#হঠাৎ_পাওয়া_সুখ
১০ম ও ১১ তম পর্ব
লেখা – শারমিন মিশু
মারজুক রুমে ডুকেই নাবিলার উদ্দেশ্যে সালাম দিলো।
নাবিলা মনে মনে সালামের জবাব দিলো। এ মুহূর্তে কথা বলার শক্তি পাচ্ছেনা। কেউ যেনো কন্ঠনালী চেপে ধরে আছে।
-মারজুক সামান্য গলা কেশে বললো, কেউ সালাম দিলে তার জবাব দিতে হয়?
-নাবিলা মৃদু শব্দে বললো,, জী নিয়েছি।
মারজুক খাটে এসে বসলে নাবিলাও সালাম দিলো।
বেশ কিছুক্ষণ দুজনে নিরব! কিছুক্ষন পরে মারজুক বললো,, দেখি খাট থেকে একটু নামো তো!
-নাবিলা এবার চোখ তুলে অসহায়ভাবে মারজুকের দিকে তাকালো। মারজুক নাবিলার এভাবে তাকানোর কারণ কিছুটা বুঝতে পেরে বললো,, আরে বিয়ের রাতে স্বামী স্ত্রীকে দু’রাকায়াত শোকরানার নামাজ পড়তে হয় তাই নামতে বলেছি। এটাও কি জানোনা?
-নাবিলার মুখ দিয়ে চলে আসছিলো, যে আমার কি আগে বিয়ে হয়েছিলো নাকি যে জানবো বিয়ের রাতে কি করতে হয়? পরক্ষণে নিজেকে দমিয়ে নিলো।
-মারজুক বললো,, কি হলো?
-নাবিলা মাথা নেড়ে খাট থেকে নামলো।
মারজুক বললো, অযু করা আছে তো নাকি?
-জী আছে।
মারজুক লাগেজ খুলে একটা সুতির হিজাব নিয়ে নাবিলার দিকে বাড়িয়ে বললো,, এটা পরে নাও! শাড়ী পরা অবস্থায় নামাজ পড়তে গেলে পুরো সতর ঢাকা পড়েনা। নামাজ পড়া অবস্থায় মাথার চুল থেকে শুরু করে হাতের গিঁট আর পায়ের পাতা অবদি যেকোনো একটা অঙ্গ প্রকাশ পেলে নামাজ হবেনা। তাই পূর্ণ সতর্কতার জন্য এভাবে ঢেকে নেয়া ভালো। আর নয়তো বড় ওড়না দিয়ে শরীর পেঁছিয়ে নিতে হবে।
-নাবিলা হিজাবটা মাথায় পরতে পরতে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বললো,,, জী জানি আমি।
-জানলে তো আরো ভালো। আমাকে আর কষ্ট করে শিখাতে হবেনা।
-কেন শিখাবেন না। আমি কি সবটা জানি নাকি? যেটা জানিনা ওটা শিখিয়ে দেয়া আপনার দায়িত্ব।
আর তাছাড়া হাদীসে এসেছে,,,
যে স্বামি তার স্ত্রীকে ১টি মাসয়ালা শিখাবে সে ব্যক্তি ৭০ বছর নফল ইবাদতের সওয়াব পাবে।
-সুবহানআল্লাহ্! এতোবড় সওয়াব তো আমি কখনো হাতছাড়া করবোনা।
যাক তাহলে স্বামী হিসাবে আমাকে মেনে নিয়েছো।
-কেন মানবো না। সত্যি অস্বীকার করার ক্ষমতা তো আমার নেই।
-আগে নামাজ পড়ে নিই চলো।
নামাজ শেষে মারজুক নাবিলার কপালের উপর চুলে হাত দিয়ে দোয়া পড়লো।
তারপর দুষ্টুমি করে বললো,, এবার কি করবো?
-নাবিলা লজ্জায় আর ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেলো। সত্যি সত্যি উনি যদি এখন উনার অধিকার দাবি করে?
-মারজুক বললো,, আমি কিন্তু তোমার মোহরানা পুরোপুরি শোধ করে দিয়েছি। তাই আমি তো আমার অধিকার টা আদায়ের দাবি করতেই পারি কি বলো?
