সেই সন্ধ্যা পর্ব-২৮

0
1311

#সেই_সন্ধ্যা
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_২৮
.
আরিফুল ইসলামের পাশে লাজুক চেহারা নিয়ে বসে আছে সকাল। তার সামনেই মুখে এক চিলতে হাসি নিয়ে বসে আছে স্নিগ্ধ। অবশেষে সে তার মিস বিকালের রাগ, অভিমান দুটোই ভাঙাতে সক্ষম হয়েছে। সকালের এই হাসি মুখটা দেখেই এক প্রকার প্রশান্তি অনুভব করছে স্নিগ্ধ। আসমা বেগম ভীষণ খুশি তার ছেলের জন্য সকালকে পেয়ে। সব কথাবার্তা বলে বিয়ের তারিখ ঠিক করে ফেললো দুই পরিবার মিলে। আংটি পড়ানোর সময় স্নিগ্ধ অনেক সাবধানে আস্তে-ধীরে আংটি পড়ালো সকালকে, যাতে সকাল ব্যথা না পায়। স্নিগ্ধকে আংটি পড়াতে গিয়ে ভীষণ ভাবে কাঁপছিল সকাল। এক অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করছে ওর ভেতরে। আংটিটা স্নিগ্ধর আঙুলের সামনে নিয়ে স্নিগ্ধর চোখের দিকে তাকালো সকাল। মুচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে ইশারায় আংটি পড়াতে বললো স্নিগ্ধ তাকে। সকালও আর দেরি না করে স্নিগ্ধকে আংটি পড়িয়ে অর্ধেক নিজের করে নিলো। স্নিগ্ধ এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে সকালের দিকে। মেয়েটার চোখ দুটো খুশিতে ছলছল করছে। এই খুশি স্নিগ্ধকে নিজের করে পাওয়ার খুশি। কারণ সে স্নিগ্ধকে ভালোবাসে।

-“তাহলে ভাই সেই কথাই রইলো! তিন মাস পরেই সকাল মা-কে আমি নিজের ছেলের বউ করে নিয়ে যাবো।”
-“জ্বি আপা অবশ্যই। ততদিনে ওরা দু’জন দু’জনকে নাহয় আরো ভালো করে চিনে নিবে। এতে ওদেরই সুবিধা।”
-“জ্বি। তাহলে আজ আমরা উঠছি।”
-“সে-কি! না না আপনারা কিছু না খেয়ে চলে যাবেন এটা তো হচ্ছে না। একেবারে রাতের খাবার খেয়ে তবেই যাবেন।”
-“না আপা আজ না। পরের বার নিশ্চয়ই খাবো। আজ উঠি।”
-“না বললে শুনছি না তো ভাইজান। আপনারা খেয়ে তবেই যাবেন। এটাই আমার শেষ সিদ্ধান্ত। আর আমার এই সিদ্ধান্ত আপনাদের মানতেই হবে।”
-“জ্বি রেহেনা ঠিকই বলেছে। আপা-ভাইজান আজ আপনারা না খেয়ে কোথাও যাচ্ছেন না। কি স্নিগ্ধ বাবা তোমার কোনো আপত্তি আছে না-কি!”
-“না আঙ্কেল আমি আর কি বলবো! আম্মু-আব্বু যা বলবে তাই হবে।”
-“আচ্ছা ঠিক আছে আমরা আছি।”

রেহেনা বেগম খুশি হয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলেন। মেয়ের হবু শ্বশুর-শ্বাশুড়ি আর জামাইকে যদি ঠিকঠাক মতো আপ্যায়ন না করতে পারে তাহলে কি হয়! আসমা বেগমও সাহায্য করার জন্য রেহেনা বেগমের সাথে রান্নাঘরে গেলেন। ড্রইংরুমের সোফায় স্নিগ্ধ, সকাল আর তাদের বাবারা বসে আছে। আরিফুল ইসলাম মেয়ের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন,
-“মামনি তুমি স্নিগ্ধকে নিয়ে পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখাও। এখানে বড়দের মাঝে বসে তো বোর হয়ে যাবে।”
-“ঠিক আছে পাপা।”
সকাল উঠে গেল সেখান থেকে। স্নিগ্ধও একহাতে মাথা চুলকাতে চুলকাতে সকালের পেছন পেছন গেল।

