সেই_সন্ধ্যা পর্ব_৪২

0
1515

#সেই_সন্ধ্যা
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_৪২
.
ঘুমের ভেতরে শরীরে উষ্ণতা পেয়ে আরও আষ্টেপৃষ্টে কোলবালিশ জড়িয়ে ধরলো মেঘ। হঠাৎ ঘুমের ভেতরেই তার মনে হলো কোলবালিশটা একটু বেশিই নরম। কিন্তু এত লম্বা কেন? চোখ হালকা পিটপিট করে খুলে ভালো করে দেখেই চমকে উঠলো সে। একলাফ দিয়ে উঠে বসলো। মিহু এখনো ঘুমোচ্ছে। আর মেঘ এতক্ষণ ওকে জড়িয়ে ধরেই ঘুমিয়েছিল।

-“আমি ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছি সারারাত! আল্লাহ তুমি হেদায়েত দান করো। এই মেয়ে যদি জানতো আমি ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছি তাহলে এতক্ষণে নিশ্চিত আমাকে লাথি দিয়ে খাট থেকে ফেলে দিতো। ঠিক আগেরবার যেভাবে লাথি দিয়ে ফেলে দিয়েছিল সেভাবে।”

সেই কথা ভাবতেই মেঘের চেহারা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। সেই বার মেঘরা ওর দাদু বাড়িতে গিয়েছিল ঘুরতে। মিহুও ছিল সাথে। গ্রামের বাড়িতে সাধারণত টিনের ঘরবাড়ি বেশি। মেঘ আর মিহুকে যে রুমে থাকতে দেওয়া হয়েছে, সে রুমে ঢুকেই মিহুর কপাল কুঁচকে গেল। ও মেঘের দিকে ঘুরে বললো,
-“এত ছোট খাটে দু’জন শুবো কীভাবে?”
-“এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। দাদু বাড়ির সবগুলো খাটই ছোট। তারা বড় খাট ব্যবহার করে না। তাদের মতে স্বামী-স্ত্রী ছোট খাটে ঘুমোলে বেশি কাছাকাছি থাকে। এতে স্বামী-স্ত্রীর ভেতরে ভালোবাসা বাড়ে। আর যারা একা ঘুমায় তাদের জন্য তো এই খাটই পারফেক্ট।”
-“ভালোবাসা না ছাই! যদি সত্যি ভালোবাসা থাকে তাহলে ছোট খাটে কাছাকাছি না ঘুমালেও ভালোবাসাটা বাড়ে। তাই ফালতু লজিক দেওয়া বন্ধ করো।”
-“আমার কি দোষ! আমি উনাদের এই লজিক বলেছিলাম না-কি?”
-“এখন তর্ক করতে চাইছি না তোমার সাথে। কিন্তু আমার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে ঘুমোবে। নয়তো লাথি দিয়ে ফেলে দিব খাট থেকে।”
-“মগের মুল্লুক না-কি! এতটুকু খাটে কোনোভাবেই দূরত্ব রেখে শোয়া যাবে না। এমনিতেই সিঙ্গেল খাট। তার ওপর দু’জন মানুষ এই খাটে ঘুমোলে দূরত্ব রাখা যায় কীভাবে?”
-“আমি কিছু জানি না। কিন্তু আমার সাথে ঘেঁষে ঘুমোনো যাবে না।”

মিহুর কথায় অনেকটাই বিরক্ত হলো মেঘ। ওরা তো বিবাহিত। তাহলে একসাথে মিশে ঘুমোলে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হবে? কিন্তু এই কথাটা মিহুকে কে বুঝাবে! মিহু খাটের একপাশে শুয়ে পড়লো। মেঘ অপর পাশে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মিহুর দিকে। ও নিজেও সামান্য দূরত্ব রেখে কোনোরকমে এক কোণায় শুয়ে পড়লো। একটু নড়লেই ঠাস করে নিচে পড়ে যাবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। সেভাবেই ঘুমিয়ে গেল মেঘ।

