#সেই_সন্ধ্যা
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_৯
.
স্নিগ্ধ কিছু বললো না। শুধু মুচকি হাসি দিল। সকাল অবাক হয়ে তাকালো স্নিগ্ধর দিকে। স্নিগ্ধ এই বিষয়ে কিছু বললো না তার মানে সত্যি সত্যি সকাল ওর জন্য স্পেশাল। কথাটা বুঝতে পেরে সকাল নিজের খুশি যেন ধরে রাখতে পারছে না। মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে মৃদু হাসলো সকাল। বিকেল ঘনিয়ে সন্ধ্যা নেমে এলো। তখনো ওরা দু’জন পাশাপাশি পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আছে। কারও মুখে কোনো কথা নেই। দু’জনেই চুপ করে বসে আছে। নিস্তব্ধ এক সন্ধ্যায়, অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছে দু’জনের মাঝে।
স্নিগ্ধ বসা থেকে উঠতে উঠতে বললো,
-“চলো এখন যাওয়া যাক। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। একটু পরেই অন্ধকার নেমে আসবে।”
-“আচ্ছা চলুন।”
স্নিগ্ধ নিচে ঝুঁকে প্যান্টের পা ঠিক করতে লাগলো। মুজা-জুতা পড়ে হাত ঝারতে ঝারতে পাশে তাকাতেই একটা ধাক্কা লাগলো বুকে। এই ধাক্কাটা মানুষের দেয়া ধাক্কা নয়। এই ধাক্কা এক রূপসী কন্যার আবেদনময়ী চেহারা দেখে লেগেছে স্নিগ্ধর বুকে। সন্ধ্যার হালকা আলোয় শত শত কাশফুলের মাঝে একটা লাল গোলাপ তার হাসির মাধুর্যে চারপাশের পরিবেশটাকে মাতাল করে তুলছে। স্নিগ্ধ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেই সকালের দিকে। বুকের বাম পাশে হাত রাখতেই স্নিগ্ধ অবাক হয়ে গেল। হঠাৎ করে হৃদয়ের স্পন্দন গুলো প্রয়োজনের চেয়ে অতি দ্রুত চলাচল করতে শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু কেন? এই উত্তরটা খুঁজে পেলো না স্নিগ্ধ। এতক্ষণের হালকা শীতটা এবার যেন একটু বেশিই লাগছে। সকাল এক হাত দিয়ে অপর হাত ঘষতে লাগলো। এখানে আর থাকা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। এমনিতেই সকাল ভীষণ শীতকাতুরে। একটু শীতেই ওর কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে যায়। তাই আর সময় নষ্ট না করে স্নিগ্ধর কাছে এসে ওর হাত ধরে ঝাঁকিয়ে বললো,
-“ডাক্তার সাহেব চলুন এখান থেকে। ঠান্ডাটা বাড়ছে, আমার শীত লাগছে।”
সকালের ঝাঁকুনিতে হুঁশ ফিরলো স্নিগ্ধর। সে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে আশেপাশে তাকিয়ে বললো,
-“আসলেই শীত বাড়ছে। চলো এখন আমরা যাই।
-“হুম চলুন।”
হাঁটতে হাঁটতে স্নিগ্ধ খেয়াল করলো সকাল শীতে কাঁপছে। দেরি না করে দ্রুত নিজের কোট খুলে সকালের গায়ে জড়িয়ে দিল স্নিগ্ধ। সকাল অবাক হয়ে তাকালো স্নিগ্ধর দিকে। বিনিময়ে নিজের সেই মনকাড়া মুচকি হাসিটা দিল স্নিগ্ধ। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো সকাল সেদিকে। হঠাৎ কি যেন হলো স্নিগ্ধর। সকালের চোখের দিকে তাকিয়ে সকালের হাত ধরে হাঁটতে লাগলো ও। তৎক্ষনাৎ সকালের শরীরে এক অদ্ভুত কম্পন সৃষ্টি হলো। বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো স্নিগ্ধর দিকে। কিন্তু স্নিগ্ধ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে নিজের মতো হাঁটতে লাগলো। গাড়ির সামনে এসে সকালের জন্য গাড়ির দরজা খুলে দিল স্নিগ্ধ। সকাল ড্যাবড্যাব করে স্নিগ্ধর দিকে তাকিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো।
স্নিগ্ধ গাড়িতে বসে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“ওভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”
-“না মানে… মানে আপনি ঠিক আছেন তো?”
