#সেই_সন্ধ্যা
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_২৫
.
“ভালোবাসি ডাক্তার সাহেব।” এরপর কতগুলো হলুদ ইমোজি দেয়া যার ঠোঁটের সামনে লাভ রয়েছে। স্নিগ্ধ হেসে ফেললো সকালের পাগলামি দেখে। ম্যাসেজের উত্তর দিতে গিয়েও কি ভেবে যেন উত্তর দিল না। ফোন পকেটে ঢুকিয়ে রাখতে যেয়ে আবার বের করে সকালের ম্যাসেজ বের করলো। “বাসায় পৌঁছে হাত-মুখ ধুয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। নাহলে আগামীকাল মেডিকেলে দেরি করে পৌঁছাবে। প্রথম ক্লাসটা কিন্তু আমার। যদি দেরি করো তাহলে কিন্তু ক্লাসে ঢুকতে দিব না।” ম্যাসেজটা লিখে পাঠিয়ে স্নিগ্ধ নিজেই হাসতে লাগলো।
স্নিগ্ধ বাসায় ঢুকে দেখলো নিপার আম্মু শিহাবকে বকাবকি করছে। স্নিগ্ধ শিহাবের দিকে তাকিয়ে নিপার আম্মুকে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে মামীমনি?”
-“আরে স্নিগ্ধ একটু দেখ না ওকে বাবা। কোত্থেকে যে মারামারি করে এসেছে ওপরওয়ালাই জানে আর ও জানে। কিছুই তো বলছে না আমাকে।”
স্নিগ্ধ শিহাবের পাশে বসে টেবিলের ওপর থেকে স্যাভলনের বোতল নিয়ে তুলোয় ঢেলে শিহাবকে নিজের দিকে ফিরিয়ে তার গালে আর ঠোঁটের কোণে রক্ত পরিষ্কার করতে লাগলো।
-“তোমার ছেলের ব্যাকগ্রাউন্ড অনেক ভালো কি-না! দেখো হয়তো আবারও কোনো মেয়েকে উত্ত্যক্ত করতে গিয়ে মার খেয়ে এসেছে। কিন্তু এবার যে মেরেছে সে এমনভাবে মেরেছে যে এরপর থেকে কোনো মেয়েকে উত্ত্যক্ত করতে গেলে হাজার বার ভাববে তোমার ছেলে।”
কথাগুলো শিহাবের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো স্নিগ্ধ। গালের ক্ষতস্থানে তুলো একটু জোরে চেপে ধরতেই ব্যাথায় ককিয়ে উঠলো শিহাব। কিন্তু মুখে কিছু বললো না। মামীমনিও ততক্ষণে চুপ হয়ে গিয়েছেন। নিজের ছেলের এই একটা বাজে অভ্যাসের কারণে তাকে সব জায়গাতে মাথা নিচু করে থাকতে হয়। শিহাব স্নিগ্ধর দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নিচু করে ফেললো।
স্নিগ্ধ ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখলো আসমা বেগম তার বিছানায় বসে গভীর মনোযোগ সহকারে কি যেন ভাবছে। স্নিগ্ধ মুচকি হেসে বিছানায় যেয়ে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। আসমা বেগম চমকে উঠলেন। পরক্ষণেই স্নিগ্ধকে দেখে স্বাভাবিক হয়ে গেলেন তিনি। চুলে হাত বুলাতে লাগলেন।
-“কিছু বলবে?”
আসমা বেগম ইতস্তত করে বললেন, “হুম।”
-“বলো।”
-“সকাল মা তোর ছাত্রী!”
-“হ্যা।”
-“কেমন মেয়েটা!”
-“ভালোই। একটু বেশিই ভালো আর কি। আমার স্পেশাল ছাত্রী।”
আসমা বেগম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “স্পেশাল ছাত্রী মানে!”
-“মানে ওকে আমার একটু বেশিই ভালো লাগে।”
স্নিগ্ধর কথায় আসমা বেগম কিছুটা খুশি হলেন। তিনি বেশ উৎসুক হয়ে বললেন, “আমার কিন্তু মেয়েটাকে অনেক ভালো লেগেছে। খুব মিষ্টি মেয়ে। দেখতে যেমন মাশাআল্লাহ, ব্যবহারও তেমন মাশাআল্লাহ।”
-“হুমম আমারও তাই মনে হয়।”
-“একটা কথা বলি স্নিগ্ধ!”