মাঝরাতে নিজের শরীরের উপর ভারী কিছু অনুভব করতে পারছে মিহু। যার জন্য ঠিক মতো নিঃশ্বাসও নিতে পারছে না। দম বন্ধ হয়ে আসছে। খট করে চোখ মেলে তাকিয়ে নিজের উপর বিশালদেহী এক পুরুষকে দেখে মিহুর বুঝতে বাকি রইলো না যে এটা মেঘ। এমন ভাবে ওকে জাপ্টে ধরে আছে যে বেচারি হাত-পা নাড়াতে পারছে না ঠিক মতো। রাগে মিহুর শরীর জ্বলে যাচ্ছে। খুব কষ্টে এক পা ছাড়িয়ে কোনো কিছু না ভেবেই জোরে এক লাথি দিল মেঘকে। ঘুমের ভেতরে লাথি খেয়ে মেঘ চমকে উঠলো। ফলে খাট থেকে সোজা মাটিতে গিয়ে পড়লো। মিহু খাট থেকে নেমে দু’হাত কোমড়ে রেখে রাগী চোখে তাকিয়ে রইলো মেঘের দিকে।

-“কেমন লাগলো লাথিটা! তোমাকে আমি ঘুমোনোর সময় সতর্ক করে দিয়ছিলাম যাতে তুমি আমার থেকে দূরত্ব বজায় রাখো। কিন্তু তুমি তো দেখছি আমার উপরে এসেই ঘুমিয়েছিলে। তাই লাথিটা উপহার দিলাম তোমাকে।”
-“আমি কি ইচ্ছে করে তোমার উপরে গিয়েছিলাম? কমনসেন্স নেই মাথায়! ঘুমের ব্যক্তিকে এভাবে কেউ লাথি দেয়?”

মেঘ বেশ ক্ষেপে গেছে মিহুর কাজে। তার ওপর নিচে পড়ে গিয়ে হাতেও ব্যাথা পেয়েছে। চোখ বন্ধ করে নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে ও। মিহু বুঝতে পারলো মেঘ হাতে ব্যাথা পেয়েছে। তাই ও আস্তে করে মেঘের কাঁধে হাত রাখলো। কিন্তু মেঘ রেগে সাথে সাথেই ওর হাত ঝারা দিয়ে সরিয়ে দিল। মিহুও কম যায় না। শক্ত করে মেঘের হাত ধরে দুই ঝারি দিল মেঘকে। গাল ফুলিয়ে উঠে খাটে বসলো মেঘ। হাতে যেখানে ব্যাথা পেয়েছে সেখানে কিছুক্ষণ মাসাজ করে দিল। তারপর মেঘকে শুয়ে পড়তে বলে মিহু ল্যাপটপ বের করে টেবিলে নামিয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়লো।

-“তুমি ঘুমাবে না!”
-“নাহ! তুমি ঘুমোও৷ আমার কিছু কাজ আছে আমি সেগুলো করবো এখন।”
-“এত রাতে!”
-“হ্যা। এখন কথা না বাড়িয়ে ঘুমোও।”

চুপ করে উল্টো দিকে ফিরে ঘুমিয়ে পড়লো মেঘ। মিহু ল্যাপটপে কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে মেঘকে দেখছে। কখন যে সেভাবে বসেই টেবিলে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে তার ঠিক নেই। সকালে মেঘের ঘুম ভাঙতেই ও দেখলো ও একাই পুরো খাটে হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। পাশে তাকিয়ে মিহুকে চেয়ারে বসে ঘুমোতে দেখে বেশ মায়া হলো ওর। খাট থেকে নেমে মিহুর কাছে যেয়ে ওকে কোলে নিতে গেলেই চোখ মেললো মিহু। তাড়াতাড়ি দূরে সরে মেঘ বললো,
-“খাটে যেয়ে ঘুমোও। এখানে বসে থাকলে কোমড়, পিঠ ব্যাথা হয়ে যাবে।”

কথা না বাড়িয়ে খাটে যাওয়ার জন্য সোজা হয়ে উঠে বসতেই ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠলো মিহু। ইতোমধ্যে ওর কোমড় আর পিঠ ব্যাথা হয়ে গেছে। তা বুঝতে পেরে মেঘ ওকে ধরে খাটে শুইয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। একটু বাদেই মেঘ হটব্যাগ এনে মিহুর কোমড়ে আর পিঠে ধরে ব্যাথা কমাতে লাগলো।

