সেই_সন্ধ্যা পর্ব_৪১

0
1228

#সেই_সন্ধ্যা
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_৪১
.
অন্ধকার রুমে জানালার পাশে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে আফি। আজ আকাশে না আছে তারা আর না আছে চাঁদ। মেঘের চাদরে সব ঢেকে গেছে। ওর জীবনটাও ঠিক ওই কালো আকাশের মতো হয়ে গিয়েছে। যেখানে না আছে কোনো তারা আর না আছে চাঁদ। যাকে ভালোবেসেছিল সে এত বড় প্রতারণা করবে আফির সাথে যা ও কল্পনাও করেনি। ভালোবাসার মানুষটির কাছে ও শুধু একজন ভোগের বস্তু ছিল। ভোগ করা শেষ তাই ওকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু ওর নিষ্পাপ বাচ্চাটা কি দোষ করেছিল? বাচ্চাটা তো পৃথিবীর আলোটুকুও দেখতে পারলো না। তার আগেই তাকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো। এই পৃথিবীটা আসলেই নিষ্ঠুর। তার থেকেও বেশি নিষ্ঠুর এই পৃথিবীতে মুখোশ পড়ে বসবাস করা মানুষগুলো। যারা ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলায়। গিরগিটিও হয়ত এত রঙ বদলায় না।

বাচ্চাটার কথা ভাবতেই আফির চোখজোড়া ভিজে উঠছে বারবার। যতই হোক ও তো একটা মেয়ে। ওর ভেতরেও মাতৃত্ব আছে। যেদিন প্রথম জানতে পারলো যে ওর ভেতরে একটা প্রাণ ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে, সেদিন ওর মাথায় সবার প্রথমে এটা আসেনি যে ও অবিবাহিত বা এই সমাজ এসব জানতে পারলে ওকে কি বলবে; বরং ওর কোলজুড়ে একটা ফুটফুটে সন্তান আসবে। সে মেয়ে হবে না ছেলে হবে? এই চিন্তাটাই এসেছিল। আলাদা সুখ অনুভব হচ্ছিল ওর। কিন্তু এই সুখ যে ক্ষণিকের জন্য ছিল তা ঘূর্ণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি ও। আজ আফির অবুঝতার কারণে ওর বাচ্চা ওর সাথে নেই। চোখ থেকে অঝোর ধারায় জল গড়িয়ে পড়ছে। এই জলগুলো ওর নিত্যদিনের সঙ্গী। প্রতিদিন রাতে ওর চোখে এসে ভিড় জমায় গড়িয়ে পড়ার জন্য।

ফোনের শব্দে আফি চোখের পানি মুছে ফোনটা হাতে নিলো। পরশের কল দেখে ফোনটা খাটে নামিয়ে রেখে আফি ওয়াশরুমে গেল। ভালো করে চোখে-মুখে পানি দিয়ে বেরিয়ে এসে এক গ্লাস পানি খেয়ে গলাটাকে স্বাভাবিক করে নিলো। আবারও ফোন বেজে উঠতেই রিসিভ করলো আফি।

-“এতক্ষণ কেন লাগলো কল রিসিভ করতে? কতবার কল দিয়েছি দেখো তো।”
-“আ..আমি আসলে… আমি আসলে রুমে ছিলাম না।”
-“তো কোথায় ছিলে শুনি!”
-“ওয়া..ওয়াশরুমে ছিলাম।”
-“তুমি এভাবে কথা বলছো কেন?”
-“ঘুমচ্ছিলাম তো তাই হয়ত এমন লাগছে।”

ওপাশ থেকে পরশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,
-“চকলেট আছে ঘরে?”
-“হ্যা আছে কেন?”
-“চকলেট মুখে দাও এখুনি।”
-“কেন?”
-“যা বলছি করো।”

আফি যেয়ে ফ্রিজ থেকে চকলেট নিয়ে মুখে দিয়ে রুমে ফিরে এলো। ফোন কানে ধরে বললো,
-“হ্যা মুখে দিয়েছি চকলেট।”
-“এখন ৫ মিনিট চুপ করে বসে থাকো। চকলেটটা খেয়ে শেষ করো।”
-“কি করতে চাইছো তুমি?”
-“চুপ!”

