হঠাৎ পাওয়া সুখ পর্ব-৪

0
1271

#হঠাৎ_পাওয়া_সুখ (৪র্থ পর্ব)
লেখা – শারমিন মিশু

রাস্তা অনেকটা ফাঁকা থাকায় আধাঘন্টার রাস্তা ১৫মিনিটে পৌঁছে গেলাম। হাসপাতালে পা রাখতেই আনিকা দৌড়ে এলো। স্যার তাড়াতাড়ি আসুন বলে আনিকা সামনে সামনে হাটতে লাগলো।
-কি অবস্থা বলেন তো?
-স্যার মনে হচ্ছে ঘটনা অন্যরকম!
-মানে???
-আই মিন,,, রেপ কেস হবে আমার মতে! তবে উনারা এখনো কিছু বলেনি!
-রেপ কেস!!! পুলিশে ইনফর্ম করেছেন?
-না স্যার আমার মনে হলো আপনি আসলেই যা করার করবেন। ইসহাক স্যার ও এখনো বের হয়নি ওটি থেকে আমরা তো এখনো ভর্তিও নেইনি। তবে রুগীর শরীরের অবস্থা দেখে আমরা উনাকে ২০২ কেবিনে রেখেছি এখন। কিন্তু রোগীর মা বাবা অনেক কান্নাকাটি করতেছে চিকিৎসা করার জন্য!
-আচ্ছা আমি দেখছি। আপনি এক কাজ করুন গাইনি বিভাগের সোহানা ম্যাডামকে খবর দেন। উনি বোধহয় এখন সরকারী হসপিটালে আছে। ফোন দিয়ে বলেন,, ইমিডিয়েট উনি যেন হসপিটালে আসে।
-জ্বী স্যার বলে আনিকা চলে গেলো।

মারজুক হাসপাতালের করিডোর পেরিয়ে একটু সামনে এসে ২০২ নাম্বার কেবিনে ঢুকতেই লক্ষ্য করলো,, দুজন মধ্যবয়স্ক নারী পুরুষ বসে বসে কাঁদতেছে।
মারজুককে দেখেই ভদ্রলোক উঠে এলো৷ দুহাত জোড় করে অনুনয়ের সুরে বললো,, স্যার আমার মেয়েটাকে বাঁচান স্যার! আমার মেয়েটা মরে যাবে স্যার! দয়া করুন!

ভদ্রলোকের কথায় বেডের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো সম্ভবত ২০কি ২২ বছরের এক তরুনী বেডে নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। মেয়েটার পায়ের দিকটায় রক্তে ভেসে গেছে। সাদা বিছানার চাদর লাল রঙের রক্তে রন্জিত হয়ে আছে। মুখ ঘাড় সহ সব হাতের দিকে অনেকগুলো আচড়ের চিহ্ন। ঠোঁটে কেটে এখনো রক্ত ঝরছে। খুব বিশ্রী এক অবস্থা! কোন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের দেখার মত অবস্থা নয়!
মারজুক ইন্নালিল্লাহ বলে নিজের দৃষ্টি নামিয়ে মেয়েটার মাকে লক্ষ্য করে বললো,, উনার পুরো শরীর ঢেকে দিন।

তারপর বললো,,, দেখুন এটাতো পুলিশ কেস! তাই পুলিশকে ইনফর্ম না করে আমরা উনার চিকিৎসা করতে পারবোনা।

-স্যার দয়া করুন! আমরা পুলিশের ঝামেলায় পড়তে চাইনা! আমার মেয়েকে নিয়ে আর কোন ঝামেলায় জড়াতে চাইনা!

