#হঠাৎ_পাওয়া_সুখ
(৫ম পর্ব)
লেখা – শারমিন মিশু
আমি রাফিউল ইসলাম,,একটা বেসরকারী অফিসে কর্মরত আছি।
স্যার,,, আমার দুই মেয়ে সুমনা আর নাবিলা। বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। আর নাবিলা এবার অনার্স ২য় বর্ষে পড়ছে বাংলা সাহিত্য নিয়ে।
কতো মা বাবাকে চোখের পানি ফেলতে দেখেছি সন্তান বিফলে যাওয়ার কারণে,, সন্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে দেখেছি! অথচ সেখানে আমি আমার মেয়েদের নিয়ে সবসময় গর্ভবোধ করতাম!!
স্যার আমার মেয়েদের কখনো আমাকে শিখাতে হয়নি এ পথে চলো,, এ পথে চলবেনা। পর্দা করো,,, নামাজ পড়ো,, অপরিচিত কোন পুরুষের সাথে বিনা প্রয়োজনে কথা বলোনা। যখন থেকে প্রাপ্ত বয়স্ক হয়েছে তখন থেকে ওর মার দেখাদেখি ওরা ইসলামের বিধিবিধান গুলো নিজে থেকে মেনে চলতো। ওর মা অনেকটা ধার্মিক!
আমি তেমন ভাবে ইসলামের নিয়ম কানুন গুলো মানতাম না। ঘরে প্রায় অনেক নারী মূর্তি আর অনেক জীবজন্তুর ছবিতে আমার দেয়ালে টাঙ্গিয়ে ছিলাম। আমার মেয়েরা সব ফেলে দিয়েছে। বলেছে, বাবা আমাদের ঘরটাকে কেন তুমি আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছো।
স্যার কখনো আমার ঘরে গেলে দেখতে পাবেন,, আমার পুরো ঘরদোরে ইসলামী সংস্কৃতির একটি প্রতিফলন আছে। আমার মেয়েরা রুমের দেয়ালটাকে বিভিন্ন অথোপূর্ণ ক্যালিগ্রাফী আর প্রাকৃতিক দৃশ্য দ্বারা সাজিয়েছে। নাবিলা বলতো বাবা জানোতো,, এ পৃথিবীর চমৎকার সৃষ্টির পিছনে যে একজন মহান কুশলী স্রষ্টা রয়েছেন এগুলো সেই সাক্ষ্যই দিচ্ছে। তোমার ওই কুকুর বিড়ালের ছবি আমাদের ঘরে রহমতের ফেরেশতা প্রবেশ করতে দেয়না। আমাদের ঘর হবে ইসলামের আলোয় আলোকিত একটা ঘর,, যার চারদিকে তাকালেই মন জুড়িয়ে যাবে।
অনেক বেশী শো- পীস না কিনে পয়সা নষ্ট না করে ওরা ঘরে একটা চমৎকার পাঠাগার গড়ে তুলেছে।
বলতো,, বাবা এসব দামি জিনিস কিনে কি হবে? বই পড়বে বেশি করে! কেননা জ্ঞানই হচ্ছে প্রকৃত আলো! বলেই দুবোন হাসতে থাকতো।
এমন ভাবে প্রাইমারী লেভেল থেকে পার হবার পর সহশিক্ষার কুফল থেকে বাঁচার জন্য ওরা গার্লস স্কুলে পড়াশুনা করেছে। এখনো গার্লস কলেজে পড়ছে। আমার ছোট মেয়ের যুক্তি হলো,, ওর মাকে ও বলেছে,, মা সহ শিক্ষার ফলে না চাইতেও ছেলে মেয়ে একে অপরের সাথে দুষ্টামি করতে করতেও নানা রকম অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। আমরা যতই বলি যে আমরা ও পথে পা বাড়াবোনা,, কিন্তু তা কখনোই সম্ভব হয়না!
একটা নারী হলো চুম্বক সদৃশ্য আর পুরুষ লোহা সদৃশ্য! কিন্তু সত্য হচ্ছে চুম্বকের নাগালে লোহা থাকলে তা স্পর্শ করবেই!!
আগুনের পাশে মোমবাতি রাখলে তা গলবেই!!
এটা ঠেকানোর কোন উপায় নাই
নারী এমন সৃষ্টি যা পুরুষের কাছে অতিশয় লোভনীয়,, বড়ই আকর্ষনীয়। তাই নারীকে সর্বদা পুরুষের নাগালের বাহিরে অবস্থান করা বাঞ্ছনীয়! উভয়কেই দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে! যাতে কোন প্রকার অঘটন না ঘটতে পারে!
