সেলাই মেশিন ————- (৮)

সেলাই মেশিন
————-
(৮)
————-
দাদার মৃত্যুর সংবাদ শুনে মৌরি এক মুহূর্ত দেরি করেনি, ছুটে গিয়েছে দাদির কাছে। গ্রামের বাড়িতে তখন অনেক মানুষের ভিড়। বাবা চাচা ফুফুরা সবাই চলে এসেছেন। মৌরি অতি পরিচিত হাসিখুশি দাদি পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিলেন। এতদিনের জীবনসঙ্গী হঠাৎ এভাবে হুট করে চলে গেলে মানসিক ভাবে বিদ্ধস্ত হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। মৌরি সারাক্ষন দাদির কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করলো। দাদার দাফন ঠিকঠাক মতো শেষ হওয়ার পরে ধীরে ধীরে সবাই বিদায় নিচ্ছিলেন, এর মাঝে বড় ফুফু বললেন, “এতদিন মৌরি মায়ের কাছে ছিল, ওইটাই ভালো ছিল। জিদ কইরা ঢাকায় গেলো, পইড়া বড় অফিসার হইবো। মাইয়াগো এত সাহস ভালা না। মৌরি, তুই আবার মার কাছে চইলা আয়। মা কি এইখানে একলা থাকবো নাকি? তুই থাকলে দেখাশুনা করতে পারবি।”

এমন অন্যায় নির্দেশের বিরুদ্ধে মৌরি কী বলবে ভেবে পেলো না। দাদিকে দেখাশোনা করতে তার কোন আপত্তি নেই, কিন্তু তার তো এখন পড়ালেখা করার সময়। অথচ তার হয়ে কেউ কিছু বললো না, এমনকি বাবাও না। শেষে দাদি বললেন, “মৌরিরে এর মইধ্যে টানোস ক্যান? ও এইখানে থাইকা কী করবো? ক্ষেতে কাম করবো? আমি একলাই সব সামলাইতে পারমু। ও ঢাকায় গেছে পড়তে, পড়ুক।”
“মাইয়া মানুষ এত পড়ার দরকার আছে মা? ওই তো জামাইয়ের ঘরে গিয়া সংসার করবো।পড়া কোন কামে লাগবো?” ছোট ফুফু যোগ করলেন।
“সংসার করার সময় করবো। লেখাপড়া করতেছে অহন, করুক। পড়া নষ্ট কইরা আমারে পাহারা দিতে হইবো না। গেরস্তি দেখার জন্য কামলা লোকজন আছে, কবির আছে। আমি পারমু।”
সবাই চলে যাওয়ার পরে মৌরি দাদির কাছে আরো কয়েকদিন থাকলো। এমন মায়া হচ্ছিলো দাদির জন্য! হঠাৎ করেই মানুষ কেমন একা হয়ে যায়! দাদির সাথে সারাদিন কথা বলেছে মৌরি, একা হতে দিতে চায়নি। ওর সাধ্য থাকলে দাদিকে নিজের সাথে ঢাকায় নিয়ে আসতো। এদিকে বেশিদিন গ্রামে থাকাও সম্ভব না , পুরোদমে ক্লাস চলছে, সামনে আবার পরীক্ষা। শেষে দাদি নিজেই বললেন, “আর কতদিন এইখানে থাকবি? তোর কেলাস শুরু হইছে না? আমারে নিয়ে চিন্তা করার দরকার নাই, তুই যা।”

হলে ফিরে আসার জন্য গোছগাছ করতে করতে দাদিকে হলের বন্ধুদের গল্প করছিলো। গল্পের বিষয় – হলে কেমন খাবার হয়, কেমন করে একজনের কাপড় আরেকজনের কাপড়ের সাথে মিশে মজার সমস্যা তৈরী হয়, কিভাবে সকালে বাথরুমে লাইন লেগে যায় ইত্যাদি। একসময় হলের মেয়েদের কাপড় সেলাই করার গল্পও করলো। শুনে দাদি হঠাৎ বললেন, “তুই আমার সেলাই মেশিনটা নিয়া যা। ওইটা তোর কাছে থাকলে সুন্দর মতো সেলাই করতে পারবি।”
“কী বলেন দাদি? ওইটা নিয়ে গেলে আপনে ক্যামনে সেলাই করবেন?”
“আমি কি আর অহন সেলাই করতে পারি? চোখে দেখি না ঠিক মতো না। সেলাই করা কষ্ট। তারচেয়ে তুই নিয়া যা।”
“সত্যি নিমু?”
“হ, নিয়া যা। কবিররে বললে বাসে উঠায় দিবো। ঢাকায় গিয়া একটা কুলিরে বলবি রিকশায় উঠায় দিতে। এত ভারী জিনিস তুই একলা নিতে পারবি না।”

