সেই সন্ধ্যা পর্ব-৮

0
1687

#সেই_সন্ধ্যা
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_৮
.
স্নিগ্ধ ক্লাসে ঢুকতেই সকাল একটা মিষ্টি হাসি দিল। যা দেখে ভীষণ ভালো লাগলো স্নিগ্ধর। মুহূর্তেই স্নিগ্ধও তার সেই চমৎকার মুচকি হাসিটা উপহার দিল সকালকে। ক্লাসের ফাঁকে আড়চোখে বারবার একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে স্নিগ্ধ আর সকাল। যতবারই ওদের চোখাচোখি হচ্ছে ততবারই সকালকে হাসতে দেখেছে স্নিগ্ধ। মেয়েটা দিন দিন ওকে দূর্বল করে দিচ্ছে। হালকা হেসে স্নিগ্ধ আবার ক্লাসে মনযোগ দিল। ক্লাস শেষে বের হতেই দেখলো একটু দূরে স্নিগ্ধ প্যান্টের পকেটে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। সকাল এসে ওর সামনে দাঁড়ালো। সকালকে দেখেই আপনা-আপনি মুখে হাসি ফুটে উঠলো স্নিগ্ধর।

-“মিস বিকাল আই অ্যাম সো স্যরি।”
-“ইট’স ওকে ডাক্তার সাহেব। বাট মাই নেইম ইজ নট বিকাল।”
-“আমি তোমাকে বিকাল বলেই ডাকবো।”
-“না! কেন? আমার নাম তো সকাল।”
-“তোমাকে বিকাল বলে ডাকতে আমার ভালো লাগে তাই।”
-“অঅঅ…. কি কিউট! শুধু বিকাল বলে ডাকতেই ভালো লাগে! যাকে এই নামে ডাকেন তাকে ভালো লাগে না?”
সকাল দুষ্টু হেসে কথাটা বলতেই স্নিগ্ধ হালকা কাশি দিল। মাথা চুলকাতে চুলকাতে আড়চোখে সকালের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
-“লেটারে তো লিখেই দিয়েছিলাম।”
-“আমার ঠিক মনে পরছে না আপনি লেটারে কি লিখে ছিলেন। একটু কষ্ট করে মুখে বলে মনে করিয়ে দিন না!”

স্নিগ্ধ বেশ বুঝতে পারলো যে সকাল তার মুখ থেকে কথাটা শুনতে চাইছে। কিন্তু মুখে কথাটা স্বীকার করা ওর পক্ষে অসম্ভব প্রায়। কারন গলায় এসে বারবার বেঝে যাচ্ছে কথাটা।
তাই এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্নিগ্ধ বললো,
-“বিকেলে ফ্রি আছো?”
-“হ্যা। কেন? আজকেও কি কফি খেতে নিয়ে যাবেন?”
-“না আজ কফি খেতে নয় বরং ঘুরতে নিয়ে যাবো।”
-“রিয়্যালি!”

খুশিতে বাচ্চাদের মতো লাফিয়ে উঠলো সকাল। এই হাসিটাই তো ও দেখতে চায় সকালের মুখে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো হা করে তাকিয়ে আছে সেই হাসির দিকে। যেন এই মুহূর্তে এই কাজটি খুবই জরুরি স্নিগ্ধর কাছে।
সকাল হাসি থামিয়ে বললো,
-“আচ্ছা কোথায় নিয়ে যাবেন আমাকে?”
-“দেখি কোথায় নিয়ে যাওয়া যায়।”
-“অঅঅ…. কি কিউট।”
-“আচ্ছা মিস বিকাল!”
-“সকাল।”
-“ওই হলো একটা।”
-“হুহ।”
-“শোনো এবার!”
-“বলেন।”
-“লং কোনো ড্রেস পড়ে এসো।”
-“লং ড্রেস! উমম…. আচ্ছা ঠিকাছে।”
-“তাহলে দেখা হচ্ছে বিকেলে!”
-“হুমম।”
-“আচ্ছা তাহলে এখন বাসায় যাও।”

