের হয়েছো! লাইক সিরিয়াসলি?”
-“বকবক কম করো। সারাদিন এত বকবক করো কেন বলো তো!”
-“কত ঠান্ডা পরেছে তুমি দেখছো না! কি শান্তিতে একটু ঘুমোচ্ছিলাম আমি। কিন্তু তোমার কাছে তো আমার শান্তি ভালো লাগে না।”
-“একদমই তাই। সেজন্যই তো তোমাকে ঘুম থেকে টেনে তুলে নিয়ে এসেছি।”
-“সোয়েটার, জ্যাকেট আর চাদর পরে আছি তারপরও কি ঠান্ডা।”
-“আর একটা কথা বললে মুখ সেলাই করে দিব তোমার।”
-“হুহ্!”
কিছুদূর যেতেই পথিমধ্যে এক বুড়োলোককে দেখতে পেলো ওরা। এইটা পাহাড়ি এলাকা বিধায় এখানে ঠান্ডা বেশি। কিন্তু বুড়ো লোকটি বেশ গরিব তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। পাশেই একটা অর্ধ ভাঙ্গা কুটির দেখতে পেলো। লোকটা যে সেই কুটিরেই থাকে তা বুঝতে সময় লাগলো না তেমন একটা। লোকটির গায়ে কেবল একটি পাতলা গেঞ্জি। তাও সেটা ছিঁড়া। নীলাম একমুহূর্ত দেরি না করে নিজের সোয়েটারটা খুলে উনাকে পরিয়ে দিল। চাদরটা দিয়ে ভালোভাবে মুড়িয়ে দিল লোকটাকে। স্নিগ্ধ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে নীলামের দিকে। লোকটা খুশি হয়ে নীলামকে দু’আ করে দিল। নীলাম মুচকি হেসে বললো,
-“গরম চা খান। তাহলে ঠান্ডা কম লাগবে।”
-“ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়াই করতে পারি না অভাবের কারনে। আর তো চা…. আমাদের গরিবদের জন্য এসব নয় মা।”
নীলামের বেশ খারাপ লাগলো লোকটির কথা শুনে। নীলাম কিছু না বলে নিজের ব্যাগ থেকে ৫ হাজার টাকা বের করে লোকটির হাতে দিয়ে বললো,
-“এটা রাখেন।”
-“না না মা। আমি ভিখারি নই।”
-“আমি কি একবারও বলেছি যে আপনি ভিখারি? আপনি আমাকে আপনার মেয়ে মনে করতে পারেন। মেয়ের কাছ থেকে তো টাকা নেয়াই যায়। এবার আর না করবেন না। রাখুন টাকাটা।”
লোকটা নীলামের দিকে ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে টাকাটা নিয়ে নিলো। নীলাম মুচকি হেসে স্নিগ্ধর হাত ধরে আবার সামনের দিকে হাঁটা শুরু করলো। স্নিগ্ধর চোখে চোখ পরতেই নীলাম খেয়াল করলো অন্য রকম এক মোহনীয় দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে স্নিগ্ধ ওর দিকে। নীলাম দাঁড়িয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“কি হলো তোমার?”
-“তুমি সবার কত খেয়াল রাখো।”
-“আমার ভালো লাগে এগুলো তাই।”
-“হুম, কিন্তু নিজের খেয়াল কেন রাখো না?”
-“আমার খেয়াল রাখার জন্য তুমি আছো তো!”
স্নিগ্ধ মুচকি হেসে নীলামকে নিজের কাছে টেনে জড়িয়ে ধরলো। নীলামও দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো স্নিগ্ধকে। কিছুদূর গিয়ে পাহাড় ঘেঁষে ঝর্ণার পাশে বসে পরলো ওরা। এমনিতেই ঠান্ডা তার ওপর এই ঝর্ণার পানি যেন ঠান্ডাটাকে বাড়িয়ে দ্বিগুণ করে দিয়েছে। কুয়াশাচ্ছন্ন মেঘের চাদরের আড়ালে চাঁদ মামা মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে। পরিবেশটা বেশ সুন্দর। স্নিগ্ধ নীলামের পেছনে বসে ওকে জড়িয়ে ধরলো। নিজের গায়ের চাদর দিয়ে নীলামকেও ভালোভাবে ঢেকে নিলো। সকালের চেঁচামেচি শুনে স্নিগ্ধ বাস্তবে ফিরলো। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সকালের দিকে তাকালে সকাল বললো,
-“কোন রমণীর প্রেমে এতক্ষণ বুদ হয়ে ছিলেন, হ্যা?”
