সেদিনও জ্যোৎস্না ছিল পর্ব-৯

0
6921

#সেদিনও_জ্যোৎস্না_ছিল

#তানিয়া

পর্ব:৯

অনেক্ক্ষণ ধরে মেহু আদ্যর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মেহু যেতেও পারছেনা আবার দাঁড়িয়ে থাকতেও ভয় লাগছে।দু’বার জিজ্ঞেস করেছে সে যাবে কিনা কিন্তু আদ্য হা হু কিছু বলে নি।পাঁচ মিনিটে যে কফিটা শেষ হতে পারে সেটাকে মনে হচ্ছে পাঁচ ঘন্টায় শেষ করবে।প্রচুর রাগ হচ্ছে মেহুর আমেনা খালার ওপর।সে পইপই করে বলেছে আসবেনা কিন্তু খালা যেভাবে সহজে বললো যাবি, দিবি আর চলে আসবি কিন্তু কিছুই হলো না।কফিটা নিয়ে আসলো ঠিকই তবে কফিটা টেবিলে রাখতেই আদ্য চ্যাত করে উঠলো যেন অনেক বড় ভুল করেছে।

“এই মেয়ে আমি কি তোমাকে বলেছি কফিটা রাখতে তাহলে রাখলে কেনো?”

মেহু বুঝলো না কফিটা টেবিলে রেখে সে অন্যায় করলো কিনা?এটা তো নতুন না।এর আগেও সে চা, কফি এনে টেবিলে রেখে চলে গেছে তাহলে এটা দোষের হলো কেনো?কফিটা টেবিল থেকে নিয়ে আবারও হাতে নিলো।সেই যে দাঁড়িয়ে আছে এখনো অবধি আদ্য কফিটা নিলো না।অনেক সময় পর কফি নিলো ঠিকই তবে মেহু যেতেই তাকে আটকে দিলো।

“এ মেয়ে তোমাকে আমি যেতে বলেছি তুমি অনুমতি ছাড়া চলে যাচ্ছো কেনো?”

এবার মেহু অবাক না হয়ে পারলো না।আজ হঠাৎ আলুর হলো কি?সব কি তার অনুমতি নিয়ে করতে হবে?মনে হচ্ছে উঠা বসা, খাওয়া,আসা যাওয়া সবকিছু তাকে জানিয়ে জানিয়ে করতে হবে।রাগ লাগছে তবুও সেটাকে দমিয়ে রাখছে মেহু। তাছাড়া যে সময় লাগছে তাতে মনে হচ্ছে আজ এ ঘর থেকে সে বেরুতে পারবেনা।খালায় বা কেমন একটু ডাকতে আসছে না।তাহলে সেই অযুহাতে বের হতে পারতো।এখন সে কি বলবে?এরমধ্যে মেহু কয়েকবার কাজের কথা উল্লেখ করেছিল বটে কিন্তু আদ্য শুনলো কি শুনলো না বুঝা গেলো না।সে চুক চুক করে একটু একটু কফি খাচ্ছে। মনে হচ্ছে আজকে কফি নয় অমৃত খাচ্ছে।তাড়াতাড়ি খেলে যেন আর কোনোদিনই পাবেনা তাই আস্তে আস্তে খাচ্ছে। কেনো রে আলু তোর আরো খেতে ইচ্ছে করলে আমি বানিয়ে আনবো এভাবে ঢং করে খাওয়ার কি আছে? মেহু মনে হচ্ছে এবার সে কেঁদেই ফেলবে।

“স্যার আফনের আরকিছু কওনের আছে। নইলে আমি চইলা যাইতাম।ওদিহে মেলা কাম পইড়া আছে। ”

আদ্য এবার আরো আস্তে পান করছে।মেহুর ইচ্ছে করছে দৌড়ে গিয়ে কফিটা নিয়ে তার মুখ হা করিয়ে পুরোটা ঢেলে দিতে আর বলবে,

দেখ আলু দেখ এভাবে পান করতে হয়।শালা কফি খাচ্ছিস নাকি লোহা যে এতো সময় লাগে।”

আদ্য কফিটা অবশেষে শেষ করলোই।এবার সে টিস্যু নিলো।খুব সুন্দর করে মুখ মুছলো।তারপর মেহুর দিকে তাকালো।

“গতকাল ঘুমোতে তোমার কোনো সমস্যা হয় নি তো?”