সকাল আলমারি থেকে যত গুলো লং ড্রেস ছিল সব গুলো বের করে বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখলো। কোনটা পড়বে বুঝতে পারছে না। অনেক চিন্তা ভাবনা করার পর গাঢ় লাল রঙের চুরিদারি পড়ে তৈরি হয়ে নিলো। সকাল নিজের চুল কখনো ছেড়ে রাখে না। আজ পর্যন্ত ওর চুলের মাপ বুঝতে সক্ষম হয় নি কেউ। তাই আজও চুল গুলো সুন্দর করে স্টাইল করে খোপা করে নিলো। ঠোঁটে হালকা লিপজেল লাগিয়ে বেরিয়ে গেল। গাড়ির সামনে দাঁড়াতেই বডিগার্ড গুলোকে দেখে বেশ বিরক্ত হলো সকাল। কিন্তু কিছু করার নেই। বডিগার্ড ছাড়া বের হতে দিবে না ওর মাম্মা-পাপা। বিরক্তির ছাপ মুখে রেখে গাড়িতে যেই উঠতে যাবে ওমনি স্নিগ্ধর নম্বর থেকে কল আসলো।
কল রিসিভ করতেই স্নিগ্ধ বললো,
-“আমি তোমার বাসার বাইরে গাড়িতে অপেক্ষা করছি। তুমি আমার সাথে এসো। আর তোমার বডিগার্ডদের বলো অন্য গাড়ি করে আমাদের সাথে আসতে।”
-“আপনি বুঝলেন কিভাবে যে আমি বডিগার্ড নিয়ে বিরক্ত হচ্ছিলাম?”
-“এমনি মনে হলো তাই বললাম।”
-“আচ্ছা আসছি।”

সকাল বডিগার্ডদের অন্য গাড়ি করে আসতে বলে ও এসে স্নিগ্ধর গাড়িতে উঠে বসলো। স্নিগ্ধ ওর দিকে এক পলক তাকিয়ে মুচকি হেসে গাড়ি চালাতে লাগলো। গাড়ি এক জায়গায় এসে থামতেই ওরা দু’জন নেমে গেল। বডিগার্ড গুলো পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে। সকাল ওদের সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে বলে স্নিগ্ধর সাথে সামনে এগিয়ে গেল। কিছুদূর আসতেই দেখতে পেলো একটা বড় খোলা মাঠ। তার ভেতর অসংখ্য কাশফুল। সকাল “ওয়াও” বলে জোরে একটা চিৎকার দিয়ে দৌড়ে কাশফুলের মাঝখানে চলে গেল। খুশিতে বাচ্চাদের মতো লাফাচ্ছে সকাল। ওর চোখ-মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে ওর খুশির পরিমাণ ঠিক কতটা। স্নিগ্ধ মুচকি হেসে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো সকালের দিকে। অসংখ্য এই সাদা কাশফুলের মাঝে যেন একটি লাল গোলাপ ফুটে আছে মনে হচ্ছে। স্নিগ্ধর ভীষণ ভালো লাগলো এই দৃশ্যটা। সকালের বাচ্চাদের মতো লাফালাফি, মুগ্ধকর হাসি, কাজল কালো চোখ আর ঘন কালো কেশ সবই স্নিগ্ধকে অদ্ভুত ভাবে টানছে। হুট করে কি যেন মনে হতেই ফোন বের সকালের বেশ কয়েকটা ছবি তুলে নিলো। ছবি গুলো দেখে ফোনটা পকেটে ভরে এগিয়ে গেল সকালের দিকে। পেছন থেকে সকালকে ডাকতেই হাস্যজ্জ্বল চেহারা নিয়ে পেছন ঘুরে স্নিগ্ধকে দেখে ওর খুশি গুলো যেন উপচে পরতে চাইলো।
স্নিগ্ধ হালকা হেসে জিজ্ঞেস করলো,
-“কেমন লাগলো জায়গাটা?”
-“অসম্ভব সুন্দর। এতটাই বেশি সুন্দর যে ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।”
-“চলো সামনে যাই। সেদিকে একটা চমৎকার ঝিল আছে।”
-“সত্যিইইই! চলুন চলুন তাড়াতাড়ি চলুন।”