-“নী.. না কিছু না।”
-“কিছু না মানে? কি চিন্তা করছিলেন আপনি?”
-“তেমন কিছু না। একটা সার্জারি আছে একটু পরে। সেটার চিন্তাই করছিলাম।”
-“তার মানে এখন আপনি হসপিটালে যাবেন?”
-“হ্যা।”
-“আচ্ছা তাহলে টাটা।”
-“টাটা মানে! এই মেয়ে তুমি একা যাবে না-কি?”
-“হ্যা। কেন?”
-“চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসো। আমি তোমাকে পৌঁছে দিব তোমার বাসায়।”
-“আপনার অসুবিধা হবে না?”
-“না। এখন চলো।”
সকাল গোসল করে এসে বিছানায় শুয়ে ফোন হাতে নিতেই দেখলো পরশের নাম্বার থেকে অনেকগুলো কল সাথে ম্যাসেজও রয়েছে। সকাল অবাক হয়ে গেল তা দেখে। সকাল ম্যাসেজগুলো না দেখে পরশকে কল করলো। দু’বার রিং হতেই কল রিসিভ করলো পরশ।
-“সকাল তুমি কোথায়? তোমাকে কতবার কল দিয়েছি, কতগুলো ম্যাসেজ দিয়েছি। কিন্তু তুমি কোনো রিপ্লাই করো নি কেন?”
-“পরশ পরশ পরশ থামো। এত চিন্তার কি আছে। আমি সকাল থেকে ডাক্তার সাহেবের সাথে ছিলাম। একটু আগেই বাসায় এসেছি।”
-“স্যারের সাথে এতক্ষণ কি করছিলে তুমি?”
-“এমনি ঘুরাঘুরি করছিলাম। উনার একটা সার্জারি ছিল বলে উনি একটু আগে আমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে হসপিটালে চলে গেছেন।”
-“সকাল তুমি এভাবে না বলে কোথায় যাবে না প্লিজ। আমার চিন্তা হয় তোমার জন্য।”
সকাল অবাক হয়ে বললো,
-“কি বলছো তুমি পরশ! আমি এখন কোথায় যাবো না যাবো তোমার কাছে বলে যেতে হবে আমার?”
-“হ্যা এখন থেকে এটাই করবে তুমি।”
এবার কিছুটা রেগে সকাল বললো,
-“আ’ম স্যরি বাট আমি পারবো না। আমার লাইফে আমি কিভাবে চলবো না চলবো সেটা একান্তই আমার ব্যাপার। তার কৈফিয়ত আমি কাউকে দিব না। এমনকি তোমাকেও না। সো নেক্সট টাইম এরকম কিছু বলবে না।”
-“কিন্তু সকাল….”
-“রাখছি আমি।”
সকাল কলটা কেটে দিল। পরশ মন খারাপ করে বসে পরলো। বেশ কয়েকবার কল দিল সকালের নম্বরে। কিন্তু সকাল রিসিভ করলো না। পরশের কাছে ব্যাপারটা খারাপ লাগলেও কিছু করার নেই। সকালকে পরশ পছন্দ করে। কিন্তু সকাল ওকে একজন ভালো বন্ধু ছাড়া আর কিছু ভাবে না তার প্রমাণ পরশ আজ পেয়ে গেল। এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে পরশ চুপ করে বসে রইলো। ও কি পারবে সকালকে নিজের অনুভূতি গুলো বুঝাতে? এসবই ভাবতে লাগলো পরশ।
চলবে….