জানো মা বড়ই আফসোস হয়, আজকের শিক্ষাব্যবস্থা নর নারীর সহ অবস্থান এক কঠিন মরণ ব্যধির রুপ নিয়েছে। তাই আমাদের নিরাপত্তার পথ আমাদের খুঁজে নিতে হবে।
আর আজ আমার সেই মেয়েটা এভাবে পড়ে আছে বলে ভদ্রলোক আবারো কান্নায় ভেঙে পড়লো।
এতক্ষণ আমরা মগ্ন হয়ে ভদ্রলোকের কথা শুনছিলাম। যে মেয়ে এতো কিছু জানে বুঝে তার এ অবস্থা কেন? আমাদের সবার মনে একটা প্রশ্ন! কৌতুহল আরো বেড়ে গেলো পুরোটা জানার জন্য!
ডাক্তার ইসহাক তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো,, যে মেয়ে এত কিছু বুঝে আজ তার এ অবস্থা কেন? আমাদের পুরোটা বলুন আঙ্কেল!
ভদ্রলোক তার স্ত্রীকে বললো,, তুমি বাহিরে যাও নাবিলার মা!
ভদ্রমহিলা বেরিয়ে গেলো।
ভদ্রলোক আবারো বলতে লাগলো,, বড়ই সুখের সংসার ছিলো আমাদের। কিন্তু জানোয়ারদের চোখ তা সইতে পারলোনা।
নাবিলা কলেজে সবসময় একা যেতো একা আসতো। কলেজ আর বাসা ছাড়া খুব একটা কোথাও যেতোনা। কলেজে মেয়ে বান্ধবী ও ওর তেমন নেই। ওর মানুসিকতা সবার সাথে মিলতোনা বলে নিজের মতোই চলতো।
দু তিন মাস যাবত এলাকার কিছু উঠতি মাস্তান নাকি ওর পথ আটকাতো। কয়েকদিন নাবিলা আমাদের কিছু জানায়নি। ওরা কখনো ওর স্কার্ফ ধরে টান মারতো কখনো হাতে টান মারতো। কখনো বা চলন্ত রিকশায় কেউ ওর পাশে উঠে বসে যেতো।
ওদের এসব অত্যাচার যখন ভয়ংকর রূপ ধারণ করে নাবিলা তখন ওর মাকে জানায় যে ও আর কলেজে যাবেনা!
ওর মা কারণ জানতে চাইলে কেঁদেকেটে সব খুলে বলে।
নাবিলার মা আমায় এসব জানালে আমি সিদ্ধান্ত নিই পরদিন আমি নাবিলার সাথে গিয়ে ওদের বুঝিয়ে বলবো। না হলে পুলিশের দারস্ত হবো।
পরদিন যথারীতি আমি নাবিলাকে নিয়ে গেলাম। মৌড়ে আসার পরে ওরা আমাকে নাবিলার সাথে দেখে সামনে আগাতে গিয়েও আগায়নি। নাবিলা হাত দিয়ে ইশারা করে দেখিয়ে দেয়।
আমি রিকশা থামিয়ে নেমে গিয়ে, ওদের খুব ভালো করে বুঝিয়ে বলি।
ওদের মধ্যে একজন বললো,, না সরলে কি করবেন?
আমি শান্তস্বরে বলি বাবা এটা অন্যায়!! এভাবে একটা মেয়েকে রাস্তার মধ্যে অপদস্ত করা ঠিক নয়! তোমাদের ঘরেও তো মা বোন আছে!!
আরেকজন বললো,, পৃথিবীর সব মেয়ে যদি মা বোন হয় প্রেমিকা হবে কে?
লজ্জায় আমার মাথা কাটা গেলো।
ওদের মাঝের একটা ছেলে এসে জোরে কথা বলা ছেলেটাকে টেনে নিয়ে যায়।
আমরা আমাদের মতো সেদিন চলে যাই।
সেদিন আবারো নাবিলা আসার পথে ওরা আবারো পিছু নেই৷ মেয়েটা বাড়ীতে এসে সারাদিন রাত কেঁদেছে। বুঝতে পারি ওরা বুঝার মতো ছেলে নয়!
পুলিশের সাহায্য চাইলে তারা জানায়,, এ ছেলেগুলোর মাথার উপর নামীদামী একজন রাজনীতিবিদের হাত আছে। এদের কিছুই করা সম্ভব নয়! পারলে আপনারা আপনাদের মেয়েকে চোখে চোখে রাখুন! আমাদের পক্ষে কিছুই করা সম্ভব নয়!