আফি ছাদের এক কোণে রেলিং ধরে উদাসী হয়ে সন্ধ্যার আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তার জীবনটা কি থেকে হুট করে কি হয়ে গেল সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না সে। কাউকে মন থেকে ভালোবেসে যে এত বড় ধোঁকা খাবে কখনো ভাবেনি। কি দোষ ছিল তার! শুধু পলাশকে অন্ধের মতো ভালোবেসে বিশ্বাস করেছিল। এটাই কি তার দোষ ছিল!
-“আজ জীবন আমাকে একটা কথা খুব ভালো করে বুঝিয়ে দিল। নিজের থেকে বেশি বিশ্বাস কাউকে করতে নেই। আর কাউকে বেশি ভালোবাসলে তা সম্পূর্ণ প্রকাশ করতে নেই। নাহলে আপনার অতিরিক্ত ভালোবাসার বদলে আপনি তার কাছ থেকে শুধু অবহেলা পাবেন। মাঝে মাঝে সেটা ধোঁকাও হতে পারে। যেমনটা আমি পেয়েছি।”

নিজের অজান্তেই চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো আফির। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে সেই পানি মুছে নিলো। এই এক জীবনে কত কিছু দেখা হয়ে গেল তার। ভাবতেই হাসি পেলো আফির। পরক্ষণেই চোখের বাঁধ ভেঙে অঝোর ধারায় পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো।
-“আজ থেকে আমার জীবনের একটা কালো অধ্যায় ছাড়া আর কিছুই নও তুমি পলাশ। খুব ভালোবেসে ছিলাম তোমাকে। কিন্তু তুমি ভালোবাসার নামে আমাকে ঠকিয়েছো। আমার অনুভূতি নিয়ে খেলা করেছো। খেলা শেষ করে খেলনার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে বলে আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছো। তুমি যেমন আমাকে ছুঁড়ে ফেলেছো, তোমাকেও ঠিক এভাবেই একদিন কেউ ছুড়ে না ফেলে। আমাকে যে কষ্ট তুমি দিয়েছো তার থেকে বেশি কষ্ট যেন আবার তোমাকে কেউ না দেয়। বলা তো যায় না হয়তো আমাকে দেয়া সকল কষ্টের ফল একদিন তোমাকে তোমারই খুব কাছের কেউ দিবে। আমি অপেক্ষা করবো সেই দিনের, যেদিন তুমি নিজে থেকে আমার কাছে এসে তোমার কৃতকর্মের জন্য হাত জোর করে ক্ষমা চাইবে। কিন্তু আমি তোমাকে কখনো ক্ষমা করবো না; কক্ষনো না। ঘৃণা করি আমি তোমাকে পলাশ। আই হেইট ইউ, আই হেইট ইউ, আই হেইট ইউ।”

কাঁদতে কাঁদতে ছাদের দেয়াল ঘেঁষে নিচে বসে গেল আফি। আজ খুব কাঁদতে মন চাচ্ছে তার। হয়তো এই কান্নার মধ্যে দিয়েই নিজের কষ্টটা কমানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু মনের কষ্টগুলো কি এত সহজে মুছে যায়! কষ্ট নামক জিনিসটা বড্ড বেহায়া। তাকে হাজার বার তাড়িয়ে দিলেও বারবার ফিরে আসবেই। সারাজীবন কেউ পাশে থাকুক বা না থাকুক, কষ্ট মানুষের পাশে আজীবন থাকবে। তাই বিশ্বাস করতে হলে কষ্টকেই করা উচিৎ। সে কখনো কাউকে ঠকায় না।

