#হঠাৎ_পাওয়া_সুখ (৩য় পর্ব)
লেখা – শারমিন মিশু
আসসালামু আলাইকুম ডাক্তার সাহেব!
-পিছন থেকে ডাক্তার ইসহাকের সালাম পেয়ে তার উত্তর দিয়ে হাসিমুখে ঘুরে দাঁড়ালো ডাঃ মারজুক শাহরিয়ার। এরপর নিজেও সালাম দিয়ে ডাঃ ইসহাকের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো মুসাফাহা করার উদ্দেশ্যে।
মুসাফাহা শেষে ইসহাকের সাথে কুশলাদি বিনিময় শেষে মারজুক বললো,, কখন আসলেন চিটাগাং থেকে ?
-এইতো ঘন্টাখানেক হলো! আপনি অপারেশন থিয়েটারে ছিলেন তাই কথা হয়নি।
-ওহ আচ্ছা। তা আপনার ওয়াইফের এখন কি অবস্থা?
-জী আলহামদুলিল্লাহ। সে এখন আল্লাহর রহমতে পুরোপুরি সুস্থ।
-আজ থেকে জয়েন করবেন?
-হুম। কিছুক্ষণ মারজুককে চোখ দিয়ে নিরীক্ষণ করে বললো,, মাশাআল্লাহ্!!! আপনাকে তো দাঁড়িতে বেশ মানিয়েছে!!
-মারজুক মুচকি হেসে বললো,,, জাযাকাল্লাহু খাইরান।
-সহীহ নিয়ত আছে তো?
-মানে??
-মানে হলো,, মানুষের প্রতিটি কাজের কোন না কোন উদ্দেশ্য কাজ করে। আর আমাদের ইসলাম এটাই দাবি করে যে আমাদের জীবনের প্রতিটি কাজের পিছনে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্য থাকতে হবে।
সেইজন্য বললাম যে,,, আল্লাহর রাসূলকে ভালোবেসে দাঁড়ি রেখেছেন নাকি আবার কয়দিন পরে ছেটে ফেলবেন?
– আল্লাহ আমার দ্বারা এমন না করুক!!
আল্লাহ এবং তার রাসূলকে ভালোবেসে আমি দাঁড়ি রেখেছি। আর দাঁড়ি তো নবীর সুন্নাত!!! রাসূলের আদর্শ মতে যখন চলার চেষ্টা করছি তখন তার এই সুন্নাতটা বাদ দিবো কেন?
-মাশাআল্লাহ!!বেশ ভালো করেছেন! আছরের নামাজের আযান তো হয়ে গেছে। নামাজ পড়তে এখন যাবেন নাকি দেরি হবে?
-না এখন কোন ব্যস্ততা নাই। আর তাছাড়া আপনি তো বলেছেন সময়মত জামায়াতে নামাজ পড়ে নিলে সওয়াব বেশি।
-হুম জামায়াতে নামাজ পড়া একাকী নামাজ পড়ার থেকে সাতাশ গুন সওয়াব বেশি হয়। তাই যত ব্যস্ততায় থাকুক সব ফেলে নামাজ আদায় করা উত্তম।
-হুম দেরি হয়ে যাচ্ছে। চলুন যেতে যেতে কথা বলি বলে দুজন নওজওয়ান মসজিদের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।
ভাবছেন মারজুক তো এমন ছিলোনা তাই তো?
এখন কি করে কি হলো?
বলছি….
