সেই_সন্ধ্যা পর্ব_৩৮

0
1516

#সেই_সন্ধ্যা
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_৩৮
.
অফিসের কাজ শেষ করে বাসায় এসে বেল দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো মেঘ। এবারের কেসটা অনেকটাই গুছিয়ে ফেলেছে ও। তাই বেশি সময় থাকেনি অফিসে। একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা এসে দরজা খুলে দেওয়া মাত্রই মেঘ তাকে জড়িয়ে ধরলো।

-“শুভ সন্ধ্যা মা। সারাদিন কেমন কাটলো তোমার?”
-“ভালো। তোর কেমন কাটলো আজকে সারাদিন?”
-“শয়তান ফেরত আসছে তো অফিসে। ঘাড়ের উপর শয়তান বসে থাকলে কি আর ভালো থাকা যায়!”
-“একটা থাপ্পড় দিব ফাজিল। আমি নিশ্চিত তুই মিহুকে শয়তান বলছিস তাই না?”
-“তোর আর কাকে বলবো! ওর থেকে বড় শয়তান এই পৃথিবীতে আছে? নটাংকিবাজ একটা। সারাক্ষণ মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে রাখার মতো করে কথা বলে। আচ্ছা মা ওর জন্মের পর কি মুখে মধু দেয়নি?”
-“হ্যা কেন?”
-“মনে তো হয়না মধু দিয়েছিল ওর আম্মু। আমার তো মনে হয় ওকে করল্লার রস, চিরতার পানি, মরিচ বাটা এসব খাইয়েছিল। নাহলে ওর মুখ থেকে সারাক্ষণ শুধু তেঁতো আর ঝাঁঝালো কথা বের হয় কেন?”
-“উফফ… থাম তো তুই! তোরা দুটোই এক। ছোটবেলা থেকেই একজন আরেকজনকে সহ্য করতে পারিস না। কেন বলতো!”
-“জানি না। তা ম্যাডাম কোথায়? বাসায় আসেনি!”
-“হ্যা এসেছে। নিজের রুমে গেছে। দেখে অসুস্থ মনে হলো।”
-“ওহ আচ্ছা ঠিক আছে। আমি রুমে যাচ্ছি। তুমি আমার কফিটা একটু পাঠিয়ে দিও কষ্ট করে।”

মায়ের গালে চুমু খেয়ে মেঘ বাইকের চাবি আঙুলে ঘোরাতে ঘোরাতে রুমে চলে এলো। কিন্তু রুমের দরজা লাগানো দেখে ওর কপাল কুঁচকে গেল। গাল ফুলিয়ে নক না করেই দরজা খুলে হা হয়ে গেল।

মিহু গায়ের শার্ট খুলে হাতে মেডিসিন লাগাচ্ছিল। শার্টের নিচে হাতা কাটা গেঞ্জি পড়া ছিল। এখনো সেটাই পড়া। হঠাৎ রুমের দরজা খুলে যাওয়ায় তড়িঘড়ি করে শার্ট পড়তে গেলেই হাত ব্যাথা পেয়ে চোখ-মুখ কুঁচকে বসে পড়লো। হাতে কারও ঠান্ডা স্পর্শ পেয়ে চোখ মেলে তাকালো মিহু। ওর সামনেই মেঘ বসে হাঁটু ভাজ করে চিন্তিত হয়ে বসে আছে। মিহু একহাত দিয়ে শরীর ঢাকার চেষ্টা করতে লাগলো। বুঝতে পেরে মেঘ আলমারি খুলে একটা ওড়না নিয়ে এসে মিহুর গায়ে জড়িয়ে দিল।