পরশ ছাদে কফি হাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আকাশের মেঘগুলোকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। এই মেঘগুলোর সাথে সকালের খুব মিল পায় সে। সকালও যে এই মেঘের মতোই তার ধরা-ছোয়ার বাইরে। ও সকালকে ভালোবাসলেও সকালের মন তো অন্য একজনের কাছে বন্ধক রেখে দিয়েছে সকাল। পরশের এই মুহূর্তে নিজের উপরেই ভীষণ রাগ উঠছে। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে কি করে পারলো ও সকালকে ভালোবাসতে! ও যদি সকালের প্রতি নিজের মনে অনুভূতি তৈরি হওয়া থেকে আটকাতো তাহলে এরকম পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না তাকে। পরশ মেঘগুলোর দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বললো,
-“জীবনে অনেক মেয়ের সাথে প্রেম করেছি কিন্তু কারো প্রতি কোনো অনুভূতি তৈরি হয়নি বা কাউকে মন থেকে ভালোবাসিনি। তুমিই প্রথম যাকে আমি মন থেকে ভালোবেসে ছিলাম। কিন্তু দেখো! কষ্ট ছাড়া কিছুই পেলাম না। কেউ হয়তো সত্যি কথা-ই বলেছিল। ভালোবাসা হলো কাটার মতন। যা একবার খেলে গলায় বিঁধে যায়। আর একবার গলায় বিঁধলে না গিলে ফেলা যায় আর না বের করা যায়। শুধু যন্ত্রণা দিয়ে যায়। যেমন তোমাকে ভালোবেসে আমি যন্ত্রণা ভোগ করছি। তবে একটা কথা পরিষ্কার হয়ে গেল। ভালোবাসতে হলে একটা মুহূর্তই যথেষ্ট। কাউকে ধরে বেঁধে বিবেচনা করে ভালোবাসলে সেটা কখনো ভালোবাসা হয় না। ভালোবাসা হুট করে হয়ে যায়। কখন হয় আর কীভাবে হয় তা অজানা। তোমায় ভালোবেসে আমি ভুল করেছি পরী। এখন এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার মতো কোনো রাস্তা খুঁজে পাচ্ছি না আমি।”

চোখ দুটো জলে ভরে উঠেছে পরশের। ওই বিশাল আকাশে সে সকালের হাসি মুখটা দেখতে পাচ্ছে। “এই মেয়েটা একটা ভয়ংকর জিনিস। যে এ-র প্রেমে পড়বে সে জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাবে। কারণ সকাল অন্য কারো হৃদয়ে বিচরণ করুক বা না করুক, সকালের হৃদয়ে ঠিকই অন্য একজন বিচরণ করছে। স্নিগ্ধ স্যার অনেক আগেই তার হৃদয় দখল করে বসে আছে।” মনে মনে কথাগুলো ভেবে এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো পরশ। বাম হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে চোখের কোণে থাকা পানিটা মুছে নিলো। কফিতে চুমুক দিয়ে আবারো আকাশের দিকে তাকালো সে। বাইরে থেকে সে স্বাভাবিক হলেও ভেতরে ভেতরে তার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। সকালকে না পাওয়ার যন্ত্রণা তাকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে।

স্নিগ্ধকে পুরো বাড়ি ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে সকাল। সব ঘুরিয়ে দেখানো শেষ করে নিজের রুমের সামনে এসে থেমে গেল। পেছন ঘুরে স্নিগ্ধর দিকে তাকিয়ে মাথা কাঁত করে বললো,
-“এটা সকালের রুম। সকালের রুম দেখবেন আপনি!”

সকালের কথা বলার ভঙ্গি দেখে স্নিগ্ধর হো হো করে হাসতে মন চাইলো। মেয়েটা এত কিউট কেন! তার সব কথাই কি সুন্দর করে বলে সে। প্রতিটা কথার সাথে যে অভিব্যক্তি দেয় সে তা দেখে বেশ মজা পায় স্নিগ্ধ। মুচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে সকালের রুম দেখার জন্য সম্মতি জানালো। সকালও খুশি হয়ে স্নিগ্ধকে নিয়ে রুমের ভেতরে ঢুকে গেল। রুমটা অনেক সুন্দর করে গোছানো। হালকা গোলাপি আর সাদা রঙের জিনিসপত্র দিয়ে রুমটা সাজানো। হুট করেই সকালের কাছে এসে হাত আলতো করে ধরে হাতের তালু দেখতে দেখতে স্নিগ্ধ জিজ্ঞেস করলো,
-“ফার্স্ট এইড বক্সটা কোথায়? ক্ষতগুলো পরিষ্কার করে মেডিসিন না লাগালে ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে।”
-“সব দোষ আপনার। আপনার জন্য আমার এত সুন্দর হাতের এই অবস্থা।”
-“হ্যা আমি তো বলেছিলাম হাতের এই অবস্থা করতে। তাই না!”
-“না তা বলেন নি। তবুও আমার এই অবস্থার জন্য আপনি দায়ী হুহ্!”
-“আচ্ছা বাবা স্যরি। এখন আবার অভিমান করতে বসে যেও না। ফার্স্ট এইড বক্সটা কোথায় সেটা বলো।”
-“ওই যে টেবিলের মাঝের ড্রয়ারে রাখা আছে।”
-“ঠিক আছে। তুমি বসো এখানে।”