চকলেট খাওয়া শেষ করে একটা বড় করে শ্বাস নিলো আফি। এতক্ষণ যে দম বন্ধ একটা ভাব ছিল তা এখন আর নেই। অনেকটা ভালো লাগছে। কান্নার রেশ একেবারেই কেটে গেছে। এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো আফির মুখে।

-“খাওয়া শেষ?”
-“হুম।”
-“কেমন লাগছে এখন?”
-“অনেকটাই ভালো।”
-“এখন থেকে কান্না আসলেই চকলেট মুখে দিয়ে বসে থাকবে। দেখবে আর কান্না পাবে না। তুমি একটু আগে কাঁদছিলে তা আমি বুঝতে পেরেছি।”
-“(….)”
-“আচ্ছা এখন লক্ষ্মী মেয়ের মতো ঘুমিয়ে পড়ো তো।”
-“হুঁ!”

আফি ফোন কানে নিয়েই শুয়ে পড়লো। ওপাশ থেকে পরশ এটা-সেটা বলছে। মূলত পরশ চাইছে যাতে আফির মাথা থেকে আপাতত পুরোনো স্মৃতিগুলো সরিয়ে দেওয়া যায়। এর ফলে আফি তাড়াতাড়ি ঘুমোতে পারবে। আর পরশ এতে সফলও হলো। আফি পরশ কথা শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে গেল। পরশ বুঝতে পেরে মুচকি হাসলো। ফোন কেটে দিয়ে ও নিজেও ঘুমিয়ে গেল।

ছাদের দোলনায় বসে একধ্যানে গোলাপ গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে সকাল। সেদিন প্রথম স্নিগ্ধ তার অনেকটা কাছে এসেছিল। সকালকে কিছু নতুন অনুভূতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল সেদিন স্নিগ্ধ। আজও সেই অনুভূতিগুলোর কথা মনে পড়লে এক অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করে সকালের মাঝে। কিন্তু তখন ও ভাবতো এগুলো স্নিগ্ধ ওকে ভালোবাসে বলে করছে। কিন্তু আজ সে জানে এগুলো স্নিগ্ধ বাধ্য হয়ে করেছে। কারণ ও একপ্রকার জোর করেই তো স্নিগ্ধর জীবনে ঢুকেছে। হাতের আংটির দিকে তাকিয়ে এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো সকাল। আদৌও কি এখন আর কোনো সম্পর্ক আছে এই আংটি পড়িয়ে দেওয়া মানুষটার সাথে তার? চোখের কোণে আসা পানিটা মুছে নিচে নেমে গেল সকাল। রুমে এসেই আফিকে কল দিল।

-“কিরে! তোর তো কোনো খোঁজ খবরই নাই। কোথায় থাকিস তুই?”
-“বাসাতেই ছিলাম। তুই আমাকে কল দিয়েছিলি অনেকবার কিন্তু রিসিভ করতে পারিনি। আসলে একটু অসুস্থ ছিলাম।”
-“কেন কি হয়েছে তোর? এখন ঠিক আছিস? আমাকে জানাসনি কেন? তাহলে তোকে দেখতে আসতাম।”
-“বেশিকিছু না, শুধু একটু জ্বর ছিল। আচ্ছা বাদ দে এই কথা। ফ্রি আছিস এখন?”
-“হ্যা কেন?”
-“একটু ঘুরতে বের হতাম আর কি। বাসায় বসে থাকতে ভালো লাগছে না আর।”
-“তা আমাকে কেন! তোর ডাক্তার সাহেবকে বললে তো ডাক্তার সাহেবই তোকে ঘুরতে নিয়ে যায়।”
-“আমি তোকে জিজ্ঞেস করেছি যে তুই যেতে পারবি কি-না! এখানে ডাক্তার সাহেবকে টানছিস কেন?”
-“আরে বাবা রেগে যাচ্ছিস কেন? আসছি আমি তুই তৈরি হয়ে থাক।”
-“তোর আসতে হবে না। আমি গাড়ি নিয়ে আসছি। তোর বাসার সামনে থেকে তোকে উঠিয়ে নিবো।”
-“আচ্ছা ঠিক আছে আয়।”

