স্মৃতির দেয়াল🍁 পর্ব-১২

0
817

স্মৃতির দেয়াল🍁
#পর্ব_১২
Writer -Afnan Lara
.
মুন কি বলবে বুঝতেছিলো না,তাও এক প্রকার রাগান্বিত হয়ে সে নীলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো
নীলের মা মুনকে নিজের পুত্রবধূ হিসেবে পেলে খুশি হতেন কিন্তু এতে মুনের ও তো একটা মত থাকা জরুরি তাই তিনি মুনকে ধরে কোণায় নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন সে এই বিয়েতে রাজি কিনা
মুনের মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না ঠিকমত
.
দেখো মুন,,এ কদিনে তোমার উপর আমাদের সবার মায়া লেগে গেছে,,তোমাকে আমরা সবটা নাহলেও অনেকটাই জেনে গেছি,তুমি মা হারা অনাথ মেয়ে, বাবা থেকেও নেই,তোমাকে আমার ছেলের বউ করলে আলাদা সওয়াব পাবো,কিন্তু সওয়াব পাবার আশায় আমরা তোমাকে কোনোরকম জোর করতে পারি না
তুমি তোমার মতটা জানাও
.
মুন মুখ খুললো কথা বলার খাতিরে তার আগেই নীল ওদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বললো”জবাব “হ্যাঁ’ তো হবে না জানি,তোমার উত্তর সবসময় ” না”,বাট তাতে আমার কিছু যায় আসে না,দরকার হলে জোর করেই বিয়ে করবো,দ্যাটস ইট”
.
নীল মায়ের দিকে তাকিয়ে ব্রু কুঁচকে নিপাকে ডেকে বললো মুনকে সাজিয়ে আনতে

আমি উকিলকে আসতে বলেছি কাগজে কলমে বিয়ে হবে
.
মা খুব রাগলেন এবার,বাবাকে ইশারা করে নীলকে তাদের রুমে ডাকলেন
.
নীল রুমে এসেছে ১০মিনিট হলো
মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে আছে সে,, আর বাবা মা তাকে দেখে যাচ্ছে কেবল
.
কি??কিছু বলবা তো নাকি?? আমার অনেক কাজ,রেডি হতে হবে
.
নীল??তোর কি শরীর খারাপ?
.
আই এম ফাইন,তাই তো বিয়েটা করতে চাইলাম,মৌটুসি আন্টিকে ডাকিও বিয়েতে,তিনি পুরো এলাকাতে খবর প্রাচারের দায়িত্ব পালন করবেন
.
সেটা বাদ দে,আমরা তোকে এখানে ডেকেছি হুট করে বিয়ের সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছিস সেটা জানার জন্যে
.
আমি এতদিন বিয়ে করিনি,অনেক লেট হয়ে গেলো তাই ভাবলাম আজই করে ফেলি
.
নীল ভেবে দেখ,এতদিন ধরে বিয়ে করস নাই আজ হঠাৎ কি এমন হলো তুই এই ডিসিশন নিয়েছিস?

মুনকে কি তোমাদের পছন্দ না?

পছন্দ কিন্তু তাই বলে ওকে জোর করে বিয়ে করবি?ওর তো এই বিয়েতে মতই নেই

না থাকলে না থাকুক,বিয়ে করলে ওকেই করবো,,ফাইনাল কথা এটা
.
না কিছু একটা হয়েছে যেটা তুই আমাদের থেকে লুকাচ্ছিস,সোজা সোজা বল,আমাদের কনফিউশানে রাখবি না,তোর সারাটা মন জুড়ে হিয়া ছাড়া কেউ নেই আর সেই তুই কিনা রাতারাতি বদলে গেলি??কিছু তো একটা নির্ঘাত হয়েছে,কারন টা বলে দে আমরা খুশি খুশি সব আয়োজন শুরু করবো
.
বাবার কথায় নীল একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে মাথা উঁচু করে বললো”যার জন্য এত স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে ছিলাম সে এখন অনেক খুশি বাবা,,সে আমাকে ভুলে আরেকটা মানুষকে ভালোবাসতে শিখেছে,কেয়ার করা শিখেছে
ভেবেছিলাম হয়তবা বিয়ের পর সে তার স্বামীকে কিছুতেই মেনে নেবে না,বাট আই ওয়াজ রং!!!
সে অনেক হ্যাপি,আমিও খুশি হলাম হিয়া খুশিতে আছে দেখে
সুখী আছে এটাই তো চেয়েছিলাম,তাহলে আমি নাহয় ওর মতন আরেকটা মানুষকে নিজের জীবনসাথী বানিয়ে লাইফটা সম্পূর্ন করে ফেলি?
.
বাবা চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নীলের কাছে আসলেন,নীলের কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে বললেন”হিয়া তার হাসবেন্ডকে মেনে নিতে পেরেছে বুঝলাম,মানলাম,কিন্তু তুমি কি মুনকে সেই সুখী রাখতে পারবে যেমনটা হিয়াকে বউ হিসেবে পেলে রাখতে??