-নাবিলা শান্ত অথচ দৃঢ় কন্ঠে বললো,,, আমার উপর এখন আপনার পূর্ণ অধিকার আছে। তাই আমি চাইলেও আপনাকে বাঁধা দিতে পারবো না। আমি প্রস্তুত আছি আপনার কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে।
-মারজুক নাবিলার মুখটা দুহাতে তুলে বললো,,, আলহামদুলিল্লাহ!! সম্মতিটাই অনেক বেশি। আমি অনেক খুশি হয়েছি জবাব টা পেয়ে। এরকম জবাব পাবো আমি সত্যি আশা করিনি৷ তবে কোনো ব্যাপারে তোমায় জোর করবো না। আর আজ রাতে অন্য কিছু করবো না৷ শুধু একে অপরের হাত ধরে গল্প করে রাতটা কাটাতে চাই।
কিছুক্ষন চুপ থেকে মারজুক বললো,, হাতটা কি ধরতে পারি?
-নাবিলা সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো।
মারজুক নাবিলার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিলো। মাশাআল্লাহ! মেহেদী পরেছো?
-আসলে আমি পরতে চাইনি আপু জোর করে পরিয়ে দিয়েছে।
-ঠিকইতো করেছে! বিয়ের রাতে স্ত্রীর মেহেদী রাঙানো হাত না দেখলে কি ভালো লাগবে! শাড়ীটাতে কিন্তু তোমাকে অনিন্দ্য সুন্দরী লাগছে!
নাবিলার হাত কাঁপছে। কথা বলার সময় ঠৌঁট কেঁপে উঠছে।
মারজুক বললো,, নরমাল হও নাবিলা। আমি তো বলেছি কিছু হবেনা। একটু কথা বলে আমরা ঘুমিয়ে পড়বো।
আমার কিন্তু কিছু দাবি আছে তোমার কাছে না করতে পারবে না?
-আমি অবশ্যই চেষ্টা করবো পালন করতে।
-কঠিন কিছু নয়! পারবে তুমি
-নাবিলা হুট করে বলে ফেললো, কি দরকার ছিলো আমার জন্য আপনার মা বাবাকে কষ্ট দেয়ার?
-মারজুক কিছুক্ষন চুপ থেকে শান্ত স্বরে বললো,, তা যদি বুঝতে প্রশ্নটা করতে না! আর এসব কথা এখন বাদ দাও! এমন সময় সে কথাগুলো মনে করে এ সুন্দর মুহূর্তটা নষ্ট করতে ইচ্ছে করছেনা।
-নাবিলা আর কিছু বলেনি। যে মানুষ এমনিতে কষ্ট পাচ্ছে তাকে আর সেগুলো স্মরণ করিয়ে কষ্ট দেয়া মোটেও ঠিক না।
গুমোট পরিবেশটা স্বাভাবিক করতে মারজুক বললো,, যা বলছিলাম আমার দাবিগুলো। তুমি না চাইলে ফিজিক্যাল সম্পর্কের জন্য আমি কখনোই জোর করবো না। অবশ্য তুমি নিজে থেকে চাইলে তো আর আমি বাঁধা দিতে পারবোনা। আমার স্ত্রীর চাওয়া বলে কথা!
-এভাবে লজ্জা দেয়া কি ঠিক হচ্ছে?
-মারজুক হাসতে হাসতে বললো,, সরি দুষ্টামি করেছি!
যা বলছিলাম,,, আমি তোমাকে মাঝে মাঝে হুটহাট করে জড়িয়ে ধরবো। মাঝে মাঝে তোমার কপালে আমার ঠৌঁটের স্পর্শ দিবো। আরো কিছু আছে তা এখন বলবোনা পরে বলবো। লোকে শুনলে হাসবে। অবশ্য এইসব ব্যাপারে তোমার পক্ষ থেকেও পূর্ণ সম্মতি থাকতে হবে।
রান্নাবান্না তোমার নিজ হাতে করে খাওয়াতে হবে। রান্নার ব্যাপারে আমিও তোমাকে হেল্প করবো। আমি আবার রান্না অনেক ভালো করতে পারি।
-মার্জিয়া আপু বলেছে।
-আর কি কি বলেছে মার্জিয়া আপু?
