সেই সন্ধ্যা পর্ব-৩২

0
1370

#সেই_সন্ধ্যা
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_৩২
.
মেডিকেলের মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে আরিফুল ইসলাম আর রেহেনা বেগম। পাশেই স্নিগ্ধ দাঁড়িয়ে আছে সকালের হাত ধরে। সামনেই মেডিকেলের সকল প্রফেসররা দাঁড়িয়ে আছে। ওদের চারপাশে কালো পোশাক পড়া গার্ডস দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে সকল ছাত্র-ছাত্রীদের ভিড় জমে আছে। সকাল এখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আরিফুল ইসলাম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সব প্রফেসরদের দিকে।
-“কি ব্যাপার আরিফুল সাহেব! আপনি হঠাৎ এখানে এলেন। তা-ও আবার আমাদের এই মাঠে ডাকলেন কেন?”
অন্য একজন প্রফেসর সকালকে লক্ষ্য করে বললেন,
-“এই অসভ্য মেয়েটাকে মেডিকেলে কে ঢুকতে দিয়েছে? এই মেয়ে তোমার কি লজ্জা বলতে কিছু নেই? এত অপমান করার পরেও আবার মেডিকেলে এসেছো তুমি!”
স্নিগ্ধ রেগে বললো,
-“ব্যস স্যার! ওর নামে আর একটা বাজে কথা বললে আমি কিন্তু ভুলে যাবো যে আপনি আমার সিনিয়র।”
-“ডক্টর স্নিগ্ধ আপনি এখন আর ডক্টর নেই। আপনার ডাক্তারি লাইসেন্স বাতিল করে দিয়েছি আমরা।”
আরিফুল ইসলাম এতক্ষণ চুপ করে প্রফেসরদের কথাবার্তা শুনে বললেন,
-“সকালকে যে আপনারা মেডিকেল থেকে অপমান করে বের করে দিয়েছেন, তা আপনি কি ওর পরিচয় জানেন?”
-“ওর পরিচয় জানার ইচ্ছে আমাদের নেই। ও যা করেছে তা অন্যায়। ওর জন্য আমাদের মেডিকেলের বদনাম হয়েছে।”
-“তাছাড়া আরিফুল সাহেব আপনিই বা ওই মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?”
-“আমার মেয়েকে আপনারা যা নয় তাই বলবেন, তাকে মেডিকেল থেকে বের করে দিবেন আর আমি কি হাতে হাত গুটিয়ে বসে থাকবো?”

বেশ শান্ত স্বরে কথাগুলো বললেন আরিফুল ইসলাম। সব প্রফেসররা চমকে উঠলেন আরিফুল ইসলামের কথা শুনে। তারা একবার সকালের দিকে তাকিয়ে আবার আরিফুলের দিকে তাকালেন। ভয়ে কাঁপতে লাগলেন একেকজন তার শান্ত গলার স্বর আর শান্ত দৃষ্টি দেখে।
-“আমরা জানতাম না ও আপনার মেয়ে।”
আরিফুল ইসলাম এবার হুংকার দিয়ে বললেন,
-“কিন্তু এখন তো জানতে পেরেছেন যে ও আমার মেয়ে। আপনাদের সাহস দেখে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। আপনারা আমার মেয়েকে এত বিশ্রী বদনাম দিয়েছেন! এত বাজে ভাষায় কথা বলেছেন ওর সাথে! যে মেয়ের গায়ে আমি একটা ফুলের টোকাও লাগতে দেইনি সহজে আপনারা তাকে এত অপমান করার সাহস পেলেন কোথা থেকে? আজ আপনাদের জন্য আমার মেয়েটা কতটা কষ্ট পেয়েছে যে তার চোখের পানিগুলোও আজ অবাধ্য হয়ে গিয়েছে। আপনাদের জন্য আমার মেয়েটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আপনাদের কি হাল হতে পারে এর জন্য আপনারা তা জানেন?”
-“স্যরি আরিফুল সাহেব। কিন্তু আপনার মেয়ের নামে আমরা কমপ্লেইন পেয়েছি বলে যে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি তা নয়। আমরা সমস্ত সাক্ষ্য প্রমাণ দেখেই এসব বলেছি। আপনার মেয়ে আর আমাদের মেডিকেলের প্রফেসর এন্ড ডক্টর, ডক্টর স্নিগ্ধর সাথে তার একটা বাজে সম্পর্ক আছে। ওদের এই নোংরামির কারণে বাকি ডক্টর আর স্টুডেন্টদের উপর কি প্রভাব পড়তে পারে বুঝতে পারছেন আপনি!”
স্নিগ্ধ অগ্নি দৃষ্টিতে প্রফেসরদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললো,
-“নিজের বাগদত্তাকে জড়িয়ে ধরাটা যে অন্যায় তা তো আমি জানতাম না। আপনাদের চিন্তা ভাবনা কতটা নিচু হলে আপনারা সরাসরি ব্যাপারটা আমাদের কাছে জিজ্ঞেস না করে বা আমাদের পরিবারের কাছে না বলে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন তাই ভাবছি আমি। আর স্যার! আপনাদের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে আমাকে নিয়ে যে সকালের বিরুদ্ধে আপনারা এতগুলো বাজে কথা বলেছেন, সেই সকাল আমার বাগদত্তা, আমার হবু স্ত্রী সে।”