নীল চোখ তুলে বাবার দিকে তাকালো,বাবা একটা চিরন্তন সত্যি কথা বললেন,আসলেই সে মুনকে সেই ভালোবাসা দিতে পারবে না যতটা সে হিয়াকে বাসে
কিসব ভেবে মুচকি হাসলো নীল এরপর বললো”হিয়ার মতন ভালোবাসা ওকে দিতে পারবো না ঠিক তবে স্ত্রী হিসেবে ও সব অধিকার পাবে,, আমি দেবো ওকে,আর তোমরাই ভাবো মুনের এখন একটা ঠাঁই দরকার,মানুষের কটু কথা শুনে সে বারবার চলে যাচ্ছে,নিজেকে বিপদে ঠেলে দিচ্ছে
.
মুনকে আমরা পছন্দ করি,তুই ও বিয়েতে রাজি মানলাম,কিন্তু মুন তো রাজি না
.
মুন বাচ্চা মেয়ে,ওর এখনও বুঝজ্ঞান হয়নাই যে বিয়ের ব্যাপারে মত দেবে,মনে নেই ও নিজের বিয়েতে পালিয়ে গেছিলো??কতটা অবুঝ হলে মানুষ এই কাজ করে,আর আমি তুষার না যে পুলিশকে দেখে থমকে যাবো
আমি নিজেই একজন পুলিশ অফিসার
.
এই দাপট দেখিয়ে বিয়ে করবি ওকে?
.
যেটা ভাবো সেটাই,তবে আমি বিয়ে করবোই,এবং সেটা মুনকে,মুন আমার স্ত্রী হয়ে সুখী হবে একশো পারসেন্ট গ্যারান্টি আমি দিতে পারবো
.
তাহলে ভালো,তুই যখন মুনের দায়িত্ব নিতে চাস,আমরা আর কি বলবো,তবে মুনের মতামত নেওয়া দরকার বলে আমরা মনে করি,কারণ ও তোকে পছন্দ করে কিনা সেটা কিন্তু আমরা জানি না
.
ও আমাকে পছন্দ করে না কারন ও আমার বাহ্যিক রুপটাই দেখেছে,পরে ভেতরের রুপ দেখলে নিজেই ফিদা হয়ে যাবে কিন্তু ততক্ষণ আমি ওয়েট করতে পারি না
.
মা বাবা মুচকি হাসছে নীলের কথা শুনে
.
তোমরা হাসছো কেন??সব অধিকার দেবো মানে এই না যে হিয়ার জায়গায় ওকে বসাবো,,হিয়া হিয়ার স্থানে অটল থাকবে,ওর জায়গা কেউ নিতে পারবে না কোনোদিন
.
কথা শেষ করে নীল চলে গেলো রুম থেকে

