সেলাই মেশিন (৪)

সেলাই মেশিন
(৪)

সেদিন সকালে বাবা তাকে এক মামার বাসায় রেখে এসেছিলেন। সন্ধ্যায় কাচুমাচু মুখে শাহেদাকে নিয়ে উপস্থিত হলেন। মামা মামী আগেই হয়তো সব জানতেন, মিষ্টি মুখ করিয়ে নতুন দম্পতিকে ঘরে তুলে নিলেন। রাতে পোলাও রোস্টের আয়োজন ছিল। কিন্তু মৌরির কেমন কষ্ট লাগছিলো, তার বাবা যেন আগের মতো নেই। কেমন লাজুক মুখে আড়ে আড়ে ওই মহিলার দিকে তাকাচ্ছে! মামী বললেন, “মৌরি, আজকে থেকে উনি তোমার মা। মায়ের কোলে গিয়ে বসো।”

মৌরি শক্ত হয়ে শাহেদার কোলে বসলো। কেউ বললেই মাত্র কয়েক মুহূর্তে সম্পূর্ণ অপরিচিত কাওকে মা হিসাবে মেনে নেয়া সম্ভব? অথচ মামা মামী বারবার বলতে লাগলেন, “মা বলে ডাক, গলা জড়িয়ে ধরো।” কেউ বুঝতে পারলো না মৌরির বুক ফেটে কান্না পাচ্ছে। এমন জোর জবরদস্তি করে মায়ের জায়গা অন্য কেউ দখল করতে পারে না।

সেদিন রাতে মৌরি আলাদা রুমে একা ঘুমাতে গেলো। বাবার পাশে শুয়ে এতদিন ঘুমাতে ঘুমাতে বাবার গন্ধে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল, একদিনের মধ্যেই বাবা তাকে সরিয়ে দিলো? বাবার গায়ের গন্ধ ছাড়া ও ঘুমায় কেমন করে? ছোট্ট মৌরি সে রাতে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়েছিলো, কেউ ওকে সান্তনা দিতে আসেনি।

শাহেদা মৌরিকে বকা দিতো, মারতো- এমনটা না। সময় মতো স্কুলে নেয়া আনা, খাওয়ানো সবই সে করতো কিন্তু বয়স কম হলেও মৌরি বুঝতো, তার নতুন মা এসব করতে অসম্ভব বিরক্ত বোধ করে। শীতল একটা দূরত্ব তৈরি করে রাখে যা অতিক্রম করার সাধ্য ছোট্ট মৌরির ছিল না। শাহেদাকে ও ভয় পেতো, আপন করে নিতে পারতো না। ওর ইচ্ছা করতো নতুন মায়ের মমতা পেতে, কিন্তু ওর চাওয়া অপূর্ণই থাকলো। বাবা যদি মৌরির জন্য বিশেষ কিছু করতো বা কিনতো, শাহেদা তারপর বেশ কয়েকদিন মৌরির সাথে কথাই বলতো না, মৌরি সামনে এলে মুখ ঘুরিয়ে রাখতো, যেন মৌরি বিরাট কোন অপরাধ করেছে। মৌরি একদিন শুনে ফেললো শাহেদা তার বাবাকে বলছে, “ওই মেয়ের জন্য সব খরচ কইরা ফেললে আমার বাচ্চাদের জন্য কী থাকবো? কয়দিন পরপর নতুন জামা, জুতা, জন্মদিনের কেক, এইসব কী?”
মৌরি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো বাবা ওর হয়ে কোনো কথাই বললো না। অফিস থেকে ফেরার পথে চকলেট আনা বন্ধ হয়ে গেলো, ছুটির দিনে বেড়াতে যাওয়াও বন্ধ হলো। মৌরি ধীরে ধীরে সব কিছুর সাথে মানিয়ে জীবন চালাতে শিখে যাচ্ছিলো। আগের মতো সব কিছু নিয়ে কষ্ট পায় না। বুঝতে পারে, ওকে নিয়ে বাবা আর নতুন মায়ের মাঝে মনমালিন্য সবসময় চলছে। বাসায় মন টেকে না মৌরির। স্কুল বন্ধ হলেই দাদির কাছে যাওয়ার আবদার জুড়ে বসতো আর বাবাও তাকে কিছুদিনের জন্য দূরে সরিয়ে স্বস্তি পেতো।

দাদির কাছে কাটানো ছুটির দিনগুলো মৌরির শৈশবের সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতি। দাদী তাকে এতটাই ভালোবাসতো, মনে হতো ও দেশের রাজকন্যা! দাদা বাজার থেকে কত কিছু কিনে আনতো, কত পদের রান্না যে দাদি করতো! দাদির পুরোনো সেলাই মেশিনে কত রকম জামা ওকে বানিয়ে দিতো।

তখন ও ক্লাস সিক্সে পড়ে। চিকেন পক্সে একেবারে নাজেহাল হয়ে গেলো সে বছর। মৌরির সামনে কিছু প্রকাশ না করলেও বাবা আর নতুন মায়ের মাঝে ঝগড়া তখন তুমুল। শাহেদার গর্ভে তখন রুনু। তার ধারণা এই অবস্থায় যদি মৌরির ছোঁয়াচে রোগ তাকে ধরে তাহলে অনাগত শিশুর বিরাট ক্ষতি হতে পারে। প্রতিদিনের অশান্তি ত্যেকে রক্ষা পেতে একদিন বাবা ওর ঘরে এসে বললো, “মা রে, এইখানে তুই ভালো থাকতে পারবি না। কয়দিন পরে তোর একটা ভাই বোন আসবো, তোর মা ব্যস্ত হইয়া যাইবো। তোরে দাদির কাছে রাইখা আসি?”

