“হালাল প্রেম” পর্ব- ২৭

“হালাল প্রেম”
পর্ব- ২৭
(নূর নাফিসা)
.
.
সকালে দুজনেরই ঘুম ভাঙলো ফোনের রিংটোনের শব্দে। জোভান ঘুমঘুম কণ্ঠে “হ্যালো” বলতেই মিরাজের চেচানো কণ্ঠ শোনা গেলো,
“তোর জন্য এখনো নাস্তা না করে বসে আছি আর তুই এখনো ঘুমাচ্ছিস! তোকে না বললাম সকাল সকাল ভাবিকে নিয়ে চলে আসতে! থেকে যেতে বললাম, সেটাও করলি না! তারাতাড়ি আয়।”
“এই খিচুড়ি খাওয়ার জন্য তোর ভাবিকে নিয়ে আসবো!”
“কি! অন্যসময় থালা নিয়ে কাড়াকাড়ি করেন আর এই খিচুড়ি আজ এতোটা তুচ্ছ হয়ে গেলো! ভাবিকে না আনবি, তুইও তো আসবি!”
“ভালো লাগছে না। বারবার আসা যাওয়া ভেজাল। তোরা নাস্তা করে নে। আমি তোর ভাবিকে নিয়ে একেবারে দুপুরেই আসবো।”
“বারবার আসা যাওয়া ভেজাল? ভাবি ডাকলে তো শতবারেও ভেজাল হতো না। বিয়ে করেছিস বলে বেঁচে গেলি! নতুবা তোর ভেজাল গিরি ছুটায় দিতাম! দুপুরে তোরে আমি এই খিচুড়িই খাওয়াবো।”
“ওকে, বাই…”
জোভান কল কেটে মৃদু হাসলো। শারমায়াকে টেনেটুনে শাড়ি ঠিক করতে দেখে বললো,
“টানাটানি কেন? ঠিকই তো আছে। সারারাত তো আমিই শাড়ির খেয়াল রাখলাম। যেই লজ্জাবতী তুমি, আমি ভয়েই সাবধান।”
শারমায়া মুখ চেপে হেসে উঠতে গেলে জোভান তা হতে দিলো না।
“আরও পরে।”
“ক’টা বাজে?”
“নয়টা।”
“এতো দেরি! এতোক্ষণ ঘুমালাম কিভাবে!”
জোভান মুচকি হেসে বললো,
“আমার জন্য। এজন্যই তো বলেছি, রাতে থাকতে বলবে না। অভ্যাস খারাপ হয়ে যাবে।”
“উঠুন এবার।”
“কেন, ক্ষুধা লেগেছে?”
“উহুম।”
“তাহলে দশটায় উঠবো।”
“বাসায় যাবো না?”
“কেন? সাফওয়ানা তো আর আসবে না। বাসায় গিয়ে কি করবে? একেবারে দাওয়াত খেয়ে তারপর যাবে।”
“কি আশ্চর্য! আমি কি ড্রেস নিয়ে এসেছি? না এগুলোই পরে যাবো!”
“সেই চিন্তা তো আমার মাথায়ই আছে। তুমি শুধু এখন আমাকে ফিল করো।”
“আমি এখন উঠবো।”
“অসম্ভব।”
“তো কি করবো?”
“ফিল করবে।”
শারমায়া তার দিকে একবার তাকিয়ে পরক্ষণে হাত বাড়িয়ে জোভানের ফোন নিলো। গ্যালারিতে একের পর এক ছবি দেখতে লাগলো। মোটরসাইকেলে জোভানের ছবি দেখে শারমায়া বললো,
“আপনি বাইক চালান কেন? গাড়িতে যাওয়া যায় না সবসময়। বাইকে এক্সিডেন্ট বেশি হয়।”
“চালাই না তো। এটা এমনিতেই ঘুরতে গিয়েছিলাম সেদিন।”
“আমি আরও একদিন রাস্তায় দেখেছি আপনাকে বাইক চালিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছেন।”
“মাঝে মাঝে শখ হয় তাই একটু আধটু চালাই।”
“এতো শখের প্রয়োজন নেই। বাইক চালাবেন না। পেছনে বসেও চড়বেন না আর। কোথাও যাওয়ার হলে গাড়িতে যাবেন।”
“এটা রাখো। আমি কাছে আছি, তুমি আমাকে দেখে দেখে কথা বলো। প্রতিদিন কি আর কাছে পাবে?”
