সেলাই মেশিন (১)

সেলাই মেশিন
(১)
তিন বছর পর দেশে এসেছে মৌরি। পাঁচ বছর আগে বিয়ের পর সেই যে সুইডেন চলে গিয়েছিলো, তারপর একবার এসেছে দেশে, ঈদ করতে। ওইবার দেশ থেকে যাওয়ার সময় নিজের সাথে প্রতিজ্ঞা করেছিল, দেশে আর আসবে না। কিন্তু তার দাদির মৃত্যুর খবর পেয়ে মনটা আর কোন শাসন মানলো না। কেন জানি মনে হলো দাদির কবরের পাশে একবার গিয়ে দাঁড়াতেই হবে। ছোটবেলা থেকে এই দাদিই তো ওর সবচেয়ে কাছের মানুষ, মানুষটা পৃথিবী বিদায় নিলো অথচ এত দূরে থাকে যে চাইলেও শেষবারের মতো দাদির মুখটা দেখতে পারলো না। আদনানকে অনেক বুঝিয়ে ক্রেডিট কার্ডে প্লেনের টিকেট কেটে তবেই দেশে আসতে পেরেছে। ওরা দুজনই পিএইচডির ছাত্র ছাত্রী, অনেক হিসেবে করে দিন পার করে। তার মাঝে দুজনকেই দেশে অল্প হলেও টাকা পাঠাতে হয়, হাত ভরা টাকা কখনোই থাকে না। এমন হুট করে দেশে আসার পরিকল্পনা করা ওদের সামর্থের বাইরে। কিন্তু মৌরির বারবার দাদির কথা মনে পড়ে। ফোনে কথা হলেই বলতো, “ও মৌ, তোরে কি আর দেখতে পারুম না?” মৌরি ভিডিও কল করলেও দাদি সন্তুষ্ট হতো না। ওই একই কথা বলতো, “আমি মরলেও আসবি না? আমি মরলে একবার আসিস।”

বাড়িতে একজন মানুষের মৃত্যু হলে অতিথির সমাগম অনিবার্য। মৌরি বাড়িতে ঢুকেই দেখে তার ফুফু, চাচা চাচী আর কাজিনদের ভিড়ে বাড়ির ভেতর তিল ধরণের জায়গা নেই। দাদির মৃত্যুর সাত দিন পেরিয়ে গেলেও মেহমান সব বিদায় নেয়নি, মৌরি আসবে বলে সবাই এই বাড়িতে থেকে গেছে। ক্লান্ত আদনান আর মৌরিকে রুনু ঝুনুর রুমে থাকতে দেয়া হলো। বাড়িতে দুইটাই বেডরুম। একটায় মৌরির বাবা মা, আরেকটায় থাকতো ছোট দুই বোন রুনু ঝুনু। রুনুর বিয়ে হয়েছে বছর খানেক হলো, আঠারোয় পা দেয়া ঝুনুর জন্যও নাকি পাত্র দেখা হচ্ছে।

হাত মুখ ধুয়ে সামান্য খাবার খেয়ে বিছানায় পড়ে মরার মতো ঘুমালো ওরা দুইজন। অথচ মৌরি ঠিক করেছিল বাড়িতে ঢুকেই প্রথমে দাদির কবর দেখবে। দাদিকে মসজিদের পাশে কবরস্থানে কবর দেয়া হয়েছে, বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে। দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তিতে এতই ঘুম পেয়েছিলো যে সব ভুলে ঘুমিয়ে পড়লো, বাড়িশুদ্ধ আত্মীয়স্বজন কারো সাথেই ঠিক মতো কথা হলো না।

মৌরির ঘুম ভাঙলো সন্ধ্যায় মাগরিবের আজান শুনে। বুকের ভেতরটা কেমন মুচড়ে উঠলো ওই শব্দে। দাদি মিহি সুরে বলতেন, “ও মৌ, আজানের সময় মাথার চুল খুইলা বাইরে যাইস না। জ্বীনের নজর পড়বো।”
মৌরি হাসতে হাসতে বলতো, “না গো দাদি, আমার মতো কালো মেয়ের দিকে জ্বীনও নজর দিবে না।”
“এহ! কে কালা? আমার মৌ পাখি কত সুন্দর! ওই যে আসমানের চাঁদ, ঠিক সেই চাঁদের মতো সুন্দর। খবরদার, আর কোনোদিন নিজেরে কালা বলবি না। বললে একটা চটকনা খাবি।”

তার শ্যামল বরণ রূপ দাদির চোখে সবচেয়ে সুন্দর ছিল। শেষবার ঈদের সময় যখন এত কান্ড হলো, মৌয়ের চোখের পানি মুছে দাদি বলেছিলো, “কান্দিস না রে মৌ পাখি। এরপরে যখন আসবি, তোরে এর চেয়েও ভালো জিনিস গড়ায় দিমু।”

আহারে, দাদির সেই মায়াভরা কথাগুলো আর শুনবে না? চোখের কোলে জমে ওঠা অশ্রুবিন্দু আলতো করে মুছে ধীরে ধীরে খাট থেকে নেমে দরজা খোলে মৌরি। বসার ঘরে তখন পুরুষদের নামাজের আয়োজন চলছে। মায়ের ঘরে মহিলা আর শিশুদের কলরব। মৌরি ওই ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো খাটের ওপর ঘোমড়া মুখে বড় ফুফু বসে আছেন। তার চাচি একগাল হেসে বললে, “এতক্ষনে ঘুম ভাঙছে? আমরা তো মনে করছি তোমার সাথে আর দেখাই হইবো না। নামাজ পইড়াই চইলা যাবো ভাবতেছিলাম।”
“চাচী সরি। অনেক লম্বা জার্নি করে আসছি তো। গত দুই রাত ঘুম হয় নাই। তাই …..”
“থাক থাক। সবই বুঝছি। তুমি থাকবা কয়দিন?
“এক সপ্তাহ। আমার তো ক্লাস চলছে চাচী। এক সপ্তাহের জন্য কোর্স ম্যানেজারের কাছে ছুটি নিয়ে আসছি।”
“আর কত পড়বা মা? এইবার সংসারে মন দেও। এত বছর হইলো বিয়া হইছে, নাতি নাতনির মুখ দেখমু কবে?”

মৌরি ছোট্ট একটা নিঃস্বাশ ফেললো। এই প্রশ্নের সম্মুখীন হবে, আগেই ভেবেছিলো।

(ক্রমশ)

(একদিনে বেশি লিখতে পারি না, কাজের প্রচুর চাপ। কাজের ফাঁকে চুরি করে এদ্দুর লিখলাম, ধীরে ধীরে বাকিটাও লিখবো আশা করি। এটা ছোট গল্প)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here