-নাবিলা মারজুকের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে বললো,, কিছুনা! আপনি আপনার কথা বলুন।
-হুম শুন। কখনো ইসলামের ফরয ইবাদত গুলো বাদ দিয়ে সংসারের কাজে মনোযোগী হওয়া চলবেনা। সবচেয়ে বড় কথা, আমি তোমার সবরকম কমতি মেনে নিবো কিন্তু আমলের ক্ষেত্রে কোন কমতি মেনে নিতে পারবোনা।
কথা বলতে বলতে প্রায় রাত একটা। মারজুকের পেটের মধ্যে কেমন যেন করে উঠলো। ক্ষিধে পেয়েছে বুঝতে পারছে। নানারকম পেরেশানিতে আজ ঠিকমতো খাওয়া হয়নি।
নাবিলার দিকে তাকিয়ে বললো,, তুমি খাবার খেয়েছো?
-নাবিলা মাথা নেড়ে আমতা আমতা করে বললো,, না!
-আমতা আমতা করছো কেন? খাবারের কথা বলতে লজ্জার কি আছে? তোমার ক্ষিধে পায়নি? আমার তো পেটের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠতেছে খানিক পর পর। সারাদিন না খেলেও রাতে না খেয়ে থাকতে পারিনা। না খেলে ঘুম হয়না আমার।
আচ্ছা তুমি বসো আমি খাবার নিয়ে আসছি বলে উঠতে নিলে খেয়াল করলো, টেবিলে খাবার রাখা। তার মানে মার্জিয়া আগেই রেখে গেছে?
খাবার খেয়ে ঘুমাতে ঘুমাতে তিনটা বেজে গেছে। নাবিলা ঘুমাতে নিলে ওর মাথার নিচে মারজুক হাত মেলে দিলো। নাবিলা তা বুঝতে পেরে উঠতে নিলে মারজুক অন্যহাতে টান দিয়ে শুইয়ে দিলো। আজ থেকে এটাই তোমার বালিশ আলাদা বালিশের কোন দরকার নেই!
নাবিলা নড়াচড়া শুরু করতেই মারজুক বললো,, সমস্যা কি? চুপচাপ ঘুমাও!
অগত্যা নাবিলা চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লো।
ভোর সাড়ে পাঁচটার এলার্ম বাজতেই মারজুকের ঘুম ভেঙে গেলো। নাবিলা বিঘোরে ঘুমাচ্ছে।
কি মায়াবী লাগছে দেখতে! মারজুক নিজের অনুভূতি সংবরণ করতে না পেরে ওর কপালে একটা চুমু দিয়ে উঠে পড়লো।অযু করে এসে নাবিলার হাত ধরে কয়েকবার ডাক দিতেই নাবিলা ধড়পড় করে উঠে বসলো। মারজুক ওকে ধরে বললো,, আস্তে! এভাবে কেউ উঠে!
-নাবিলা চোখমুখ কচলে শাড়ীর আচল টেনে মাথায় দিলো।
-মারজুক বললো,, নামাজের সময় হয়ে গেছে অযু করে আসো।
নাবিলা নামাজ পড়ে খাটের দিকে তাকিয়ে দেখলো মারজুক ঘুমিয়ে পড়েছে। নাবিলার ইচ্ছে করছে একবার মারজুককে ছুঁয়ে দেখতে৷ কিন্তু এক অদৃশ্য শক্তি যেন ওকে টেনে ধরে রেখেছে। নাবিলা মারজুকের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো,, আপনাকে না দেখলে কখনোই জানতাম না এত খারাপ মানুষের ভীড়ে পৃথিবীতে আজো এরকম ভালো মানুষ আছে। নয়তো কে এভাবে সমাজের, পরিবারের অবাধ্য হয়ে একজন ধর্ষিতাকে নিজের ঘাড়ে তুলে আনে?
আপনাদের মতো কিছু মানুষ আছে বলে আজো পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যায়নি!
নাবিলা বিছানায় মাথা দিয়েছে মাত্র চোখটা একটু লেগে এসেছে তখনি মার্জিয়া জোরে ভাইয়া বলে ডেকে উঠলো। মার্জিয়ার এমন বিকট চিৎকারের শব্দে ওরা দুজন ঘুম ভেঙে বিছানা থেকে উঠে বসলো। কি ব্যাপার এতো ভোরে মার্জিয়ার কি হলো ভাবতেই মারজুক দরজা খুলে ছুটে আসলো। পিছন পিছন নাবিলা ও বেরিয়ে আসলো………
চলবে………..