মুহূর্তেই পুরো মেডিকেলে নিস্তব্ধতা বিরাজ করতে লাগলো। আশেপাশের সকল ছাত্র-ছাত্রীরা কানাঘুঁষা শুরু করে দিল ব্যাপারটা নিয়ে। এবার সত্যি সত্যি সব প্রফেসরদের হাত-পা কাঁপতে লাগলো ভয়ে। আগে থেকে যদি জানতো যে সকাল স্নিগ্ধর বাগদত্তা তাহলে এরকম কোনো ভুল তারা কখনোই করতো না। এখন এই ভুল করার কি পরিণাম ভোগ করতে হবে তা ভাবতেই শিউরে উঠতে লাগলো একেকজন। আরিফুল ইসলাম কাকে যেন ফোন দিলেন। ফোনে কথা বলা শেষ করে প্রফেসরদের উদ্দেশ্যে বললেন,
-“আপনাদের ক্যারিয়ারে আপনারা কীভাবে উপরে ওঠেন তা আমি দেখে নিবো। আগামীকাল থেকে আপনাদের একজনকেও যাতে এই মেডিকেলে না দেখা যায় তার ব্যবস্থা করা হয়ে গিয়েছে। আপনাদের নামে যে মানহানীর মামলা করছি না এটা আপনাদের শত পূর্ব পুরুষের ভাগ্য। তবে আপনাদের প্রত্যেককে যদি আমি পরিবার সমেত রাস্তায় বাটি হাতে না বসিয়েছি তো আমার নামও আরিফুল ইসলাম না।”
-“প্লিজ এমন করবেন না। দেখুন আমরা মাফ চাইছি আমাদের কৃতকর্মের জন্য।”
-“আমরা ভুল করেছি। দরকার পড়লে পা ধরে মাফ চেয়ে নিবো। তবুও দয়া করে এমন করবেন না।”
-“আপনার একটা কল আমাদের সকলের জীবন নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট তা আমরা সকলে জানি। দয়া করুন আমাদের উপর।”
-“শাট আপ! জাস্ট শাট আপ। আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি। আমার এই সিদ্ধান্তের কোনো নড়চড় হবে না।”