আদ্যর কথা শুনেই মেহুর চোখ গুলো বড় বড় হয়ে যায়। কাল ঘুমোতে তার অসুবিধা হয়েছে কিনা তা এ আলু জিজ্ঞেস করছে কেনো?তার মানে কি মেহু যা ভেবেছে তাই ঠিক। কাল কি তাহলে আদ্য তাকে দেখে নিয়েছে।সব পরিষ্কার হয়ে গেছে এখন।মেহুকে এ মুহুর্তে এ বাড়ি ছাড়তে হবে।কথাটা ভাবতেই তার সমানে মাথাটা দুলিয়ে উঠলো।মনে হচ্ছে এ মুহূর্তে আদ্যর সামনে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে।

“গতকাল কি তোমার এতো বড় সাইজের বিড়াল আর কোনো ডিস্টার্ব করেছে?”

আদ্যর এ কথা শুনে মেহুর ধড়ে যেনো প্রাণ ফিরে এলো।তার মানে এতক্ষণ যা ভাবছিলো সব মিথ্যা। আদ্য তাকে দেখে নি।সে ভেতরে ভেতরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।

‘কি হলো কথা বলছো না যে? তুমি কি অন্য কিছু ভাবছো?”

মেহু তাড়াতাড়ি মাথা নাড়ায়।

“না না স্যার কি কন?আমি আর কি ভাবমু।না স্যার কাল রাইতে খুব ভালো ঘুম হইছে।আর আফনারে তো কইছি আমি তালা দিয়া রাখি তাই আর বিলাই ঢুকোনের সুযোগ থাকে না।স্যার আফনে আরকিছু কইবেন এবার নাহলে আমি যাই?”

আদ্য মেহুকে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখছে।এ মেয়েটাকে একটু ভড়কে দিলে কি হয়।মেহু চলে যেতে হঠাৎ আদ্য বললো,

“শোনো তোমার ঘরের জানালায় সমস্যা আছে। আমি একজন মিস্ত্রিকে বলে দিচ্ছি সে জানলাটা ঠিক করে দিবে।’

মেহুর পা জোড়া থেমে যায়। কেউ যেনো শিকল আটকে দিয়েছে পা দুটোতে। কি বলছে আদ্য?এতক্ষণ মনের মধ্যে যে চিন্তাটা কমে এসেছিলো সেটা উড়ে উড়ে আবারও যেনো মনে ফিরে এলো।সত্যি সত্যি তাহলে আদ্য…..।চোখের কর্নিশে এবার জলটা এসেই গেলো।মেহু ফিরছে না কিন্তু আদ্য বুঝতে পারছে এ মুহুর্তে তার অবস্থা কি?তাই বিষয়টা সহজ করতে সে বললো,

আসলে কিছু দিন আগে আমি যখন ছাদে গিয়েছিলাম তখন দেখি জানলা খোলা।তখনই বুঝলাম বিড়ালটা দরজা বন্ধ থাকলেও জানলা দিয়ে ঢুকে তোমার বিছানায় ইয়ে করে বসে।তাই তোমাকে জানলার কথাটা বলবো বলবো ভাবছিলাম।কিন্তু বলা হয়ে উঠে না।যাই হোক এখন মনে পরলো তাই বলে দিলাম।তুমি ভেবো না জানলা ঠিক হলে দরজায় তালা থাকলে বিড়াল তো দূরে থাক মাছিরও সাধ্য থাকবে না তেমার ঘরের ঢুকার।এখন তুমি যাও।”

আদ্য কথা শেষ করলেই মেহু ধীরে ধীরে বের হয়ে যায়। আদ্য বুঝেছে ঔষধ কাজ করেছে।মেয়েটার হাঁটার গতিই বুঝিয়ে দিচ্ছে কালকের যা দৃশ্যমান সবই সত্যি। এখন শুধু জানতে হবে কেনো সে এ বাড়িতে এসেছে?