মিহু হালকা নড়েচড়ে উঠতেই মেঘ আগের কথা ভাবা বাদ দিয়ে আবারও শুয়ে পড়লো। তবে এবার আর মিহুকে জড়িয়ে ধরে নয়; বরং মিহুর থেকে দূরত্ব বজায় রেখে অন্যপাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। ঘুম ভাঙতেই চোখ মেলে মেঘকে নিজের কাছে না পেয়ে পাশে তাকিয়ে দেখে কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে মেঘ। হাসলো মিহু। এত বড় ছেলে কি-না এখনো কোলবালিশ ছাড়া ঘুমোতে পারে না। শোয়া থেকে উঠে বসে আড়মোড়া ভাঙলো। ডান হাতটা আগের থেকে অনেকটাই ভালো মনে হচ্ছে। হালকা ব্যাথা আছে, তবে তা সহনীয়। বিছানা থেকে নেমে অপর পাশে মেঘের সামনে হাঁটু ভেঙে বসে মাথায় আলতোভাবে হাত বুলিয়ে দিল। টুপ করে গভীর এক চুমু খেলো ওর কপালে। চাপ দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে আলতোভাবে গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে, মিহু উঠে ওয়াশরুমে চলে গেল। ওয়াশরুমের দরজা লাগানোর শব্দে উঠে বসলো মেঘ। একহাত গালে আর অন্য হাত কপালে দিয়ে ‘থ’ হয়ে বসে আছে।

-“আমাকে ঘুমন্ত পেয়ে এভাবে আমার সুযোগ নেয় ও? না জানি আর কি কি করেছে আমার সাথে। আম্মু আমি এতদিন সিঙ্গেল আর পিয়র ভার্জিন ছিলাম। কিন্তু তোমার ছেলের শাঁকচুন্নি বউ তোমার ছেলের ঘুমের সুযোগ নিয়ে তার ইজ্জতে হামলা করেছে। নেহিইইই… এখন আমার এতগুলো গার্লফ্রেন্ডের কি হবে? কি জবাব দিব আমি তাদের? মোনা, সোনিয়া, পিউ, মালিহা, সাদিয়া, জুঁই, নায়লা…. আমি আমার এই গার্লফ্রেন্ডগুলোকে কি বলবো?”

মেঘ ফোন নিয়ে সাথে সাথে তার বন্ধু মানিককে কল দিল। মানিক ফোন রিসিভ করতেই মেঘ কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো,
-“দোস্ত আমার শাঁকচুন্নি বসবউ আমার সব কেঁড়ে নিয়েছে। আমার ঘুমের সুযোগ নিয়ে আমার মতো একটা নিরীহ অবলা মাসুম সিঙ্গেল ছেলেকে কিস করেছে। দোস্ত আমার ভার্জিনিটি নিয়ে গেছে ওই শাঁকচুন্নি বসবউ। এখন আমার এতগুলো গার্লফ্রেন্ডের কি হবে?”
-“আবে শালা থাম। কখন থেকে বকবক করে যাচ্ছিস! আর ওই তুই সিঙ্গেল কেমনে? তোর বউ আছে, এতগুলো গার্লফ্রেন্ড আছে তারপরও তুই নিজেরে সিঙ্গেল দাবি করস?”
-“বউ তো আর আসল বউ না, নামমাত্র বসবউ। আর গার্লফ্রেন্ডগুলো তো টাইম পাস। তো হলাম না আমি সিঙ্গেল পিস!”
-“তুই শালা আসলেও একটা (….)”
-“গালি দিবি না হারামি।”
-“ভালো কথা! তুই নিরীহ অবলা মাসুম ছেলে? ভাই তোর চেহারাটা আয়নায় দেখ একবার! মনে হয় এক বাচ্চার বাপ। আর তুই নিজেরে নিরীহ অবলা মাসুম ছেলে বলস তাই না! মিহুর সাথে তোর সম্পর্ক ঠিক থাকলে এতদিনে ৩-৪ টা বাচ্চা পয়দা করে ফালাইতি।”
-“শালা তোর উপরে ঠাডা পড়ুক। আজাইরা পেঁচাল পারোস ক্যান?”
-“কিস করলে ভার্জিনিটি নষ্ট হয় তা তোর কাছ থেকেই প্রথম শুনলাম। ভাই আমাকে একটু বলবি কোন বইতে লেখা আছে কিস করলে ভার্জিনিটি নষ্ট হয়?”
-“আর কারও না হোক আমারটা নষ্ট হইছে। নামমাত্র বসবউ কিস করছে আমার গালে, কপালে। দোস্ত আমার গার্লফ্রেন্ডগুলোর কি হবে এখন?”
-“গালে, কপালে কিস করছে! শালা হারামি জানি কোথাকার! গালে, কপালে কিস করলে ভার্জিনিটি নষ্ট হয়? ঠোঁটে কিস করলেও নাহয় একটা কথা ছিল। গালে, কপালে চুমু দেওয়াকে ভালোবাসার স্পর্শ বলে।”
-“রাখ তোর ভালোবাসার স্পর্শ। আমার গার্লফ্রেন্ড, আমার ইজ্জত সব শেষ।”
-“ধুর শালা ফোন রাখ! আমার সময় নষ্ট করতিছিস তুই যতসব আজাইরা কথা বলে। মিহুর কাছে যেয়ে শুধু একবার বলিস যে ও তোর ভার্জিনিটি নিয়ে টানাটানি করছে। সাথে সাথে ও তোকে লাথি দিয়ে ওর সিআইডি টিম থেকে তোকে বের করে দিবে।”
-“তুই দোস্ত না দুশমন।”
-“হ্যা আমি দুশমনই। রাখ ফোন! সকাল সকাল আমার কানের পোকা নাড়ানোর জন্য কল দিছিস আমি কি বুঝি না! হারামি।”