দাদির সেলাই মেশনটা যেমন ভারী তেমনই ভালো মানের ছিল। সিঙ্গার ব্যান্ডের মজবুত সেলাই মেশিনটা নাকি দাদির বাবা বিয়ের সময় তাকে কিনে দিয়েছিলেন । ফুফুরা কেউ সেলাই শিখতে পারেনি, শিখেছে মৌরি। দাদির কথা মতো সেলাই মেশিন নিয়ে হলে চলে এলো। হলের মেয়েরা উত্তেজিত হয়ে গেলো মৌরির সেলাই মেশিন দেখে। সবার ভাবখানা এমন যে, মৌরির সেলাই মেশিন থাকা মানে সবার মুশকিল আসান।

দাদার মৃত্যুর পরে আরেকটা দুঃশ্চিন্তা ভর করলো, এখন পড়ার খরচের টাকা কিভাবে আসবে? দাদিকে কিছুইতেই এই অবস্থায় টাকা চাওয়া যাবে না। বাবার কাছেও না। তাহলে উপায় কী ? মৌরি ভাবছিলো দুই একটা টিউশনি জোগাড় করে নেয়া যায় কিনা। শিমলা বুদ্ধি দিলো মেয়েদের কাপড় সেলাই করে দেয়ার কাজটার জন্য মৌরি টাকা নিতে পারে। ভালো বুদ্ধি কিন্তু তাতে খুব বেশি টাকা আয় করা সম্ভব না বলেই মনে হলো। হলের মেয়েরা কেউ এত বেশি অর্থশালী না যে নিয়মিত কাপড় বানায়। কাজেই এখানে সেলাই করে খুব বেশি আয়ের আশা করা দুরাশা।

ঢাকায় তখন দেশীয় কাপড়ের বেশ কিছু বুটিক গড়ে উঠছিলো। ক্লাসের এক বন্ধুর পরামর্শে তার পরিচিত এক বুটিকের মালিকের সাথে যোগাযোগ করলো মৌরি। মৌরির সেলাইয়ের প্রশংসা আগেই সেই বন্ধু করেছিল। বুটিকের মালিক সেই ভদ্রমহিলা মৌরির সাথে কথা বলে সন্তুষ্ট হলেন। নিজের সেলাই করা কিছু কাপড় দেখালো মৌরি। প্রতিদিন বিকেলে বুটিকের কারখানায় সাধারণ সেলাইকর্মীদের সাথে সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করতে শুরু করলো ও।

কারখানা তেজগাঁওয়ের এক ঘুপচি বাড়িতে। চাকরির পদবি সুপারভাইজার হলেও মৌরিকে আসলে কাটিং সেলাই ফিনিশিং সবই করতে হতো। প্রথমে গিয়ে দেখে সব সেলাই কর্মী নিতান্তই আনাড়ি। কাটিং সেলাইয়ের খুব সাধারণ বিষয় ছাড়া তেমন কিছুই জানে না। মৌরীও অল্প বয়সী বাচ্চা মেয়ে, পুরুষ কর্মীরা তার কথা শুনতেও চায় না। কিন্তু মৌরীও হাল ছাড়লো না। নিজের দক্ষতা আর বুদ্ধি এমন ভাবে প্রদর্শন করলো , বয়স্ক লোকগুলো ধীরে ধীরে বুঝতে পারলো মৌরির বয়স কম হলেও কাপড় কাটিং আর সেলাই বোঝার ক্ষমতা অনেক বেশি। বুটিকের মালিক বেশ কিছু ফ্যাশনের ম্যাগাজিন গছিয়ে দিলো। মৌরি অবসর সময় লাইব্রেরিতে না বসে সেসব ম্যাগাজিনে নানান ডিজাইন দেখে। বিদেশী জামা দেখে ধারণা করার চেষ্টা করে কিভাবে কাপড় কাটলে আর সেলাই করলে ওরকম কিছু বানানো সম্ভব। দুই একটা কাপড় পরীক্ষামূলক ভাবে বানিয়েও ফেললো। বুটিকের ডিজাইনাররা তার সাথে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করতে শুরু করলো। কারণ মৌরিকে কাটিং ডিজাইন আর সেলাইয়ের নিয়ম বুঝিয়ে দিলে খুব সহজেই সেটা ধরে ফেলে আর বাকি কর্মীদের ভালো করে বুঝিয়েও দিতে পারে। সেলাই কর্মীদের সাথে তাদের মতো করে কথা বলা মৌরির জন্য খুব সহজ কাজ যেটা ডিজাইনাররা পারতো না।