কিছুক্ষণ পর নীল একটা গোল্ডেন কালারের পাঞ্জাবি পরে বেরিয়ে আসলো রুম থেকে ,সবাই শুধু নীলের কাজ দেখছে,খুব জলদি সব কিছুর ব্যবস্থা সে করে ফেলছে
.
মুন নিপার দিকে তাকিয়ে আছে,নিপা চুপচাপ মুনকে সাজাচ্ছে,সবেমাত্র চুলটা সাজিয়েছে,শাড়ী পরাতে নিতেই মুন উঠে চলে গেলো রুমের শেষ প্রান্তে তারপর বললো”আমি এই বিয়েতে রাজি না নিপা আপু!!
হঠাৎ বিয়ের সিধান্ত নিলেন কেন উনি,আমার মাথায় কিছু আসছে না!”
.
মুন কথাটা ভাইয়াকে বলা উচিত তোমার
.
উনি আমার কথায় পাত্তায় দিচ্ছেন না কি করবো?জোর করে বিয়ে করছেন উনি
.
হঠাৎ দরজায় নক হতেই ওরা দুজন সেদিকে তাকালো,নিপা গিয়ে দরজা খুলতেই নীল একটু ভিতরে এসে বললো”রেডি?”
.
মুন ব্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে ওর দিকে
.
নীল মুনের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিয়ে বললো”বিয়ে কি মাথার ফুলকো ফুলকো খোঁপা দেখে করবো আমি??শাড়ী পরতে হবে না?নাকি সেলোয়ার কামিজ পরে বিয়ে করার শখ হয়েছে?”
.
দেখুন আমি বিয়ে করবো না,সাফ কথা বলে দিলাম,এবার এসব নাটক অফ করেন,আর ভালো লাগে না
.
নীল নিপার দিকে তাকিয়ে বললো”যা মাকে কাজে হেল্প কর,আমি বরং পাজল সলভ করি
.
পাজল মানে?
.
সলভ করার পরেই দেখিস নাহয়
.
নিপা মাথা চুলকাতে চুলকাতে চলে গেলো
.
নীল টেবিলের উপরে থাকা বেনারসির প্যাকেট খুলে শাড়ীটা হাতে নিয়ে মুনের সামনে এসে দাঁড়ালো
তারপর মুনের পাশে দেয়ালের উপর হাত রেখে বললো”তুমি কি চাও আমি তোমায় শাড়ী পরিয়ে দেই?”
.
মুন চোখ কপালে তুলে ফেলেছে কথাটা শুনে
.
কি হলো বলো?
.
এসব কি উল্টা পাল্টা কথা বলছেন আপনি??আপনি কেন আমাকে শাড়ী পরাবেন
.
গুড গার্ল,আমি কেন তোমাকে শাড়ী পরাবো,বরং তুমিই পরে নাও,আমি এই যে এই নাটি বিসকুট খাচ্ছি ততক্ষণে তুমি শাড়ীটা পরে নাও,১০মিনিট সময় দিলাম,শাড়ীটা যদি আমি ফিরে দেখি এখনও পরোনি তো আমি জোর করে ধরে পরিয়ে দেবো,সেটা ভালো লাগবে??
.
মুন শাড়ীর দিকে তাকাচ্ছে আর নীলের দিকে তাকাচ্ছে
নীল টেবিলের উপরে থাকা বিসকুটের বাটিটা হাতে নিয়ে আরেকদিকে ফিরে বসলো
এবার বিসকুট গুলো মুড় মুড় করে খাচ্ছে সে আর হাতের নীল রঙের ঘড়িটার দিকে তাকাচ্ছে,পাঁচ মিনিট ধরে মুন ভাবলো অনেক
নীলের স্বভাবের সাথে সে খুব ভালোভাবে পরিচিত তাই সে এখন শাড়ীটা না পরলে যদি নীল সত্যি সত্যি শাড়ী পরানো শুরু করে দেয়??লজ্জায়, রাগে তো মরেই যাব আমি
তার চেয়ে বরং শাড়ীটা পরে ফেলি,কিসমতে আমার এটাই লিখা ছিল হয়ত
.
নীল বিসকুট চিবাতে চিবাতে বললো”আর চার মিনিট”
.
মুন জলদি করে শাড়ীটা পরছে,বরাবর দশমিনিট পুরাতেই নীল পিছন ফিরে তাকালো,মুন শাড়ী পরে ফেলেছে ততক্ষণে,চোরের মতন একটা লুক নিয়ে সে নীলের দিকে তাকিয়ে আছে শাড়ীটা পরে
.
ভেরি গুড,এবার চলো বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হই
.
নীল মুনের হাত ধরে টেনে সোফার রুমে নিয়ে এসেছে
নিপা শরবতের ট্রে নিয়ে যত মেহমান আসছে সবাইকে দিচ্ছে,নাহার আর নীলের মা নাস্তা রেডি করছেন
.
মুনকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে নীল গেলো উকিলের সাথে কথা বলতে
নিপা শরবত সব সবাইকে দিয়ে খালি ট্রে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে যাওয়া ধরতেই দেখলো মুন বউ সেজে মুখটা ছোট করে বসে আছে সোফায়
নিপা এগিয়ে এসে বললো”এত জলদি শাড়ী পরে নিলা,বাহহহ,কিন্তু মাথার ঘোমটা কই?”
.
আর ঘোমটা!!আমার অস্বস্তি লাগছে সব
.
নিপা এগিয়ে এসে মুনের শাড়ীর আঁচল টেনে মাথায় দিতে দিতে বললো”আমাকে ননদ হিসেবে কি পছন্দ হচ্ছে না?”
.
মুন মুখ বাঁকিয়ে বললো”কিসের সমস্যা আর,সমস্যা তো মেইন যাকে বিয়ে করবো তাকে নিয়ে,চেহারা দেখো তুমি,কেমন রাগী রাগী চোখে নিজের বেস্টফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছে,এই জন্যই বুঝি হিয়া আপু উনাকে বিয়ে করে নাই
.
নিপার মুখের ভাবগতি মূহুর্তেই বদলে গেলো,চুপ করে থাকলো কিছুক্ষণ এরপর মুচকি হেসে বললো”আমার ভাইয়াকে তাহলে তুমি এখনও চিনো নাই,ওকে যে পাবে তার ভাগ্য অনেক অনেক ভালো,হিয়া আর নীল ভাইয়ার অতীতটা নাহয় ভাইয়া নিজেই তোমাকে জানাবে,আমাদের আর কিছু বলতে হবে না,শুধু একটা কথাই বলবো আর তা হলো ভাইয়াকে তুমি চিনলে না,বুঝলে না,যা বুঝলে তা ভুল ছিলো
.
মুন নিপার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো,,একটা কঠিন কথা বলেছে নিপা
.
নীল মিলনের সাথে কথা বলা শেষ দিয়ে মুনের পাশে বসেই একটা পেপারে সাইন করে দিয়ে পেনটা মুনের দিকে এগিয়ে ধরলো
.
মুন নীলের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে না জানালাে সাথে সাথে

