স্বপ্নচূড়ার আহবান ‘ পর্ব-২০

0
975

“স্বপ্নচূড়ার আহ্বান”
পর্ব-২০

টানা তিনটি ক্লাস করে গরমে তিক্ত হয়ে মুখে টিস্যু দিয়ে মুছতে মুছতে বের হলো নীলাংশ। তার পেছনে আরেকটা ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট নিনিকা। সেও ক্লাস টপার। দুজনের বেশ ভালো সম্পর্ক। নীলাংশের ক্ষেত্রে সেটা শুধু মাত্র বন্ধুত্ব হলেও, নিনিকার পক্ষে থেকে বেশি। নীলাংশ মাঝে মধ্যে কথা বলছে দুই একটা। বেশিরভাগ সময়ই নিনিকার মুখ চলছে ৷ নীলাংশের কাছাকাছি থাকলে তার মুখটা একটু বেশিই চলে। নাহলে, খুব বেশি কথা বলেনা। নীলাংশ ভার্সিটির ক্যান্টিনে গিয়ে দাঁড়ালো৷ তিতিক্ষা, নিশান, তেজসী, তমাল, প্রবীর এরা প্রথমের ইম্পর্টেন্ট ক্লাসটা সেরেই আগেভাগে আড্ডা দিতে বের হয়েছে। আর কারিমা আজ বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঘুরতে বেরিয়েছে। নতুন নয়, প্রায়ই এমন করে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে চলে যায়। বন্ধু বান্ধব থাকায় তেমন সমস্যা হয়না। প্রবীর গেটের দিকেই ছিলো৷ তেজসী নিশানের কাঁধ হেলান দিয়ে বসে ছিলো৷ যেমন তাদের ঝগড়া হয় তেমন মিলও হয়। একটু আগেও নিশান তাকে অতিরিক্ত লিপস্টিক দেয়ায় খোঁচা দিয়েছিলো। তেজসী ইচ্ছেমতো কিল ঘুষি দিয়ে সুদেআসলে প্রতিশোধ নিয়েছে ৷ নিশান কথা দিয়েছে তাঁকে নিয়ে ঘুরতে বেরোবে, সঙ্গে তার পছন্দের নিউ পারফিউমটাও কালেক্ট করে দেবে। সঙ্গে সঙ্গে তেজসী মিষ্টি করে হেঁসে টুপটুপ করে চুমু খেয়েছে গালে। ব্যস দুইজনেই টুকটাক রোম্যান্টিক কথাবার্তা বলছে। নিশান অবশ্য জানে, মেয়েটাকে কিছু কিনে দেয়ার সময় ঠিকই তাকে টাকা দিতে দিবেনা। কারণ, তেজসীও জানে নিশানের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। তেজসী বড়লোক বাবার বড় আদরের মেয়ে। নিশান তেজসীকে বিয়ের জন্য এখন থেকেই টিউশনি করে। অন্তত, যাতে কেউ বেকার না বলতে পারে। সম্পর্কের দুই বছর। দুজনের মধ্যে যেমন ঝগড়া হয় তেমনই ভালোবাসাও আছে।
প্রবীর ভালোবাসায় বিশ্বাসী নয়। প্রতি মাসেই দুই তিনটা মেয়েকে মুখের উপর না বলে মন ভাঙছে। আর তমাল হাজার চেষ্টা করেও গার্লফ্রেন্ড জুটাতে পারছেনা। সে তার ক্রাশ রোগেই সীমাবদ্ধ। ক্রাশ খাওয়ার পর প্রপোজ করছে। রেজাল্ট প্রতিবারই নেগেটিভ, তবুও সে থেমে নেই। ‘ভাগ্যে থাকলে হবেই ‘ এই কথায় মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়েই চলেছে। তিতিক্ষা মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। বাবা মা আগে থেকেই চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করে রেখেছে। তাই, অন্য কারো দিকে তাকানোর সুযোগ নেই।

নীলাংশের কল পেতেই প্রবীর সবাইকে নিয়ে ক্যান্টিনের উদ্দেশ্য হাঁটা ধরলো। কিছুক্ষণ পরই গিয়ে দেখলো নীলাংশ নিনিকা দাঁড়িয়ে আছে। নিনিকা কথা বলতে বলতে নীলাংশের দিকে প্রখর দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। প্রবীরসহ সবাই-ই আন্দাজ করতে পারে নিনিকার মনের কথা। কিন্তু তারা নিনিকাকে তেমন একটা পছন্দ করেনা। কারণ সে কারো সাথে কথা বলেনা৷ সবাইকে এড়িয়ে যায় নীলাংশ বাদে। প্রবীর গম্ভীর মুখে এগিয়ে আসলো৷ তমাল হ্যাংলার মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে নিনিকার দিকে তাকিয়ে বললো-
‘হ্যালো নিনিকা! ‘

নিনিকা একবার তাকিয়ে হালকা স্বরে বললো-
‘হায়। ‘

প্রবীর বিরক্ত হয়ে দাঁতে দাঁত চেপে তমালের মাথায় থাপ্পড় দিলো৷ তমাল মুখ ছোট করে বললো –
‘আমাকে মারলি কেন? ‘

প্রবীর চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো –
‘হ্যাংলামি কম কর। মেয়ে দেখলেই কুকুরের মতো জিহ্বা বের করে রাখতে হবে!’

