সেই সন্ধ্যা পর্ব-১৯

0
1412

#সেই_সন্ধ্যা
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_১৯
.
স্নিগ্ধ কিছু না বলে শুধু মুচকি হাসলো। সকাল গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে গিয়েও আবার ফিরে এলো স্নিগ্ধর কাছে। স্নিগ্ধ গাড়ির কাঁচ নামিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কিছু বলবে?”
-“আই লাভ ইউ।”

স্নিগ্ধ থমকে গেল মুহূর্তেই। ওর হাসি মুখটা নিমিষেই হা হয়ে গেল। এই মাত্র ও যা শুনলো তা ঠিক না ভুল তা বুঝতে পারলো না। স্নিগ্ধর চেহারার ভাবগতি দেখে সকাল মাথা নিচু করে লাজুক হেসে বাড়ির ভেতরে চলে গেল। সকালকে চলে যেতে দেখে হুঁশ ফিরলো স্নিগ্ধর। সকালকে ডাকার আগেই সকাল বাড়ির ভেতরে চলে গেল। স্নিগ্ধ ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। কেন জানি না বারবার মনে হচ্ছে এটা একটা স্বপ্ন ছিল, অথবা কোনো ঘোর ছিল। কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনে হচ্ছে সকাল সত্যিই তাকে নিজের মনের কথা বলে গিয়েছে। ভীষণ ভাবে বিভ্রান্ত হয়ে গেল স্নিগ্ধ। চিন্তা করতে করতে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেল সে।

সকাল নিজের রুমের দরজা লাগিয়ে লজ্জায় বিছানার এক কোণায় গুটিশুটি মেরে বসে পরলো। গাড়িতে আসার সময় সারাটা রাস্তা শুধু নিজেকে মনে মনে অভয় দিয়ে এসেছে। এইরকম একটা কাজ করার জন্য নিজেকে অনেক কষ্টে প্রস্তুত করেছে সকাল। যখন “আই লাভ ইউ” বলছিল স্নিগ্ধকে তখন ওর হাত-পা সব অসার হয়ে আসছিল। ঠোঁট দু’টো কাঁপছিল ভীষণভাবে। একবার তো মনে হয়েছিল কিছু বলতেই পারবে না। কিন্তু নিজের মনে অনেকটা সাহস সঞ্চার করে কিভাবে যে মনের কথাটা স্নিগ্ধকে বলে দিল বুঝতেই পারলো না। গালে হাত দিতেই সকাল বুঝতে পারলো যে তার গাল গরম হয়ে এসেছে। অর্থাৎ তার মাত্রাতিরিক্ত লজ্জা লাগছে।

স্নিগ্ধ একহাত মাথার নিচে রেখে ওপরে চলন্ত ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে এক ধ্যানে। মাথায় সকালের বলা “আই লাভ ইউ” বাক্যটা ঘুর ঘুর করছে। এখনো সে এটাই বুঝার চেষ্টা করে যাচ্ছে যে সেটা স্বপ্ন ছিল না বাস্তব ছিল? আর যদি বাস্তবই হতো তাহলে সকাল তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কেন চলে গেল? স্নিগ্ধ ভাবতে লাগলো যদি সকাল সত্যি সত্যি তাকে “আই লাভ ইউ” বলে থাকে তাহলে এরপরে তার কি উত্তর দেয়া সঠিক হবে! স্নিগ্ধর ভেতরে এক অন্যরকম অস্থিরতা কাজ করছে। অনেক চিন্তা-ভাবনা করার পর স্নিগ্ধ ফোন হাতে নিয়ে আখির নম্বরে কল দিল।

আখি নয়নকে ঘুম পাড়িয়ে দোলনায় শুইয়ে দিল। এক স্বস্তির নিশ্বাস নিয়ে চুলগুলো হাত খোঁপা করতে করতে রুমের চারপাশ ভালো করে দেখতে লাগলো। তারপর লেগে পরলো রুমের পেছনে। পুরো রুমটা তছনছ হয়ে আছে। রুম গুঁছানো শেষ করে বেডশিট বদলাতে গেলে, কোত্থেকে যেন পলক এসে আখিকে জড়িয়ে ধরলো। আখি সাথে সাথেই বালিশ দিয়ে দিল পলকের গায়ে বারি। পলক দূরে সরে যেয়ে ভ্রু কুঁচকে ফেললো।

-“মারলে কেন?”
-“মারবো না! তুমি এখন এসেছো অসভ্যতামি করতে। আমি কি তা বুঝি না ভেবেছো?”
-“এতই যখন বুঝো, তখন বারি না মেরে একটু আদর করলেও তো পারো!”
-“এই তুমি যাবে এখান থেকে! তোমার আর তোমার ছেলের জ্বালায় আমি অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছি।”
-“এমন করো কেন? একটু আদরই তো চেয়েছি!”
-“একটু আদর না! সারাক্ষণ এই তালেই থাকো।”
-“আমার কি দোষ! তোমার ছেলে যদি সব সময় বারা ভাতে পানি ঢেলে দেয় তো আমি কি করতে পারি?”
-“আমি সিরিয়াসলি পাগল হয়ে যাবো তোমাদের দু’টোর জ্বালায়।”