সকালকে নিয়ে কাশবন পেড়িয়ে একটু এগিয়ে একটা ঝিলের সামনে এসে দাঁড়ালো স্নিগ্ধ। ঝিলের পানি গুলো একদম স্বচ্ছ ও পরিস্কার। সকালের চোখ জোড়া চিকচিক করছে। এত সুন্দর দৃশ্য সে আগে কখনো দেখি নি। আজই প্রথম দেখলো। তাও স্নিগ্ধর জন্য। সবুজে ঢাকা বড় মাঠ। তার ভেতর সাদা কাশফুলের বাহার। তার একটু সামনেই বড় একটা ঝিল। চারপাশে বড় বড় অসংখ্য গাছগাছালি। আকাশের ঘন সাদা মেঘ যেন আজ ওদের জন্যই জমা হয়েছে। হালকা সূর্যের কিরণ উঁকি দিচ্ছে বারং বার মেঘের আড়াল থেকে। যেন ওই আকাশের মেঘ আর সূর্যের কিরণ একে অপরের সাথে লুকোচুরি খেলছে। হালকা মৃদু বাতাস বইছে। মাঝে মাঝে ঠান্ডাটা একটু বেশিই লাগছে।খুব সুন্দর একটা পরিবেশ। মন ভালো করার জন্য একদম সঠিক জায়গা এটা। স্নিগ্ধ প্যান্টের পা ভাজ করে ঝিলের পানিতে পা ডুবিয়ে বসলো। সকাল ড্যাবড্যাব করে স্নিগ্ধর দিকে তাকিয়ে নিজের পায়ের দিকে তাকালো। এই পায়জামা তো উঁচু করা যাবে না। অসহায় দৃষ্টিতে একবার স্নিগ্ধর দিকে আরেকবার ঝিলের দিকে তাকাচ্ছে সকাল।
সকালের মনের কথা বুঝতে পেরে স্নিগ্ধ বললো,
-“আরে এভাবেই বসে পড়ো। একটু ভিজলে ভিজবে সমস্যা কোথায়? মনের ইচ্ছে তো পূরণ হবে! এটাই মূল কথা।”