-“দরজায় নক ভেতরে আসা যায় না?”
-“আমি কি জানতাম যে তুমি ভেতরে এই অবস্থায় বসে আছো?”
-“দরজা চাপানো দেখে অন্তত বোঝা উচিৎ ছিল তোমার।”
-“উফফ… চুপ থাকো। গেঞ্জি পড়া ছিলে তো সমস্যা কোথায়? এমন তো না যে গে… কিছু না ছাড়ো। গুলি লাগলো কীভাবে হাতে?”
-“চট্টগ্রামে যে কেসের জন্য গিয়েছিলাম সেখানে গুলাগুলি হয়েছিল। গুলাগুলি চলাকালীন একটা গুলি এসে হাতে লেগেছে।”
-“ডক্টর দেখিয়েছো? মেডিসিন এনেছো? কোনো সমস্যা হবে কি-না কিছু জিজ্ঞেস করেছো ডক্টরকে?”
-“আমি ঠিক আছি। ডক্টর দেখিয়েছি, মেডিসিনও এনেছি। আর সমস্যা হবে না। শুধু একটু সাবধানে থাকতে বলেছে, নাহলে ইনফেকশন হতে পারে হাতে। আর তুমি কেন এত উত্তেজিত হচ্ছো? আমি মরে গেলে তো তোমার লাভই বেশি। এখন তো তোমার ঘাড়ে বোঁঝা হয়ে আছি।”

মেঘ কোনো কথা না বলে উঠে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মিহু এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও নিজের হাতে মেডিসিন লাগানোতে মনোযোগ দিল। মেডিসিন লাগিয়ে হাতে ব্যান্ডেজ করে নিলো। ফ্রেস হয়ে এসে দেখে মেঘ এখনো রুমে আসেনি। মিহু জানালার পাশে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। আকাশে থাকা তারা গুলোর মাঝে নিজের বাবা-মাকে খুঁজতে লাগলো। হঠাৎ কাঁধে কারও স্পর্শ পেয়ে পেছনে তাকিয়ে মেঘের মাকে দেখে মুচকি হাসলো মিহু।

-“বাবা-মাকে মনে পড়ছে?”
-“হুম। তাই তো তারাদের মাঝে তাদের খুঁজে চলেছি।”
-“তোর বাবা-মা আকাশে বসে তোকে দেখে অনেক গর্ব করে। তাদের মেয়ে একজন সাহসী সিআইডি অফিসার।”
-“আচ্ছা মামনি তোমাদের কখনো আমাকে বোঁঝা মনে হয়নি?”
-“তুই না আমার ছেলের বউ! তাহলে তোকে বোঁঝা কেন মনে হবে?”
-“২ বছর বয়স থেকে তো তোমাদের প্রতিবেশী ছিলাম। ১৪ বছর বয়সে বাবা-মাকে হারালাম। তারপর তো তোমরাই আমাকে তোমাদের বাসায় নিয়ে এলে। আস্তে আস্তে যখন বড় হতে লাগলাম তখন আশেপাশের মানুষের কানাঘুঁষা বাড়তে লাগলো দেখে তুমি মেঘের সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দিলে। তো হলাম না তোমাদের ঘাড়ে বোঁঝা!”
-“একটা থাপ্পড় দিব পাঁজি মেয়ে। এইসব উল্টো পাল্টা কথা ভাবিস না-কি তুই সারাক্ষণ?”
-“নাহ! সারাক্ষণ তো কেস নিয়েই ভাবি। যতটুকু সময় বাসায় থাকি না চাইতেও এসব ভাবনা মনে চলে আসে।”
-“আর কখনো এসব ভাববি না। তুই আমার ছেলের বউ হলেও আমার মেয়ের মতন। তোর সম্পূর্ণ অধিকার আছে এই বাসায় থাকার। আর কখনো এসব উল্টো পাল্টা চিন্তা করবি না।”
-“অধিকার মানে তো তোমার ছেলের বউয়ের অধিকার। তোমার ছেলে এখনো নিজেকে সিঙ্গেল বলে দাবি করে। এমনকি অফিসের বস বাদে কেউ জানে যে আমি আর তোমার ছেলে স্বামী-স্ত্রী। তোমার ছেলে আমাকে কথায় কথায় বলে বিবাহিত মহিলা। তখন আমার মন চায় তোমার ছেলের কানের নিচে একটা দিয়ে মনে করিয়ে দিই যে আমাকে বিয়েটা তোমার ওই বজ্জাত ছেলেই করেছে। তার জন্যই আমি আজ বিবাহিত।”
-“এত চিন্তা করার কি আছে! যখনই এই কথা বলবে, তখনি দিয়ে দিবি সোজা কানের নিচে। আমি অনুমতি দিলাম।”
-“ঠিক আছে। তাহলে এর পরেরবার মারবো।”