#হঠাৎ_পাওয়া_সুখ
১১তম পর্ব
লেখা – শারমিন মিশু
মারজুক আর নাবিলা মার্জিয়ার রুমে আসতেই দেখলো মার্জিয়া আয়ানকে কোলে নিয়ে কাঁদছে।
মারজুক গিয়ে ওর কোল থেকে আয়ানকে নিজের কোলে নিয়ে নিলো। নাবিলা গিয়ে মার্জিয়ার পাশে বসলো।
আয়ানের খুব জোরে জোরে নিঃশ্বাস উঠানামা করছে। ঠৌঁট এবং জিহ্বা কিছুটা নীল হয়ে উঠেছে। প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। নিঃশ্বাস নিতে পারছেনা।
মারজুক ব্যতিব্যস্ত হয়ে মার্জিয়াকে বললো,, কখন থেকে এমন হচ্ছে?
-মার্জিয়া কাঁদতে কাঁদতে বললো,, আমি অযু করতে গিয়েছি। এসে দেখি ও এমন করছে।
-আজীম কোথায়?
-কাল রাতে ওর হসপিটাল থেকে ইমার্জেন্সি ফোন আসায় ও বারোটার দিকে চলে গেছে।
-ওহ তুই ওকে ফোন করে এক্ষুনি আমার হসপিটালে আসতে বল। আয়ানকে এক্ষুনি হসপিটালে এডমিট করতে হবে। যা সন্দেহ করছি তা হলে বেশি দেরী করা যাবেনা। মার্জিয়াকে রেডি হতে বলে মারজুক গাড়ী আনতে বেরিয়ে গেলো।
মারজুকের হসপিটালটা কাছাকাছি হওয়ায় আয়ানকে আগে ওখানে নিবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো।
নাবিলাকে বাসায় রেখে গাড়ীতে উঠতেই মারজুকের মনে হলো নাবিলাকে এভাবে একা বাসায় রেখে যাওয়া ঠিক হবেনা। তাই নাবিলাকেও ওদের সাথে নিয়ে নিলো।
ওরা ওখানে যাওয়ার কিছু পরে আজীম ও চলে আসলো। মার্জিয়ার ফোন পেয়ে ওর বাবা মা একমাত্র নাতির অসুস্থতার খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে আসলো।
আয়ানকে হসপিটালে ভর্তি করানোর পর অনেকগুলো টেস্ট করতে দেয়া হলো।
মারজুক আর আজীম সেগুলো নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। নাবিলা মার্জিয়ার পাশে বসে ওকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। আপু দেখো আয়ানের কিছু হবেনা আল্লাহকে ডাকো আপু। একমাত্র উনি সমস্ত বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করার ক্ষমতা রাখেন। কান্নাকাটি করলে তো আর সব ঠিক হবেনা।
বাবা মাকে দেখে মার্জিয়া দৌড়ে গিয়ে তাদের জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন।
মুনতাসির আহমেদ মার্জিয়াকে সান্ত্বনা দিতপ দিতে একপাশে দাঁড়িয়ে থাকা নাবিলার দিকে তাকালো।
নাবিলা প্রথমে বুঝতে না পারলে পরে বুঝলো যে এরা ওর শশুর শাশুড়ি। মার্জিয়া একটু সরে দাঁড়াতেই নাবিলা ধীর পায়ে ওদের দিকে এগিয়ে গেলো।
মার্জিয়া বললো,, ভাবি আব্বু আম্মু!