– এটা আইন বিরোধী। আমরা যদি পুলিশকে ইনফর্ম না করে চিকিৎসা শুরু করে তবে আমাদের ডাক্তারদের পুলিশের কাছে জবাবদিহী করতে হবে।
আপনারা অপেক্ষা পুলিশ আসুক তারপর আমরা ট্রিটমেন্ট শুরু করবো!
-স্যার ততক্ষন পর্যন্ত আমার মেয়ে মরে যাবে স্যার। যদি প্রয়োজন হয় পুলিশকে জবাবদিহি আমি করবো বলে ভদ্রলোক কান্নায় ভেঙে পড়লো।
-আপনারা প্লিজ…
-ভদ্রলোক হঠাৎ করে মারজুকের পা চেপে ধরে বললো,,, স্যার আপনার পায়ে পড়ছি স্যার।
-আরে আরে করছেন কি ছাড়ুন! বলে মারজুক নিজের পা ছাড়িয়ে নিলো।

ডাক্তার সোহানা আসার খবর পেয়ে মারজুক কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে এলো।

পরে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলো,, পুলিশের অপেক্ষা করে ট্রিটমেন্ট শুরু করতে যত দেরী করবে ততই রুগীর অবস্থা খারাপের দিকে যাবে।
ডাক্তার ইসহাক বললো,,, দেখুন আমাদের লক্ষ্য মানবতার সেবা করা! এখন আইনের দোহাই দিয়ে একজন মানুষ যদি শুধুমাত্র আমাদের অবহেলার জন্য মারা যায় তার দায় কিন্তু আমাদের। এর তার দায় ও তো এড়াতে পারবে না হাসপাতাল কতৃপক্ষ!

তাই পরে যায় হোক হবে আমার মনে হয় আমাদের আগে ট্রিটমেন্ট শুরু করা দরকার।

আমরা সবাই উনার সাথে সহমত হলাম।
সোহানা ম্যাডাম দুজন নার্সকে সাথে করে রোগীকে ওটিতে নিয়ে গেলেন।রুগীর বাবাকে বললাম হসপিটালের রিসেপশানে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি পূরণ করে হাসপাতালে ভর্তি করে নিতে।

পুরো চারঘন্টা সময় ব্যয় করে রাত তিনটার সময় ডাক্তার সোহানা ওটি থেকে বেরিয়ে এলো।
প্রয়োজনীয় ট্রিটমেন্ট সারা হলো। রুগীকে বেডে নিয়ে আসা হলো। এখনো জ্ঞান ফিরেনি তবে আশংকামুক্ত
ডাঃ সোহানা বেরিয়ে আসতেই মারজুক আর ডাঃ ইসহাক উনার চেম্বারে গেলো।

সোহানা জানলো,, কি বলবো বুঝতে পারছিনা! কোন জানোয়ারের কাজ জানিনা! তবে মেয়েটার এমন বিশ্রী অবস্থা করেছে বলার মতো না! মেয়েটাকে দেখেই আমার শরীর শিউরে উঠেছিলো।
কি সুন্দর মায়াবতী একটা মেয়ে! নিষ্পাপ তার মুখের ভাষা।
জীবনে এতো এতো অপারেশন করেছি,, এসব ধর্ষনের কেসও কিন্তু একটা করিনি! কিন্তু আজকের মেয়েটাকে দেখে আমার কেন জানি খুব কষ্ট হয়েছিলো। আমার চোখ দিয়ে পানি পড়েছে।
ডাক্তারদের হতে হয় শক্ত মনের, আবেগ অনুভূতি তাদের থাকতে হয়না এতদিন এই মেনে চলেছি। কিন্তু আজ কেন জানি খুব খারাপ লেগেছিলো।
আমার নিজের মায়া লেগেছে মেয়েটার নিষ্পাপ মুখ দেখে আর জানোয়ারটার একবারো বুক কাঁপলো না।

ডাঃইসহাক বললো আসলে এইরকম কিছু মানুষরূপী নিকৃষ্ট জানোয়ারের জন্য জানিনা আর কত মেয়েকে এভাবে নির্যাতিত হতে হবে কে জানে?
জানিনা কবে আমরা মানুষ হতে পারবো?
কবে নিজেদের মন মানুসিকতা বদলাবো?
আল্লাহ আমাদের সহ বাকী সবাইকে হেফাজত করুক।