মিহু ফিক করে হেসে বললো। মেঘের মাও মিহুর সাথে হেসে উঠলেন।

ছাদের কর্ণারে দাঁড়িয়ে সিগারেটের ধোঁয়াগুলো আকাশে উড়িয়ে দিচ্ছে মেঘ। মুখটা গম্ভীর হয়ে আছে। মনে মনে কিছু একটা ভাবছে সে। বুকের গভীরে কোথাও খুব কষ্ট হচ্ছে তার। কিন্তু এই কষ্টগুলো অনুভব করার মতো কেউ নেই। বারবার তার চোখের সামনে একটা মুখই ভেসে উঠছে। যা ওর কষ্টগুলোকে দ্বিগুণ করে তোলে প্রতিটা মুহূর্তে। সিগারেট শেষ হতেই ফেলে দিয়ে ছাদের রেলিং এর উপরে উঠে বাইরে পা ঝুলিয়ে বসে পড়লো মেঘ। সাত তলা থেকে নিচে একবার পড়লে হাড়-গোড় আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। সিগারেটের প্যাকেট থেকে আরও একটা সিগারেট ধরিয়ে লাইটার আর প্যাকেটটা পাশে নামিয়ে রাখলো। মনের আনন্দে আবারও আকাশে ধোঁয়া উড়াতে লাগলো মেঘ।

মেঘের মা মিহুর রুম থেকে বেরিয়ে এসে এক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এই ছেলে-মেয়ে দুটোকে নিয়ে তিনি খুব চিন্তায় থাকেন। মাঝে মাঝে ভাবেন ভুল করেননি তো ওদের জোর করে বিয়ে দিয়ে! মেঘ বা মিহু কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না। সবসময় একজন আরেকজনের পেছনে লেগেই থাকে। কেউ ওদের ঝগড়া দেখলে বলবে না ওরা স্বামী-স্ত্রী। এত বড় হয়ে গেছে অথচ এখনো ছোটখাটো প্রতিটা বিষয়ে বাচ্চাদের মতো ঝগড়া করে। কিন্তু দু’জন আবার দু’জনের অনেক খেয়ালও রাখে। মাঝে মাঝে উনার মনে হয় মেঘ আর মিহু একে অপরকে ভালোবাসে। কিন্তু পরক্ষণেই ওদের ঝগড়া দেখলে মনে হয় উনি ভুল ভাবেন। এইজন্য তিনি খুব চিন্তায় আছেন। ভবিষ্যৎ কি এই ছেলে-মেয়ে দুটোর?

স্নিগ্ধর বাসার ড্রইংরুমে বসে আছে পলক আর আখি। পাশেই নয়ন বসে একা একা খেলা করছে। আসমা বেগম ওদের দেখেই রান্নাঘরে ঢুকে গিয়েছেন ভালো-মন্দ রান্না করার জন্য। স্নিগ্ধ হাত দিয়ে চুল ঝারতে ঝারতে নিচে নেমে এলো। আখি উঠে এসে স্নিগ্ধকে জড়িয়ে ধরলো। স্নিগ্ধও আলতোভাবে জড়িয়ে ধরলো। আখি ছাড়তেই পলক এসে জড়িয়ে ধরলো স্নিগ্ধকে। স্নিগ্ধ পলককে ছেড়ে সোজা নয়নের কাছে গিয়ে ওকে কোলে তুলে নিলো। নয়ন প্রায় সাথে সাথেই চেহারায় কান্না ভাব নিয়ে এলো। ও নামতে চাইছে স্নিগ্ধর কোল থেকে কিন্তু স্নিগ্ধ ওকে নামাবে না। কয়েকবার চেষ্টা করার পর না পেরে জোরে কেঁদে উঠলো নয়ন। স্নিগ্ধ থামানোর চেষ্টা করলেও থামে না। শেষে আখি এসে কোলে নিতেই চুপ হয়ে গেল নয়ন। ঠোঁট উল্টে ফোঁপাতে ফোপাঁতে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো নয়ন স্নিগ্ধর দিকে। তা দেখে হেসে উঠলো পলক, আখি আর স্নিগ্ধ। বেশ কিছুক্ষণ গল্প করার পর পলকের ফোনে কল আসতেই ও “এখনি আসছি” বলে বেরিয়ে গেল। আখি আশেপাশে তাকিয়ে দেখে নিয়ে স্নিগ্ধর দিকে তাকালো।

-“কিছু কথা জিজ্ঞেস করি স্নিগ্ধ?”
-“অনুমতি নেওয়ার কি আছে! যা জিজ্ঞেস করতে চাস করে ফেল।”
-“সকালের সাথে কি তোর কিছু হয়েছে?”