মানিক কল কেটে দিতেই মেঘ আবারও নিজের কপালে আর গালে হাত দিয়ে কাঁদো কাঁদো চেহারা বানিয়ে বসে রইলো।

মেডিকেলের সামনে গাড়ি থামিয়ে বসে আছে সকাল। পলক আর আখি অনেক বুঝিয়েছে ওকে যাতে রেগুলার মেডিকেলে আসে আর ক্লাসগুলো মিস না দেয়। নাহলে শুধু কোচিং এ পড়ে কখনো ভালো রেজাল্ট করতে পারবে না ও। আখি নিজেও একজন ডাক্তার তাই আখির কথায় অবিশ্বাস করার কোনো মানে হয় না। ফলে ব্যাগ গুছিয়ে আজ মেডিকেলে এসেছে সকাল। কিন্তু ভেতরে যেতে ইচ্ছে করছে না। যদি আবারও তাকে স্নিগ্ধর সামনে পড়তে হয় তখন! অবশ্য এই মেডিকেলে পড়লে একদিন না একদিন স্নিগ্ধর সামনে এমনিতেও পড়তে হবে। স্নিগ্ধ তাদের টিচার বলে কথা। এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো। আশেপাশে তাকিয়ে মাথা নিচু করে ভেতরে ঢুকেই শান্তি লাগলো সকালের। কতদিন পর আবার আসলো মেডিকেলে।

সকাল আফিকে আগে থেকেই কল দিয়ে বলে দিয়েছিল যাতে সে আর পরশ মাঠে ওর জন্য অপেক্ষা করে। ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে মাঠে তাকালো। শত শত ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেদের মতো গ্রুপ বানিয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছে। মাঠের একপাশে বট গাছের নিচে পরশ আর আফিকে বসে থাকতে দেখে সেদিকে চলে গেল সকাল। সকালকে দেখে আফি আর পরশ হেসে ওকে বসতে বললো পাশে।

গতকাল আফির সাথে দেখা করার সময় পরশও ছিল আফির সাথে। আফি সকালকে ওদের রিলেশনের ব্যাপারটা জানালে প্রথমে অনেক অবাক হলেও পরে সকাল অনেক খুশি হয়েছে। এতদিন যে অপরাধবোধ কাজ করতো পরশকে রিজেক্ট করে, সেই অপরাধবোধ এক নিমিষেই হাওয়া হয়ে গেছে।