মেহু রুমে এসে জানলার কাছে এসে দাঁড়ালো।সে ভালো করে জানলা পরখ করছে।কীভাবে সেটা খুললো?ভালো করে রাতে জানলা আটকেছিলো তাহলে খুললো কোনদিক দিয়ে।চেক করতে গিয়ে বুঝলো জানলার একটা অংশের হুক লুজ।হালকা ধাক্কায় সেটা খুলে যায়। মেহু বুঝলো গতকাল হয়তো বাতাসের ঝাপটায় জানলার একপাটি খুলে গেছে। জানলা আঁকড়ে ধরে সে আফসোস করছে কেনো এতদিন বিষয়টা নজরে এলো না?

মেহু আছে নিজের কর্মজীবন নিয়ে আর আদ্য আছে অফিসের কাজ নিয়ে। মেহু প্রায় ভুলেই গেছে আগের ব্যাপার সমূহ।তবে আদ্য এখনো সেসব নিয়ে ভাবে।সে প্রায় চেষ্টা করে মেহুকে দেখার কিন্তু সেই সুযোগ হয়ে উঠে না।কারণ সত্যি সত্যি মিস্ত্রি দিয়ে সে জানলা ঠিক করেছে।কারণ সে চায় না সত্যিটা না জানা পর্যন্ত কেউ মর্জিনা নামের মেয়েটার আসল বিষয় জানতে পারুক।এক প্রকার নিজের স্বার্থেই সে কাজটা করেছে।তবে মেহু লক্ষ্য করেছে ইদানীং আদ্য তাকে নিয়ে কোনো হইচই করে না।তার ওপর রাগ করে না।বরং সুযোগ পেলে এটা সেটা নিয়ে ওর সাথে কথা বলে।কথার মাঝে আটকে রাখে।বিষয়টা মেহুর ভালো লাগে না কারণ আদ্যর সহজ ব্যবহার মেহুর কাছে ধাঁধা মনে হয় যা সে ধরতে পারছে না।এতো সেদিন মেহু আদ্যর ঘর ঝাড় দিচ্ছিলো আদ্য ল্যাপটপে কি যেনো কাজ করছে। এমন সময় মেহু খেয়াল করে আদ্য কাজ বাদ দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মেহু বেশ অস্বস্তিতে পড়ে যায়। কাজ করতে বারবার সে নিশপিশ করছে আদ্য বুঝেও যেনো না বোঝার ভান করছে।হঠাৎ আদ্য বলে উঠে,

“মর্জিনা তুমি তো আগে থেকে সুন্দর হয়ে গেছো!প্রেম ট্রেম করছো নাকি?”

মেহু হকচকিয়ে যায়। কি বলে গোল আলু,সে সুন্দর হয়ে গেছে? সে তো রোজ একি সাজে থাকে তাহলে কি আজ রং টা কম খাপ খেয়েছে?মেহু পাশে থাকা আয়না টায় নিজেকে দেখে নেয়।না ঠিকই তো লাগছে।এ ব্যাটার চোখে ন্যাবা হয়েছে বোধ হয়?

“কি কন স্যার? আমাগো মতো কালা আর গাইয়া মাইয়ারে কে পছন্দ করবো?তাছাড়া সারাদিন কাম করতে করতে জীবনডা শেষ এসব পেরেম পিরিতি করার সময় কই?”

“তাই নাকি কিন্তু আমার তো অন্য কিছু মনে হচ্ছে। আমি যখন তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম সেদিন যে যতটা কালো মনে হয়েছিল এখম তেমন মনে হচ্ছে না।তুমি কি সুন্দর হওয়ার কোনো প্রোডাক্ট ব্যবহার করছো?”