প্রফেসররা হাত জোর করে ক্ষমা চাইতে লাগলেন। স্নিগ্ধ আশেপাশে চোখ বুলিয়ে একদম সবার পেছনে লুকিয়ে থাকা ইমিকে দেখতে পেলো। সে সেখানে ঘাপটি মেরে আছে। স্নিগ্ধ তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বডিগার্ডের কানে কানে কিছু একটা বললো। বডিগার্ড স্নিগ্ধর কথা শুনে সেদিকে একটু তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে চলে গেল সেখান থেকে। ইমি লুকিয়ে ভয়ে বড় বড় ঢোক গিলছে বারবার। আশেপাশে তাকিয়ে পালানোর পথ খুঁজছে সে। কিন্তু বডিগার্ডরা যেভাবে পুরো জায়গাটা ঘিরে রেখেছে তাতে পালানোর কোনো সুযোগ নেই। মাথা উঁচু করে উঁকি দিতে গেলে কেউ একজন ওর হাত ধরে টেনে সামনে নিয়ে যেতে থাকে। হঠাৎ এমন হওয়ায় ভরকে গেল ইমি। ধীর কন্ঠে হাত ছাড়তে বলছে সে সামনের ব্যক্তিকে। মোচড়ামুচড়ি করেও কোনো লাভ হচ্ছে না। হাত ছুটাতে পারছে না সে। বডিগার্ড ইমিকে সামনে এনে ধাক্কা দিয়ে হাত ছেড়ে দিল। তারপর আবার নিজের যথাস্থানে গিয়ে দাঁড়ালো সে। ইমি এতক্ষণে বুঝতে পারলো লোকটা সকালদের বডিগার্ড। স্নিগ্ধ ওর সামনে দাঁড়িয়ে আললো,
-“তুমি ঠিক কার গায়ে কাঁদা ছোঁড়ার চেষ্টা করেছো আজ তা হারে হারে টের পাবে। এই যে আজ এত এত কাহিনির মূল কেন্দ্রবিন্দু তো তুমি। তুমিই আমার আর সকালের ছবি স্যারদের কাছে বাজেভাবে উপস্থাপন করেছো তাই না! কেন করেছো এমন? কি লাভ পেয়েছো এই কাজ করে?”
-“দেখো মেয়ে! এই কাঁদো কাঁদো চেহারা বানিয়ে রেখে কোনো লাভ নেই। আরিফুল নিজের মেয়ের খুশির জন্য কারও খুন করতেও দ্বিতীয়বার ভাবে না। আর আমার সেই মেয়েকেই তুমি যে পরিমাণ হেনস্তা করেছো সকলের সামনে এতে করে শাস্তি তো তুমি নিশ্চিত পাবে। নিজের শাস্তি বাড়াতে না চাইলে বলো কেন করেছো এমন! বলো কেন করেছো?”

আরিফুল ইসলাম রেগে ধমকে বললেন কথাগুলো। ইমি চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে ও জানতো না ব্যাপারটা এতদূর গড়াবে। ও শুধু স্নিগ্ধ আর সকালকে একটা শিক্ষা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তার পরিণাম যে কতটা ভয়ংকর হতে পারে সেটা ভাবেনি সে। এখনি কেঁদে দিবে এমন অবস্থা তার। গলা কাঁপছে তার। স্নিগ্ধ নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ইমির গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল। উপস্থিত সবার মধ্যে যেটুকু গুঞ্জন শুরু হয়েছিল তা থেমে গেল। ভয়ে সবাই তটস্থ হয়ে গেল। স্নিগ্ধকে তারা শান্তশিষ্ট হিসেবেই জানে। মেয়েদের দিকে সহজে চোখ তুলে তাকিয়ে কথা বলতে দেখেনি কেউ কখনো স্নিগ্ধকে। শুধু সকাল আর আফি ব্যতীত। কথায় আছে শান্তশিষ্ট মানুষের রাগ ভয়ংকর হয়। তারা একবার রেগে গেলে একমুহূর্তে সবকিছু উলট পালট করে দিতে দ্বিতীয়বার ভাবে না। আজ তা নিজেদের চোখেও দেখে নিলো সবাই। ইমি নিচে বসে গালে হাত দিয়ে কেঁদে উঠলো। চড়টা যে তার গালসহ দাঁত পুরো নাড়িয়ে দিয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
সকাল নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে এখনো চোখের জল ফেলছে। আফি আর রেহেনা সকালকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। স্নিগ্ধ সকালের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি দেখে নিজের চোখজোড়া বন্ধ করে বড় করে শ্বাস নিয়ে এক প্রকার চিল্লিয়ে উঠলো ইমির উপর।
-“যে মেয়ের চোখের পানি আমি সহ্য করতে পারি না, যে মেয়ের সামান্য কষ্ট আমাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাঁক করে দেয় তাকে তুমি কষ্ট দিয়েছো। তার মনে আঘাত করেছো তুমি। একটা মেয়ে হয়ে কি করে অন্য একটা মেয়ের সাথে এসব করলে তুমি? তোমার কি একটুও বুক কাঁপেনি এসব বলতে? এখন কথা বলছো না কেন তুমি? কি হলো বলো!”