স্নিগ্ধ চমকে উঠলো। আখির দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলো,
-“কেন?”
-“সকালের অবস্থা আজকে খুব খারাপ ছিল। মেয়েটা গায়ে জ্বর নিয়ে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করেছিল। যা ওর জ্বরটা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। তার ওপর আবার ঘুমের ওষুধ খেয়েছিল দুটো।”

স্নিগ্ধ আরও একবার চমকে উঠলো। সকাল এসব পাগলামি করতে পারে তা কখনো কল্পনাও করতে পারেনি। মেয়েটা ঠিক আছে তো! ভাবতেই বুকের ভেতরটা ধুক করে উঠলো। চিন্তিত হয়ে আখির দিকে তাকাতেই আখি মাথা নাড়িয়ে বললো,
-“দুপুরের দিকে যখন আমরা রুমে যেয়ে দেখি তখন ওর জ্ঞান ছিল না। পরে ইনজেকশন দিয়ে জ্বর কমিয়ে তারপর জ্ঞান ফেরাতে হয়েছে।”
-“(…..)”
-“ওকে যখন আমি জিজ্ঞেস করলাম কিছু হয়েছে কি-না তখন না করে দিয়েছে। পরে যখন জিজ্ঞেস করলাম তোর সাথে কিছু হয়েছে কি-না তখন ও বললো তোর সাথে ওর কোনো ঝগড়া হয়নি। ‘আমার মন খারাপই যেখানে উনি সহ্য করতে পারেননা সেখানে উনি করবে আমার সাথে ঝগড়া!’ এই বলে কাটিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ওর এই কথাগুলোর ভেতরে অনেক দুঃখ-কষ্ট আর অভিমান মেশানো ছিল।”

স্নিগ্ধ অবাক হয়ে গেল আখির কথায়। যে মেয়েকে ও ফোনে যা নয় তাই বলেছে, যে মেয়েকে ও কাঁদিয়েছে, যে মেয়ে ওর জন্য কষ্ট পাচ্ছে সেই মেয়েই ওর দোষ ঢাকার জন্য ওর গুনগান গাইছে? এসব ভেবে স্নিগ্ধর নিজেকে আরও বেশি অপরাধী মনে হচ্ছে।

-“দেখ আমি বুঝতে পেরেছি তোদের ভেতরে কিছু হয়েছে। কিন্তু সেটা কি স্নিগ্ধ? তুই নিজেই সবসময় আমায় বলতি যে সকাল পিচ্চি মেয়ে, এখনো বাচ্চা ও। আর আজ তুই সেই বাচ্চা মেয়েটাকেই কষ্ট দিচ্ছিস। আমি জানি তোদের ভেতরে যা হয়েছে তাতে তোরই দোষ। অন্তত তোকে আমি এতটুকু চিনি।”
-“আমি নীলামকে ভালোবাসি আখি।”

স্নিগ্ধর কথায় চমকে গেল আখি। ও ভেবেছিল স্নিগ্ধ এতদিনে নীলামকে ভুলে সকালকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। অন্তত স্নিগ্ধর কথাবার্তায় ও তা-ই বুঝেছিল। তবে আজ হঠাৎ নীলামকে ভালোবাসে কেন বলছে স্নিগ্ধ?