আদ্য হাসিহাসি মুখে মেহুকে কথা গুলো ছুড়ে দেয়। মেহুর ইচ্ছে করছে হাতে থাকাটা ঝাড়ু দিয়ে কয়েক ঘা আদ্যকে দিতে।রাগটাকে আল্লাহ আল্লাহ বলে সামলে নিলো।তাড়াতাড়ি ঘরটা ঝাড় দিয়ে সোজা বেরিয়ে গেলো।আদ্য হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে।ইদানীং এ মেয়েটাকে জ্বালাতে আদ্যর খুব মজাই লাগে।তবে একটা বিষয় সে ভেবে পায় না রোজ সকালে মেহু যায় কোথায়?এ বিষয়টা এখনো আদ্য উদ্ধার করতে পারলো না!

অফিসের কাজ নিয়ে আদ্য খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে অন্য কোনো ভাবনা আপাতত তার মাথায় নাই। তবে আদ্যর কাজ যতই হোক তার নজর কিন্তু কখনো মেহুর ওপর থেকে সরে না।সুযোগ পেলেই সে মেহুকে এমন সব ফাঁদে ফেলে বেচারি ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা।

বেশ কয়েকদিন মারাত্মক গরম পরছে আর গরমের বেগ এতটাই যে মিনিট মিনিটে ঠান্ডা পানি শেষ হচ্ছে। আদ্য একটানা ঠান্ডা পানি খেয়ে এখন তার গলা আর নাকের অবস্থা যাচ্ছে তাই। বেচারা না কথা বলতে পারে না শান্তিতে বসতে পারছে।হাঁচি দিতে দিতেই সে কাহিল।এরমধ্যে মর্জিনা তাকে কতো ধরনের পানীয় দিয়েছে যাতে সর্দিটা একটু কমে কিন্তু সেটা হচ্ছে না।একটানা বেশি ঠান্ডা কারো জন্য সুখকর নয়।

আদ্যর ঘুম ভেঙেছে সাড়ে আটটায়।সে মাথা তুলতে পারছেনা। যেন মাথাটা মাথা নয় বড় একটা শিল পাথর যেটার ওজন কয়েক মণ।আদ্য অনেক কষ্টে ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলো।এক কাপ গরম চা পড়লে সকালের এ অশান্তি একটু হলেও কমবে।রান্নাঘরে গিয়ে আমেনা খালাকে চায়ের কথা বলে।আবার গিয়ে জিজ্ঞেস করে,

“খালা মর্জিনা কোথায়? ”

আমেনা খালা হকচকায়।কারণ আদ্য তো সহজে মর্জিনাকে নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করে না।কিছু প্রশ্ন এমন হয় যে হুট করে সেগুলোর উত্তর খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবুও কিছু একটা ভেবে বলতে হবে।

“আরে তুমি জানো না?ও তো ঐ বাইচ্চাটারে আনতে গেছে। চইলা আইবো একটু পর ক্যান বাবা?”

“না খালা এমনি জিজ্ঞেস করছিলাম।আচ্ছা খালা তুমি কি জানো ও কোথায় কাজ করে।”

এবার আমেনা খালা আরো চমকায়।ও কোত্থেকে জানবে মেহুর বিষয়। কি জিগায় এ পোলা?

“না বাবা আমি কেমনে জানমু।ও আইছে তো এ কদিন হইলো আমি জিগায় নাই। আমার কি ঠেকা পড়সে? ”

“তবুও খালা একসাথে যখন আছো জেনে নিবে ও কোথায় কাজ করে।”

“আইচ্ছা জিগামু নে।তয় তোমার কি হইছে,বেশি খারাপ লাগতাছে নি?আপারে কমু ডাক্তার ডাকতে?”

“না খালা আমি ঠিক আছি।এতক্ষণ যতটা খারাপ লাগছিল চা খাওয়ার পর সেটা কমেছে।”
,
,
,
চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here