স্নিগ্ধর চিৎকারে প্রফেসররাসহ জমে থাকা ভিড়ের সকলে কেঁপে উঠলো। ইমি উঠে দাঁড়িয়ে গালে হাত দিয়ে নাক টানতে টানতে হালকা স্বরে বললো,
-“আ..আমি সেই প্রথমদিন থেকে স্নিগ্ধ স্যারের মনোযোগ পাওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত উনি আমাকে পাত্তা দেননি। প্রথমদিন থেকেই আমি সকালকে দেখেছি স্নিগ্ধ স্যারের পেছনে ঘুরতে। তাছাড়া স্নিগ্ধ স্যারও সকালের প্রতি আলাদা কেয়ার করতেন যা আমার ভালো লাগতো না। উনি সকালকে সবসময় সবদিক থেকে কেয়ার করতেন। অন্য কোনো ছাত্রীদের সাথে তুলনামূলকভাবে উনি কম কথা বলতেন। কিন্তু সকালের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে কথা বলতেও কখনো দ্বিধাবোধ করতেন না। এই জিনিসটা আমাকে প্রচন্ড রকমের আঘাত করেছিল। আমি তখন অনেক ভেবেছিলাম যে স্যার কেন এমন করেন? অনেক চিন্তা-ভাবনা করার পর তখন আমার মাথায় আসলো হয়তো সকালের সৌন্দর্য দেখে উনি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছেন। এটা অবশ্যই স্বাভাবিক। কারণ সকাল মাত্রাতিরিক্ত সুন্দরী। ওকে মেডিকেলের প্রায় সব ছেলেরা এবং ছেলে প্রফেসর আর ডক্টররা পছন্দ করে। এসবে কখনোই সকালের খেয়াল ছিল না। সে সবসময়ই স্নিগ্ধ স্যারের সাথে থাকতো। আর স্নিগ্ধ স্যারও একমাত্র ওর সাথেই ভালোভাবে কথা বলতেন। আমি যখনি স্যারকে বিভিন্ন আকারে-ইঙ্গিতে বোঝাতে চেষ্টা করেছি আমার উনাকে ভালো লাগে তখনি উনি আমাকে এড়িয়ে গিয়েছেন। এই নিয়ে কিছুদিন আগে ক্লাসে আমাকে সবার সামনে অপমান করেছেন। যা আমার সহ্য হয়নি। তাই আমি ভেবেছিলাম সকালকে কথা শুনিয়ে তার প্রতিশোধ নিবো। তাই সকালকে ধরেছিলাম। কিন্তু উল্টো ও আমাকে অপমান করে চলে গিয়েছে। তাই সেদিনই আমি প্রতিজ্ঞা করি যে আমি সকালকে আর স্নিগ্ধ স্যারকে একটা শিক্ষা দিব। তাই গতকাল যখন স্যারের কেবিনের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন কেবিনের ভেতর থেকে সকালের আওয়াজ শুনে থেমে যাই। স্যারের কেবিনের দরজা প্রায় অনেকটাই খোলা ছিল। দরজার সামনে গিয়ে সকাল আর স্যারকে কিছুটা ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি ছবি তুলে নিয়ে যাই। আর সেগুলো প্রিন্ট করিয়ে আজ সকালে তাড়াতাড়ি মেডিকেলে প্রফেসরদের দিয়ে বলি যে স্নিগ্ধ স্যারের সাথে সকালের বাজে সম্পর্ক আছে। আর স্যাররা ছবিগুলো দেখে তা বিশ্বাসও করে নেয়। আর তারপরেই এসব হয়।”