সকাল তৈরি হয়ে নিচে নেমে দেখে আসমা বেগম আর স্নিগ্ধ সোফায় বসে আছে। স্নিগ্ধকে দেখে সিঁড়িতেই দাঁড়িয়ে গেল সকাল। কতদিন পর তার ডাক্তার সাহেবকে সামনা-সামনি দেখছে সে। পেছন থেকে আখি এসে ওর কাঁধে হাত রাখতেই পেছন ঘুরলো সকাল।

-“উনারা কখন এসেছে ভাবী?”
-“এই একটু আগে। আমি তোমাকে ডাকতেই যাচ্ছিলাম। কিন্তু রুমে দেখলাম তুমি নেই। তাই নিচে এলাম।”
-“ওহ আচ্ছা।”
-“তুমি কি কোথাও যাচ্ছ?”
-“হ্যা আফির সাথে একটু বের হচ্ছি। বাসায় থাকতে ভালো লাগছে না।”
-“আচ্ছা দেখা করে যাও উনাদের সাথে।”
-“হুম।”

স্নিগ্ধ মাথা নিচু করে সোফায় বসে আছে। সামনেই রেহেনা বেগম আর আসমা বেগম গল্প করছেন। সকাল আসমা বেগমের কাছে এসে উনাকে সালাম দিল। স্নিগ্ধ তড়িৎ গতিতে সকালের দিকে তাকালো। বুকে চিনচিন ব্যাথা হতে লাগলো সকালকে দেখে। জ্বরের কারণে মুখটা শুকিয়ে গেছে। চোখের নিচে হালকা কালি পড়েছে। মুখের হাসিটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে জোর করে হাসার চেষ্টা করছে। খুব খারাপ লাগছে স্নিগ্ধর। আজ তার জন্যই সকালের এই অবস্থা। সবথেকে বেশি খারাপ লাগছে এই দেখে যে সকাল তার দিকে একবারও তাকাচ্ছে না।

-“কেমন আছো মা? শুনলাম তোমার না-কি জ্বর এসেছিল! স্যরি মা আসলে খুব ব্যস্ত ছিলাম তাই এই ক’দিন তোমায় দেখতে আসতে পারিনি।”
-“ব্যাপার না আন্টি। ব্যস্ততা থাকতেই পারে। তাছাড়া আমি এখন ভালো আছি, সম্পূর্ণ সুস্থ আছি।”
-“খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়ম করবে না একদম। নাহলে আবার অসুস্থ হয়ে পড়বে।”
-“জ্বি।”
-“পড়াশোনা ঠিক মতো করছো তো!”
-“জ্বি আন্টি বাসাতে বসেই সব পড়া শেষ করে রাখছি।”
-“হুম ভালো। সামনেই তো পরীক্ষা! ভালো করে পড়াশোনা করো। ইনশাআল্লাহ ভালো রেজাল্ট করবে।”
-“ইনশাআল্লাহ। আচ্ছা আন্টি আপনি তাহলে আম্মুর সাথে গল্প করুন। আমি আসলে একটু বের হবো। বন্ধুরা অপেক্ষা করছে আমার জন্য।”

