স্বপ্নচূড়ার আহবান ‘ পর্ব-২১

0
967

“স্বপ্নচূড়ার আহবান”
পর্ব-২১

নীলাংশের এহেন কথায় আয়মান সাহেব বেশ আমোদিত হলেন। পায়রা সচেতন দৃষ্টিতে তাকালো।
বুকের মধ্যে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে কেউ গুণগুণ করে আনন্দের গান গেয়ে উঠছে ৷ চোখ টলটল করে উঠলো। নরম গোলাপের পাপড়ির ন্যায় অধর দ্বয়
আপন শক্তিতে হা হয়ে গেলো। নীলাংশ সেদিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। আয়মান সাহেব খুশমেজাজেই বললেন-
‘ঠিক কথা বলেছো মাই সান! আমিও ভাবছিলাম পায়রা মায়ের পড়াশোনা আবার শুরু করা প্রয়োজন।”

নীলাংশের চোখ মুখ উজ্জ্বল আভায় আলোকিত হলো। অবশ্য সে জানতো, তার বাবা পায়রার পড়াশোনার জন্য না করবেনা। আসল কথাটা হলো, মায়ের জন্য সে দ্বিধায় আছে। কিন্তুু তানজিমা কোনো কিছু বলছেন না। তিনি চুপচাপ খাবারের চামচটা দিয়ে
খাবার নাড়াচাড়া করছেন। নীলাংশ নিজের মুখে অল্প কিছু খাবার পুড়ে নিচুস্বরে বললো-

‘মম, তোমার এ বিষয়ে মতামত কী? ‘

তানজিমা নির্বিকার চিত্তে বললেন-
‘যা ভালো হয় করো। আমার কী বলার থাকবে? ‘

নীলাংশ মায়ের আপত্তি দেখতে না পেয়ে খুশি হলো।
ভেবেছিলো কাঠখড় পোড়াতে হবে। সে উৎফুল্ল হয়ে
চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মাকে পিছনে থেকে আলতোভাবে জড়িয়ে ধরলো। তানজিমা হাসলেন।
ছোট থেকেই কোনো কিছুতে নীলাংশ খুশি হলে এভাবেই জড়িয়ে ধরে। সবকিছুতেই চঞ্চলতার আভাস। স্বভাবে হাসিখুশি, মনেও সাদা। এজন্যই সবসময় আগলে রাখেন তিনি। কারণ, নীলাংশ সবার সাথেই সদ্ব্যবহার করে। কঠিন কথা বা আচরণ তার স্বভাবে রপ্ত হয়নি। রাগ হলেও নীলাংশ হাসে। মাঝে মাঝে ছেলের আচরণে ভয় পান তিনি। ঠান্ডা মানুষের রাগ ভয়ংকর হয়। একবার ছোটবেলায় ক্রিকেট খেলার সময় ওকে বোকাসোকা ভেবে দলের দুইটা ছেলে ওর সবচেয়ে পছন্দের ব্যাটটা ভেঙে দুই টুকরো করে ফেলেছিলো। ব্যাটটা যেমন তেমন পছন্দও ছিলো না, সেই ব্যাটটা নীলাংশের দাদাজান মারা যাওয়ার কয়েক দিন আগে কিনে দিয়েছিলেন৷ দাদাজানকে খুব ভালোবাসতো সে। যখন চোখের সামনে সেটা ভেঙে পড়েছিলো নীলাংশ হেঁসে ব্যাটটা তুলে নিয়ে মুছে জোড়া লাগিয়ে আলমারিতে তালাবদ্ধ করে দিয়েছিলো। ছেলেগুলো ভেবেছিলো হয়তো তাদেরকে ভয় পায় বলে কিছু করতে পারবেনা, তাই চুপ করে আছে৷ কিন্তু, ঠিক তার পরের দিন প্রথম ছেলেটার পছন্দের নতুন বাইসাইকেলটা ভাঙা অবস্থায় তাদের বাড়ির পেছনের দিকে পাওয়া যায়। আর দ্বিতীয় ছেলেটা স্কুল থেকে ফেরার পথে পড়ে গিয়ে আঘাত পেয়ে মাথা ফেটে যায়। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো কোনো ঘটনার সময়েই নীলাংশ সে জায়গায় উপস্থিত ছিলো না। কিন্তু ঘটনা ঘটার পর তানজিমার কাছে এসে মৃদু হেসে নিজের দোষ স্বীকার করে নিতো। তানজিমা অবাক হয়ে যদি জিজ্ঞেস করতো কীভাবে করলো এসব? নীলাংশ অতশত বলতো না। সেই ঘটনার পর তেমন কিছু দেখতে পাননি বলে। সম্বিত ফিরলো তানজিমার। নীলাংশ সামনের চেয়ারে গিয়ে বসে খাচ্ছে। নীলাংশের দিকে তাকিয়ে একটি প্রশ্ন করলেন –

‘নীল, তোমার সঙ্গে কী এই মেয়েটার পূর্ব পরিচয় আছে? ‘

নীলাংশ পানি পান করে বললো –

‘ইয়েস মম। ‘

‘কীভাবে? ‘

নীলাংশ মৃদু হেসে বললো –
‘পিকনিক থেকে আসার পথে বাস জার্নিতে পিচ্চি আমার পাশের সিটেই ছিলো। ‘