-“হ্যা আমি জানি নীলামকে তুই ভালোবাসতি। কিন্তু নীলাম তো এখন তোর অতীত। বর্তমানে সকাল তোর হবু স্ত্রী। আর সকালের প্রতি তোর অনুভূতিগুলো তো ওর প্রতি তোর ভালোবাসা তাই না?”
-“কি বলছিস তুই এসব! নীলাম হোক আমার অতীত তবুও আমি ওকেই ভালোবাসি। ওকে যদি আমি ভুলে যাই তাহলে ওর প্রতি আমার ভালোবাসাগুলো তো মিথ্যে হয়ে যাবে। আর আমি নীলামকে সত্যি ভালোবাসতাম। আমি ওকে ভুলতে পারবো না। আর আমি সকালকেও ভালোবাসি না। ওর সাথে আমার শুধু মায়ার সম্পর্ক। ও শুধুমাত্র আমার দায়িত্ব। এছাড়া আর কিছু না।”
-“স্নিগ্ধ! তুই কি পাগল হয়ে গিয়েছিস! আমি বুঝতে পারছি না হঠাৎ করে তোর হয়েছেটা কি? এতদিন সকালের এত কাছে এসে তুই আজ বলছিস ওর সাথে তোর মায়ার সম্পর্ক! ও শুধুমাত্র তোর দায়িত্ব! তুই বুঝতে পারছিস তুই কি বলছিস? সকাল যদি এসব জানতে পারে তাহলে কতটা কষ্ট পাবে বুঝতে পারছিস তুই?”
-“(…..)”
-“এতদিন তোর কথায় আমি স্পষ্ট সকালের প্রতি তোর ভালোবাসাগুলো বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু আজ তুই সেটাকে অস্বীকার করছিস। নিজেও খামোখা কষ্ট পাচ্ছিস আর মেয়েটাকেও কষ্ট দিচ্ছিস।”
-“(…..)”
-“স্নিগ্ধ! আমার সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিবি তুই। বল কি হয়েছে তোর! তুই এসব কেন বলছিস হঠাৎ? মিথ্যে আমি শুনতে চাই না। আর এখন তুই বলতে না চাইলে আমি মানবো না। তাই বল কি হয়েছে?”

স্নিগ্ধ অসহায় চেহারায় অনন্যার বলা কথাগুলো বললো আখিকে। তারপর সকালের সাথে কথাগুলো বলতেই স্নিগ্ধ নিজের চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললো। কারণ তার গালে অত্যন্ত জোরে একটা থাপ্পড় পড়েছে। গালে হাত দিয়ে অবাক হয়ে সামনে তাকাতেই নিজের মায়ের অগ্নিমূর্তি দেখে আরও বেশি অবাক হলো স্নিগ্ধ।

আসমা বেগম এদিকেই আসছিলেন। তখনি নিজের ছেলের কথাগুলো তার কানে ঢুকেছে। তিনি কখনোই এমন কিছু আশা করেন নি স্নিগ্ধর কাছে। সব শোনার পর রাগের মাথায় উনি ছেলের গালে সজোরে থাপ্পড় মেরে দেন। উনার চোখ-মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে উনি রেগে আছেন।

-“মা তুমি আমায় মারলে কেন?”
-“তোকে আমি এই শিক্ষা দিয়েছিলাম! একটা মেয়ে যে কি-না আজ বাদে কাল তোর বউ হয়ে আসবে তুই তার সাথে এত বাজে আচরণ করেছিস?”
-“মা আমি…
-“তুই কি হ্যা! অনন্যাকে তুই চিনিস না? ও কেমন তুই জানিস না! তারপরও কি করে তুই অনন্যার কথায় এসে গেলি?”
-“আন্টি তুমি শান্ত হও। আমি আছি তো! বুঝিয়ে বলছি আমি ওকে। তুমি শান্ত হয়ে বসো।”