আসমা বেগম সকালের কথায় স্নিগ্ধর দিকে তাকালেন। স্নিগ্ধ অসহায় চেহারা নিয়ে বসে আছে সকালের দিকে তাকিয়ে। আসমা বেগম এক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ছেলে যা করেছে তার জন্য এটাই তার প্রাপ্য। আসমা বেগম হাসি মুখে বললেন,
-“ঠিক আছে মা। তাহলে তুমি যাও, ঘুরে আসো বন্ধুদের সাথে। এতদিন বাসায় বসে থেকে নিশ্চয়ই একঘেয়েমি চলে এসেছে। ঘুরে আসলে ভালো লাগবে।”
-“জ্বি আন্টি।”

সকাল চলে যেতে গিয়েও আবার ফিরে এসে আখির দিকে তাকিয়ে বললো,
-“ভাইয়া কোথায় ভাবী?”
-“ও তো কি কাজের জন্য সাভার গিয়েছে।”
-“ওহ! ভাইয়াকে কল দিয়ে কোচিং এর ব্যাপারে খোঁজ নিতে বলো। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কোচিং দরকার আমার।”
-“আচ্ছা আমি বলে দিব কল দিয়ে।”
-“ঠিক আছে। আমি আসছি তাহলে।”

বেরিয়ে গেল সকাল। স্নিগ্ধ সোফায় বসে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। মেয়েটাকে ও একটু বেশিই কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। যে মেয়ে একসময় তাকে ছাড়া কিছু বুঝতো না, আজ সেই মেয়েই ওর দিকে একবার ফিরেও তাকালো না। ব্যাপারটায় স্নিগ্ধ কষ্ট পেলেও মাথা নিচু করে ফেললো। কারণ এর জন্য ও নিজেই দায়ী।

-“বাবা তুমি কিছু মনে করো না। আসলে এই ক’দিন জ্বরের কারণে ওর মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেছে। বাসার কারও সাথে তেমন একটা কথা বলে না। কথা বলতে গেলেই চেঁচামেচি করে। তাই তুমি এখানে থাকা সত্ত্বেও ও বাইরে যেতে চাওয়ার পরও ওকে কিছু বলিনি।”
-“না না আন্টি ঠিক আছে। এখন ওর মেজাজ একটু খারাপ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। জ্বরের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এটা। চিন্তা করবেন না। আমি কিছু মনে করিনি।”
-“তুমি বরং আখির সাথে গল্প করো।”
-“জ্বি ঠিক আছে।”

রেহেনা বেগম হালকা হেসে আবারও আসমা বেগমের সাথে গল্পে মশগুল হয়ে গেলেন। স্নিগ্ধ আখির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“নয়ন কোথায়?”
-“রুমে ঘুমোচ্ছে।”
-“ওহ!”
-“চল ছাদে যেয়ে ঘুরে আসি। এখানে একা একা আর কতক্ষণ বসে থাকবি?”
-“হুম চল।”

ছাদে এসে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালো স্নিগ্ধ। এপাশ-ওপাশ তাকাতেই ওর চোখ গেল গোলাপ গাছগুলোর দিকে। সেদিনের কথা মনে পড়তেই মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। আখি এসে পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
-“গোলাপ গাছগুলো তোর দেওয়া তাই না?”
-“হুম।”
-“এরপরেও বলবি তুই সকালকে ভালোবাসিস না!”
-“(….)”
-“গোলাপ নীলামের পছন্দের ছিল। তাই তুই এত এত গোলাপ গাছ নিয়ে এসেছিলি বিদেশ থেকে। নীলাম আর আন্টি ছাড়া অন্যকেউ এই গাছগুলো ধরলেই তুই জানার পর পুরো বাসা মাথায় উঠিয়ে ফেলতি। আর এখন সকাল চেয়েছে বলে তুই সকালকে তোর অর্ধেক গাছই দিয়ে দিয়েছিস। সকালকে ভালোবাসিস বলেই তো এই গাছগুলো ওকে দিতে পেরেছিস।”
-“(….)”
-“কবে যে তুই নিজের মনের কথা বুঝবি আর কবে যে সকালকে নিজের মনের কথা বলবি কে জানে! তবে দেখিস বেশি দেরি করে ফেলিস না। দেরি করে ফেললে হয়ত দেখা যাবে সকাল আর তোর জীবনে নেই।”