সোহানা বললো,, আমাদের নারী সমাজের দোষ কিন্তু কম নয়! তাদের নিজেদের দোষে আমরা প্রায় সময় নির্যাতিত হই! তাদের উশৃঙ্খল চলাফেরার জন্যই কিন্তু মাঝে মাঝে এসব ঘটনার স্বীকার হতে হয়!
আজকাল তো রাস্তায় নারী নামের পুরুষের বেশ ধরা মেয়েগুলোকে দেখে আমার নিজেকে নারী বলে পরিচয় দিতে লজ্জা হয়।

মারজুক বললো,,,ম্যাডাম কি আর বলবো!! আমাদের প্রগতিশীল যুগের কথা! আমাদের নারীরা স্বাধীনতার নামে মাঠে নামে কিন্তু নির্যাতিত হয়ে ঘরে ফিরে। যারা তাদের স্বাধানতার জন্য উস্কানি দেয় তারাই কিন্তু ওদের ইজ্জতকে ভূলুন্ঠিত কিন্তু।
আর একটা কথা ম্যাডাম ,,,আমাদের কিন্তু রুগীর পরিবারের সাথে ট ব্যাপারে কথা বলা দরকার। পুরো ঘটনাটা জানতে হবে না হলে পুলিশ ইনভেস্টিগেশন করতে আসলে আমাদেরও সমস্যায় পড়তে হবে।

হুম তা ঠিক বলেছেন। পেশেন্টের মা বাবাকে ডেকে আনুন।

উনারা আসতেই মারজুক বসতে বললো।
সোহানা বললো,,, আপনার মেয়ের এ অবস্থা কে করেছে আপনারা কিছু জানেন?
-উনারা চুপ করে ছিলেন।
-মারজুক বললো,, দেখুন আমাদের বললে কোন সমস্যা হবেনা। তাছাড়া আমরা উনার চিকিৎসারত ডাক্তার এটা আমাদের জানতে হবে।এমনিতে পুলিশ আসলে সব তো বলতেই হবে!

-যে এ কাজ করেছে তার সাথে আপনার মেয়ের অন্য কোন সম্পর্ক ছিলো। মানে প্রেমঘটিত কোন ব্যাপার?

-না স্যার আমার মেয়ে অপরিচিত কোন ছেলের সাথে কথা বলতোনা। ওর এই ধরনের কোন সম্পর্ক ছিলোনা!
ও আমাদের সব বলতো!

-আপনারা কি কিছু জানেন? কে এই কাজ করতে পারে?
-ওই দম্পতী একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো।
-আমার মনে হয় আপনারা কিছু লুকোচ্ছেন?

-ভদ্রলোক বললো,,,স্যার আমি আপনাদের বলবো! তবে আপনারা পুলিশকে কিছু জানাবেন না প্লিজ।
আমরা চাইনা আমার মেয়েকে নিয়ে কোন আলোচনা সমালোচনা হোক। পুলিশ জানবে! পেপারে খবর বেরুবে! সবাই আমার মেয়ের দিকে ঘৃণার দৃষ্টি ছুঁড়বে। এগুলো আমার মেয়েটা আরো বেশি সইতে পারবেনা। আমার মেয়েটার অনেক বেশি আত্মসম্মানবোধ!
ওর ভাগ্যে যা ছিলো তাই হয়েছে। যে এসব করেছে সে কোন সাধারণ মানুষ নয়। মানুষরূপী এক জগন্য জানোয়ার! আমরা পুলিশকে জানালে পুলিশ বিচার তো করবেইনা! উল্টো আমাদের স্বাভাবিক জীবন যাত্রাটা ও থেমে যাবে।
তাই আপনাদের কাছে অনুরোধ আপনারা এ ব্যাপারটা কাউকে বলবেন না।

আমরা বসে থাকা তিনজন একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম।
ডাঃ সোহানা বললো,, আপনি আমাদের নিশ্চিন্তে সব বলুন! কথা দিচ্ছি আমাদের তিনজনের বাহিরে কেউ জানবেনা!

শুনুন তাহলে……..
চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here