আখির কথায় আসমা বেগম ধপ করে বসে পড়লেন পাশের সোফায়। স্নিগ্ধ মাথা নিচু বসে আছে। আখি স্নিগ্ধর কাঁধে হাত রেখে বললো,
-“অনন্যা তোকে ভালোবাসে জানিস সেটা। নীলামের সাথে তুই রিলেশনে থাকাকালীন ও তোকে প্রপোজ করেছিল। কিন্তু তুই ওকে রিজেক্ট করে দিয়েছিলি কারণ তুই নীলামকে ভালোবাসতি। তারপরও বেশ কয়েকবার তোকে ও মানানোর চেষ্টা করেছে। শেষে না পেরে হাল ছেড়ে দিয়েছে। আরও হাল ছেড়েছিল কারণ নীলাম অনন্যার ছোটবোন ছিল। নিজের ছোটবোনের ক্ষতি তো আর করতে পারবে না, তাই ও তোর কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। কিন্তু নীলাম চলে যাওয়ার পর ও আবারও তোকে পাওয়ার একটা আশা দেখতে পেয়েছে।”
-“কিন্তু আমি কখনো ওকে সেই নজরে দেখিনি। আর আমি কখনোই ওকে মানবো না।”
-“হ্যা আমি জানি। আমাকে কথা শেষ করতে দে।”
-“(…..)”
-“নীলাম চলে যাওয়ার পর ও আবারও তোকে পাওয়ার একটা আশা দেখতে পেয়েছে। সেটা একান্তই ওর ভাবনা। কিন্তু মাঝখানে তোর জীবনে সকাল চলে এসেছে। এবং নিজের ভালোবাসা দিয়ে তোর মন জয় করে নিয়েছে। তুই নিজেও সকালের প্রতি আসক্ত স্নিগ্ধ। তুই সেটা এতদিন বুঝেছিস, মেনেছিস। কিন্তু অনন্যার কথাগুলো শুনে তোর মাথা থেকে এসব মুছে গিয়ে ‘শুধু নীলামকেই ভালোবাসতে হবে’ এই একটা কথাই মাথায় রেখে দিয়েছিস। অনন্যা ভালো মতোই জানে যে তুই বোকামি করিস শুধুমাত্র নীলামের ব্যাপারে। ওর ব্যাপারে কিছু বললে তোর মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়। সেই সুযোগটাই অনন্যা নিয়েছে। তোর মাথায় হাবিজাবি কথা ঢুকিয়েছে যাতে তুই সকালের সাথে খারাপ ব্যবহার করিস আর একসময় সকাল তোর থেকে দূরে সরে যাক। অনন্যা তো এটাই চায় যাতে তুই সকালকে তোর জীবন থেকে বের করে দিস। ও তোকে চায়। ও চায় তুই ওকে নিজের জীবনের সাথে জড়িয়ে রাখিস। বুঝেছিস আমার কথাগুলো!”
-“হুঁ!”

আখির কথাগুলো স্নিগ্ধ শুনেছে ঠিকই কিন্তু অনন্যার কথাগুলোও ও ভুলতে পারছে না। সবকিছু স্নিগ্ধর মাথায় গুলিয়ে যাচ্ছে। ও বুঝতে পারছে না কিছুই। আখি সেটা বুঝতে পেরে বললো,
-“আমার এখনকার কথাগুলো একটু মনোযোগ দিয়ে শোন। ভালোবাসা কিন্তু দিনকাল, সময় দেখে হয়না। কারণ এটা কোনো মিটিং নয়। ভালোবাসা হলো মনের অন্যতম অনুভূতি। যেই অনুভূতিগুলো তোর নীলামের প্রতি এসেছিল সেটা ভালোবাসা। আর যেই অনুভূতিগুলো তোর সকালের প্রতি আছে সেটাও ভালোবাসা।”
-“একসাথে দু’জনকে কি করে ভালোবাসা সম্ভব!”
-“কে বললো একসাথে দু’জনকে ভালোবাসা সম্ভব? একটা সময় ছিল যখন নীলাম তোর সাথে ছিল। তুই তখন ওকে ভালোবাসতি। কিন্তু এখন নীলাম নেই সকাল আছে তোর জীবনে। আর সকাল নিজের ভালোবাসায় জড়িয়ে ফেলেছে তোকে। তুই এখন সকালকে ভালোবাসিস। নীলাম তোর অতীত আর সকাল তোর বর্তমান। নীলামের স্মৃতিকে নিজের বর্তমান জীবনের উপর পড়তে দিস না। এতে না তুই ভালো থাকতে পারবি আর না তোর আপনজনেরা ভালো থাকতে পারবে। একসাথে তো দু’জনকে ভালোবাসছিস না তুই। নীলাম যে কি-না তোর অতীত ছিল, তুই তাকে তখন অর্থাৎ তোর অতীতে ভালোবাসতি। আর সকাল যে কি-না তোর বর্তমান, তুই ওকে এখন ভালোবাসিস। মানুষ যে তার জীবনে একবারই প্রেমে পড়ে তা কিন্তু নয়। সে বহুবার প্রেমে পড়তে পারে। সময়ের কথা আর মনের খবর কেউ বলতে পারে না। যে পর্যন্ত না ব্যক্তি একজনকে ভালোবেসে নিজের কাছে আঁকড়ে ধরতে পারবে সে পর্যন্ত সে প্রেমে পড়তেই থাকবে। এখন সে কার প্রেমে পড়বে তা তার মন ঠিক করবে।”