চমকে উঠলো স্নিগ্ধ। বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো আখির দিকে। সকাল ওর জীবনে থাকবে না শুনেই ওর নিজেকে কেমন যেন শূন্য মনে হচ্ছে। আখি বুঝতে পেরে স্নিগ্ধর কাঁধে হাত রেখে বললো,
-“চিন্তা করিস না। আমি শুধু কথার কথা বলেছি। তবে এই কথা সত্যি হতেও পারে যদি না তুই মেয়েটাকে নিজের মনের কথা বলে দিস।”
-“(….)”
-“আচ্ছা বাদ দে। তারপর বল কি ভেবেছিস সকালের ব্যাপারে?”
-“ওকে স্যরি বলতে হবে ওর করা খারাপ ব্যবহারের জন্য। মিস বিকাল আমার উপর রেগে নেই। ও শুধু অভিমান করে আছে। ওর অভিমান ভাঙাতে হবে।”
-“যাক তাহলে এতটুকু আক্কেলজ্ঞান হয়েছে তোর। ওর খোঁজ নিয়েছিলি এই কয়দিনে একবারও?”
-“কল দিয়েছিলাম বহুবার। কিন্তু রিসিভ করে নি।”
-“অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে তোকে।”
-“সমস্যা নেই আমি রাজি আছি। আগামীকাল কলেজে আসবে তো মনে হয়! তখন থেকেই নাহয় শুরু করবো ওর অভিমান ভাঙানো।”
-“সে গুড়ে বালি। সকাল কলেজে যাবে না আর।”

ভ্রু কুঁচকে চোখ দুটো ছোট ছোট করে স্নিগ্ধ বললো,
-“যাবে না মানে কি? ও কি পড়বে না?”
-“পড়বে কিন্তু ক্লাস করবে না। শুধু পরীক্ষাগুলো দিতে যাবে। এজন্য পলককে কোচিং খুঁজে দিতে বলেছে। ওর যা যা সমস্যা সব কোচিং থেকে বুঝে নিয়ে বাসায় পড়বে।”
-“হোয়াট দ্যা… এই মেয়ের সমস্যা কি! পড়াশোনা নিয়েও এখন হেলাফেলা করার কোনো মানে হয়? এভাবে পড়াশোনা করলে তো জীবনেও ডক্টর হতে পারবে না।”
-“ওই মেয়ের সমস্যাটা তুই। তোর সামনে আসতে চায় না বলেই সম্ভবত কলেজে যাবে না বলে ঠিক করেছে।”
-“একটা খুবই জঘন্য গালি আসছে মুখে। কিন্তু দিতে চাইছি না। তুই যেভাবেই হোক পলককে বল যে সকালকে যেন কলেজে আসতে রাজি করায়। কারণ শুধু কোচিং এ পড়ে ও কখনো ভালো রেজাল্ট করতে পারবে না। ল্যাব ক্লাসগুলো কীভাবে করবে ও! যদি শুধু কোচিং এ পড়ে?”
-“হ্যা তা-ও ঠিক। আচ্ছা দেখি বাসায় আসুক আগে তারপর কথা বলে ওর ডিসিশন জানাবো তোকে।”
-“ডিসিশনটা যেন হ্যা হয় সেদিকে খেয়াল রাখিস।”
-“আচ্ছা ভাই ঠিক আছে।”

ঘড়ির কাটায় প্রায় আটটার মতো বাজে। এখনো অফিসে নিজের কেবিনে বসে কাজ করে যাচ্ছে মিহু। তখনি শাহিন এসে মিহুর কেবিনে নক করলো।

-“কাম ইন।”

