সেলাই মেশিন
(২)
কোনো জবাব দিলো না মৌরি, ম্লান হেসে বড় ফুফুর পাশে বসলো। নামাজ পড়ে তসবি জপছিলেন তিনি। মৌরির মা শাহেদা বিরাট এক ট্রেতে অনেকগুলো চায়ের কাপ নিয়ে ঢুকলেন, পেছনে ঝুনুর হাতে হাফ প্লেট ভর্তি টোস্ট বিস্কুট। সবার দিকে চায়ের কাপ এগিযে দিলেন শাহেদা কিন্তু বড় ফুফু চায়ের কাপ না নিয়ে মুখ কালো করে ঘুরিয়ে নিলেন। সেটা দেখে চাচী ঠোঁট চেপে হাসলো। শাহেদাও ননাসকে পুছলেন না, চায়ের কাপ একে একে সবার হাতে ধরিয়ে দিলেন, সাথে একটা করে টোস্ট বিস্কুট দিলো ঝুনু। মহিলাদের চা দিয়ে বসার ঘরে ছেলেদের চা দিতে চলে গেলেন। মা আর বড় ফুফুর মাঝে কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে, বোঝা যাচ্ছে। মৌরি একবার ভাবলো ঝুনুকে জিজ্ঞেস করবে, কিন্ত পরে মনে হলো এত কৌতূহল দেখানোর কিছু হয়নি।
বড় ফুফু, চাচী, চাচা সবার হাতে সস্তার শ্যাম্পু সাবান তুলে দিলো মৌরি। এরচেয়ে বেশি কিছু কেনার সামর্থ তার নেই আর দাদির মৃত্যুর খবর শুনে শপিং করার চিন্তাও হয়নি। আসার আগের দিন আদনান বললো, “এতদিন পরে দেশে যাচ্ছ, টুকটাক কিছু নিয়ে যাও। সবাই তোমার সাথে দেখা করতে আসবে, কিছু হাতে না দিলে চলে?”ওই শুনে বাসার পাশে সুপারমার্কেট থেকে সামান্য কিছু কিনেছে। মুরব্বিদের ওসব দিতে বেশ কুন্ঠা লাগছিলো, কিন্তু কী আর করবে।
সবাই চলে যাওয়ার পরে ঝুনুকে ছোট ফুফু ফোন করলেন। এই পরিবারে ছোট ফুফুর প্রভাব একটু বেশিই। বড়লোক বাড়িতে তার বিয়ে হয়েছে, ফুফা মস্ত ইঞ্জিনিয়ার, শহরে বিরাট এক বাংলোতে থাকেন, মাঝে মাঝেই বিদেশে বেড়াতে যান। ছোট ফুফুর জানাশোনাও অনেক বেশি। মৌরির বিয়েটা তিনিই ঠিক করেছিলেন। রুনুর বিয়েও তিনি দিতে চেয়েছেন কিন্তু বাবা দুম করে কোন এক ছেলেকে পছন্দ করে রুনুর বিয়ে দিয়ে দিলো।
ছোট ফুফু ফোন করে জানতে চাইলেন বড় ফুফু বিদায় নিয়েছেন কিনা। সব জেনে রুনুকে ওর শশুড় বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে মৌরিকে দেখতে এলেন। বড় ফুফুর মতো ছোট ফুফুও শাহেদাকে এড়িয়ে গেলেন, কোনো কথাই বললেন না। শাহেদাও এমন ভাব দেখালেন যেন কেউ কথা না বললে তার কিছুই যায় আসে না। ছোট ফুফু বাড়িতে ঢুকেই বেশ হাঁকডাক শুরু করলেন। একগাদা মিষ্টি আর বিরিয়ানি নিয়ে এসেছেন মৌরি আর আদনানের জন্য। বিয়েটাতো তিনিই করিয়েছেন, কয়েকবার সেটা শোনালেন। মৌরিকে তো বলেই ফেললেন, “এই সোনার টুকরা ছেলের সাথে বিয়া দিছিলাম বলেই এই মরার দেশ ছাইড়া বিদেশে আরামে আছিস। আছে এই পরিবারের কেউ, যে বিদেশে পড়ালেখা করছে, বিদেশে থাকে? নাই। থাকবো ক্যামনে, ধইরা ধইরা যার তার সাথে বিয়া দিলে কপাল তো পুড়বোই।”
শেষের কথাটা রুনুর উদ্দেশ্যে বলা। তার শশুর বাড়ির অবস্থা খুব একটা ভালো না, কিছুদিন আগে নাকি তার বরের চাকরি চলে গেছে। ছোট ফুফুর কথা শুনে রুনু মাথা নিচু করে থাকলো। রুনু এমনিতে যথেষ্ট মুখরা মেয়ে। ছোট বেলা থেকেই ওর এই বাজে স্বভাব ।আজকে একেবারে ভেজা বিড়াল হয়ে গেছে যেন। মৌরি কথা ঘুরিয়ে বললো, “আপনি এত দেরি করে এলেন কেন ফুফু? সন্ধ্যায় সবাই ছিল, কত গল্প করলাম । তখন এলে সবার সাথে দেখা হতো। আপনার এত মিষ্টি আর বিরিয়ানি সবাই খেতে পারতো। বড় ফুফুর নাতি অলি কী সুন্দর হয়েছে! ও খুব মিষ্টি পছন্দ করে। বাসায় কোন মিষ্টি নেই, তাই তার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। এই মিষ্টি পেলে অলি খুব খুশি হতো।”
বড় ফুফুর কথা শুনেই ছোট ফুফুর চেহারায় বিরক্তির ছায়া পড়লো।
“থাক, এত পিরিতের দরকার নাই। আমি ইচ্ছা করেই দেরি করে আসছি। তোর বড় ফুফুর লগে দেখা করনের কোন ইচ্ছা আমার নাই।”
ছোট ফুফুর মেজাজ সেই যে খারাপ হলো, সেটা আর ভালো হলো না। বাবা এসে কিছুক্ষন গল্প করলেন, তবুও তার মুখ শক্ত হয়ে রইলো।
ছোট ফুফু চলে যাবার পরে মৌরির রুমে এলো রুনু ঝুনু। আদনান তখন বসার ঘরে বাবার সাথে গল্প করছে।
রুনু হাসি হাসি মুখে বললো, “বিদেশ থেকে কী আনছো আপা? ভালো কসমেটিক্স আনছো? ফাউন্ডেশন?”