স্নিগ্ধ চুপ করে বসে রইলো। আখির কথায় যুক্তি আছে। তা-ও ওর মনে একটা কিন্তু কিন্তু ভাব রয়ে গেছে। যে কথাগুলো আগে ওর কাছে পরিষ্কার ছিল, আজ তা যেন ধোঁয়াশা হয়ে আছে। মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করে ফেললো। আখি বুঝতে পারলো একসাথে এত চাপ দেওয়া ঠিক হবে না স্নিগ্ধকে। একটু সময় দেওয়া উচিৎ ওকে। আখি আর কিছু বলার আগেই আসমা বেগম বললেন,
-“আখি! ওকে বলে দে যে সকাল মা-ই ওর বউ হবে। আমি এখানে আর কোনো কথা শুনতে চাই না। ওর যদি এই বিয়েতে মত না থাকে তবে দরজা খোলা আছে ওকে চলে যেতে বল এই বাসা থেকে। আর যদি এই বাসায় থাকতে চায় তবে সকাল মাকেই বিয়ে করতে হবে ওকে। আমার বউমাকে যথাযথ সম্মান দিতে হবে, ভালোবাসতে হবে, ঠিক মতো যত্ন নিতে হবে। তাহলেই এই বাসায় ওর জায়গা হবে। সময় দিচ্ছি ওকে। ভেবে উত্তরটা আমাকে জানাতে বলিস।”

আসমা বেগম তার কথা শেষ করে হনহন করে নিজের রুমে চলে গেলেন। স্নিগ্ধ এখনো সেভাবেই মাথা নিচু করে বসে আছে। আখির ফোন আসায় সে ফোন রিসিভ করে কথা বলতে লাগলো। কিছুক্ষণ পরে কল কেটে আখি বললো,
-“পলক বাইরে গাড়িতে আছে। আমাকে নয়নকে নিয়ে যেতে বলেছে। সকালের জ্বরটা না-কি আবার বেড়েছে। তাই বাসায় যাবে। আমি চলে যাচ্ছি। তুই আন্টিকে জানিয়ে দিস।”

সকালের জ্বর বাড়ছে কথাটা শোনা মাত্রই মাথা উঁচু করে করুণ চোখে তাকালো স্নিগ্ধ আখির দিকে। আখি বুঝতে পেরে মাথায় হালকা হাত বুলিয়ে দিল।

-“আমি যা যা বলেছে একটু ভেবে দেখ। সকালকে তুই নিজেও কিছু ভালোবাসিস। সেটা তুই না বুঝলেও বাকি সবাই বুঝে। মেয়েটাকে আর উপেক্ষা করিস না। এতে তুই নিজেও কষ্ট পাচ্ছিস আর মেয়েটাকেও কষ্ট দিচ্ছিস। তুই বড় তুই নিজেকে সামলে নিতে পারলেও সকাল পারেনা। ও এখনো ছোট। এসব প্রেম ভালোবাসার অনুভূতিগুলো ওর কাছে নতুন। যা ও তোর সংস্পর্শে এসেই শিখেছে। আগে যেভাবে সকালের সাথে মিশতি, ওকে বুঝতি, ওকে ভালোবাসতি, ওর যত্ন নিতি ঠিক সেভাবেই এখনো কর। এতে দেখি তুইও ভালো থাকবি আর সকালও ভালো থাকবে। ভেবে দেখিস। আসছি আমি। আন্টির আর নিজের খেয়াল রাখিস।”

নয়নকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে গেল আখি। স্নিগ্ধ আখির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে ওর বলা কথাগুলো ভাবতে ভাবতে নিজের রুমে চলে গেল। নীলামের ছবির ওপর থেকে পর্দা সরিয়ে নিচে খাটের সাথে হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে এক ধ্যানে তাকিয়ে রইলো ছবিটার দিকে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here