তমাল মুখ কিড়মিড় করে বললো –
‘শালা! তোমার আর নীলাংশের পিছনে তো মাইয়ারা লাইন ধইরা থাকে! আমিই হইলাম কপাল পোড়া ‘

প্রবীর চুপচাপ সিটে বসতে বললো। তমাল মুখ পেঁচার মতো করে বসলো। পাশের দুটো সিটে নিশান, তেজসী, তার উল্টো পাশে তিতিক্ষা। নীলাংশ আর নিনিকা অপর পাশে। নিলাংশ আনমনে কিছু একটা ভাবছিলো। প্রবীর ভ্রু কুচকে বললো-

‘কীরে এতো কী ভাবিস? ‘

নীলাংশ চোখ তুলে তাকালো। চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। তিনটি ক্লাসে সাধারণত এতটাও হাঁপায় না নীলাংশ। প্রবীর আঙুল নাড়াচাড়া করতে করতে বললো –

‘ কী হয়েছে বলবি তো! ‘

নীলাংশের মুখের অবস্থা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তার মনের অবস্থা সম্পর্কে সেও অবগত নয়। তার হুটহাট ভালো লাগছে, আবার তড়িৎ গতিতে খারাপ হচ্ছে। যেনো মন নামক যন্ত্রের রিমোটটি অন্য কারো হাতে। যখন ইচ্ছে অন অফ করছে। এমন তো কখনো হয়না।
নিজের উপরে যে একটা হাস্যজ্জল আভাস তা সদা বিরাজমান থাকে, সেই আবরণের আড়ালে লুকিয়ে আছে ভিন্ন রকমের নীলাংশ। হয়তো সময়সাপেক্ষ তা বেরিয়ে আসতো। কিন্তু সেই সুযোগ নিজেকে দেয়নি।
মায়ের নিয়মে বড় হওয়া আলাদা তৈরি করে রেখেছে। প্রবীরের দিকে তাকিয়ে বললো-

‘নাথিং। শরীর খারাপ লাগছে একটু। ‘

বেস্ট ফ্রেন্ডই হোক। এত বড় হয়ে সে তো বলতে পারবে না, “আমার মনটা খারাপ লাগছে। শরীরে কিছু হয়নি। সব দোষ মনের৷ যন্ত্রে কোনো ভাইরাস সংক্রমণ করে আমার মনটাকে অনিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছে। সেই ভাইরাসকে চিনতে আমি অক্ষম! ‘

নীলাংশ দ্রুত কন্ঠে বললো-
‘তোরা থাক, বাসায় যেতে লেট হয়ে যাচ্ছে। মম অপেক্ষা করছে। ‘

প্রবীর সহ সবাই একদফা হেঁসে বললো –
‘মাম্মাস বয়! আর কিছুক্ষণ আমাদের সঙ্গে থাকলে কিছু হবে না। ‘

নীলাংশ মৃদুমন্দ হেঁসে চলে গেলো। তার পেছন পেছন নিনিকাও। বাকি সবাই কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলেও জানে নীলাংশ সবসময়ই তার মায়ের জন্য অস্থির থাকে। তাই আবারও আড্ডা শুরু হলো। নিনিকাকে পেছনে আসতে দেখে বললো-
‘তুমি কোথায় যাচ্ছো? ‘

নীলাংশের প্রশ্নে খানিকটা লজ্জিত হলো নিনিকা। ছেলেটা এতো বোকা কেনো! এত ব্রিলিয়ান্ট হয়েও তার মনের ভাষা বোঝে না। নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করে! নিনিকা কানের পিঠে চুলো গুঁজে মৃদু কন্ঠে বললো-
‘তোমাকে আজ খুব অস্থির লাগছে। কী হয়েছে তোমার? ‘
নীলাংশ স্বাভাবিক ভাবেই বললো-
‘কিছু হয়নি নিনিকা, আই এম ওকে। বাড়ি গেলেই ঠিক হয়ে যাবো। ‘