মেডিকেলে উপস্থিত থাকা সকলে স্তব্ধ হয়ে যায় ইমির কথা শুনে। স্নিগ্ধ আর সকালকে যারা এতক্ষণ দোষারোপ করছিল তারা সকলেই ইমিকে নিয়ে কানাঘুঁষা শুরু করে দিল। স্নিগ্ধ রাগে নিজের হাত মুঠো করে রেখেছে। প্রফেসররা ভয়ে অসহায় চেহারা বানিয়ে রেখেছে। আজ তাদের কপালে অনেক দুঃখ আছে তা তারা জানে। কিন্তু তার থেকেও দশগুণ বেশি দুঃখ যে ইমির কপালে আছে সেটাও তারা জানেন। মনে মনে ইতোমধ্যে ইমিকে সান্ত্বনা দিয়ে দিচ্ছেন তারা। কারণ সামনা-সামনি সান্ত্বনা দেয়ার জন্য হয়তো আর কখনো সুযোগ পাবেন না। স্নিগ্ধ ইমির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আরিফুল ইসলামের আওয়াজ শুনে থেমে গেল সে।
-“তোমার বাবা-মা এসে গিয়েছে। এখন যা করব সব তাদের সামনে দাঁড়িয়েই করব আমি।”

সঙ্গে সঙ্গে ইমি পেছনে তাকালো। দেখলো তার বাবা-মা হন্তদন্ত হয়ে এদিকেই ছুটে আসছেন। তাদের চিন্তিতমুখ দেখে হুঁ হুঁ করে আবারও কেঁদে ফেললো সে। আজ তার জন্য তার বাবা-মায়ের সম্মানহানি হবে ভাবতেই বুকের ভেতরটা কেউ যেন খামচে ধরলো। ইমির বাবা-মা এসেই ইমিকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর আরিফুল ইসলামের দিকে তাকিয়ে ইমির বাবা বললো,
-“কি হয়েছে স্যার! আমাদের এভাবে ডেকে পাঠালেন কেন এখানে? আর আমার মেয়েটাই বা কাঁদছে কেন?”
কথাটা শোনামাত্রই গর্জে উঠলেন আরিফুল। বললেন,
-“আপনার মেয়ে তার করা অন্যায়ের জন্য কাঁদছে। মেয়েকে কি এই শিক্ষাই দিয়েছিলেন!”
-“কি হয়েছে বলবেন তো!”
-“আপনার মেয়ে পুরো মেডিকেলের সকলের সামনে আমার মেয়ে ও তার হবু স্বামীর নামে মিথ্যে অপবাদ দিয়েছে। বিশ্রী একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। আমার মেয়েকে প্রফেসররা মেডিকেল থেকে বের করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়! আপনার মেয়ের কথা শুনে মেডিকেলের প্রফেসররা, আমার মেয়ে যাতে অন্য কোনো মেডিকেল বা ভার্সিটিতে পড়তে না পারে সেই ব্যবস্থাও করিয়েছে। এই বদনাম সহ্য করতে না পেরে অসুস্থ হয়ে পড়েছে আমার মেয়েটা। এখন আপনিই বলুন কি করা উচিৎ আমার?”
ইমির মা কাঁদো কাঁদো গলায় বললে,
-“স্যার দয়া করে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলুন আমাদের। কি করেছে আমার মেয়েটা?”