-“হ্যা। কেন?”
-“সত্যি! মানে আপনার জ্বর-টর আসে নি তো?”
-“না তো! হঠাৎ জ্বর কেন আসবে আমার?”
-“না। কিছু না।”
সকাল মনে মনে খুশিতে লুঙ্গি ডান্স দিচ্ছে। কারন স্নিগ্ধ নিজে থেকে ওর হাত ধরেছে। আবার ওর ঠান্ডা লাগছে বলে নিজের কোট খুলে পড়িয়ে দিয়েছে ওকে। এগুলো সব ওর স্বপ্ন মনে হচ্ছে। ব্যাগ থেকে একটা ক্যাডবেরি বের করে খেতে লাগলো সকাল। কয়েক বাইট খাওয়ার পর স্নিগ্ধর দিকে তাকিয়ে আবার নিজের চকলেটের দিকে তাকালো। তারপর চকলেটটা এগিয়ে দিল স্নিগ্ধর দিকে। স্নিগ্ধ চকলেটের দিকে তাকিয়ে আবার সকালের দিকে তাকালো। মুচকি হেসে হা করলো। সকাল থতমত খেয়ে গেল স্নিগ্ধ হা করায়। মনে মনে বললো “এখন কি উনাকে চকলেট খাইয়ে দিতে হবে না’কি?” দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে স্নিগ্ধর মুখের সামনে চকলেটটা ধরলো। এক বাইট নিয়ে আবারও ড্রাইভিং-এ মনোযোগ দিল স্নিগ্ধ। এভাবেই বেশ কয়েকবার চকলেট খাইয়ে দিল স্নিগ্ধকে সকাল।
দ্রুত হসপিটালে এসে নিজের কেবিনে গেল স্নিগ্ধ। এ্যাসিস্ট্যান্টের কাছ থেকে পেশেন্টে রিপোর্ট গুলো নিয়ে তাড়াতাড়ি দেখতে লাগলো। রিপোর্ট গুলো দেখে ওটি রেডি করতে বললো এ্যাসিস্ট্যান্টকে। একটু আগে যখন স্নিগ্ধ সকালকে বাসায় পৌঁছে দিতে যাচ্ছিল তখনি হসপিটাল থেকে ওকে কল করা হয় একটা ইমার্জেন্সির জন্য। তাই স্নিগ্ধ সকালকে বডিগার্ডদের সাথে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে গাড়ি ঘুরিয়ে হসপিটালে চলে আসে। চেঞ্জ করে ওটিতে গেল স্নিগ্ধ।
সকাল শুয়ে শুয়ে ল্যাপটপে স্নিগ্ধর ছবি দেখছে। স্নিগ্ধর ফেসবুক আর ইন্সটাগ্রামে যতগুলো ছবি ছিল স্নিগ্ধর সব গুলো ছবি নিজের ল্যাপটপে সেভ করে রেখেছে সকাল। এই ক’দিনে স্নিগ্ধর অজান্তে হাজারের উপরে ছবি তুলেছে স্নিগ্ধর। প্রতিদিন একবার হলেও এই ছবি গুলো ঘাটা ওর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে বললেই চলে। আজকেও বেশ কয়েকটা ছবি তুলেছে যখন চোখ বন্ধ করে ঝিলের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে ছিল তখন। বক্স থেকে এক চামচ করে আইসক্রিম মুখে দিচ্ছে আর পলকহীন চোখে ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে সকাল।
দীর্ঘ চার ঘন্টা পর অপারেশন শেষ করে বাসায় ফিরলো স্নিগ্ধ। টাওয়াল নিয়ে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে শাওয়ার ছেড়ে দিল। একহাত কোমড়ে রেখে আরেক হাতে দেয়াল ধরে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ জোড়া বন্ধ করতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো একটা চেহারা। যার মিষ্টি হাসিতে পুরো দুনিয়া ভুলে যাওয়া সম্ভব। যার কাজল কালো মায়াবী চোখ জোড়া দেখে অনায়াসে ভালোবাসার অতল সাগরে ডুবে যাওয়া যায়। ও স্পষ্ট খিলখিল হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছে। সাথে সাথেই মনে হলো বুকের ভেতরে হাত দিয়ে কেউ ওর হৃদপিণ্ডটা টেনে বের করে নিচ্ছে।
-“তুমি সব সময় থাকবে তো আমার পাশে স্নিগ্ধ?”