শাহিন একটা খাম হাতে কেবিনে ঢুকতেই মিহু সোজা হয়ে বসলো।

-“ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট এসে গেছে?”
-“জ্বি ম্যাম।”
-“কি আছে রিপোর্টে?”
-“আপনি ঠিকই আন্দাজ করেছিলেন। বাকি লাশ দুটো মিস্টার রুবেল ও মিস্টার পাটোয়ারীর। ডিএনএ মিলে গিয়েছে।”
-“উনাদের পরিবারের খোঁজ পেয়েছো?”
-“না ম্যাম এখনো তিনজনের পরিবারের একজন সদস্যেরও খোঁজ পাওয়া যায়নি।”
-“বাচ্চাদের সবার স্কুল, কলেজ আর ভার্সিটিতে খোঁজ নাও। দেখো কিছু জানতে পারো কি-না।”
-“ওকে ম্যাম।”

শাহিন কেবিন থেকে বের হতে গেলে মিহু পেছন থেকে বলে ওঠে,
-“মেঘ কোথায় শাহিন?”
-“স্যার তো উনার কেবিনে সোফায় শুয়ে ঘুমোচ্ছেন।”
-“কিহ! এটা ঘুমানোর জায়গা?”
-“আসলে ম্যাম আজকে আমরা সবাই এই একটা কেস এর ইনভেস্টিগেশনে ব্যস্ত ছিলাম তাই বাকি কেসগুলোর দিকে নজর দিতে পারিনি। মেঘ স্যার একা হাতে বাকি কেসগুলো দেখেছেন। তাই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। উনার কেবিনে ফাইলপত্র সব ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে।”
-“ঠিক আছে তুমি যাও।”

শাহিন বের হতেই মিহু ল্যাপটপ বন্ধ করে উঠে গেল। মেঘের কেবিনে ঢুকে দেখে সোফার উপর চার হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে মেঘ। বুকের উপর একটা ফাইল নামানো রয়েছে। টেবিলের উপরে ফাইলপত্র সব উল্টেপাল্টে পড়ে আছে। মিহু মেঘের কাছে যেয়ে আস্তে করে বুকের উপর থেকে ফাইল নিয়ে কপালের উপর থেকে আলতো হাতে চুলগুলো সরিয়ে দিল। টেবিলের কাছে যেয়ে এক এক করে সবগুলো ফাইল গুছিয়ে রেখে মেঘের সামনে এসে বসলো। হালকা হেসে কপালে গাঢ় এক চুমু দিল। মেঘ হালকা নড়েচড়ে উঠতেই মিহু চোখ বড় বড় করে একলাফে উঠে দাঁড়ালো।

হালকা পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালো মেঘ। সামনে মিহুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো। ঘুমের রেশ এখনো কাটেনি ওর। সোফা ছেড়ে দাঁড়িয়ে ঘুমুঘুমু কণ্ঠে আমতা আমতা করে বললো,
-“আসলে কখন যে চোখ লেগে এসেছে খেয়াল করি নি। স্যরি ম্যাম।”

স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো মিহু। যাক তাহলে মেঘ বুঝেতে পারেনি ও মেঘের কপালে চুমু দিয়েছে। গলা ঝেড়ে নিয়ে মিহু বললো,
-“আপনার কি কাজ শেষ আজকের?”
-“জ্বি।”
-“তো বাসায় যাননি কেন? বাসায় যেয়ে ঘুমোতেন।”
-“(….)”
-“প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে নিচে আসুন। আমি বাসায় যাচ্ছি। আপনি আমার সাথে চলুন। এই অবস্থায় বাইক চালানোর দরকার নেই। অ্যাক্সিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা আছে।”

মেঘকে কিছু বলতে না দিয়ে মিহু কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। মিহুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো মেঘ। পরক্ষণেই কপালে হাত ছুঁইয়ে চিন্তিত হয়ে বললো,
-“ঘুমের মধ্যে কেন যেন মনে হলো আমার কপালে কেউ নিজের ঠোঁট ছোঁয়ালো। হয়তো আমার মনের ভুল। তাড়াতাড়ি নিচে যাই। নয়তো ম্যাম আবার ক্ষেপবে।”

