স্বয়ম্বরা (৪র্থ পর্ব) রাজিয়া সুলতানা জেনি

স্বয়ম্বরা (৪র্থ পর্ব)
রাজিয়া সুলতানা জেনি

‘হি ওয়ান্টস টু ম্যারি ইউ’ কথাটা শুনে অবাক হলেও সেটার মাত্রা খুব বেশি ছিল না। সুন্দর একটা মুখশ্রী নিয়ে জন্ম নেয়ার কারণে জীবনে প্রেমের প্রস্তাব খুব কম পাইনি। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখেছি, কারণে অকারণে ছেলেরা গাল টিপে দিয়ে ‘কি কিউট’ টাইপ কিছু বলত। এরপরে শুরু হল বিভিন্ন ছুতায় আলাপ করার চেষ্টা। যখন সব বুঝতে শিখলাম, তখন শুরু হল ছেলেদের লোলুপ দৃষ্টি। হ্যান্ডসাম কেউ সুন্দরভাবে তাকালে খারাপ লাগত না, বাট সেরকম জুটত কালে ভদ্রে। বেশির ভাগই, ‘কি মাল রে’ টাইপ দৃষ্টি।
গাড়ীতে স্কুল যাওয়া আসা করতাম দেখে ছেলেদের টিপ্পনী তেমনভাবে ফেস করতে হয়নি। প্রথম শুরু হয়েছিল প্রাইভেট পড়তে গিয়ে। ব্যাচে, ছেলে মেয়ে একসাথে। একটা দুটা প্রেমের প্রস্তাব পেতাম। প্রথম প্রথম মজাই লাগত। এমনকি সুন্দর কোন ছেলে স্টেয়ার করলে বান্ধবীরা নিজেরা আলাপ করতাম। এরপরে ব্যাপারটা যখন বেশ ঘনঘন ঘটতে লাগল, তখন একসময়ে ফিল করলাম, বিরক্ত লাগা শুরু করেছে। আর ‘তোমাকে ছাড়া বাঁচব না’ টাইপ অফার যখন পেতে শুরু করলাম, তখন তো বোরিংয়ের চুড়ান্ত লাগা শুরু হল। কলেজে ওঠার পরে স্টাইল পাল্টাল। শুরু হল ‘লেটস বি ফ্রেন্ড’ টাইপের সব অফার। কিছুদিন পরেই, ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’ হতে চাওয়া। তারপর… সমস্যা হচ্ছে এই বিশাল গ্রুপের ভেতর থেকে আমার এই স্পেশাল ‘পাণি প্রার্থী’টিকে খুঁজে বের করব কি করে? ভদ্রলোক কবে আমার প্রেমে পড়েছিল? প্রপোজ করেছিল? করে থাকলে আমি কি অ্যান্সার করেছিলাম? ‘ভেবে দেখি’ টাইপ? না ফ্ল্যাটলি রিজেক্ট করেছিলাম?
তেমন কাউকে তো মনে পড়ছে না। আসলে বেশিরভাগ অফারের দিকে ফিরেও তাকাইনি। কনসিডার করার মত ছিল হাতে গোণা কটা। তবে কোনটাই শেষ পর্যন্ত প্রেমে পরিণত হয়নি।
না, খুব খুঁতখুঁতে আমি না। অহংকারী? কিছুটা, বাট ওটা সব সুন্দরী মেয়েই হয়। দারুণ রাজপুত্র খুঁজছিলাম, বলব না। বলতে পারেন কাউকেই, জাস্ট মনে ধরেনি। আই মিন, এমন কাউকে এখনও পাইনি, যাকে দেখে মনে হবে ‘হি ইজ মাই ম্যান’।
নাও দ্যা ভাইটাল কোয়েশ্চেন ইজ, এই ইশতিয়াক চৌধুরী আমার কোন বয়সের প্রেমিক? কবে প্রেমে পড়ল? স্কুল কলেজে হওয়ার কথা না। সেই বয়সে প্রেমে পড়ে এতো বছর পরে অ্যাকশানে যাবে? অসম্ভব না, তবে সম্ভাবনা খুব কম। দ্যাট মিনস, রিসেন্ট প্রেমিক।
মনে করবার চেষ্টা করলাম। রিসেন্ট কার কার প্রস্তাব পেয়েছি। ফেসবুকে প্রায়ই পাই, কিন্তু সেগুলো বেশিরভাগই ফ্লার্ট। নাম মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করিনি। অনেক ক্ষেত্রেই ব্লক করেছি। সেসবের ভেতরে ইশতিয়াক নামের কেউ ছিল কি? মনে হচ্ছে না। ভ্রু বোধহয় অনেক্ষণ ধরেই কুঁচকে ছিল, ব্যাপারটা লক্ষ্য করে কিডন্যাপার সাহেব মনে করিয়ে দিলেন
— খাবার ঠান্ডা হচ্ছে।
সম্বিৎ ফিরে পেলেও বুঝতে দিলাম না। মাথা ওপর নীচে ঝুঁকিয়ে সম্মতি জানালাম। এরপরে খাবার মুখে দিলাম। মাথার জেমস বন্ড এখনও অ্যানালাইসিস করছে। অনুভব করলাম, ভদ্রলোকের ওপর রাগের চেয়ে ইন্টেরেস্ট ফিল করছি বেশি। কে এই মিষ্টার ক্রেজি লাভার। প্রেমে পড়ে একেবারে সেই হিন্দি ‘ডার’ সিনেমার শাহরুখ খানের ক্রেজি লাভার টাইপ অ্যাকশানে নেমে গেল। তাও আবার ভাড়া করে গুন্ডা নিয়ে।