মৌরির ব্যস্ততা দ্বিগুন হলো। সেইসাথে নিজে আয় করার স্বাধীনতার আনন্দ পেয়ে গেলো। ওদিকে মৌরিকে অবাক করে প্রতি মাসে অল্প হলেও টাকা পাঠায় দাদি। বাবাও মাঝে মাঝে টাকা পাঠায়। মৌরিকে এখন আর এত চিন্তা করে খরচ করতে হয় না। নিজের জন্য সুন্দর কাপড় জুতো কিনতে পারে। মাঝে মাঝে বান্ধবীদের মতো পার্লারে যায়। একটা সুন্দর মোবাইল ফোনও কিনে ফেলেছে। এভাবে সেকেন্ড ইয়ার পার করে ফেললো সে।

দ্বিতীয় ধাক্কা এলো তখন। দাদার অবর্তমানে দাদির ভরসার জায়গা ছিল কবির চাচা। হঠাৎ করে দুই দিনের জ্বরে কবির চাচা চির বিদায় নিলেন। মৌরি আবারও গ্রামে গেলো। দাদি এই দুই বছরে আরো অনেকটা বুড়ো হয়েছেন যেন। মৌরি ছুটি পেলেই আগের মতো দাদিকে দেখতে গ্রামে যেতে পারতো না, কাজের জন্য। দাদিকে দেখে কেমন অপরাধবোধে আচ্ছন্ন হলো মৌরি। নিজেকে নিয়ে এতই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে দাদিকে অবহেলা করা হয়েছে। দাদি আরো মুষড়ে পড়েছেন। দেখে মনে হচ্ছে কোন রোগ হয়তো তার শরীরে বাসা বেঁধেছে কিন্তু সেটাকে এড়িয়ে চলছেন, বাইরে সবাইকে দেখাচ্ছেন তিনি ভালো আছেন।

মৌরি বুঝতে পারছিলো এভাবে একা একা গ্রামে চাষাবাদ দেখাশোনা করা দাদির জন্য কঠিন হবে। দাদিকে দেখাশোনার লোক দরকার। ছোট ফুফুর আর্থিক অবস্থা সবার মধ্যে সবচেয়ে ভালো। কিছুদিন আগেই ফুফু ঢাকায় চলে এসেছেন। এখানে কৃষিকাজের পাট চুকিয়ে দাদি যদি ফুফুর কাছে গিয়ে থাকে, তাহলে মৌরিও নিয়মিত দাদিকে দেখতে পারবে। দাদিকে এই প্রস্তাব দিলো। কিন্তু দাদিও কি কম জেদি? কিছুতেই ছেলে মেয়েদের বাসায় যাবেন না।

“ক্যান? আমার নিজের ঘর বাড়ি আছে না? অগো গলার কাটা হইতে ক্যান যামু?
“গলার কাটা হইবেন ক্যান দাদি? এইখানে একলা থাকলে আপনি আরো অসুস্থ হইয়া যাইবেন। ঢাকায় গিয়া থাকলে আমি সবসময় আপনারে দেখতে যাইতে পারমু, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাইতে হইলে নিয়ে যামু। এইখানে এত দূরে তো চাইলেও আসতে পারি না।”
“আসনের দরকার নাই। থাক তুই তোর মতো।” অভিমানে বুজে আশা কণ্ঠে দাদি বলেন।
“দাদি, এমন অবুজের মতো ক্যান করেন? বাপ মা বুড়া বয়সে ছেলে মেয়েদের কাছে যাইবো নাতো কার কাছে যাইবো ?”
“আমি কি বুড়া নাকি?”
এবার মৌরি হেসে ফেললো, “না, আপনে বুড়া না। আপ্নে বুড়ি। আর জিদ কইরেন না দাদি। চাচারে বলেন এইখানে জমিজমার একটা ব্যবস্থা কইরা দিতে, উনি এগুলা ভালো বুঝে। তারপর আপনে ঢাকায় চইলা আসেন।”
“এত বুড়ি হয় নাই এখনো। আচ্ছা তুই যা। আমি ভাইবা দেখি।”

ভাবতে ভাবতে দাদির এক বছর লেগে গেলো। পুকুর ঘাটে পিছিলে পড়ে যখন কোমরের হাড় ভেঙে গেলো, তখন তার মনে হলো গ্রামের বাড়িতে একা থাকা আর সম্ভব না। দাদির সব ছেলে মেয়েরা মিলে সিদ্ধান্ত নিলো দাদি ঢাকায় ছোট ফুফুর বাসায় থাকবে। ছোট ফুফু সে সিদ্ধান্ত সাদরে গ্রহণ করেছে কিনা, মৌরির সন্দেহ আছে। তবুও দাদি এখন থেকে ঢাকায় থাকবে, চাইলেই দাদিকে একবেলার জন্য কাছে পাওয়া যাবে, এই আনন্দে মৌরি ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল।

(ক্রমশ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here