-“অনুমতি নেয়ার কি আছে মা? যা বলতে চাও বলে ফ্যালো।”
-“আর কতদিন এভাবে কষ্ট পাবি তুই? এবার তো নিজেকে গুছিয়ে নে। আমি মা হয়ে নিজের ছেলের এই অবস্থা কি করে সহ্য করবো বল! কম তো হলো না। নীলাম চলে গিয়েছে বছর খানিক তো পাড় হতে চললো। ওর জন্য কষ্ট পেয়ে তুই নিজেকে কেন শেষ করছিস! ধরে নে যে ও তোর ভাগ্যে ছিল না।”
-“আমি নীলামকে ভালোবেসেছি মা। ওকে ভুলে যাওয়ার জন্য তো ওকে ভালোবাসিনি। আমি ওকে সারাজীবন নিজের করে পাওয়ার জন্য ভালোবেসেছি। কোনো খাঁদ তো ছিল না আমার ভালোবাসায়; তাহলে নীলাম কেন আমাকে ছেড়ে চলে গেল মা?”
-“তুই’ই বা কেন এত অবুঝ হচ্ছিস! স্নিগ্ধ একটু বুঝার চেষ্টা কর ব্যাপারটা। যে যাওয়ার সে চলে যাবেই। হাজার কিছুর বিনিময়েও তুই তাকে আটকে রাখতে পারবি না। ঠিক সেভাবেই নীলামেরও যাওয়ার ছিল তাই সে চলে গেছে। কিন্তু তার মানে তো এই না যে তুই নিজেকে শেষ করে দিবি। আমাদের কথাটাও একটু ভাব! আমি আর তোর বাবা কতদিন বেঁচে থাকবো? আমরা এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করার আগে তোর একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ, তোর একটা ছোট পরিবার দেখতে চাই স্নিগ্ধ।”
স্নিগ্ধ আসমা বেগমের কোল থেকে উঠে রুমের দক্ষিণ দিকে দেয়ালের কাছে এসে দাঁড়ালো। দেয়ালটা পর্দা দিয়ে ঢাকা। স্নিগ্ধ একটানে পর্দা সরিয়ে দিতেই নীলামের ছবিটা বেরিয়ে এলো। ছবিতে হাত বুলিয়ে স্নিগ্ধ বললো,
-“আমি যদি অন্য কাউকে গ্রহণ করি, তাহলে কি নীলামকে ঠকানো হবে না?”
-“কেন ঠকানো হবে! নীলাম না থাকলে তুই নিজের বাকিটা জীবন দেবদাস হয়ে কাটিয়ে দিবি বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলি না-কি ওর কাছে?”
-“আমি তা বলতে চাইনি মা। একজনকে মনে রেখে আরেকজনের সাথে সংসার করাটা তো অন্যায়।”
-“কোনো অন্যায় না। একসাথে থাকতে থাকতে অনেক সময় একে অপরকে ভালোবাসা যায়। ভালোবাসা না গেলে অভ্যাস আর মায়া পড়ে যায়। তুই ভালো না বাসতে পারিস তবে মায়া আর অভ্যাস নিয়ে তো থাকতে পারবি তার সাথে এই ঢের।”
-“যদি কখনো নীলাম ফিরে আসে তখন!”
-“ও আর কখনো ফিরবে না স্নিগ্ধ। তুই নিজে ডাক্তার হয়েও এসব বলছিস?”
স্নিগ্ধ নীলামের চোখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো, “তাহলে কি এবার সত্যি সত্যি তোমাকে ভুলতে হবে নীলাম! যাকে নিজের সবটুকু দিয়ে ভালোবেসে ছিলাম একদিন তাকে ভুলে যাওয়া আদৌও কি সম্ভব? হয়তো ভুলতে পারবো, আবার হয়তো পারবো না। কিন্তু একটা চিরন্তন সত্য কথা কি জানো! আমার প্রথম ভালোবাসা তুমি ছিলে আর তুমিই থাকবে।” এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্নিগ্ধ তার মায়ের দিকে তাকালো।
-“এখন তুমি কি চাইছো?”
-“আমি চাই তুই এবার বিয়ে কর। বিয়ে করে ঘরে একটা লক্ষ্মী বউ নিয়ে আয়, যে তোকে সারাদিন আগলে রাখবে।”
-“আমাকে আগলে রাখবে মানে! আমি কি বাচ্চা না-কি?”
-“আমার কাছে তো তুই আজীবনই বাচ্চা থাকবি।”
-“কিছুদিন পর তোমার ছেলের ২৯ বছর হবে মা। তাকে এখনো বাচ্চা বলছো তুমি; সিরিয়াসলি!”
-“এ আর এমন কি বয়স! ছেলেদের এমন একটু-আধটু বয়স হয়েই থাকে।”
-“তোমার সাথে কথায় পারবো না আমি।”
-“পারতে হবেও না। শুধু বল তুই কি বিয়ে করতে রাজি!”
-“তোমার যা ভালো মনে হয় করো। তবে মেয়েটা কে তা একটু কষ্ট করে জানিয়ে দিও আমাকে।”
-“আচ্ছা একটু বোস, তোকে আরো কিছু জিজ্ঞেস করবো।”
-“আবার কি?”
-“তোর ছাত্রী মানে সকাল মা’কে যদি আমি তোর বউ করে নিয়ে আসতে চাই তাহলে কি তোর কোনো আপত্তি আছে!”
