স্বপ্ন চূড়ার আহবান
পর্ব-৭
আশেপাশের আবহাওয়া কেমন ভারি হয়ে উঠছে। মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ বাদেই ঝড় আসবে। গুমোট ভাব চারপাশে নিজের শিকড় বাকড় ছড়িয়ে দিয়েছে৷ পায়রা চিঠিটা মুঠো করে কবরের পাশের বাঁশে মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে। চোখের কোণায় জল শুকানোর দাগ। নিজের জন্য দুঃখ নেই, কথায় আছে যার দুনিয়ায় কেউ নেই, পুরো দুনিয়াটাই তার।
নিশ্চয়ই, আল্লাহই কোনো ব্যবস্থা করে দেবেন। এসব ভাবতে ভাবতে কারো আসার আওয়াজ পেলো পায়রা। পেছনে তাকিয়ে দেখলো তুহিন দাঁড়িয়ে। পায়রা একটু ভরসা পেলো। হয়তো এবার আর সমস্যা হবে না ভেবে উঠে দাঁড়িয়ে গেলো পায়রা। মুখের উপর থেকে ওরনা সরতেই তুহিন চোখ বড়বড় করে চিৎকার করে বললো –
‘আল্লাহ গো! ছি ছি, পায়রা তুই সামনে থিকা সর ‘
আরেকটু থেমে মুখে দিয়ে চেপে চেপে বললো-
‘কী বিচ্ছিরি! কাইল শুনসি তোর মুখে এসিড ফালাইসে কে যানি। এত খারাপ অবস্থা হইবো জীবনেও ভাবি নাই ‘
পায়রা হতবাক চাহনি দিয়ে তাকিয়ে আছে। সেই ছোট্ট বেলা থেকে একজন ভালো বন্ধুই মেনেছে পায়রা তুহিনকে। তাঁরা বুবুর পর সব কথা এই একজনকেই বলতো সে। অথচ আজ এরও রূপটা দেখা গেলো।
হায়রে মানুষ!
পায়রা বুঝতে পারলো, তুহিনও এতদিন তার সৌন্দর্যের মোহে আঁটকে পড়ে ছিলো। তার মুখ তো এতটাও খারাপ হয়নি। এক সাইডের চামড়া ঝলসে গেছে শুধু। দেখতে হয়তোবা কুৎসিত বিকৃত মনে হচ্ছে। সত্যিকারে ভালোবাসলে হয়তো কখনোইএমন আচরণ করতে পারতো না।
পায়রা হালকা হেসে বললো –
‘কেন তুহিন ভাই? এহন আর আমারে সুন্দর লাগে না?’
তুহিন নিজেকে সামলিয়ে নিলো। বুঝতে পারলো, এতটা রিয়েক্ট করে ফেলা উচিত হয়নি। আমতা আমতা করে বললো –
‘আ..আসলে, আমি ভয় পাইয়া গেছিলামরে ‘
‘তাই নাকি! আইচ্ছা.. তো তুহিন ভাই। এতদিন আপনে কইতেন আমারে নাকি আপনে ভালোবাসেন তাইলে চলেন আজই আমারে বিয়া করেন’
তুহিন দুই পা পিছনে চলে গেলো। বুক ধকধক করছে। না! কখনোই না! সে কী এতটাই খারাপ নাকি যে এমন মুখ ঝলসানো একটা মেয়েকে বিয়ে করে জীবন নষ্ট করবে? ঝটপট করে তুহিন বললো –
‘পায়রা, শোন আমার মা কহনো আমগো বিয়া মাইনা নিবো না। আগে বুঝতে পারি নাই৷ এহন বুঝি, আর শোন আমি তো রোজগার করিনা৷ তুষার ভাই বাঁইচা থাকতে ভরসা আছিলো, এহন বাপের টাকায় পুরা সংসার চলে৷ ভাই মারা যাওয়ার পর মাও সবসময় অসুস্থ, বুঝিসই তো কত খরচা! ‘
পায়রা সবকিছু চুপ করে শুনলো৷ আগে থেকেই সে জানতো তুহিন এরকম কিছু একটা বলবে৷ তুহিন পায়রাকে চুপ করে থাকতে দেখে ভাবলো এখান থেকে মানে মানে কেটে পড়াই ভালো, তাই বললো-
‘পায়রা, ভালো থাকিস। আমার অনেক কাজ বুঝেছিস, আমি যাই হ্যা?’
পায়রার উত্তরের অপেক্ষা না করেই সে প্রস্থান করলো৷ পায়রা সেই দিকে তাকিয়ে রইলো মিনিট খানিক। ভালো ব্যবহার করা মানুষটা খারাপ কিছু করলে আমরা ভাবি, মানুষটার রূপ বদলেছে। কিন্তু ওটা আমাদের ভুল ধারণা। রূপ এত দ্রুত বদলায়না। বুঝতে হবে, মানুষটা আগে থেকেই এমন ছিলো৷ শুধু মুখোশের আড়ালে ছিলো বলে কেউ দেখতে পায়নি।
পায়রা নিজের জামাটা ঝেরে নিলো ৷ মাটিতে বসায় হালকা কাঁদা লেগেছে। উঠে হাঁটা শুরু করলো। যে দিকে দুই চোখ যায় এবার সেইদিকে যাত্রা হবে। হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি থেকে অনেকটাই দূরে চলে এসেছে সে৷ স্কুল এখানে থেকে পাঁচ মিনিটের রাস্তা, ঐতো ঢংঢং আওয়াজে বেল বেজে উঠলো।
গরমের সময়ে হাঁটলে এমনিতেই শরীর ক্লান্ত হয়ে আসে। আর সে তো আগে থেকেই অসুস্থ তাই বেশি দূর যেতে পারলো না। একটু পরই, বটগাছের নিচে হাঁটু গুটিয়ে বসে পড়লো। কপালের জমা ঘাম ওরনা দিয়ে মুছে নিয়ে মাথাটা এলিয়ে দিলো। ক্লান্তিতে শরীর নুইয়ে আসছে৷ চোখ বুজতেই ঘুমদেবী দুই চোখের পত্রপল্লবে বসে পড়লো। পায়রা কিছুক্ষণের মধ্যেই নিদ্রাপুরী প্রবেশ করলো। হঠাৎই পায়রা এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলো।
নীল রঙের বিশাল একটা ছাঁদের রেলিংয়ে একা দাঁড়িয়ে আছে পায়রা। পড়নে সাদা শাড়ি,হাল্কা কোঁকড়ানো চুলগুলো এলোমেলো ভাবে ছড়ানো। ছাঁদে থেকে এক পা বাড়াতেই দুটো পুরুষালি হাত কোমর পেচিয়ে নিচে নামিয়ে ফেললো। চার, পাঁচ সেকেন্ডে এর বেশি কিছু দেখলো না পায়রা। শুধু একটা জিনিস খেয়াল করলো পুরুষটির চোখগুলো ধূসর বাদামী রঙ। চেহারা একবারেই মনে নেই৷
কার ধাক্কায় যেনো ঘুম ভেঙে গেলো তার। চোখ কচলে ধরফরিয়ে উঠলো পায়রা। উপরে তাকিয়ে হা করে বললো –
‘আপনি! ‘
চলবে…
কিছু কী বোঝা গেছে? কেউ কী অনুমান করতে পারবে সামনে কী হবে? খুব শীঘ্রই টুইস্ট আসবে।