তারপর বাবা মায়ের দিকেও তাকিয়ে বললো,, ও নাবিলা।
নাবিলা সালাম দিতেই মুনতাসির আহমেদ তা সম্পর্ণ এড়িয়ে গিয়ে ওখান থেকে চলে গেলো। সেলিনা রাগী কন্ঠে দাঁত খিঁচিয়ে চাপা কন্ঠে বললো,, এটা হসপিটাল! আর তাছাড়া আমার মেয়ের বিপদ এখন তাই কিছু বলছিনা। নয়তো কোনদিনও এই মুখটা দেখার ইচ্ছা ছিলোনা।
শোন মেয়ে,,তুমি আমাদের সাথে কোনভাবে কথা বলার চেষ্টা করোনা।
নাবিলার চোখে পানিতে ভরে উঠলো। মার্জিয়া ওকে ইশারায় কাঁদতে নিষেধ করলো।
শিশু হৃদরোগ সার্জন মাহমুদুল হাসান রিপোর্টগুলোতে ভালো করে কয়েকবার চোখ বুলালো,, তারপর মারজুকের দিকে তাকিয়ে বললো আপনার ধারনা সত্যি ডাক্তার মারজুক।
-মারজুক আর আজিম একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো।
-হুম আপনার ভাগ্নের হার্টে একটা বড়সড় ছিদ্র রয়েছে। যাকে মেডিকেলের ভাষায় ‘সায়ানসিস’ বলে। ছিদ্রটা ছোট হলে ঔষধের মাধ্যমে সেরে যেতো। কিন্তু, ওর হার্টের ছিদ্রটা এতোবড় যে কয়দিনের মাঝে অপারেশন না করালে এটি আরো বড় আকারের ক্ষতির দিকে যাবে। একপর্যায়ে বাল্ব নষ্ট হয়ে যাবে। হার্টে এরিদমিয়া তৈরি হবে। পালমোনারী হাইপারটশন বেড়ে যাবে। একপর্যায়ে ফুসফুস পুরো নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
তারপর আজীমের দিকে তাকিয়ে বললো,, আপনিও তো একজন ডাক্তার। সাধারণত এ ধরনের রোগের লক্ষণগুলো অনেক আগ থেকে দেখা দিয়ে থাকে। আপনারা আগে এমন কিছু বুঝতে পারেননি?
-আজীম বললো,, স্যার আয়ানের মাঝে মাঝে জ্বর হতো, কাশির সাথে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যেতো। আবার কখনো বেশি দৌড়াদৌড়ি করতে গেলে অনেকটা হাঁফিয়ে উঠতো। শিশু বিশেষজ্ঞ দেখিয়েছি উনি কিছু ধরতে পারেনি। মেডিসিন দিয়েছে ওগুলো খাওয়ানোর পরে কিছুটা কম ছিলো। আজ আবার হঠাৎ করে!
-আমি বুঝতে পারিনা আপনি একজন ডাক্তার হয়ে আপনার বাচ্চার অসুস্থতা নিয়ে এতো অবহেলা করলেন কিভাবে?
এখন সিদ্ধান্ত নেন কি করবেন? যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে।
আর চাইলে অপারেশনটা আপনারা এখানেও করাতে পারেন আবার বাহিরে গিয়েও করাতে চাইলেও পারেন। আপনাদের ইচ্ছা।
মারজুক আর আজিম ডাক্তারের চেম্বার ছেড়ে চিন্তিত মুখে বেরিয়ে আসতেই মুনতাসির আহমেদের মুখোমুখি হলো।
ওরা দুজনে সমস্বরে সালাম দিলো। মুনতাসির আহমেদ আজিমের দিকে তাকিয়ে বললো,, ডাক্তার কি বললো?
আজীম সব খুলে বলতেই উনি বললেন,, তো অপারেশন করাতে যখন হবে তখন দেরি করছো কেন?
মারজুক কিছু বলতে নিলেই মুনতাসির আহমেদ গম্ভীরভাবে বললেন, আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করিনি।
মার্জিয়া আয়ানের মাথার এক পাশে বসে ছিলো। মারজুকের মুখে সব শুনে আজীমের দিকে তাকিয়ে বললো,, আমি এই লোকটাকে আগেই বলেছি। ও আমার কথার কোন গুরুত্ব দেয়নি! নিজের ব্যস্ততাই ওর কাটেনা আমাদের দিকে কি নজর দিবে? আজ যদি আরো আগে আমার ছেলেকে ভালো করে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতাম তাহলে আমার ছেলেটা এতো রোগে ভুগতোনা।
-মারজুক বললো,, মার্জিয়া কি শুরু করেছিস? এটা হাসপাতাল!
তোদের মেয়েদের এই একটা সমস্যা তোরা কিছু একটা ছুঁতো পেলে হাজবেন্ডের দোষ ধরা শুরু করিস।
ও একজন ডাক্তার ওর ব্যস্ততা সবসময় থাকবে। যেটা আমার বেলায় আমি বুঝি! ডাক্তারদের ছুটি চলাকালীন অবস্থায়ওমহসপিটাল থেকে ফোন আসতেই ছুটে যেতে হয়। যেটা কাল রাতেও আজীমের বেলায় হয়েছে।
ওকে যে দোষ দিচ্ছিস তখন তো অবহেলা তুই করেছিস। তুই কি করেছিস তুই তো ওর মা। বাবা না খেয়াল করলেও মায়েদের সবসময় খেয়াল রাখতে হয় তার বাচ্চার দিকে। আজীম না নিয়ে গেলেও তুই তো আয়ানকে ডাক্তার দেখাতে পারতিস!