সকালকে বিছানায় বসিয়ে স্নিগ্ধ টেবিলের কাছে চলে গেল ফার্স্ট এইড বক্স খুঁজতে। টেবিলের মাঝের ড্রয়ার খুলতেই বক্স পেয়ে গেল সে। বক্সের ভেতরে থাকা ওষুধগুলো ঘেঁটে একটা মলম নিয়ে সকালের সামনে হাঁটু মুড়ে বসলো।
-“আরে নিচে বসছেন কেন!”
-“মলম লাগাতে সুবিধা হবে। এখন চুপ করে থাকো একদম।”

যত্ন সহকারে সকালের হাতে মলম লাগিয়ে দিচ্ছে স্নিগ্ধ। সকাল মুচকি হেসে তাকিয়ে আছে তার দিকে। এই মানুষটা এখন থেকে ওর। এতদিন স্নিগ্ধকে না পাওয়ার যে ভয়টা ছিল, আজ আর তা নেই। কারণ আজ সকাল জানে স্নিগ্ধ শুধুই তার। স্নিগ্ধ তার বাগদত্তা এবং সে স্নিগ্ধর। আগে স্নিগ্ধর সাথে কথা বলতে যেটুকু জড়তা কাজ করতো এখন থেকে তা আর করবে না। এই মানুষটার উপর সম্পূর্ণ ভরসা আছে তার। কখনো তাকে ঠকাবে না। এতদিনে এইটুকু অন্তত চিনেছে স্নিগ্ধকে সে। নিজের অজান্তেই একহাতে স্নিগ্ধর গাল ছুঁয়ে ফেললো সকাল।
হঠাৎ এমন অনুভূতিময় স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলো স্নিগ্ধ। সকালের দিকে তাকিয়ে সে বুঝতে পারলো না এই মুহূর্তে ঠিক কি চলছে তার মনে। স্নিগ্ধ চোখের ইশারায় “কি” জিজ্ঞেস করতেই সকালের মুখের হাসি আরো প্রসারিত হলো। বললো,
-“আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না আপনার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। যাকে আমি ভালোবাসি তার সাথে আমার জীবনের গাঁট বেঁধে দিয়েছে আমার মাম্মা-পাপা। জানেন এতদিন খুব ভয় হতো আপনাকে হারিয়ে ফেলার। আজ থেকে সেই ভয়টা আর থাকবে না। কেনই বা থাকবে! আপনি তো আজ থেকে আমাকে আপনার জীবনের সাথে বেঁধে ফেলেছেন। তাই আপনাকে আমার হয়েই থাকতে হবে।”