-“পরশ কি এখন পুরোপুরি ভাবে সুস্থ?”
-“হ্যা। তোমারও তো জ্বর ছিল এতদিন। তুমি পুরোপুরি সুস্থ তো!”
-“একদম ফিট। আচ্ছা এসব বাদ দাও। বিয়ে কবে করবে তোমরা?”
-“এখনি বিয়ের চিন্তা করছি না। কারণ আমি এখনো পড়াশোনা করছি। তার উপর তুমি তো শুনেছই যে আমার বাবা-মায়ের সাথে আমার সম্পর্ক খুব একটা ভালো নয়। তাই আমি চাই না আফিকে বিয়ে করার পর ওর দায়িত্ব আমার বাবা-মা নিক। আগে ডাক্তারি পাস করে ডাক্তার হই, তারপর বিয়ে করবো।”
-“গুড আইডিয়া। কিন্তু আমার মনে হয় ততদিনের জন্য কাবিন করে রাখলে ভালো হয়। এতে সবাই অন্তত এতটুকু জানবে যে আফি বিবাহিত। কারণ ও যেই মহল্লায় থাকে সেখানকার লোকজন তেমন একটা ভালো না। দেখা যাবে তুমি ওর সাথে দেখা করতে গেছো এটা কেউ একজন দেখে নিবে। আর কথা ছড়াবে যে তোমার সাথে বাজে অবস্থায় দেখেছে তারা আফিকে। মানে একটা কথাকে চৌদ্দভাবে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে খারাপ মেন্টালিটিতে নিয়ে তারপর ছাড়বে।”
-“সিরিয়াসলি আফি তুমি এত ডেঞ্জারাস এলাকায় থাকো?”

পরশ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো আফিকে। হালকা হাসলো আফি। মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলতেই পরশ মাথায় হাত দিয়ে অসহায় চেহারা বানিয়ে বললো,
-“তাহলে এখন আমার কি হবে?”
-“সকালের কথা মতো কাবিন করে নাও।”
-“আচ্ছা তাহলে আজ রাতে বাসায় যেয়ে বাবা-মায়ের সাথে কথা বলবো।”
-“তোমার বাবা-মা রাজি হবে তো পরশ!”
-“তারা রাজি হতে না চাইলেও হতে বাধ্য হবে। তুমি চিন্তা করো না। ভরশা রাখো আমার উপর।”
-“হুম।”

পরশ আর আফিকে একসাথে দেখে মুচকি হাসলো সকাল। ভালোবাসায় ভরশা আর বিশ্বাস জিনিসটা খুব জরুরি। যা আফি আর পরশের ভালোবাসায় আছে।

-“আফি তুই এই কয়দিন রেগুলার ক্লাস করেছিস?”
-“হ্যা।”
-“তাহলে নোটগুলো দিস আমাকে।”
-“আচ্ছা।”

সকাল চুপ করে বসে হাতের আংটি নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। হঠাৎ হাতে টান পড়ায় হকচকিয়ে গেল ও। আফি আর পরশও প্রথমে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরে স্নিগ্ধকে দেখে ওরা আর কিছু বলেনি। সকাল কোনো কথা না বলে হাত ছাড়ানোর জন্য মোচড়াচ্ছে। স্নিগ্ধ আরও শক্ত করে হাত ধরে আশেপাশে না তাকিয়ে সোজা নিজের কেবিনের দিকে যেতে লাগলো। হাত ছাড়াতে না পেরে একসময় চুপচাপ বাধ্য মেয়ের মতো স্নিগ্ধর পেছন পেছন যেতে লাগলো সকাল। হাতে ব্যাথা পাচ্ছে বলেই মূলত সকাল চুপ হয়ে গেছে। কেবিনে এসে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে সকালের হাত ছেড়ে দিল স্নিগ্ধ। সকাল মাথানিচু করে ব্যাথায় ডান হাত দিয়ে বাম হাতের কব্জি ডলতে লাগলো।

স্নিগ্ধ চুপচাপ তাকিয়ে আছে সকালের দিকে। ও আশায় আছে সকাল ওকে কিছু বলবে বা ওর দিকে তাকাবে। কিন্তু তেমন কিছুই না হওয়ায় বেশ কষ্ট পেলো স্নিগ্ধ। কিছু না বলেই সকালকে নিজের বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে ফেললো। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সকাল। ও পুরো মিশে আছে স্নিগ্ধর শরীরের সাথে। স্নিগ্ধর হৃদ স্পন্দনের শব্দ শুনে চোখ বুঁজে নিলো ও। সকালেরও খুব করে মন চাইছে দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে স্নিগ্ধকে। কিন্তু অদৃশ্য কিছু একটা বাঁধা দিচ্ছে ওকে। সেদিনের ফোনে বলা স্নিগ্ধর কথাগুলো মনে পড়তেই আবারও অভিমানগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো সকালের। দু’হাত স্নিগ্ধর বুকের দু’পাশে রেখে জোরে ধাক্কা দিয়ে সরানোর চেষ্টা করলো স্নিগ্ধকে। কিন্তু স্নিগ্ধকে একচুল পরিমাণও সরাতে পারলো না সকাল। উল্টো স্নিগ্ধ আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ওকে। মাথায় বেশ কয়েকটা চুমু দিল সকালের।