যাক, এখন এতকথা না বাড়িয়ে কি করবি তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নে!
মারজুক সেলিনা বেগমকে দেখে এগিয়ে গেলো। সালাম দিয়ে কেমন আছে জিজ্ঞেস করতেই সেলিনা বেগম বললো,, আমি এখানে কারো রং তামাশা দেখতে আসিনি! নেহাত আমার নাতি অসুস্থ নাহলে কখনো তোর সাথে দেখা করার ইচ্ছেও ছিলোনা।
-আম্মু!!
-খবরদার আমাকে আম্মু ডাকবিনা! তোর আম্মু মরে গেছে!
মারজুক কিছু বলতে নিলে আজীম মারজুককে টেনে বাহিরে নিয়ে এলো। মারজুক বাহিরে এসে খেয়াল করলো,, নাবিলা কেবিনের বাহিরে একটা চেয়ারে বসে আছে৷ এতক্ষণ নানা রকম ঝামেলায় ওর নাবিলার কথা মনেই ছিলোনা।
নাবিলা ওদের দেখতে পেয়ে উঠে দাঁড়ালো।
আজীম মারজুককে উদ্দেশ্য করে বললো,, দেখ এখানে কথা বাড়াস না। উনারা এসেছে যখন উনারা উনাদের মত থাক। তুই ভাবিকে নিয়ে বাসায় যা। বেচারি নিজেও নতুন মানুষ! তারউপর এতো কিছুর ঝামেলায় সকাল থেকে সবাই না খেয়ে আছিস এখন দুইটা বাজে।
তুই এখন উনাকে নিয়ে যা আমি ফোন দিলে আবার চলে আসিস। এখানে এখন তুই উনাকে নিয়ে থাকলে আব্বা আম্মার সাথে তিক্ততা আরো বাড়বে। তাই চলে যাওয়াটাই বেটার।
নাবিলা যেতে চাইছিলোনা মার্জিয়া আর আজীমের জোরাজুরিতে যেতে বাধ্য হলো।
হসপিটাল থেকে বেরিয়ে খাবার খেতে মারজুক নাবিলাকে নিয়ে একটা রেষ্টুরেন্টে ঢুকতেই, নাবিলা বললো,, বাসায়ই তো যাচ্ছি খাবার প্যাকেট করে নিয়ে নেন। বাসায় গিয়ে খাবো।
মারজুক ওর কথা মতো খাবার নিয়ে একসাথে বাসায় চলে আসলো।
বাসায় এসে মারজুক ওয়াশরুমে ঢুকলো। সারাদিন ঝক্কি ঝামেলায় শরীর কেমন অবসন্ন হয়ে গেছে। গোসলটা সেরে নিলে কিছুটা ফ্রেশ লাগবে।
নাবিলাও অন্য একটা ওয়াশরুমে গিয়ে গোসল সেরে তাড়াতাড়ি করে জোহরের নামাজ আদায় করে নিলো।
নামাজ শেষে মারজুক বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো। নাবিলা গিয়ে খাবারগুলো গরম করার জন্য চুলায় বসালো। এর মধ্যে ওর মায়ের ফোন। গতকাল রাতের পর আর মায়ের সাথে কথা বলা হয়নি ভাবতে ভাবতে নাবিলা মায়ের ফোন রিসিভ করলো।
ওর মা সব শুনার পরে অনেক আফসোস করলো। নাবিলা বললো,, মা এখন রাখি পরে কথা বলবো। এখনো দুপুরের খাবার খাওয়া হয়নি।
খাবার টেবিলে দিয়ে নাবিলা মারজুককে ডাকতে রুমে এলো। দূর থেকে নাবিলা কয়েকবার ডাকার পরেও মারজুক সাড়া দিলোনা।
তাই কাছে গিয়ে নাবিলা আস্তে করে ওকে কয়েকবার ধাক্বা দিলো। মারজুক নাবিলার হাত ধরে বললো, আজ আমার জন্য তোমাকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে না?
-আমি কেন কথা শুনবো? আর আপনি এতক্ষণ জেগে ছিলেন?