কানের সামনে কথাটা ভেসে আসতেই চমকে উঠলো স্নিগ্ধ। চোখ মেলে আশেপাশে তাকিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। স্নিগ্ধ মনে মনে বললো,
-“সব সময়ই তোমার সাথে থাকতে চেয়েছিলাম আমি। কিন্তু তুমিই আমাকে একা করে চলে গেলে। তুমি একটা ঠকবাজ নিলাম। তুমি একটা ঠকবাজ।”
রাগে স্নিগ্ধ দেয়ালে জোরে একটা ঘুষি মারলো। হাতে বেশ ব্যাথা পেলো ও। কিন্তু সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে শাওয়ার অফ করে টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে যেয়ে দাঁড়ালো। আয়নার দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো নিজের আগুন লাল চোখ। মনে হচ্ছে রক্ত জমে গেছে পুরো চোখে। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে টি-শার্ট গায়ে জরিয়ে যেয়ে দরজা খুলে দিল স্নিগ্ধ। মোটা ফ্রেমের চশমা চোখে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। স্নিগ্ধ তাকে দেখেই জড়িয়ে ধরলো।
-“কেমন আছে আমার বাবাটা?”
-“ভালো আছি আম্মু।”
-“তুই কিরে? তুই যে এই বাসায় থাকিস বুঝাই যায় না। কখন আসিস কখন যাস কিছুই জানি না আমরা। আমাদের সাথে কি দু’দন্ড বসে কথা বলতে ইচ্ছে করে না তোর?”
-“তেমন কিছু নয় আম্মু। জানোই তো আমি কত ব্যস্ত থাকি।”
-“ব্যস্ততার বাহানা একদম দিবি না স্নিগ্ধ। আগে তো এমন ছিলি না তুই! আগে তুই বাসায় এসেই সবার আগে আমার সাথে দেখা করতি। আর এখন! এখন তো সারাদিনে একটা খোঁজও নিস না।”
-“আচ্ছা আম্মু এখন থাক না এসব! আমার মাথাটা প্রচন্ড ব্যাথা করছে। একটু টিপে দিবে?”
বেশ আহ্লাদী স্বরে প্রশ্ন করলো স্নিগ্ধ। স্নিগ্ধর মায়ের অনেক মায়া হলো তার ছেলের ওপর। তিনি জানেন ভালো মতোই যে তার ছেলে ভালো নেই। প্রতিটা মুহূর্তে তার ছেলে তিলে তিলে কষ্ট পাচ্ছে। প্রতিটা ক্ষণে ক্ষণে তার ছেলের ব্যাথা গুলো তিনি উপলব্ধি করতে পারেন। ছেলে যে নিজের ভেতরে কত শত কষ্ট কত শত ব্যাথা লুকিয়ে রেখেছে তা বুঝেন তিনি। তবুও কিছু করতে পারেন না। ছলছল দৃষ্টিতে স্নিগ্ধর দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। স্নিগ্ধ মায়ের হাত ধরে তাকে বিছানায় বসিয়ে নিজে মায়ের কোলে শুয়ে পরলো। আলতো হাতে স্নিগ্ধর মাথার চুল গুলো টেনে দিতে লাগলেন স্নিগ্ধর মা। অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে শান্ত রাখতে পারলো না স্নিগ্ধ। মা’কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিল ও। পুরোনো জখম গুলো আজ হঠাৎ আবার তাজা হয়ে উঠেছে। বুকের ভেতরটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে। স্নিগ্ধকে কাঁদতে দেখে স্নিগ্ধর মায়ের চোখ থেকেও পানি গড়িয়ে পরতে লাগলো। তিনি মনে মনে বললেন,
-“আর কতদিন এভাবে কষ্ট পাবে আমার ছেলেটা? এবার তো অন্তত একটু শান্তি দাও ওকে! একটু সুখ দাও ওর কপালে। কেন আমার ছেলেকে এত কষ্ট দিচ্ছ তুমি আল্লাহ্?”
চলবে….