সেই দিনের পর প্রায় ছয় বছর পেরিয়ে গেছে। সেদিন লাবন্য বিয়েটা ভেঙ্গে দেয়নি! মারজুকের সামান্য আবেগের চোখের পানিতে ও ভেসে যায়নি। সেদিন জুয়েলকে বিয়ে করে ও এখন ওর সাথে প্রবাসে আছে। এমনকি ওদের একটা মেয়েও আছে।
আর মারজুকও সেদিন আর পিছনে ফিরে তাকায়নি। লাবন্যকে আল্লাহ ওর ভাগ্যে লিখে রাখেনি এটা ভেবেই ও নিজেকে সামলে নিয়েছে। সেদিনের পর লাবন্যের সাথে আর কোন যোগাযোগ ও রাখেনি। তখন মারজুক জানতোনা বিয়ের আগে ছেলে মেয়ের মাঝে প্রেম ভালোবাসা নামক কোন সম্পর্ক তৈরি হতে পারেনা। এটা পুরোপুরি হারাম। কিন্তু আজ জানে একটা মেয়ে আর একটা ছেলে কখনোই বন্ধু হতে পারেনা। প্রেম ভালোবাসা তো কখনোই না! ফ্রী মাইন্ডের নাম করে ছেলে মেয়েরা যে অবাদে মেলামেশা করছে তা ইসলাম সমর্থন করেনা।
তাই নিজের অজান্তে সেদিন যে আবেগী ভালোবাসায় নিজেকে জড়িয়েছে আজো সেই কথা ভেবে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে প্রতিনিয়ত তওবা করে। না জেনে যে ভুল করেছে তার জন্য ও নিজেই লজ্জিত। আর ওর পরিবারও ততটা ইসলামের শিক্ষা দেয়নি। ওর বাবা মা কেউই ইসলামী জীবন বিধান তেমন মেনে চলেনা। তাই কখনো ইসলামের অনুশাসন গুলো ভালোভাবে জানা হয়নি। কিসে ভালো কিসে খারাপ তার বিবেচনা কি করে করবে।
সেদিনের সেই স্মার্ট আর আধুনিক ছেলে মারজুক এখন পুরোপুরি খাঁটি মুমিন হওয়ার চেষ্টা করছে। ইসলামের বিধিবিধান গুলো মানার চেষ্টা করছে।
অবশ্য তা সম্ভব হয়েছে ডাক্তার ইসহাকের জন্য। ডাঃ ইসহাক এমন একজন মানুষ যিনি তার কথার দ্বারা মানুষকে তার প্রতি আকৃষ্ট করে নিতে পারেন। মিষ্টভাষী আর সুদর্শন ব্যক্তি ডাঃ ইসহাক ইসলামের একনিষ্ঠ অনুসারী। মারজুক আজ দুবছর ধরে উনার সাথে থাকতে থাকতে নিজেও ইসলামের ছায়াতলে সামিল হওয়ার চেষ্টা করছে। পাঁচওয়াক্ত নামাজ জামায়াতে পড়ে। আরবী প্রতি মাসের ১৩/১৪/১৫তারিখে রোযা রাখে৷ সুন্নাত মোতাবেক সব কাজ করার চেষ্টা করে। অবশ্য এটা নিয়ে ওর মা বাবা অনেক মনক্ষুন্ন। এ বয়সে ছেলে এখনি এভাবে সবকিছু থেকে কেন মুড়িয়ে নিবে?
বাসা থেকে মারজুককে বিয়ের জন্য বেশ চাপ দিচ্ছে। মারজুক বলেছে ও বিয়ের জন্য এখনি প্রস্তুত নই। ওর আরো সময় চাই।
সেলিনা আহমেদ এবার আর ওর কোন কথাই শুনবেনা। ছেলেকে বিয়ে দিয়ে সংসারী করে তবেই উনি ছাড়বে। আজো এক জায়গায় মেয়ে দেখতে যাওয়ার কথা। মারজুক যাবেনা বলে দিয়েছে। তারপরও বাসা থেকে বারবার ফোন দিচ্ছে। ও ফোন সাইলেন্ট করে রেখে দিয়েছে।
নামাজ পড়ে চেম্বারে না ঢুকতেই ছোট্ট আয়ান মাম..মা বলে মারজুককে এসে পা জড়িয়ে ধরলো।
মারজুক নিচের দিকে চেয়ে আয়ানকে দেখে হেসে মামা বলে কোলে তুলে নিলো। ভেতরে ডুকতেই দেখলো মার্জিয়া আর আজিম বসে আছে।
মারজুক জানতো আজিম আর মার্জিয়া একে অপরকে পছন্দ করতো। তাই পড়াশুনা শেষ করার পরে বাবা মাকে রাজি করিয়ে ওদের বিয়েটা দিয়ে দিয়েছে। নিজের মন ভেঙ্গেছে তাই বুঝতো ভালোবাসার হারানোর কষ্ট কতটুকু।
মার্জিয়া রেগে মারজুকের দিকে তাকালো। মারজুক তা লক্ষ্য করে বললো,,, কি??? এভাবে জল্লাদের মত তাকিয়ে আছিস কেন?
-আম্মু নাকি তোকে একঘন্টা যাবত ফোন দিচ্ছে,, ফোন কোথায় তোর?
-ফোন তো ড্রয়ারে। আমি নামাজ পড়তে গিয়েছি!
-আজিম বললো,, এখন চল!
-কোথায়?
-নতুন করে বলতে হবে? তোর আজ পাত্রী দেখার কথা না!