নিরাশ হয়ে ফিরে আসলাম। যাদের কাছে সাধারন জনগণ নিরাপত্তার জন্য যায় তাদের কাছেই যদি আশ্রয় না পায় তখন নিজেরাই নিজেদের সাহারা দিতে হয় । হয় লড়াই করে বেঁচে থাকো না হলে এখানেই থেমে যাও!
আমার মেয়েটা বেশ মুচড়ে পড়েছিলো। ও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলো। এতো শালীনভাবে মেনে চলার পরে জানোয়ার গুলোর স্বীকার হতে হলো ওটা ও মানতে পারতোনা। আমি নাবিলাকে থামতে দিইনি। আমার মনে হয়েছে থেমে গেলে ওরা আরো ক্ষেপে যাবে। এরপর থেকে হয় আমি না হয় ওর মা ওর সাথে যেতাম আসতাম।
এভাবে প্রায় আজ এতদিন ধরে চলেছি। আমাদের নাবিলার সাথে চলতে দেখে ওরা কিছু বলতোনা তবে ওদের চেহারা বলে দিতো ওরা যে ক্ষেপে আছে।
গতকাল আমি অফিস যাওয়ার পথে নাবিলাকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে যাই। আমাকে একটা কাজে কাল গাজীপুর যেতে হয়েছে তাই ওর মাকে বলেছি কলেজ ছুটির আগে গিয়ে ওকে নিয়ে আসতে ।
কাল কলেজে কিছু ঝামেলা হওয়ার কারণে নির্ধারিত সময়ের আগে ছুটি হয়ে যায়। নাবিলা ওর মাকে ফোন দিয়েছে। কিন্তু বাসায় হঠাৎ কিছু মেহমান এসে পড়ায় ওর মা রান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ফোনের শব্দ শুনেনি। পুরো কলেজ খালি হয়ে গেছে এখানে একা থাকাটাও অনিরাপদ তাই নাবিলা প্রায় ঘন্টাখানিক অপেক্ষা করে একা একা সাহস করে বেরিয়ে পড়ে।
কিন্তু সেই বেরিয়ে পড়াটাই ওর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।
ওর মা কলেজে গিয়ে ওকে না পেয়ে ওর ফোনে কল দেয়। কিন্তু ফোন বারবার বন্ধ বলছিলো। দিশেহারা হয়ে ফাতেমা আমাকে কল দেয়। আমি মিটিংয়ে ব্যস্ত ছিলাম তাই তখন ধরতে পারিনি।
মিটিং শেষ করে ফাতেমাকে কল দিতেই ওর কান্নাজড়িত কথাগুলো শুনে আমার আর বুঝতে দেরি হয়নি কি হতে পারে।
ফিরে এসে লোক জানাজানি বা করে নিজেরা গোপনে প্রায় সব জায়গায় খবর নেয়া শুরু করলাম। সম্ভাব্য সব জায়গায় খুৃজেছি। নিজেদের কিছু ঘনিষ্ট আত্মীয়দের জানালাম। তারাও খুঁজেছে। এতোবড় ঢাকা শহরের কোথায় খুঁজবো আমার মেয়েকে! ওর মাতো জ্ঞান হারিয়ে পড়ে ছিলো সারারাত। বড় মেয়ে সিলেটে থাকে। ওকে খবর দেয়ার কথাও মনে ছিলোনা। পরে ওকে আজ সকালে জানাতে ও সাথে সাথে রওনা দিয়েছে এখনো এসে পৌঁছায়নি।
পুলিশকে জানায়নি কারণ তারা আগেই বলেছে কিছু করতে পারবেনা তাই! আর তাছাড়া ওদের জানালে আশেপাশের লোক জানাজানি হবে আমার মেয়ে উধাও! আমার মেয়ের দিকে আঙুল তুলবে সবাই সেই ভয়ে নিরবে নিরবে মেয়েকে খুঁজেছি। যারা এ কাজের সাথে জড়িত গোপনে সবার ঠিকানা যোগাড় করে প্রত্যেকের বাড়ীতে খোঁজ নিলাম। কেউ কোন সম্ভাব্য তথ্য দিতে পারেনি।
ওদের পরিবারের কেউ ও কোন তথ্য দেয়নি। ওরা,, জানিয়েছে ওদের ছেলেদের সাথে ওদের তেমন ভালো সম্পর্ক নেই।অনেক কষ্টে একটা নাম্বার যোগাড় করে ফোন দিতে শুনি নাম্বারটা বন্ধ। কাল বিকাল থেকে আজ সন্ধ্যা পর্ষন্ত আমাদের দিশেহারা অবস্থা ছিলো। না ঘুম ছিলো চোখে!! না বাসায় কোন রান্নাবান্না!!