পলক মুচকি হেসে আখির হাত ধরে টান দিয়ে নিজের কাছে এনে কোমড় জড়িয়ে ধরলো। আখি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো পলকের দিকে। হালকা হেসে আখির কপালে এক চুমু এঁকে দিল পলক। মুহূর্তেই আখির রাগ, বিরক্ত সব হাওয়া হয়ে গেল। নেশাকাতর চোখে তাকালো পলকের দিকে। পলক আখির আরও কাছে এগিয়ে যেতেই আখির ফোন বেজে উঠলো। মুহূর্তেই একরাশ বিরক্ত এসে ভর করলো পলকের চেহারায়। আখির প্রচুর হাসি পেলেও তা বুঝতে দিচ্ছে না পলককে। হাসতে চেয়েও চুপ করে আছে সে। পলক তা টের পেয়ে ধমকের সুরে বললো, “এত হাসার কি আছে?”
-“কই হাসলাম!”
-“ধুর! তুমি আমাকে একটুও ভালোবাসো না এখন আর।”
-“না বাসলে নাই। যাও ভাগো!”

আখি ফোন হাতে নিয়ে দেখে স্নিগ্ধ কল দিচ্ছে হোয়াটস অ্যাপে। কলটা রিসিভ করতেই স্নিগ্ধ উত্তেজিত হয়ে বললো, “এতক্ষণ লাগে ফোন রিসিভ করতে?”
-“একটু ব্যস্ত ছিলাম তাই খেয়াল করি নি। যাই হোক বাদ দে। তো বল! কেমন আছিস?”
-“সেসব কথা পরে হবে। আগে আমাকে পরামর্শ দে কিছু।”
-“কি ব্যাপারে?”
-“সকাল আজ আমাকে প্রপোজ করেছে। এখন আমার ওকে কি বলা উচিৎ? আই মিন কি করব আমি?”
-“সত্যি বলছিস; এক মিনিট, কি বলবি মানে! তুই কিছু বলিস নি ওকে?”
-“আরে ও বলার সময় দিলে তো কিছু বলবো আমি। ও তো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দৌড়ে চলে গেল।”
-“আচ্ছা আচ্ছা বুঝলাম। আমি তোকে কিছু কথা জিজ্ঞেস করবো স্নিগ্ধ। সঠিক সঠিক উত্তর দিবি।”
-“কি জিজ্ঞেস করবি?”
-“তোর কোনো অনুভূতি কাজ করে না সকালের প্রতি?”
স্নিগ্ধ কিছু সময় চুপ করে থেকে বললো, “হ্যা করে।”
-“তুই বুঝতে পারিস ওকে?”
-“হয়তো… তবে ওর থেকে ওকে ভালো চিনি আমি এটা গ্যারান্টি দিতে পারি।”
-“গুড! ও সাথে না থাকলে ওর কথা ভাবিস?”
এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্নিগ্ধ জবাব দিল, “হুম।” আখি আরও জিজ্ঞেস করলো।
-“ওকে দেখতে ভালো লাগে?”
-“ভীষণ! ওকে একদিন না দেখলে মনে হয় কতকাল ধরে দেখি না।”
-“ওর মন খারাপ হলে তোর খারাপ লাগে?”
-“হ্যা। তাই তো সব সময় ওকে হাসি-খুশি রাখার চেষ্টা করি।”
-“ওর বাচ্চামো স্বভাবটা ভালো লাগে?”
স্নিগ্ধ এবার হালকা মৃদু হেসে বললো, “ওর বাচ্চামিতেই তো ওর প্রতি আমি মুগ্ধ হয়েছি।”
-“ভালোবাসিস তোর মিস বিকালকে?”
-“নিজের থেকেও বেশি।”

স্নিগ্ধ নিজেই বেকুব হয়ে গেল কথাটা বলে। এমন কিছু ও বলতে চায় নি। মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছে। স্নিগ্ধর কথায় মুখে প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠলো আখির। এই কথাটাই তো ও বের করতে চাইছিল স্নিগ্ধর কাছ থেকে। ওর কৌশল কাজে লেগেছে ভাবতেই মনে মনে হাসতে লাগলো আখি। এরপর কিছুক্ষণ পিনপতন নীরবতা চললো ওদের মাঝে। আখি নীরবতা কাটিয়ে বললো, -“তাহলে কাল তুই মেডিকেলে যেয়ে সর্বপ্রথম সকালকে তোর মনের কথাটা জানাবি। কোনো উল্টো পাল্টা কাহিনি করবি না, আগেই বলে দিলাম।”
স্নিগ্ধ আমতা আমতা করে বললো,
-“মানে আমি আর মিস বিকাল?”
-“তুই ওকে ভালোবাসিস। তাহলে সমস্যাটা কোথায় ওকে ‘ভালোবাসি’ বলতে?”
-“ভয় করছে রে!”
-“ঢং করিস না। সোজা যেয়ে তোর মিস বিকালের সামনে দাঁড়িয়ে বলে দিবি যে তুই ওকে ভালোবাসিস।”
-“আমি!”
-“তুই বলবি না তো কি অন্য কেউ তোর হয়ে ভালোবাসি বলে দিবে তোর মিস বিকালকে?”
-“এই না!”
-“তাহলে!”
-“আচ্ছা আমিই বলবো। কিন্তু…”
-“আর কোনো কিন্তু না। কালকে যদি তুই সকালকে কিছু না বলিস তো আর কখনো আমাকে কল দিবি না।”
-“আরেহ আখি এমন করিস কেন?”
-“বায়। তুই আমাকে তখনি কল দিবি যখন তোর আর সকালের মাঝে সব ঠিকঠাক থাকবে।”