-“সেদিনের ব্যবহারের জন্য আমি খুবই দুঃখিত। আসলে তখন আমার মেজাজটা ভালো ছিল না। অনেক রেগেছিলাম আমি। ঠিক ওই সময়েই তুমি কল দিয়েছিলে। তাই তোমার উপরে রাগ ঝেড়ে ফেলেছি। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি তোমার উপর রাগ ঝাড়তে চাইনি। আমার কথা শুনে তুমি যতটা না কষ্ট পেয়েছো, তার থেকে দ্বিগুণ বেশি কষ্ট আমি পেয়েছি তোমায় কষ্ট দিয়ে। প্লিজ মিস বিকাল এবারের মতো মাফ করে দাও। আমি কথা দিচ্ছি আমি আর কখনো এমন করবো না স্যরি।”
-“(….)”
-“তুমি কথা বলো আমার সাথে। তোমার নীরবতা আমাকে আরও বেশি কষ্ট দিচ্ছে। আমি মেনে নিতে পারছি না তোমার চুপ থাকা। ভুল করেছি শাস্তি দাও। কিন্তু চুপ করে থেকো না। সহ্য হচ্ছে না আমার।”
-“(….)”
-“আবারও আগের মতো কথা বলো, দুষ্টুমি করো আমার সাথে প্লিজ। আমি অনেক স্যরি অনেক অনেক স্যরি। প্লিজ মাফ করে দাও।”

সকাল কোনো কথা না বলে সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ওর চোখের জলগুলো খুবই অবাধ্য। কোনো কথা না শুনে বৃষ্টির মতো ঝরে যাচ্ছে সেই জলগুলো। স্নিগ্ধর কথা শুনে একবার মন চাইছে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তার সাথে মিশে যেতে। কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে পড়ে তার অভিমানের পাল্লা ভীষণ ভারী। সকাল স্নিগ্ধকে দু’হাত দিয়ে ধাক্কায় সরানোর জন্য। খুব কষ্ট হচ্ছে তার। কিন্তু স্নিগ্ধও নাছোড়বান্দা। কোনোভাবেই সে সকালকে ছাড়বে না যে পর্যন্ত না সকাল কোনো কথা বলছে।

-“ধাক্কা দিয়ে লাভ নেই তো! তুমি আমাকে দূরে সরাতে পারবে না। যতই দূরে সরানোর চেষ্টা করবে আমি ততই তোমার কাছে চলে আসবো। তোমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরবো। আগলে রাখবো নিজের বুকের মাঝে। প্লিজ কথা বলো। চুপ করে থেকো না।”
-“(….)”
-“কাঁদছো কেন? আমি তো কাঁদতে বলিনি তোমাকে। কথা বলতে বলেছি।”
-“ছাড়ুন আমাকে। আপনার সাথে কোনো কথা নেই আমার। ছাড়ুন বলছি নয়তো খুব খারাপ হবে।”
-“যাক তুমি বোবা হয়ে যাওনি। আমি তো ভেবেছিলাম তুমি বোবা হয়ে গিয়েছো তাই কথা বলছো না।”
-“ছাড়ুন বলছি তো! আপনাকে বিরক্ত লাগছে আমার।”