নাহ, স্মৃতি হেল্প করছে না। এমন কোন প্রেমিকের কথা মাথায় আসছে না। ব্যাপারটা নিয়ে তাই জানতে চাইলাম
— তা প্রেমিক মশাই, আমাকে প্রপোজ না করে, এমন ডেসপারেট স্টেপে গেলেন যে?
— করেছিলেন, ইউ রিজেক্টেড হিম।
এবার সত্যিই হোঁচট খেলাম। আমি যতটা মুড নিয়ে চলি, তাতে খুব কম ছেলেই আমাকে সরাসরি প্রপোজ করেছে। ফেসবুক টেসবুকে যেসব, সেসব হলে অন্য কথা, তবে ইউজুয়ালি সামনাসামনি কেউই সেভাবে প্রপোজ করে না। বান্ধবীদের মাধ্যমে অবশ্য কিছু পেয়েছি। তাদের ভেতর কি কেউ? যদি রিজেক্ট করেই থাকি, দেন আবার ট্রাই করত। তা না করে… রিডিকুলাস। ছাগলামীর একটা লিমিট থাকে।
রাগ চড়তে শুরু করল। হারামজাদাকে হাতে পেলে জনমের মত বিয়ে করার শখ মিটিয়ে দিতাম। একবার শুধু এখান থেকে বেরোই।
মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। পালাবার প্ল্যান করছি, এমন কোন ইনটেনশান দেখানো যাবে না। কথাবার্তা প্রেমিকের দিকে ঘোরালাম। জিজ্ঞেস করলাম
— তা আমার এই প্রেমিক কি করেন?
মি হ্যান্ডসামের খাওয়া শেষ। গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে আমার দিকে তাকাল। এরপরে শান্তভাবে উত্তর দিল
— কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার।
ওরে বাব্বা। এতো দেখি হেভি ওয়েট প্রার্থী। হিসেব সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। ভেবেছিলাম রোড সাইড রোমিও টাইপ কেউ হবে, এখন দেখছি ‘এ ওয়ান’ পাত্র। এমন পাত্র অফার করল, আর আমি মনে রাখলাম না? আর না যদি করেই থাকি, এমন বিচ্ছিরী রাস্তা ধরল কেন? আমার হতবাক চেহারার দিকে তাকিয়ে পরের তথ্যটা দিল
— আমেরিকায় থাকেন ভদ্রলোক।
— হোয়াট? আমেরিকায় থাকে?
মাথা উপর নীচে করে সম্মতি জানাল। এরপরে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল
— থালাটা।
আমার খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। থালাটা ছেলেটার হাতে না দিয়ে বললাম
— চলুন। আপনাকে আর কষ্ট না দিই।
আবার সেই স্মাইল।
— সিচুয়েশান যা ই হোক, আপনি গেস্ট।
বাব্বা। এতো দেখি দয়ার অবতার। এবার আর তর্ক করলাম না। থালাটা ফিরিয়ে দিতে দিতে জানতে চাইলাম
— তা প্রেমিক মশাই কবে আমাকে প্রপোজ করেন?
হ্যান্ডসাম মশাই কিচেনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন,
— মাস ছয়েক আগে।
মাস ছয়েক আগে? তখন… ইয়েস। তখন থার্ড ইয়ারের ফার্স্ট সেমিস্টার শেষ হয়েছে। ছুটিতে থাইল্যান্ড গিয়েছিলাম। ওখানে দেখেছে? ব্যাপারটা জানতে চাইলাম
— আমাকে দেখল কোথায়?
এবার কিচেন থেকেই উত্তর দিলেন
— আপনার প্রেমে পড়ার আগে আপনাকে উনি দেখেননি।
ওয়াও। এতো দেখি পৌরানিক গল্পের হিরো। এক্সাইটেড ফিল করতে শুরু করলাম। দ্রুত হাত ধুয়ে কিচেনে চলে গেলাম। মিস্টার হ্যান্ডসাম তখন আমার এঁটো থালাটা ধুচ্ছিলেন। কেন যেন খারাপ লাগল। বললাম
— আজকের পর থেকে আমার এঁটো থালা, আমি ধুবো।
ঘাড় না ঘুরিয়েই উত্তর দিল
— আমার অভ্যাস আছে।
উত্তরে আরেকবার প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় প্রশ্নটা মাথায় আসল। জিজ্ঞেস করলাম
— আমাকে কতদিন এখানে আঁটকে রাখবেন?
— মার্চের তিন তারিখ পর্যন্ত।
— তারপরে?
— এরমধ্যে আপনি বিয়েতে রাজী হয়ে যাবেন।