স্নিগ্ধকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দিল আখি। হতভম্ব হয়ে কিছু সময় বসে থেকে এক শুকনো ঢোক গিলে নিলো স্নিগ্ধ। মিস বিকালকে প্রপোজ করতে হবে কথাটা ভাবা মাত্রই ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হতে লাগলো। স্নিগ্ধ পানির গ্লাস নিয়ে এক নিমিষেই গ্লাসটা খালি করে ফেললো। এক হাতে কপালের ঘাম মুছে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে যেয়ে দাঁড়ালো। আয়নার দিকে তাকিয়ে মিথ্যে হাসার ব্যর্থ চেষ্টা করে স্নিগ্ধ সকালকে কিভাবে কি বলবে তার অনুশীলন করতে লাগলো। প্রথম বারে ব্যর্থ হলেও দ্বিতীয় বারে স্নিগ্ধ সক্ষম হলো তার অনুশীলনে।

আফি অশ্রু সজ্জিত নয়নে বেলকনিতে বসেছিল। এমন সময় ওর মা ঘরে এসে আফিকে ডাকতে লাগলেন। আফি চোখ দু’টো ভালো করে মুছে বেলকনি থেকে রুমে আসতেই আফির মা ওকে বসতে বললো। আফি চুপচাপ কথা না বাড়িয়ে বসে পরলো। আফির মা পাশে বসে জিজ্ঞেস করলেন,
-“তোর কি কিছু হয়েছে মা?”
আফি মাথা নিচু করে বললো,
-“না আম্মু। আমার আবার কি হবে?”
-“কিন্তু তোর চেহারা তো অন্য কথা বলছে।”
-“আসলে আম্মু, মেডিকেলের পড়াশোনার চাপ অনেক বেশি। এত চাপ আমি নিতে পারছি না।”
-“তাহলে কিছুদিন ছুটি নিয়ে নে। মাইন্ড রিফ্রেশ করে তারপর আবার মেডিকেলে যাওয়া শুরু কর। এভাবে মনমরা হয়ে থাকলে তো তোর শরীর খারাপ করবে। তোর কিছু হলে আমার কি হবে একবার ভেবেছিস? তুই ছাড়া তো আমার কেউ নেই। তোর বাবা তো আমাকে অনেক আগেই ছেড়ে চলে গিয়েছে। এখন তুই-ই আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।”

আফির প্রচুর কান্না পাচ্ছে এই মুহূর্তে মায়ের কথাগুলো শুনে। কিন্তু এতে ওর মা বুঝে যাবে যে ওর সত্যি কিছু একটা হয়েছে। নিজের কান্নাটা দমিয়ে রেখে নিচু গলায় আফি বললো,
-“আম্মু তুমি চিন্তা করো না। আমার কিছু হবে না। আমি ঠিক আছি। কিছুদিন রেস্ট নিলে আবারও আগের মতো ঠিক হয়ে যাবো।”
-“সত্যি তো!”
-“হ্যা আম্মু সত্যি। এবার তুমি যাও তো। অনেক রাত হয়েছে, যেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।”
-“আচ্ছা। তুইও ঘুমিয়ে পড়।”
-“ঠিক আছে।”

আফির আম্মু রুম থেকে চলে যেতেই আফি রুমের দরজা লাগিয়ে দিয়ে কান্নায় ভেঙে পরলো। আজ ওর নিজের যে অবস্থা, তার জন্য একমাত্র ও নিজেই দায়ী। পলাশকে ও সুযোগ করে না দিলে ওকে আজ এত কষ্ট পেতে হতো না, এত অপরাধবোধ কাজ করতো ওর মনে। প্রতিটা মুহূর্ত এখন নিজের করা ভুলগুলো যেন ওকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। আফি কান্না করতে করতে একটা কথাই চিন্তা করছে বারবার, ওর মা যদি কখনো জানতে পারে যে ও এরকম কিছু করেছে তাহলে ওর মা নিশ্চিত মরে যাবে। আর মেয়ে হয়ে আফি তা কখনো সহ্য করতে পারবে না। ওর পুরো দুনিয়াটা যে একমাত্র ওর মা’কে ঘিরেই।

স্নিগ্ধ মেডিকেলে ঢুকে আশেপাশে তাকাতে লাগলো। সকালকে কোথাও দেখতে না পেয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল এমন একটা চেহারা বানিয়ে নিজের কেবিনে চলে গেল।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here