স্নিগ্ধ তার সেই চমৎকার হাসিটা দিল। সকালের মুখে প্রশান্তির হাসি। একহাত সকালের গালে রেখে ওর কপালে চুমু খেয়ে স্নিগ্ধ বললো,
-“মিস বিকাল যে এত সুন্দর বড়দের মতো কথা বলতে জানে তা তো আগে জানতাম না। তবে তো তোমাকে এখনো অনেকটা চেনা বাকি রয়েছে আমার। আর শোনো! এই স্নিগ্ধ যখন একবার কারো হাত ধরে তাকে সহজে ছাড়ে না। তোমার হাত যখন ধরেছি তখন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছাড়বো না। এতটুকু বিশ্বাস আমাকে করতে পারো তুমি। তুমি এখন আমার জীবনের একটা অংশ। তোমাকে কষ্ট দেয়ার অধিকার আমার নেই। তোমাকে খুশি রাখার আর ভালোবাসার অধিকার আমার আছে। আমি নিজের সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করবো তোমাকে খুশি করার আর ভালোবাসার। এছাড়া শুধু একটা কথাই বলবো। কখনো আমাকে ভুল বুঝোনা। আমাকে ভুল বোঝার আগে অন্তত একবার আমার কাছে বিষয়টা জিজ্ঞেস করো। আমি অবশ্যই সত্য কথা বুঝিয়ে বলবো তোমাকে।”

সকাল মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরলো তাকে। স্নিগ্ধ একহাতে ফ্লোর ধরে ব্যালেন্স ঠিক রাখলো, আরেক হাতে সকালকে জড়িয়ে ধরলো। একটুর জন্য নিচে পড়ে যায়নি তারা। স্নিগ্ধ হাসলো সকালের পাগলামি দেখে। এই মেয়েটার প্রতি তার এত টান জন্মে যাবে কখনো বুঝতে পারেনি সে। তবে ওপরওয়ালাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছে মনে মনে স্নিগ্ধ। কারণ তিনি সঠিক মেয়েকেই স্নিগ্ধর সঙ্গিনী করে পাঠিয়েছেন। নীলামের পর যদি কেউ তাকে পাগলের মতো ভালোবেসে থাকে আর বুঝে থাকে তাহলে তা একমাত্র তার মিস বিকাল। সকালের কাঁধে মুখ গুঁজে চোখ বন্ধ করে প্রশান্তির নিঃশ্বাস নিলো স্নিগ্ধ। আজ কোনো জড়তা কাজ করছে না তার মাঝে।

রাতে ডিনার শেষ করে সবাই আরো কিছুক্ষণ আড্ডা দিল। শেষে স্নিগ্ধর পরিবার সকালের পরিবারের সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। সকাল স্নিগ্ধর চলে যাওয়া গাড়ির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে নিজের হাতের দিকে তাকালো। স্নিগ্ধ তার চিহ্ন বসিয়ে গেছে সকালের আঙুলে। সকাল যে শুধু তার সেকথা বুঝিয়ে দিয়ে গেছে। বাম হাত উঁচু করে অনামিকা আঙুলে থাকা আংটিতে একটা চুমু খেল সে। সাথে সাথে তার গাল দুটো লাজে রাঙা হয়ে উঠলো।
স্নিগ্ধ বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। তার চোখে মুখে ফুটে রয়েছে প্রশান্তি। শরীরটা বেশ ক্লান্ত লাগছে তার। তবে মনে কোনো ক্লান্তি নেই। আজ সকালকে আংটি পড়িয়ে নিজের করে এসেছে সে। এখন থেকে সকালকে নিজের বলে দাবী করতে পারবে স্নিগ্ধ। মনের ভেতরে আর খচখচ করবে না সকালের কাছে গেলে। এখন কোনো বাঁধা নেই মেয়েটাকে ভালোবাসতে। একবার কাউকে ভালোবাসলে দ্বিতীয়বার যে অন্য কাউকে ভালোবাসা যাবে না এমনটা তো কোথাও লেখা নেই। স্নিগ্ধ নিজের সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করবে তার মিস বিকালকে ভালোবাসার। এসব ভেবে মুচকি হেসে পাশ থেকে ফোনটা নিয়ে আখির নম্বরে কল করলো সে।