মৌরি এক গাল হেসে বললো, “ওসব মেকআপের আমি কিছু বুঝি যে আনবো ? তাছাড়া ফাউন্ডেশন যার যার চামড়ার রংয়ের সাথে মিলিয়ে কিনতে হয়, আমার গায়ের রং কি আর তোদের মতো? তোরা কত ফর্সা। আমার রঙের সাথে মিলিয়ে ফাউন্ডেশন আনলে তোদের চলতো?”
গায়ের রংয়ের তুলনা শুনে রুনুর মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো। সত্যি তো, ও কত ফর্সা, সুন্দর।
“তাহলে কিছু আনো নাই?”
“হুম এনেছি , তোদের জন্য মুখের ক্রিম আর শ্যাম্পু আছে। চকলেটও এনেছি। রুনুর জামাইয়ের জন একটা ঘড়িএনেছি।”
উপহার সামগ্রী সুসকেস থেকে বের করলো মৌরি। রুনু ঝুনু অসীম আগ্রহে সুটকেসের দিকে তাকিয়ে রইলো যেন গুপ্তধনের খাজনা খোলা হচ্ছে। স্টুডেন্ট ইউনিয়নের এক কুইজ প্রতিযোগিতায় ওই ঘড়িটা জিতেছিল আদনান, ওটাই রুনুর জামাইকে দেয়ার জন্য নিয়ে এসেছে। নতুন জামাইয়ের মুখ দেখে কিছু না দিলে হয় না। দাদির মৃত্যুতে মুষড়ে থাকলেও সময় মতো এসব সামাজিকতা রক্ষা করে লাগবে, মৌরি জানতো।
ঝুনু জিনিসপত্র নিয়ে মাকে দেখাতে চলে গেলো। রুনু মৌরির হাত ধরে ফিসফিস করে বললো, “তোমাদের জামাইয়ের খুব পারফিউমের শখ ,পারফিউম আনছো ?
মৌরি অপ্রস্তুত হলো। ইউরোপে পারফিউমের অনেক দাম, উপহার হিসেবে ওই জিনিস দেয়ার মতো অবস্থা ওর নেই। আদনানের প্রায় নতুন একটা পারফিউমের বোতল বের করে রুনুর হাতে দিয়ে মুখ রক্ষা হলো।
“আপা, আমার শাশুড়ির জন্য কিছু দিতে পারবা? মহিলার খুব বিদেশী জিনিসের লোভ। অন্য কিছু না দিলে আমার জিনিসগুলাতে ভাগ বসাইতে পারে।”
কী আর করবে মৌরি , রুনুকে আরেকটা সাবানের সেট বের করে দিলো। রুনুর চোখে কৃতজ্ঞতার শিশির চিকমিক করে উঠলো যেন। হঠাৎ খপ করে মৌরিকে জড়িয়ে ধরে বললো, “আপা, তুমি অনেক ভালো। জীবনে তোমাকে অনেক কষ্ট দিছি। মাফ করে দিও।”
মৌরি আন্তরিক ভাবেই বললো, “আমি কি আর ওসব নিয়ে বসে আছি? আমি যদি কোন কষ্ট দিয়ে থাকি, তুইও ভুলে যাস ।”
“না না, তুমি আবার কী কষ্ট দিলা? সৎ বোন হয়েও অনেক করছো।”
“এই পাগল, সৎ বোন আবার কি রে? এগুলা বলিস না। আচ্ছা বাড়িতে এসেই মনে হলো কী একটা যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব। মা আর ফুফুরা একজন আরেকজনের সাথে কথা বলে না, মুখ দেখে না, ঘটনা কী, জানিস?”
রুনু চোখ কপালে তুলে বললো, “ওমা! তুমি এখনও কিছু শুনো নাই? আচ্ছা আমি বলতেছি।”
(ক্রমশ)