স্নিগ্ধর কথায় হাসিমুখে সকাল পানিতে পা ডুবিয়ে বসে পরলো। পানি বেশি ঠান্ডাও না আবার গরমও না। আরাম লাগছে এই পানিতে পা ভিজিয়ে। হাত দিয়ে পানি গুলো নাড়াচাড়া করছে আর একাই খিলখিলিয়ে হেসে উঠছে। মুচকি হেসে স্নিগ্ধ খোলা আকাশের দিকে তাকালো। চোখ বন্ধ করে এই পরিবেশটা উপভোগ করতে লাগলো।
সকাল হাসতে হাসতে স্নিগ্ধর দিকে তাকাতেই ওর চোখ জোড়া আটকে গেল স্নিগ্ধর ওই আকর্ষণীয় চেহারার দিকে। এত সুন্দর কেন ছেলেটি? ভাবছে সকাল। সকালের কাছে স্নিগ্ধর দাঁড়ি গুলো সব থেকে বেশি ভালো লাগে। সকাল সব সময় ভাবতো ফুল বিয়ার্ড কাটিং-এ ছেলেদের ভালো লাগে না। কিন্তু স্নিগ্ধকে দেখে ওর এই ভাবনাটা পাল্টে একদম ভুল প্রমাণিত হলো। ফুল বিয়ার্ড কাটিং-এ স্নিগ্ধকে অসম্ভব ভালো লাগে দেখতে। সব সময় ফর্মাল গেটআপে দেখেছে স্নিগ্ধকে। কখনো জিন্স বা টি-শার্টে দেখে নি। লোকটা হয়তো এমনি। ভেবেই সকালের মুখের হাসিটা আরও বড় হলো। স্নিগ্ধ লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে চোখ মেলে তাকালো। ওর মুখে আপনা-আপনি হাসি ফুটে উঠলো। পাশে সকালের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো সকাল আগে থেকেই ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
মুখের হাসিটা বজায় রেখে স্নিগ্ধ জিজ্ঞেস করলো,
-“কেমন লাগছে?”
সকাল স্নিগ্ধর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে উত্তর দিল,
-“অনেক সুন্দর।”
সকাল যে প্রকৃতির কথা না বলে ওর কথা বলছে সেটা স্নিগ্ধ বুঝতে পারলো। স্নিগ্ধ সকালের গাল টেনে দিয়ে বললো,
-“আমি আমার কথা নয় জায়গাটার কথা জিজ্ঞেস করেছি।”
সকাল লজ্জা পেয়ে গেল স্নিগ্ধর কথায়। লাজে রাঙা চেহারায় মাথাটা নিচু করে মিনমিনে গলায় বললো,
-“আ..আমিও জায়গাটার কথাই বলেছি।”
স্নিগ্ধ হাসতে হাসতে বললো,
-“তুমি কি জানো তুমি খুব কিউট?”
-“আগে জানতাম না। আপনি বলার পর জানলাম।”
-“তোমার খুশি দেখে মনে হচ্ছে তুমি আগে কখনো এভাবে প্রকৃতি দেখো নি।”
-“আসলেই তাই। আমি আগে কখনো এভাবে প্রকৃতি দেখি নি। প্রকৃতি দেখতে হলে অবশ্যই ঘুরতে বের হতে হয়। আর আমাকে মাম্মা-পাপা একা বের হতে দেয় না। আর যদিও বা একা বের হই তাহলে সাথে একগাদা বডিগার্ডস্ দিয়ে দেয়। মাম্মা-পাপাও ফুরসত পায় না তাদের কাজ থেকে। তাই তারা আমাকে তেমন একটা টাইম দিতে পারে নি কখনো। আমার সকল চাওয়া-পাওয়া সকল ইচ্ছা তারা পূরণ করেছে। আমাকে অনেক বেশি ভালোবাসে ওরা। ভাইয়াই ছোট থেকে আমাকে নিজের সবটা দিয়ে আগলে রেখেছে। কিন্তু এখন ভাইয়াও গত কয়েকবছর ধরে আমাকে টাইম দিতে পারে না। ব্যবসার কাজে দেশের বাইরে আছে দুই বছর যাবৎ। আমার জীবনটা হলো বন্দী জীবন।”
-“এখন থেকে আর কখনো তুমি বন্দী জীবনযাপন করবে না। আমি সময় পেলেই তোমাকে নিয়ে এখন থেকে ঘুরতে বের হব।”
-“সত্যিইইই।”
খুশিতে লাফিয়ে উঠলো সকাল। স্নিগ্ধ মুচকি হেসে মাথা নাড়ালো। সকাল বললো,
-“থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ সো মাচ।”
-“ইয়র মোস্ট ওয়েলকাম।”
-“ডাক্তার সাহেব!”
-“হুম!”
-“আমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছেন?”
-“এই জায়গাটা আমার জন্য খুব স্পেশাল। আর এখানে আমি আমার স্পেশাল মানুষদের নিয়ে আসি।”
-“ওয়াও…. ওয়েট আ মিনিট! স্পেশাল মানুষদের নিয়ে আসেন! তার মানে আমি আপনার জন্য স্পেশাল?”

স্নিগ্ধ কিছু বললো না, শুধু মুচকি হাসি দিল। সকাল অবাক হয়ে তাকালো স্নিগ্ধর দিকে। স্নিগ্ধ এই বিষয়ে কিছু বললো না তার মানে সত্যি সত্যি সকাল ওর জন্য স্পেশাল। কথাটা বুঝতে পেরে সকাল নিজের খুশি যেন ধরে রাখতে পারছে না।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here