তানজিমা ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছেন। বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করছেন৷ পাশে রায়ানা ফট করে বললো-

‘ওও তো এজন্যই পিচ্চি বলে ডাকো! ‘

নীলাংশ তার দিকে তাকিয়ে বললো-

‘হুম। ‘

আয়মান সাহেব খাবার শেষ করে পানির গ্লাসটা হাতে নিতে নিতে বললেন –

‘ নীলাংশ, পায়রাকে কোন স্কুলে ভর্তি করালে ভালো হয় বলো তো? ‘

নীলাংশ ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভেবে বললো –

‘বাবা, আমার ভার্সিটির পাশেই যে স্কুলটা আছে সেখানে ভর্তি করালেই, আই থিঙ্ক ভালো হয়। ‘

আয়মান সাহেবও মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে বললেন –

‘তাহলে, তাই হোক। আমি রাসেলকে দিয়ে পায়রার আগের স্কুলের কাগজ পত্র আনিয়ে নিচ্ছি। ‘

খাবার শেষ হতেই সবাই নিজ নিজ কাজে বেরিয়ে গেলো। পায়রা রুমে বসে আছে। উত্তেজনায় হাত পা কাপছে। মুখে আনন্দের হাসি৷ আবার স্কুলে যাবে সে! নতুন বন্ধুবান্ধব হবে, জীবনের হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিগুলোকে নতুন রূপে ফিরে পাবে। মুখ চেপে খুশিতে কেঁদে ফেললো। দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হলো। পায়রা তড়িঘড়ি করে দেখলো। নীলাংশ হাত ভাজ করে দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে হৃদয়কাড়া মাতাল হাসি৷ পায়রার কৃতজ্ঞ মন কিঞ্চিৎ লজ্জ্বায় জুবুথুবু হয়ে রইলো। ইশ! সকাল থেকে সে যে রাগ দেখিয়েছে! তারপরও সুন্দর সাহেব তাকে পড়াশোনা করানোর জন্য রাজি করালো৷ নাহলে, পায়রা মুখ ফুটে কিছুতেই কথাটা কাউকে বলতে পারতো না।
নীলাংশ সামনে এসে দাঁড়িয়ে দুষ্টু হাসলো। পায়রা পারছেনা মাটির নিচে ঢুকে যেতে৷ কোনো রকমে বললো-

‘আপনেরে অনেক ধন্যবাদ সুন্দর সাহেব।’

হো হো করে হেঁসে উঠলো নীলাংশ। পায়রা আবারও লজ্জ্বায় লাল নীল হলো। উফ! এ যেনো নিঃশব্দে লজ্জ্বার তীর ছুড়ছে। নীলাংশের হাস্যজ্জ্বল মুখশ্রী এবার গম্ভীর হলো। সে মোটা কন্ঠে বললো-

‘তুমি তো দেখছি খুব স্বার্থপর! ‘

পায়রা হতবাক হয়ে তাকালো৷ বোধগম্য হলো না কিছু। সে কী করলো স্বার্থপরের! অসহায়ত্ব মাখানো দৃষ্টিতে বললো-

‘আমি কী করসি? ‘

নীলাংশ ভ্রু কুচকে বললো-

‘এই যে সারা দিন একটুও কথা বলোনি! এখন যেই শুনলে স্কুলের কথা অমনি ‘সুন্দর সাহেব’! ‘

পায়রার নিজেকে সত্যিই স্বার্থপর মনে হলো৷ মন খারাপের মেঘ দলবদ্ধ হয়ে হানা দিলো। পায়রার চোখ ভিজে উঠেছে। অশ্রুভেজা চোখে তাকিয়ে বললো-

‘আমারে মাফ করে দেন সুন্দর সাহেব! ‘

নীলাংশ ভড়কে গেলো। সে তো মজা করছিলো। মেয়েটা কেঁদে ফেলবে ভাবেনি। ধ্যাৎ! কী করে ফেললো আবার। বুকের ভিতর আবার সেই চিনচিন ব্যাথায় ভরে উঠছে। এই ব্যাথা এখনই থামাতে হবে। নাহলে জ্ঞান হারাবে সে। সযত্নে পায়রার মুখ থেকে ওড়নাটা সড়িয়ে চোখের জল মুছিয়ে দিলো। পায়রা হা করে তাকিয়ে আছে। হড়বড়িয়ে ওড়না দিয়ে আবারও মুখ ঢাকতে গেলেই নীলাংশ হাত আঁটকে বললো-

‘ মুখ ঢাকার কোনো প্রয়োজন নেই পিচ্চি! তোমার এক আকাশ সৌন্দর্যের মাঝে এই আবছা দাগ, সৌন্দর্যতে এক বিন্দুও ব্যাঘাত ঘটাতে পারেনি৷’

পায়রার বিস্ময়ে ভরা মুখটা উপভোগ করলো খুব। ঝুঁকে ফিসফিস করে বললো –

‘ সুন্দর সাহেবের পিচ্চির মুখে রাগও সুন্দর তা কী পিচ্চি জানে ? ‘

চলবে…
আর কেউ কমেন্ট না করলে গল্প দ্রুত আসবে না তা কী পাঠকরা জানে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here