একটা সার্জারি শেষ করে সবেমাত্র ফ্রি হয়েছে আখি। ভীষণ ক্লান্ত সে। গত দুইদিনে একফোঁটা ঘুমোতে পারেনি ডিউটি আর বাচ্চার জন্য। হসপিটালে আসলে নয়নকে পলকের কাছে রেখে আসে। নয়ন যে এই বয়সে এতটা দুষ্টু হবে তা ভাবতেও পারেনি আখি। সে নিশ্চিত পলক ছোটবেলায় প্রচুর দুষ্টুমি করতো। আর তার প্রভাব তার ছেলেও পেয়েছে। এই বয়সে এত জ্বালাতে পারে পিচ্চিটা। চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিয়ে বসা মাত্রই তার ফোন বেজে উঠলো। একরাশ বিরক্তি নিয়ে ফোনটা হাতে নিতেই সকল বিরক্তি গায়েব হয়ে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো মুখে।
-“হ্যালো স্নিগ্ধ!”
-“হ্যা। কেমন আছিস?”
-“এইতো ভালো। আমার কথা ছাড় আর তোর কথা বল। তুই কেমন আছিস?”
-“ভালো। তোর গলার স্বর শুনে তোকে ক্লান্ত মনে হচ্ছে।”
-“হ্যা রে। গত দুইদিনে একটা ফোঁটা ঘুমোতে পারিনি নয়ন আর কাজের চক্করে। মাত্রই একটা সার্জারি শেষ করে বসলাম।”
-“ওহ আচ্ছা তাহলে তুই বিশ্রাম কর। আমি তোকে পরে কল দিব।”
-“আরে না। তুই বল।”
-“তিন মাস পর আমার বিয়ে। তোকে জানানোর জন্য কল দিলাম।”
-“কিহ্!”

আখি চোখ বন্ধ করে চেয়ারের সাথে হেলান দিয়ে কথা বলছিল। স্নিগ্ধর কথা শুনে সে সোজা হয়ে নড়েচড়ে বসলো। ঠিক যেন বিশ্বাস হলো না স্নিগ্ধর কথাটা। তাই সে বিষ্ময় নিয়ে আবারো জিজ্ঞেস করলো,
-“কি বললি তুই?”
-“বললাম আজ আংটি বদল করে এসেছি। আগামী তিন মাস পর আমার বিয়ে। এবার শুনেছিস!”
-“মানে তুই সিরিয়াস! না মানে মজা করছিস না তো তুই?”
-“আরে বাবা আমি সত্যি বলছি। গত পরশু নিপা আপুর বিয়ে ছিল জানিসই তো। ওখানে মিস বিকাল এসেছিল মায়ের সাথে। মামী মনির আত্মীয় হয় না-কি তারা সেইজন্য। তো আম্মু তো মিস বিকালকে দেখে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ওইদিন রাতেই আমার সাথে কথা বলতে এসেছিল এই ব্যাপারে। আমিও আর না করিনি। রাজি হয়েছি বলে আজই ধরে নিয়ে গিয়ে আংটি বদল করিয়ে দিয়েছে। আর তিন মাস পর বিয়ের তারিখ ঠিক করে ফেলেছে।”
-“ওয়াও স্নিগ্ধ তোর বিয়ে! সত্যি সত্যি! আম..আমি বিশ্বাস করতে পারছি না ইয়্যার। আমি সত্যি খুব খুব খুব খুশি হয়েছি। তোর এই মিস বিকালই পারবে তোকে তোর অতীত ভুলতে সাহায্য করতে। প্লিজ কখনো কষ্ট দিস না ওকে।”
-“ওকে কষ্ট দিলে আমি নিজেই কষ্ট পাবো। আজ যেভাবে কাঁদছিল মেয়েটা আমারই খারাপ লাগছিল। বুকে তীরের মতো বিঁধছিল ওর কান্না।”
-“তার মানে ডক্টর স্নিগ্ধ আবারো প্রেমে পড়েছেন। মানে এখনো পুরোপুরি ভাবে পড়েননি। তবে ধীরে ধীরে পড়ছেন।”
-“হয়তো। আচ্ছা শোন! আমার বিয়েতে কিন্তু তোরা থাকছিস।”
-“অবশ্যই। এই কথা আবার বলতে হয়!”
-“ঠিক আছে তাহলে রাখছি এখন। তুইও বাসায় যেয়ে বিশ্রাম কর।”
-“আচ্ছা।”

স্নিগ্ধ বিছানায় উবু হয়ে শুয়ে জানালা দিয়ে বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বললো, “ধন্যবাদ তোমাকে আমার জীবনে আসার জন্য মিস বিকাল। আমাকে এই তীব্র যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করার জন্য।”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here