অফিসের নিচে নামতেই দেখলো মিহু গাড়ির ভেতরে বসে আছে। মেঘ যেয়ে গাড়ির সামনের দরজা খুলতে গেলে মিহু বললো,
-“পেছনে এসে বসুন।”

মেঘ কথা না বাড়িয়ে মিহুর পাশে এসে বসে পড়লো। মিহু ড্রাইভারকে গাড়ি ছাড়তে বলে মেঘের দিকে তাকালো। আসলেও আজ অনেক ক্লান্ত লাগছে মেঘকে। চোখ বন্ধ করে সিটে মাথা হেলিয়ে শুয়ে আছে। মিহু একধ্যানে তাকিয়ে রইলো মেঘের দিকে।

বাসায় এসে ফ্রেস না হয়েই শুয়ে পড়লো মেঘ। জামাকাপড়ও পাল্টায়নি। মিহু এসে আগে ফ্রেস হয়ে নিলো। তারপর মেঘকে জোর করে একপ্রকার ধাক্কিয়ে ওয়াশরুমে পাঠালো। ওয়াশরুমে ঢুকে মেঘ বিরবির করে বললো,
-“এই শাঁকচুন্নিটা আমার কপালেই কেন জুটেছে? কোন কাজ করে শান্তি পাইনা। সবসময় নিজের হুকুম চালায়। আল্লাহ তোমার কাছে বিচার দিলাম আমার সাথে হওয়া না ইনসাফির জন্য।”

কোনোমতে ফ্রেস হয়ে এসে মনে মনে মিহুকে বকতে বকতে আবার যেয়ে শুয়ে পড়লো মেঘ। ক্লান্ত থাকার কারণে শোয়ার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে গেল। মিহু মেঘের আম্মুর সাথে কথা বলে রুমে এসে দেখে মেঘ উল্টো দিকে ঘুরে কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। মিহু চোখ দুটো ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইলো সেদিকে।

-“এই ইডিয়টটা কোলবালিশটাকে ওপাশে নিয়ে গেছে কেন? এখন আমি ঘুমাবো কীভাবে? মাঝখানে কোলবালিশ না থাকায় ঘুমের মাঝে ও যদি এদিকে চলে আসে তখন! ধুর ছাই! ভালো লাগে না। এখন এভাবেই ঘুমাতে হবে। শালা তুই শুধু ঘুম থেকে ওঠ, দেখে নিবো তোকে আমি।”

দরজা লাগিয়ে রুমের আলো নিভিয়ে মেঘের পাশে যেয়ে শুয়ে পড়লো মিহু। ডান হাতটা অন্য বালিশের উপর নামিয়ে রাখলো। চোখ বন্ধ করার কিছুক্ষণ পরেই চমকে উঠে চোখ মেললো ও। কোমড়ে হালকা ঠান্ডা হাতের স্পর্শে সর্বাঙ্গ শিউরে উঠলো মিহুর। ঢোক গিলে পাশে তাকিয়ে দেখে মেঘ ঘুমের ঘোরে ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। গলার কাছে গরম নিঃশ্বাস পড়তেই বরফ হয়ে গেল মিহু। মেঘ নিজের মাথাটা মিহুর গলার কাছে রেখেছে। মেঘের নিঃশ্বাস সম্পূর্ণ মিহুর গলায় ছড়িয়ে পড়ছে। মিহু থরথর করে কাঁপতে লাগলো। মেঘকে ডাকার জন্য ওর দিকে তাকিয়েই থেমে গেল। কি নিষ্পাপ চেহারা। ঘন ঘন শ্বাস নেওয়া দেখে বোঝা যাচ্ছে মেঘ এখন গভীর ঘুমে আছে। নিমিষেই মিহুর মন ভালো হয়ে গেল। কাঁপা-কাঁপি বন্ধ হয়ে গেল। মুচকি হেসে মেঘের মাথায় চুমু দিয়ে ওভাবেই ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুমের ঘোরে মেঘ নিজেও মুচকি হাসলো।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here