নিনিকা চোখ ছোট ছোট করে বললো –

‘বাসায় এমন কী আছে যে যাওয়ার জন্য এতো অস্থির হচ্ছো! ‘

নীলাংশ এক মুহূর্তে ভড়কে গেছিলো। ঠিকই সে কেনো অস্থির হচ্ছে বাড়ি যেতে! পরেই আবার নিজেকে সামলে নিলো। এমন কিছুই নয়। তার শুধুই শরীর খারাপ লাগছে । নিনিকার সন্দেহজনক চোখের দিকে তাকিয়ে হেঁসে বললো-
‘ আমার ব্যাক্তিগত জীবনের কৈফিয়ত মা বাবা ছাড়া কাউকে দিতে পছন্দ করিনা, আই থিংক ইউ নো দ্যাট ‘

গাড়ির দরজা খুলে ড্রাইভিং সিটের পাশে গিয়ে বসে ড্রাইভারকে দ্রুত গাড়ি চালাতে বলে চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে রইলো। গাড়ি শো শো আওয়াজে চলে যেতেই নিনিকা মুখ মলিন করে দাঁড়িয়ে থাকলো। নীলাংশের এই স্বভাব জানে সে। অন্যদের মতো কখনো চিল্লিয়ে রাগ প্রকাশ করে না। রাগ, আনন্দ, অভিমান সবকিছুই ঠান্ডা। হাঁসিতেই সকল কিছুর বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। এই মাত্র ঠান্ডা মাথায় যে নিনিকাকে অপমান করে গেলো। মুখ দেখে বোঝাও গেলো না।

_____________________

পায়রা সদ্য স্নান করে চুল খুলে রেখেছে। মাথায় কাপড় রাখেনি৷ গায়েই ওরনা রেখে মুখ পেচিয়ে রাখা।
ছাদ থেকে এসে নাস্তা খেয়ে চুপচাপ ব্যালকনিতে গিয়ে বসে ছিলো৷ নীলাংশের ধারের কাছেও যায়নি। সে আর কিছুই আশা করে না। আশা করলেই তো ভেঙে যায়। কী দরকার কারো উপর আশা করার। সে ঠিক করেছে সে স্বাভাবিক থাকবে। কাউকে নিজের মনের আভাস পেতে দিবেনা। কাউকে জানাবে তার ভালো লাগা, খারাপ লাগা। শুধু উদ্দেশ্য থাকবে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। কিন্তু সে যে পড়াশোনা শেষ করেনি। নাইনে পড়ুয়া মেয়েকে কে চাকুরী দিবে! অন্যের বাড়িতে থেকে কীভাবে বলবে ‘আমি পড়তে চাই, নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই ‘ । প্রথমত অন্যের টাকায় খাচ্ছে। তারপর কোনো কাজও করতে হয়না। ভেবে ভেবে আরও মন খারাপ হয় তার। কলিং বেলের আওয়াজে সদর দরজায় উঁকি দেয়। কাজের মহিলাটি দরজা খুলেছে। নীলাংশ মৃদু হেসে ভেতরে ঢুকে হাতা গুটিয়ে জুতোজোড়া গুছিয়ে জুতার বক্সে রেখে আসলো। এতো সুন্দর হাঁসে কেনো সুন্দর সাহেব! হৃদপিণ্ডের উপর চাপ অনুভব করে পায়রা। পরমুহূর্তেই নিজেকে ধিক্কার দিয়ে নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দেয়।
দুপুরে খাবারের টেবিলে সবার আগে এসে বসে নীলাংশ। সবাই অবাক হয়। নীলাংশ এত তাড়াতাড়ি খাওয়ার জন্য আসেনা। তানজিমা ভাবলেন হয়তো পড়াশোনায় চাপে ক্ষুধা লেগেছে। আয়মান সাহেব পায়রাকে তার পাশে বসালেন। ভালো মন্দ কথা বলতে বলতে খাচ্ছে। নীলাংশ খেতে খেতে আড়চোখে পায়রাকে দেখছে। মনে মনে হাঁসে, এইটুকু মেয়ের কত রাগ! পায়রা একবারও তার দিকে তাকায়নি। নীলাংশ মৃদু কেশে আয়মান সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললো-

‘বাবা, আমি একটা কথা বলতে চাই। ‘

আয়মান সাহেব মুখের খাবার শেষ করে বললেন –

‘বলো কী বলতে চাও। ‘

নীলাংশ গম্ভীর গলায় বললো –
‘আমি চাই পিচ্চি আবার পড়াশোনা শুরু করুক। গ্রামে থাকতে নাইন পর্যন্ত পড়েছে। সেখানে থেকে কাগজপত্র এনে এখানের একটা স্কুলে ভর্তি করলে আবারও পড়ার সুযোগ পাবে। আমি কী কিছু ভুল বললাম বাবা? ‘

চলবে……
আচ্ছা, কারো গল্প বোরিং লাগছে না তো?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here