বিয়ে তো তোমাকে আজ নাহয় কাল করতেই হতো,,আমি নাহয় একটু তাড়াতাড়ি করে নিলাম
চুপচাপ সাইন করো এখন
.
নীল পেপারটা এগিয়ে ধরলো মুনের দিকে
.
মুন কাঁপা কাঁপা হাতে সই করে দিলো শেষমেষ
.
মুন উঠে দাঁড়িয়ে গেলো সই করা শেষে,তার শরীর গুলিয়ে আসছে ভয়ের চোটে
নীল মুনের হাত ধরে আবার বসিয়ে দিলো ওকে

উঠো কেন,হুজুর ও তো বিয়ে পড়াবে,উনার আসতে একটু দেরি হয়ে গেলো আর কি,তোমার তো বিশ্বাস নাই আবার কি না কি করে ফেলো,তাই আগে রেজিস্ট্রি করে ফেললাম
.
শেষে হুজুর ও বিয়ে পড়িয়ে দিলেন
.
মুন কাঁদতে কাঁদতে কবুল বলছে,এ কটা দিন ওর উপর দিয়ে যে দখল গেছে,সেসব ভাবতেই ওর মন চাচ্ছে ফ্লোরে হাত পা ছড়িয়ে কান্নাকাটি করতে

নীল ঠাণ্ডা মাথায় ওর বন্ধুদের সাথে সেলফি তুলছে
আর মুন দাঁড়িয়ে থেকে শুধু নীলকে দেখছে,হঠাৎ করে এমন কেন করলেন উনি???
এরকমটার মানে কি সেটাই মাথায় ঢুকছে না আমার,হিয়ার প্রেমে অন্ধ অথচ ওরে বিয়া না করে আমাকে বিয়ে করে নিয়েছে তাও জোর করে
কি সাংগাতিক,এটা যদি হিয়া জানে তাহলে কাঁদতে কাঁদতে মইরাই যাবে
আচ্ছা এখনও কি হিয়া প্রতিরাতে আসবে??তাতে আমার কি হুহ!!!
আসুক না,আমি রুম ছেড়ে নিপা আপুর রুমে চলে যাবো,আমার এত শখ নাই এরকম একটা লোকের প্রিয়তমা হওয়ার,অবশ্য হবো বা কি করে,উনার প্রিয়তমা তো অলরেডি সেট হয়ে আছে
বিষয়টা এমন হলো যে ভালোবাসে একটাকে বিয়ে করলো আরেকটাকে
চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here