“কিন্তু আমার স্কুল? আমার সব বন্ধুদের ফালায় চলে যাবো?”

মৌরির হাত ধরে বাবা বলেছিলো, “তোর দাদি তোমাকে অনেক আদরে রাখবো রে মা। এইখানে তুই ভালো থাকবি না।”

মিশ্র অনুভূতি নিয়ে দাদির কাছে পৌছালো মৌরি। একদিকে দাদির কাছে পাকাপাকি থাকার আনন্দ আরেকদিকে স্কুলের বন্ধুদের ফেলে আসার কষ্ট। গ্রামের হাই স্কুলে মানিয়ে নিতে ওর খুব একটা কষ্ট হলো না। দাদি তাকে স্কুলে দিয়ে আর নিয়ে আসার জন্য এক ষণ্ডা মত লোক রেখে দিলেন, কবির নাম। দাদার জমিতে কাজ করতো লোকটা। মৌরি তাকে ডাকতো কবির চাচা। কবির কথা বলতে পারতো না ,কুচকুচে কালো গায়ের রং, বড় বড় উজ্জ্বল চোখদুটো ভাটার মতো জ্বলতো। মাথা ভর্তি চুল কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে। সকালে বাড়ির উঠানে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকতো কবির। মৌরি স্কুলে হেঁটেই যেত, পিছনে নিঃশব্দে হাঁটতে থাকতো কবির। স্কুল থেকে বেরিয়ে গেটের কাছের কবিরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতো। আবারো অস্বস্তিকর নীরবতায় মৌরির পেছন পেছন আসতো কবির। রাস্তায় কেউ মৌরির সাথে কথা বলার সাহস করতো না। বাজারের মধ্যে বাড়ি ফেরার রাস্তায় চায়ের দোকানে অল্প বয়সী ছেলেপিলেরা আড্ডা দিতো। তারা মৌরির দিকে ঘুরেও তাকাতো না, কবিরের ভয়ে। এই জন্যেই কবিরকে এই কাজের দায়িত্ব দিয়েছিলেন দাদি।

এর কিছুদিন পরেই মৌরি জানতে পারলো তার একটা বোন হয়েছে। মৌরির খুব আনন্দ লাগছিলো। ছোট্ট একটা বাচ্চার সাথে ও সময় কাটাবে, খেলবে, ভাবতেই ওর কিশোরী মন বাবার কাছে যাওয়ার জন্য ছটফট করছিলো। দাদি তখন সেলাই মেশিনে ছোট বাবুদের জামা বানাতে বসলেন, কয়দিন পরে ছেলের বাড়িতে যাবেন সদ্যজাত নাতনীকে দেখতে, তার আয়োজন। মৌরি তখন বললো বোনের জন্য ও নিজের হাতে জামা বানাবে। ওই প্রথম দাদির কাছে সেলাইয়ের হাতে খড়ি।

দাদি দাদার সাথে বাসায় ফিরেছিল মৌরি। এসে দেখে ওর পুরোনো ঘরটা পুরোপুরি বদলে ফেলা হয়েছে। দেয়ালের রং বদলে গেছে, খাট সরিয়ে তোষক পেতে রাখা হয়েছে। মৌরির ছোট্ট খাট নিয়ে যাওয়া হয়েছে শাহেদার ঘরে, রুনুর জন্য আলাদা জায়গা দরকার। শাহেদা রুনুকে কোলেই নিতে দেয় না, মৌরি নাকি কোলে নিতে পারবে না। মৌরি সারাদিন বাবুর পাশে ঘুরঘুর করে, কিন্তু রুনুকে কোলে নেয়ার সুযোগ পায় না। একদিন বিকেলে শাহেদা ঘুমাচ্ছিলো, রুনু ছিল দাদির কাছে। দাদি বললো নামাজ পড়বে, মৌরি যেন কিছুক্ষন বাবুকে দেখে। মৌরি মহা আনন্দে রুনুকে কোলে নিয়ে বারান্দায় চেয়ারে বসে রাজ্যের গল্প জুড়লো, গ্রামের গল্প, স্কুলের গল্প, কবির চাচার গল্প, যেন ছোট্ট রুনু ওর সব কথা শুনছে আর বুঝতে পারছে। চেয়ার পেছন দিকে দুলিয়ে গল্প করতে গিয়ে ঘটলো বিপত্তি।

(ক্রমশ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here