স্নিগ্ধ হেসে ফেললো। আরও শক্ত করে সকালকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে বললো,
-“আমাকে বিরক্ত লাগছে সিরিয়াসলি! হাসিওনা। মিথ্যে কথা তুমি বলতে পারো না পিচ্চি। আর আমার প্রতি তো কখনোই বিরক্ত হতে পারো না তুমি।”
-“আপনি খুব খারাপ লোক। খুব খুব খুব খারাপ লোক। আমাকে কাঁদাতে খুব ভালো লাগে আপনার তাই না? তাই তো সবসময় কাঁদান আমাকে। আমাকে কষ্ট না দিলে তো ভালো লাগে না আপনার! কেন করেন আমার সাথে এরকম? আমাকে পছন্দ না হলে সরাসরি বলে দিলেই তো পাড়েন।”
-“শশশ… স্যরি। তোমার চোখের পানি আমার সহ্য হয় না। কিন্তু বারবার আমিই তোমার চোখের পানির কারণ হই। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি চাই না তোমাকে কাঁদাতে। আমি…আমি সবসময় তোমাকে হাসি-খুশি দেখতে চাই। আগলে রাখতে চাই তোমাকে। কিন্তু নিজের বোকামির কারণে তোমাকে কষ্ট দিয়ে ফেলি। প্লিজ মাফ করে দাও এইবারের মতো। স্যরি।”

এখনো চোখেরজলগুলো টপ টপ করে গাল বেয়ে পড়ছে সকালের। স্নিগ্ধর শার্ট ভিজে যাচ্ছে তাতে। কিন্তু সেদিকে স্নিগ্ধর খেয়াল নেই। এখন ও শুধু এটাই চিন্তা করছে সকালকে কীভাবে মানাবে। মেয়েটার যে অভিমান অনেক বেশি হয়েছে এবার তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ওর এই অভিমান ভাঙাতে হবে। আবারও আগের মতো করে নিজেদের সম্পর্কটাকে ঠিক করতে হবে। স্নিগ্ধ মুচকি হেসে চুমু দিল সকালের মাথায়।

স্নিগ্ধর ফোন বেজে উঠতেই একহাতে সকালকে জড়িয়ে ধরে রেখে অন্য হাতে পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে হসপিটাল থেকে কল এসেছে। রিসিভ করে জানতে পারলো একটা ইমার্জেন্সি এসেছে। এখনি যেতে হবে ওকে। কল কেটে আবারও সকালকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
-“হুঁশ! আর কাঁদতে হবে না। অনেক হয়েছে এবার থামো। হসপিটালে একটা ইমার্জেন্সি এসেছে। আমাকে যেতে হবে এখন। তুমি সাবধানে থেকো। আর ক্লাস শেষ করে সোজা বাসায় যাবে এখান থেকে। বুঝেছো!”

সকাল চুপ করে রইলো। স্নিগ্ধ সকালকে ছেড়ে কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে দু’হাতে ওর চোখের পানি মুছে দিল। সকালের হাত ধরে কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো স্নিগ্ধ। ক্লাসরুমের সামনে এসে সকালকে পৌঁছে দিয়ে ওর গালে হাত রেখে “আসছি” বলে চলে গেল।

মিহু চেয়ারে বসে ল্যাপটপে কাজ করছিল। এমন সময় তানিশা হাঁপাতে হাঁপাতে মিহুর কেবিনে ঢুকে গেল। মিহু ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে ভ্রু কুঁচকে তানিশার দিকে তাকাতেই তানিশা কাঁদো কাঁদো চেহারা বানিয়ে বললো,
-“স্যরি ম্যাম নক করতে ভুলে গেছি।”
-“ইট’স ওকে। কিন্তু তুমি এভাবে হাঁপাচ্ছ কেন?”
-“ম্যাম আমি একটা দুর্দান্ত জিনিস পেয়েছি। আপনি দেখলে আপনিও অবাক হয়ে যাবেন।”
-“কি পেয়েছো?”
-“সকালের ব্যাপারে আর তার পুরো পরিবারের ব্যাপারে খোঁজ নিতে বলেছিলেন আপনি। আমি নিয়েছি আর বিশ্বাস করবেন না ম্যাম আমি যা পেয়েছি তাতে আমি নিজেই হতবাক।”
-“আরে বাবা কথা না পেঁচিয়ে সোজাসুজি বলো।”
-“সকালের বাবা আরিফুল ইসলাম নারীপাচারের কাজের সাথে জড়িত। এমনকি উনি ড্রাগস সাপ্লাইও করেন। যা উনার পরিবারের কেউ জানেন না। উনি নিজের এই রূপ ঢেকে রাখার জন্য দেশের মানুষের কাছে বিশিষ্ট শিল্পপতি আরিফুল ইসলাম নামে পরিচিত। কিন্তু উনি নিজের মুখোশের আড়ালে অন্য কিছু।”
-“হোয়াট!”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here