-দেখ আমি বলে দিয়েছি আমি যেতে পারবোনা। তোরা দেখে পছন্দ করলেই হবে মার্জিয়াকে লক্ষ্য করে বললো।
আর তাছাড়া সন্ধ্যা ৭টার আগে আমার ডিউটি ছেড়ে যেতে পারবোনা।
-তোকে এত কথা তো বলতে বলিনি ভাইয়া! আমি সালমান আঙ্কেলের সাথে কথা বলেছি উনি তোর ছুটি দিয়েছি।
-দেখ আমি…
-কোন কথা না!! বাবা এমনিতেও ভীষন রেগে আছে। তাই মা আমাকে বলেছে আমরা যাওয়ার পথে তোকে নিয়ে বাসায় যেতে।
-আজিম বললো,, মারজুক এতো ভনিতা করিসনা তো! বিয়ে তো আজ না হয় কাল করতে হবে! বয়স তো আর কম হয়নি!
অবশেষে ওদের কথার সাথে না পেরে মারজুককে যেতেই হলো।
মেয়ে দেখতে যাওয়ার আগে মারজুক রেডি হতে নিলেই সেলিনা বেগম একটা ব্লু কালারের ব্লেজার এনে মারজুকের দিকে বাড়িয়ে বললো,, এটা পরবি যাওয়ার সময়!
-আম্মু আমি এটা…
-কথা বলবিনা। বাড়তি কথা বলা আমি পছন্দ করিনা ভালো করে জানিস!
আর প্যান্ট এটা এভাবে পরছিস কেন!
-কিভাবে পরছি?
-এতো উপরে তুলে কেন পরেছিস? কেমন আনস্মার্ট আনস্মার্ট লাগছে!
-আম্মু আমি শরীয়ত মোতাবেক পরেছি। নিজেকে জাহান্নামের জ্বালানি বানাতে আমি পারবোনা। পুরুষদের সতর টাকনুর উপর পর্যন্ত!
-সব সময় ধর্ম নিয়ে টানাটানি করিস কেন? কার সাথে মিশে এমন হয়েছিস?
-আম্মু তোমাদের তো শুকরিয়া করা উচিত তোমার ছেলে জান্নাতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহন করছে,, আর তোমরা তাকে বাঁধা দিচ্ছো!
যাক গে তোমাদের বুঝানো আমার পক্ষে সম্ভব না। তারপরও বলছি আল্লাহ তোমাদের হেদায়াত দান করুক। ইসলামের সঠিক জ্ঞান যাতে তোমরা উপলব্ধি করতে পারো!
-সেলিনা ছেলের দিকে রেগে কটমট করে তাকালো।
মারজুক তা পুরোপুরি এড়িয়ে বললো,, কই আসো! এখন তোমাদের দেরি হচ্ছেনা।
শুনো, মেয়ে কিন্তু আমার মন মত ইসলামিক না হলে আমি বিয়ে করবোনা বলে দিলাম বলে হাটা ধরলো।
মেয়ে দেখে বাসায় আসার পরে মারজুকের সাথে ওর মা সেই থেকে রাগারাগি করে যাচ্ছে। মার্জিয়ারা ওখান থেকেই চলে গেছে।
এই মেয়ের সমস্যা কোথায়? সেলিনার রাগি কন্ঠ! মেয়ে দেখতে সুন্দর, এডুকেটেড, সামজিক স্ট্যাটাস আমাদের সম পর্যায়ের। কোন দিক দিয়ে কম আছে?
-আম্মু এই মেয়ে অতিরিক্ত আধুনিক! ওর সামাজিক স্ট্যাটাস দিয়ে আমার কি?
ওর ড্রেসআপ দেখেছো?
-সমস্যা কোথায় এখন তো এভাবেই চলছে!
-কোন মুসলিম মেয়ে এভাবে পোশাক পরতে পারেনা। নামে মুসলিম হলে হয়না নিজের চলাফেরায় তার প্রমাণ দিতে হয়।
আর ওর কথা শুনেছো? কেমন নির্লজ্জের মত কথা বলেছে। একটু লজ্জা বা জড়তা ওর মাঝে দেখিনি। ও আমাকে জিজ্ঞেস করছে আমার প্রতিমাসে ইনকাম কত? বিয়ের পর ওর উপর কোন জোর জবরদস্তি করতে পারবোনা! ওর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারবোনা!
সে চাকরী করতে চাইলে বাঁধা দিতে পারবোনা!
যে মেয়ে বিয়ের আগে এমন চটুল চটুল কথা বলে বিয়ের পরে কি করতে পারে বুঝতে পারছো?
– মেয়েটা হয়তো একটু স্পষ্টবাদী তাই হয়তো এভাবে সরাসরি জিজ্ঞেস করেছে।
-আম্মু মেয়েদের এতোটা স্পষ্টবাদি হতে নেই। মেয়েদের হতে হয় নম্র ভদ্র! স্পষ্টবাদি হবে তবে এতোটা ও নয়!.
– আর কি সমস্যা?
-সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো আমি যে রকম মেয়ে চাইছি আমার স্ত্রী হিসেবে ও সেই রকম নয়। ওর মাঝে দ্বীনদারীতার অভাব আছে!
রাসূল (সাঃ) যেখানে বিয়ে করার ক্ষেত্রে সৌন্দর্য্য, সামাজিক স্ট্যাটাসের চেয়ে দ্বীনদারীতাকে সবচেয়ে আগে প্রাধান্য দিতে বলেছে সেখানে তোমার আছো ও সুন্দরী, বংশ পরিচয় আছে,, এডুকেটেড এসব নিয়ে।
-তো বিয়ের পরে তুই তোর মত করে নিবি!
-আম্মু সব মেয়েকে নিজের মত করে নেয়া যায়না। ওর মাঝে যদি একটু হলেও আল্লাহর ভয় থাকতো আমি মেনে নিতাম। কিন্তু ও সেরকম নয় মা। আমার দরকার একজন ইসলামিক পর্দানশীনশিক্ষিত নারী। আমি তাকে চাকরী করতে দিবো তবে পরিপূর্ন পর্দা মেনে।
অতিরিক্ত আধুনিকা স্মার্ট,, আর শিক্ষিত মেয়ে আমার জন্য নয়! এই মেয়ের চলাফেরা কথাবার্তার স্টাইল আমার বিপরীত।
ও আমার জন্য নয় মা! পরে পস্তানোর চেয়ে আগেই সাবধান হয়ে যাওয়া ভালো!
-এখন তুই এতো পর্দানশীন কই পাবি?
-এখনো আছে কোথাও না কোথাও। চাওয়ার মত করে কোন কিছু আল্লাহর কাছে চাইলে আল্লাহ তাকে তাই মিলিয়ে দেয়। আমি আল্লাহর উপর থেকে বিশ্বাস হারাইনি। উনি আমার ইচ্ছাটা ঠিক পূরণ করবেন!!
আল্লাহ আমার মনের খবর জানেন! আর উনি আমার জন্য উত্তম পয়সালাকারী!!!
রাতে খাওয়া দাওয়ার পরে মারজুক যখন ঘুমাতে যাবে তখনি ওর ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনের স্কিনে চোখ রাখতেই দেখলো হসপিটাল থেকে ফোন। মারজুক ফোন রিসিভ করে সালাম দিতেই ওপাশ থেকে মেয়েলি কন্ঠে বললো,,, স্যার আমি আনিকা বলছি!
-ও হ্যা আপা বলুন? এতো রাতে ফোন করেছেন কেন?
-স্যার একটা ইমার্জেন্সি রুগী আনা হয়েছে। আপনি যদি একবার আসতেন!
-কেন হসপিটালে অন্য কোন ডাক্তার নেই? আমার তো ডিউঠি শেষ এখন তো ডাঃ ইসহাক আর ডাঃ শবনমের ডিউটি।
-স্যার ইসহাক স্যার ওটিতে আছে আর শবনম ম্যাডাম উনার বাচ্ছা হঠাৎ অসুস্থ হওয়াতে চলে গেছে। সালমান স্যার তাই আপনাকে ফোন করতে বললো।
-এতো রাতে আমি এখন কি করে…
-স্যার রুগীর অবস্থা খুব খারাপ। আপনি না আসলে….
-আচ্ছা আপনি ফোন রাখুন আমি আসছি।
ফোন রেখে রেডি হয়ে নিলাম। ডাক্তারদের এই এক জ্বালা তাদের কোন ছুটি নেই, বিশ্রাম নেই। দিনরাত পরিশ্রম করতে হয়। রাত বারোটায় ফোন আসলেও ছুটতে হয় নিজের ঘুমের বিসর্যন দিয়ে।
মারজুককে বেরুতে দেখেই সেলিনা বেগম বললেন,, এতো রাতে আবার কোথায় যাচ্ছিস?
-হসপিটালে। একটা ইমার্জেন্সি রোগী আসছে।
-এতো রাতে তুই কেন যাবি? হসপিটালে কি ডাক্তারের অভাব পড়ছে?
-এটা আমাকে ডাক্তারী পড়ানোর আগে কেন মনে করোনি। এখন মানব সেবার দায়িত্ব যখন নিয়েছি তা তো পালন করতেই হবে।
সেলিনা দরজা লাগাতে গেলে মারজুক বললো,, আম্মু গেটটা ভালো করে লাগিয়ে দিয়ো রাতে আর ফিরবোনা বলে বাবার গাড়িটা বের করে নিজেই ড্রাইভ করে বেরিয়ে পড়লো হসপিটালের উদ্দেশ্যে………
চলবে……….