স্নিগ্ধ মুচকি হাসলো। বললো,
-“নাহ! কোনো আপত্তি নেই। তবে ওর পরিবার কি রাজি হবে?”
-“কেন হবে না! রেহেনা আপা তো তোকে খুব পছন্দ করেছে। আজ তোকে নিয়ে কত কি বললো। উনার কথাতেই আমি বুঝতে পেরেছি যে উনি তোকে সকালের সাথে একজোট করতে চায়।”
-“ওহ আচ্ছা। আর মিস বিকাল!”
-“মিস বিকাল আবার কে?”
-“তুমি যাকে তোমার পুত্রবধু করতে চাইছো, তাকে আমি মিস বিকাল নামেই ডাকি।”
-“যাহ শয়তান! মেয়েটার এত সুন্দর একটা নাম তুই মজা কেন করিস?”
-“মজা না মা। ভালো লাগে এই আর কি।”
আসমা বেগম হাসলেন স্নিগ্ধর কথায়। মনে মনে বললেন, “আমি শতভাগ নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি, যদি তোর বিয়ে সকাল মায়ের সাথে হয় তাহলে তুই অবশ্যই নীলামকে ভুলে সকাল মা’কে ভালোবাসতে বাধ্য হবি। মেয়েটার ব্যবহারে তো মুগ্ধতা আছেই সাথে রূপেও পুরো অপ্সরীদের মতো।”
-“কিছু ভাবছো মা!”
-“না কিছু না। আচ্ছা তুই ঘুমিয়ে পড়। আমিও যাই এখন। আর শোন! আগামীকাল বা পরশু আমরা সকাল মা’কে দেখতে যাবো। আর তুইও যাবি সাথে। তোর কোনো বাহানা আমি শুনবো না।”
-“আচ্ছা ঠিক আছে।”
আসমা বেগম চলে যেতেই স্নিগ্ধ নীলামের ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে নীলামের গালে হাত রাখতে যেয়েও হাত ফিরিয়ে নিলো। এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারো ছবিটা পর্দা দিয়ে ঢেকে দিল। আজ নিজেকে বেশ হালকা লাগছে। হয়তো মায়ের সাথে সবকিছু শেয়ার করায় এমনটা লাগছে। বিছানায় শুয়ে চোখটা বন্ধ করতেই আজকের কথাগুলো মনে পরলো। মুহূর্তেই ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি এসে ভর করলো।
সকাল দারোয়ানকে দিয়ে সবগুলো গোলাপ গাছ ছাদে রেখে এসেছে। নিজে ফ্রেশ হয়ে এসে টেডিবিয়ারকে জড়িয়ে ধরে ফোনটা নিয়ে ম্যাসেজ চেক করে স্নিগ্ধর ম্যাসেজ দেখে মুচকি হেসে সেটা পড়লো। পরক্ষণেই গালটা ফুলিয়ে ফেললো সে। স্নিগ্ধর ম্যাসেজের পরিবর্তে একটা ম্যাসেজ পাঠিয়ে ফোনটা বন্ধ করে ফেললো সকাল। টেডিকে জড়িয়ে ধরে কতক্ষণ একা একা বকবক করে ঘুমিয়ে গেল সে।
অ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল স্নিগ্ধর। টি-টেবিলের ওপর থেকে ফোনটা নিয়ে অ্যালার্ম বন্ধ করে ফোন রাখতে গিয়েও আবার অন করে ম্যাসেজ বক্সে গিয়ে সকালের ম্যাসেজ দেখে হেসে ফেললো সে। “যাবো না কাল মেডিকেলে, করবো না আপনার ক্লাস। আপনি একটা পঁচা লোক। নিশ্চিত আপনার জন্মের পর আন্টি আপনাকে আদার রস খাইয়েছিল। তাই তো আদার মতো প্যাঁচানো কথাবার্তা বলেন শুধু। আপনাকে আমি কি ম্যাসেজ দিয়েছিলাম আর আপনি কি রিপ্লাই করেছেন হ্যা! ধুর! আপনার সাথে কথা বলাই বেকার। পঁচা লোক একটা। কথা নেই আপনার সাথে। আড়ি!” শোয়া থেকে উঠে বসে সকালের নম্বরে কল দিতেই শুনতে পেলো অপর পাশ থেকে মেয়েলি গলায় বলছে, “আপনি যে নম্বরটিতে ডায়াল করছেন, তা এই মুহূর্তে বন্ধ আছে। অনুগ্রহ করে কিছুক্ষণ পর আবার চেষ্টা করুন। ধন্যবাদ।” পর পর দু’বার কল দেয়ার পরও একই উত্তর ভেসে আসলো ওপাশ থেকে। স্নিগ্ধ ফোনটা রেখে উঠে গেল ফ্রেশ হওয়ার জন্য।
চলবে….