আরিফুল ইসলাম রাগী চোখে পাশের এক প্রফেসরের দিকে তাকালেন। সেই দৃষ্টি দেখে প্রফেসর তোতাপাখির মতো ছরছর করে সবটা বললেন উনাদের। ইমি যে সবটা স্বীকার করেছে সেটাও জানালেন। ইমির বাবা হামিদ সাহেব সব শুনে মেয়ের গালে কষিয়ে একটা চড় বসিয়ে দিলেন। ইমির মা-ও মেয়েকে যা তা শুনিয়ে দিলেন। হামিদ সাহেব কান্নাটা গলায় আটকে নিচু স্বরে বললেন,
-“আপনি ইমিকে যা শাস্তি দিতে চান দিতে পারেন। আমরা কিছুই বলবো না। ও যা করেছে ভুল করেছে। তার শাস্তি ওর প্রাপ্য।”
আরিফুল ইসলাম কিছু বলতে গেলে তাকে থামিয়ে স্নিগ্ধ বললো,
-“এই পদক্ষেপটা আমি কখনোই নিতাম না যদি ব্যাপারটা শুধু আমাকে ঘিরে হতো। কিন্তু এখানে আমার ফিয়ন্সেকে টানা হয়েছে। তাকে কষ্ট দেয়া হয়েছে। তাই চেয়েও আমি পারলাম না আপনার মেয়েকে শাস্তি দেয়া থেকে নিজেকে আটকাতে।”

কথাগুলো বলে স্নিগ্ধ তাদের পেছনে তাকিয়ে দেখলো পুলিশ আসছে। মিনিট চারেক আগে পুলিশকে ফোন দিয়ে আসতে বলেছে সে। এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও ইমির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-“আজকের পর যদি আর কখনো তোমাকে আমার বা সকালের আশেপাশে দেখেছি তাহলে সেদিন তোমাকে এর থেকেও বেশি ভয়ংকর পরিণাম ভোগ করতে হবে। কথাটা মনে রেখো। আর হ্যা! যদি নূন্যতম আত্মসম্মানবোধ থেকে থাকে তাহলে দ্বিতীয়বার কখনো আর কোনো মেয়ের সাথে এরকম করতে যেওনা।”
কথা শেষ করে পুলিশের উদ্দেশ্যে স্নিগ্ধ বললো,
-“অফিসার উনাকে নিয়ে যান।”
আরিফুল কড়া গলায় বললেন,
-“আসামীকে তার প্রাপ্য শাস্তি না দিয়ে যদি ছেড়ে দিয়েছেন শুনি তাহলে আপনাদের এক একটার নাজেহাল অবস্থা করে ছাড়বো আমি কথাটা মাথায় রাখবেন।”

পুলিশ অফিসাররা কিছু বলার সাহস পেলেন না। সয়ং আরিফুল ইসলাম যেখানে আদেশ দিয়েছেন সেখানে তাদের বলার কিছুই নেই। সবারই জানের মায়া আছে এখানে। আরিফুল ইসলামের ক্ষমতা সম্পর্কে সবাই অবগত। তাই মুখ দিয়ে দ্বিতীয় কোনো টু শব্দ বের করার সাহস পেলো না। একজন মহিলা পুলিশ ইমিকে নিয়ে যেতে লাগলেন। পেছন থেকে ইমির মা-বাবা নিঃশব্দে কেঁদে উঠলেন। ইমি যেতেই প্রফেসরদের দিকে তাকিয়ে আরিফুল ইসলাম বললেন,
-“আপনাদের এই মেডিকেলে চাকরি করার আর কোনো সম্ভাবনা নেই। আজকের পর থেকে এই মেডিকেলে যেন আপনাদের না দেখা যায়।”

কথা শেষ করে আরিফুল সকালের কাছে যেয়ে হাত দিয়ে মেয়ের চোখের পানি মুছে দিয়ে মেয়ের মাথায় চুমু দিলেন।
-“আমার লক্ষ্মী মামনিটা। কাঁদে না মামনি। দেখো সব ঠিক হয়ে গিয়েছে। যারা যারা তোমাকে বাজে কথা শুনিয়েছিল সবাই তাদের যোগ্য শাস্তি পেয়েছে। এবার আমি আর আমার মামনির চোখে জল দেখতে চাইনা। তুমি জানো না তোমার কষ্ট দেখলে পাপারও কষ্ট হয়! প্লিজ মামনি আর কেঁদো না। চলো এবার আমরা বাসায় যাবো। তোমার বিশ্রাম প্রয়োজন। নাহলে অসুস্থ হয়ে পড়বে।”