— মানে?
— মানে মার্চের তিন তারিখের আগেই আপনি উনার প্রস্তাবে সম্মতি দেবেন।
— যদি না দিই?
— দেন…
কথাটা শেষ করল না। তবে কথা বলার ভেতর সুক্ষ একটা হুমকি ফিল করলাম। ছেলেটা চেহারায় এমন একটা আভিজাত্য ছিল যে, ছেলেটাকে এতোক্ষণ সত্যিকারের কিডন্যাপার ভাবতেই পারিনি। ‘দেন…’ বলে রহস্যময় একটা ‘পজ’ দেয়াতে এই প্রথম ছেলেটাকে ভয় পেলাম। কাঁপা কাঁপা গলায় জানতে চাইলাম
— দেন?
আমার দিকে মুখ না ফিরিয়েই উত্তরটা দিল
— দেন এর কোন অপশান আসবে না। আপনি রাজী হবেন।
কথাটা বলার ভেতরে এমন এক সাবলীলতা ছিল যে, শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল। লাস্ট হাফ অ্যান আওয়ারে ছেলেটা সম্পর্কে যে রোমান্টিক ফিলিং গ্রো করা শুরু করেছিল, সেটায় ছেদ পড়ল। এ ছেলে সুবিধার না। এর স্মাইল শুধু কিলিং না, ব্রেনটাও কিলারের। মনে হচ্ছে ঠান্ডা মাথায় খুন করা এ ছেলের জন্য ডালভাত। নিজেকে সাবধান করে দিলাম।
ছেলেটার কাজ শেষ। থালাগুলো র‍্যাকে রাখতে রাখতে আমার দিকে আড়চোখে একবার তাকাল। আমার পাংশু চেহারা দেখে বুঝতে বাকী থাকলো না, আমি ভয় পেয়েছি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতেই বোধহয় বলল
— আই উইশ, আপনার মত পাল্টাতে আমাকে খুব একটা কষ্ট করতে হবে না।
কথাটায় কিছু একটা ছিল। অনুভব করলাম। জেদ চাপছে। নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলাম না। কড়া চোখে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললাম
— আই উইশ দ্যা অপজিট।
আমার গলার আওয়াজে এমন একটা দৃঢ়তা ছিল যে ছেলেটা এক মুহুর্তের জন্য থমকে গেল। এই প্রথম বারের মত ওর ভেতরে হেজিটেশান দেখলাম। খুব অল্প সময়ের জন্য। দ্রুতই নিজের কনফিডেন্স ফিরিয়ে আনল। সঙ্গে ঠোঁটে সেই ড্যাশিং স্মাইল। এরপরে হাত দিয়ে সামনের দিকে ইশারা করে বোঝাল, চলুন এখন কিচেন থেকে বেরোই।
ছেলেটার দিকে কড়া দৃষ্টিতে আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে বেরিয়ে আসলাম। আমার পেছন পেছন ছেলেটাও বেরোল। ডাইনিংয়ে বেরিয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম। ছেলেটাও আমার দিকে তাকাল। বুকের ওপর হাত আড়াআড়ি করে ছেলেটার চোখে চোখ রেখে ঠান্ডা গলায় হিসহিস বললাম
— নাও টক স্ট্রেইট। খুলে বলুন, ছেলেটা কে? আর কেন এমন পাগলামী করছে?
ছেলেটা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। বোধহয় বুঝে গেল আমি অন্য কোন উত্তর শুনব না। উত্তর দিল
— উনি আপনার বাবার আমেরিকা প্রবাসী বন্ধু ইমতিয়াজ চৌধুরীর একমাত্র ছেলে। মাস ছয়েক আগে উনি যখন দেশে এসেছিলেন তখন উনি, মানে ইমতিয়াজ চৌধুরী আপনার বাবার কাছে আপনার পাণি প্রার্থনা করেন। উনার ছেলের জন্য। অ্যান্ড ইউ রিজেক্টেড।
ছেলেটা বলে চলল
— ব্যাপারটায় ছেলেটার ভেতরে জেদ চেপে যায়। সে ঠিক করে, সে আপনাকেই বিয়ে করবে। বাই এনি মিনস। আর সেটা করবে মার্চের তিন তারিখে। বিয়ের সব অ্যারেঞ্জমেন্ট কমপ্লিট। কার্ড ডিস্ট্রিবিউট, কমিউনিটি সেন্টার বুকিং, এভ্রিথিং ডান। অনলি থিং মিসিং ইজ… ‘ইয়োর কনসেন্ট’।

চলবে

আগের পর্ব
https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/posts/1309070882941269

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here