আমরা কি করবো না করবো কিছুই বুঝতে পারছিনা!
ওর মা দরজার পাশে বসে ছিলো ওর মেয়ে কখন আসবে কখন দরজার কলিংবেলটা বেজে উঠবে। আজ সন্ধ্যার পরে কলিংবেলের শব্দ হতেই আমি পাগলের মতো ছুটে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখলাম আমার মেয়েকে নিয়ে আরেকটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাবা হয়ে মেয়ের দিকে তাকাতে পারছিলাম না আমি। চিৎকার ওর মাকে ডাক দিতেই ওর মা ছুটে এসে মেয়েকে নিজের বাহুডোরে জড়িয়ে নিয়ে নিজের ওড়না দিয়ে পুরো শরীর ঢেকে নিলো। আমরা মেয়ের দিকে খেয়াল করায় কোন ফাঁকে ওকে নিয়ে আসা মেয়েটা বেরিয়ে চলে যায়।
নাবিলাকে ঘর পর্যন্ত নিতে পারিনি। ও ওখানেই ঢলে পড়ে। এরপরের ঘটনা তো আপনাদের জানা আছে!!
হাসপাতালের মসজিদ থেকে সুমধুর কন্ঠে ফজরের আযান ভেসে এলো। কথায় কথায় কখন যে সকাল হয়ে গেলো কেউ টের পায়নি।
সামনে বসে তিনজন ডাক্তারের চোখ দিয়ে সমানে পানি পড়ছে। ঘটনা যে এতো ভয়ংকর তা ওদের কারো ভাবনায় ছিলোনা। পুরো একদিন একরাত মেয়েটাকে আটকে রেখেছিলো।
ডাক্তার সোহানা বললো,, আসলে ওর অবস্থা দেখে আমি বুঝতে পেরেছি যে এটা কোন সাধারণ ধর্ষণ নয়। তারপরও আপনাদের মুখ থেকে জানার জন্য মন উসখুস করছিলো তাই।
ভদ্রলোক বললেন,,প্লিজ আপনাদের কাছে বিনীত অনুরোধ আপনার পুলিশে জানাবেন না।
মারজুক বললো,,, আপনারা নিশ্চিত থাকুন আমরা আপনার মেয়ের সন্মান নষ্ট করবোনা। ওর ঈমানদারীতার প্রতিফল আল্লাহ ঠিক দিবেন।
এমন সময় বাহিরে থেকে ছাপা কান্নার আওয়াজ শুনা গেলো। ভদ্রলোক আমার বড় মা এসেছে বলে ছুটে বেরিয়ে গেলো।
ওরা তিনজনও পিছন পিছন গেলো।
দুজন তরুন তরুণীকে জড়িয়ে ধরে নাবিলার মা কাঁদছে। তার সাথে ওর বাবা ও যোগ দিলো। দেখেই মনে হচ্ছে ওরা ভদ্রলোকের বড় মেয়ে আর জামাই।
ডাঃ ইসহাকের ফোন আসায় উনি অন্যদিকে চলে গেছে।
তরুণ ছেলেটি এদিকে এগিয়ে এসে সালাম দিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে বললো,,, স্যার এখন কি অবস্থা পেশেন্টের?
-জী উনি এখন শঙ্কা মুক্ত,,, তবে এখনো জ্ঞান ফিরেনি।
মারজুক নিজের চেম্বারে ফিরে এলো। এরকম পরিস্থিতি দেখতে ওর ভালো লাগছেনা। ভিতর থেকে সব শূন্য শূন্য লাগছে। কেন এমন হয় ভালো মানুষগুলোর সাথে?
কেন তারা স্বাধীনভাবে চলতে পারেনা?
বেপরোয়া মেয়েগুলোর বেহায়াপনার শাস্তি এরা কেন পাবে?
মনের মধ্যে এক ধরনের শ্রদ্ধাবোধের সৃষ্টি হলো নাবিলার জন্য। মনটা কেমন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। কেমন যেন অস্থিরতা কাজ করছে মনের মধ্যে।
ডাঃ ইসহাকের ডাকে ভাবনায় ছেদ পড়লো। সব চিন্তা ভাবনা ছেড়ে মারজুক বেরিয়ে পড়লো ফজরের নামাজ পড়ার উদ্দেশ্যে……
চলবে………….
চোখের কোনে যদি পানি চলে আসলে তাহলে বুঝবেন আপনি ও তার দুঃক্ষে দুক্ষি ও ইসলামিক গল্প পড়তে ভালোবাসেন।