শারমায়া তার দিকে একবার তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে আবার ছবি দেখতে দেখতে বললো,
“কি বলবো?”
“যেকোনো কিছু।”
“আপনার প্রেমকাহিনী শুনান।”
“আমার প্রেমকাহিনী জুড়ে তো তুমিই। তোমার গল্পই তোমাকে শুনাবো?”
“আগে কারা ছিলো তাদেরটা বলুন।”
“তুমি আমাকে সন্দেহ করো?”
“সন্দেহের কি আছে! আজকালকার যুগে প্রেমকাহিনী থাকতেই পারে।”
“তাহলে তোমারটা শুনাও।”
“আমার কোনো প্রেমকাহিনী নেই। আমি তো আর আপনার মতো সবার ক্রাশ না। আমি সাধারণ, তাই আমার দিকে কেউ ড্যাবড্যাব করে তাকায় না।”
“আমার দিকে তাকায়?”
“তাকায় না আবার!”
“মিরাজের বাসার সবার কথা বলছো? সেখানে তো সবাই আমার চেয়ে বেশি তোমার দিকেই তাকাচ্ছিলো।”
“তার কারণও তো আপনিই। আমি আপনার বউ বলেই তাকিয়েছে, নয়তো তাকাতো না। আর আপনার দিকে তো সবজায়গায়ই মেয়েরা ড্যাবড্যাব করে তাকায়।”
“আরও দেখেছো কখনো?”
“দেখেছি না!”
“কোথায়?”
“আমাদের কলেজেও দেখেছি।”
জোভান সামান্য চিন্তিত হয়ে বললো,
“কলেজে…? সেটা কবে?”
“আমাদের প্রিটেস্টের রেজাল্টের দিন।”
“তোমাদের প্রিটেস্টের রেজাল্ট! তারমানে আমাদের বিয়েরও আগে?”
“হুম।”
জোভান মুখে দুষ্টুমির হাসি ফুটিয়ে শারমায়ার দৃষ্টি তার দিকে ফেরাতে হুট করেই ফোন নিয়ে নিলো এবং বললো,
“সেদিন অনেক মেয়েরা আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়েছিলো তাই না?”
“তা নয়তো কি!”
“আচ্ছা? তুমিও তো তাদের মতো আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়েছিলে।”
শারমায়া সামান্য থতমত খেয়ে বললো,
“আমি! আমি কেন তাকাবো! আমার আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই।”
“মিথ্যে বলছো, আমি দেখেছি তুমি তাকিয়েছিলে।”
ধরা পড়ে দৃষ্টি লুকাতে শারমায়া জোভানের বুকে মুখ লুকিয়ে হেসে উঠলো। তার কাণ্ড দেখে জোভানও হেসে উঠলো। শারমায়া মুখ লুকিয়ে রেখেই বললো,
“আপনি কি সত্যিই দেখেছেন আমাকে?”
“যদি জানতাম কলেজে আমার বউ আছে, ঠিকই খুঁজে বের করে ফেলতাম। আর প্রতিদিন চলে যেতাম তোমার সাথে দেখা করতে। মাঝে মাঝে কলেজ ফাঁকি দিয়ে ঘুরতে চলে যেতাম।”
“ইশ! শখ কত! আমি অন্যদের মতো ড্যাবড্যাব করে তাকাইনি, জাস্ট দেখতে চেয়েছিলাম তাদের ক্রাশটা কে? আর কলেজ ফাঁকি দিয়ে পালাবেন কিভাবে? আমার শ্বশুরমশাই আছে সেখানে।”
“তোমার শ্বশুর মশাইয়ের চেয়ে বেশি পাওয়ারফুল আমার আরেক বাবা আছে সেখানে। আমি বললে উনি নিজেই ব্যবস্থা করে দিতো।”
“কে?”
“তোমাদের প্রিন্সিপাল।”
“প্রিন্সিপাল বাবা মানে!”