পেছন থেকে আবারও সোরগোল শুনে সকলে পেছনে তাকালো। দেখলো স্নিগ্ধ একটা ছেলেকে মাঠে ফেলে বেধড়ক পেটাচ্ছে। সবাই অবাক হয়ে গেল। ছেলেটার বন্ধুরা স্নিগ্ধকে থামানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু স্নিগ্ধর থামার কোনো নাম নেই। স্নিগ্ধ একটা লাথি মেরে বললো,
-“শালা কুত্তার **** আমি মেডিকেলে ঢোকার সময় কি যেন বলছিলি তুই! আবার বল কথাটা। কি হলো বল! আমি সকালকে প্রতি রাতের জন্য কত টাকা দিই, ওকে কতটা এন্টারটেইন করি এসবই তো বলছিলি তাই না!”
আবারও দুটো লাথি দিয়ে বললো,
-“তোরা পড়াশোনা বাদ দিয়ে এসব করতে আসিস এখানে? তোর কলিজা কত বড় যে তুই এসব বলিস ওর নামে! আজকে তোকে মেরে আমি এমন হাল করব ভবিষ্যৎ এ-ও এসব বলার আর সাহস পাবি না।”

ছেলেটাকে মেরে প্রায় আধমরা বানিয়ে ফেলেছে স্নিগ্ধ। আরিফুল ইসলাম অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে স্নিগ্ধর দিকে। না চাইতেও বারবার অবাক হচ্ছেন তিনি। তার মেয়েকে যে কেউ এতটা ভালোবাসে ভাবতেই তার ভালো লাগছে। তিনি মনে মনে খুব খুশি হলেন মেয়ের জন্য সঠিক ছেলেকে বাছাই করার জন্য। সকাল দু’হাতে চোখের পানি মুছে স্নিগ্ধর দিকে এগিয়ে গেল। এই মুহূর্তে স্নিগ্ধকে না থামালে ছেলেটা মরে যাবে। কিন্তু সেদিকে সকালের হুঁশ নেই। সকাল তো কেবল তার ডাক্তার সাহেবের কথা ভাবছে। ছেলেটাকে যেভাবে পেটাচ্ছে তাতে স্নিগ্ধর হয়তো কোথাও লেগে না যায়। এই ভেবে সকাল স্নিগ্ধর হাত ধরতেই স্নিগ্ধ থেমে গিয়ে হাতের দিকে তাকালো। হাতের দিক থেকে চোখ সরিয়ে সকালের দিকে তাকিয়ে দেখলো সকাল কাঁদো কাঁদো চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
-“প্লিজ থামুন। অনেক হয়েছে আর না। চলুন এখান থেকে।”
-“কিন্তু ও তোমার নামে বাজে কথা বলেছে!”
-“হ্যা জানি। তার প্রাপ্য শাস্তিও আপনি তাকে দিয়েছেন। আর না! এর থেকে বেশি হলে উনি মরে যাবেন। ছেড়ে দিন উনাকে।”

স্নিগ্ধ কথা না শুনে ছেলেটাকে আরেকটা লাথি মারতেই সকাল শক্ত করে তার হাত ধরলো এবার। স্নিগ্ধ আবারও ওর দিকে তাকাতেই দেখলো চোখ দু’টো ছলছল করছে। রাগে মাটিতে পা দিয়ে আঘাত করে উল্টো সকালের হাত শক্ত করে ধরে কিছু না বলে মেডিকেল থেকে বেরিয়ে যেতে লাগলো। পেছন থেকে আরিফুল ইসলাম সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। তারপর ছেলেটার দিকে একবার তাকিয়ে বডিগার্ডদের কিছু একটা ইশারা করতেই বডিগার্ডরা মাথা দুলিয়ে চলে গেল। আরিফুল ইসলাম প্রফেসরদের দিকে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে চলে গেলেন।

চলবে….

নোটঃ আমার বাসায় ওয়াইফাই লাইনে প্রবলেম হয়েছে। বাসায় নেট নেই। তাই কিছুদিন গল্প দিতে সমস্যা হবে। ভাইয়ার ফোনে এমবি ছিল বলে ওর ফোন থেকে গল্প পোস্ট করলাম আজকে। হ্যাপি রিডিং।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here