-হুম। মার্জিয়া আমাকে ফোন দিয়ে সব বলেছে। আমি সত্যি দুঃখিত!
-কি যে বলেন না। উনারা বাবা মা উনাদের কষ্ট থেকে উনারা কিছু বলতেই পারে এতে রাগ করবো কেন। আমি কিছুই মনে করিনি। আর তাছাড়া আমার থেকেও বেশি কথা তো আপনাকে শুনতে হয়েছে!
-আমি ওদের সন্তান ওদের কথাগুলো আমার গায়ে সয়ে যাবে। কিন্তু তোমার তো…
আর তাছাড়া আমি তো তোমাকে ও তোমার মতের বিরুদ্ধে বিয়ে করেছি…
মারজুকের গলা ধরে এলো।
-আমি সত্যি কিছু মনে করিনি। আর আমার মতের বিরুদ্ধে বলছেন কেন? আমার সম্মতি না থাকলে আপনি কখনোই আমাকে বিয়ে করতে পারতেন না।
আপনি উনাদের উপর রাগ করবেন না!
মারজুক হুট করে নাবিলাকে জড়িয়ে ধরলো। ওর ভীষন কাঁদতে ইচ্ছে করছে কিন্তু পারছেনা ছেলেরা কাঁদলে নাকি বোকা বোকা লাগে।
-নাবিলা বললো, কাঁদতে ইচ্ছে করলে কাঁদতে পারেন! এতে মন কিছুটা হালকা হবে।
-মারজুক ধরা গলায় বললো,, ছেলেদের নাকি কাঁদতে মানা!
-দূর! কে বলেছে আপনাকে এসব? ছেলে মেয়ে সবারই আবেগ অনুভূতি কষ্ট আছে। তাদের ও তো মনে অব্যক্ত কষ্ট আছে। মেয়েরা কাঁদতে পারলে তারা কেন পারবেনা?
আপনি কাঁদেন তো মন খুলে কাঁদেন যত ইচ্ছা।
-মারজুক না চাইতেও কান্নার মাঝে হেসে দিলো নাবিলার কথা শুনে।
তুমি তো ভালোই কথা পারো! আমি তো জানতাম তুমি কথাই বলতে পারোনা।
-কথা বলতে সবাই পারে কেউ কম কেউ বেশি এখন চলুন তো খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
খেতে খেতে নাবিলা বললো,, রাতে আপুদের জন্য আমি বাসা থেকে ভাত রান্না করে দিবো। হোটেলের এসব বস্তা পঁচা খাবার আর কয়বেলা খাওয়া যায় ?
-মারজুক খেতে খেতে বললো,, কোন দরকার নেই। তুমি খাবার পাঠালে কেউ খাবে কেউ খাবেনা । কথায় কথা বাড়বে। ওরা হোটেলের খাবার খেতে অব্যস্ত আছে সমস্যা হবে না।
-আর একটা কথা বলতে চাইছিলাম?
-বলো।
-আসলে আয়ানের অসুস্থতার কথা শুনে বাবা দেখতে আসতে চাইছেন। আমি কি আসতে বলবো?
-না এখন নিষেধ করে দাও। আব্বু আম্মু ওখানে আছে তোমার বাবাকে দেখে আবার কি না কি বলে বসে? আমাদের কথা শুনাচ্ছে ঠিক আছে উনাদের কিছু বললে মান সন্মান যতটুকু আছে তাও যাবে!
উনারা পরেও আসতো পারবে।
-আচ্ছা!
সন্ধ্যার দিকে মারজুক হসপিটালে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলো এমন সময় আজীম ফোন দিয়ে জানালো, আয়ানের অপারেশন কালকে করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তাই মারজুককে আজ আর হসপিটালে না যেতে নিষেধ করেছে।
রাতের রান্নাটা দুজনে মিলে করে নিলো। খাবার শেষে বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে দুজনে কিছুক্ষন সময় কাটালো।
খাটে এসে মারজুক নাবিলাকে তার জীবনের কিছু গল্প শুনালো।
নাবিলা কিছুক্ষণ পরে লক্ষ্য করলো মারজুক ওর দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। লজ্জা পেয়ে নাবিলা নিজের দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। মারজুক এক হাতে নাবিলাকে কাছে টেনে নিয়ে নিলো। নাবিলাও মারজুকের ডাকে সাড়া না দিয়ে পারলো না……
চলবে………