“বাবার বাল্যকালের বন্ধু তো। আমাকে অনেক আদর করে। আমি বাবা না ডাকলে আমার সাথে রাগ করে। উনার ছেলে নেই তাই আমাকে ছেলে মানে। দুইটা মেয়ে আছে। একজন ফেনীতে থাকে আরেকজন কানাডা থাকে। আমাকে ও জেভা আপুকে একদম আপন ছোট ভাইবোন মানে তারা। যখন তারা বেড়াতে আসে আমাদের যেতেই বলবে। কানাডার আপু দেশে আসলে দুইবোন মিলে মাঝে মাঝে আমাদের বাসায় আসে বেড়াতে। আমি কলেজে যতবার গিয়েছি কেবল প্রিন্সিপালের সাথে দেখা করতে। বাবার সাথে দেখা করতে কখনো কলেজে যাইনি। কোচিং-এ ও যাইনা, দেখো আমাকে যেতে?”
“উহুম।”
“কলেজে গেলে প্রিন্সিপালের সাথে দেখা করে চলে আসি। আমার বাবা জানেও না আমি যে গিয়েছি। পরে কারো কাছে শুনে বাসায় এসে জিজ্ঞেস করে গিয়েছি কি না। টিচাররাও অনেকে ভাবে আমি প্রিন্সিপালেরই ছেলে।”
শারমায়া বিড়বিড় করে বললো,
“প্রিন্সিপালের রুম থেকে বের হতে দেখে আমিও তো এটাই ভেবেছিলাম।”
জোভান হাসলো। শারমায়া বললো,
“আপনি তো টিচার না, তাহলে সবাই আপনাকে জয় স্যার বলে কেন?”
“এর পেছনে তোমার বলা সেই ড্যাবড্যাব কাহিনী আছে।”
“কিসের কাহিনী?”
“ইংল্যান্ড থেকে যখন দেশে ফিরেছি বেকার থাকায় বাবা বলেছিলো বাবার কোচিং এ ক্লাস করতে। তো বাবার কথামতো গেলাম। ফার্স্ট ক্লাসে ইন্ট্রডিউস দিয়ে বই ছাড়া বেসিক ক্লাস নিলাম। স্টুডেন্টদের মনযোগ দেখে বেশ খুশি হলাম। ভার্সিটি লাইফেও তো আমরা ক্লাসে হৈচৈ করতাম কিন্তু তারা সবাই কোনো হৈচৈ ছাড়া চুপচাপ আমার কথা শুনছিলো। দুতিনদিন ক্লাস করার পর আমি পড়া রিপিট চাইতে লাগলাম। কিন্তু আমি চরম অবাক! কেউ পড়া রিপিট করতে পারেনি। এতো মনযোগ দিয়ে ক্লাস করলো অথচ পড়া রিপিট করতে পারেনি, বিষয়টা কেমন যেন লাগলো। তখন আবার ছেলেমেয়ে একত্রেই ক্লাস করতো। পরদিন বিষয়টি বুঝার জন্য সবদিকেই একটু লক্ষ্য রাখলাম। দেখলাম মেয়েরা মনযোগসহ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেরাও কেউ কেউ। আবার ছেলেদের মধ্যে কেউ কেউ দেখি মেয়েদের দিকে তাকিয়ে আবার আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসে! আমি কয়েকজনকে দাঁড় করিয়ে সবেমাত্র বলা উক্তিই রিপিট করতে বললাম। দুএকজন পেরেছে আর বাকিরা পারেনি। তখন বুঝতে বাকি নেই যে আসলে তাদের মনযোগ আমার উক্তিতে না, তাদের মনযোগ আমার চেহারায় আটকে ছিলো। তাদের এই ভয়াবহ অবস্থা দেখে কোনোমতে সপ্তাহ পাড় হতেই আমি আর নাই! তোমার শ্বশুরমশাইয়ের জয়েনিং লেটার ফেরত দিয়ে দিয়েছি। সাথে প্রতিজ্ঞা করেছি, প্রয়োজনে রিকশা চালাবো তবুও শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ করবো না। সেটা করতে গেলে আগে প্লাস্টিক সার্জারি করতে হবে। সেই থেকে সাতদিন যারা পড়েছে তাদেরও স্যার, তাদের মুখে স্যার শুনে শুনে যারা পড়েনি তাদেরও স্যারই! আমার ফ্রেন্ডদের মধ্যে এই কাহিনী যারা জানে, তারা সাদাতকে টিচার হওয়াতে বিদ্রুপ করে জিজ্ঞেস করে স্টুডেন্টদের প্রেমের ক্লাস করায় নাকি বোর্ড বইয়ের ক্লাস?”
তার কাহিনী শুনে শারমায়া খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here