“হালাল প্রেম” পর্ব- ৩৭

“হালাল প্রেম”
পর্ব- ৩৭
(নূর নাফিসা)
.
.
“সালাম দিয়েছি তো।”
শারমায়া ভেজা দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রাগান্বিত গলায় বললো,
“তো কি হয়েছে? আপনাকে শুনিয়ে জবাব দিতে হবে?”
জোভান কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বললো,
“চালাইনি তো এতোদিন। কাছেই একটা কাজ ছিলো, মিরাজের বাইকটাও ছিলো অফিসে ভাবলাম তারাতাড়ি হয়ে যাবে তাই নিয়ে গিয়েছিলাম।”
“সেসব আমাকে শোনাচ্ছেন কেন? আমি জানতে চেয়েছি কিছু?”
“স্কুলের একটা বাচ্চা তার মায়ের হাত ছেড়ে রাস্তায় নেমে পড়েছিল। সাডেনলি ব্রেক করতে গিয়ে আমিই পড়ে গেছি। কোনো গাড়ির সংস্পর্শে যাইনি, সাইডে পড়েছি। ব্যাথা পাইনি তো। রাস্তায় স্লিপিং হওয়ায় একটু ছিলে গেছে।”
শারমায়া তেড়ে তার কাছে এসে পায়ের ব্যান্ডেজের উপর মেরে বললো,
“ছিলে গেছে? ছিলে গেলে এখানে ব্যান্ডেজ কেন?”
যদিও হালকাভাবে মেরেছে, ব্যাথা পেয়ে জোভান কেঁপে উঠলো এবং বললো,
“একটুখানি রক্ত বের হচ্ছিলো, তাই আপু ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। পা ভেঙে গেলে তো মোটা করে প্লাস্টার করা থাকতো। আমি হাটতে পারি তো। হাটবো?”
শারমায়া তার পাশে বেডে বসে তার হাতের উপর মেরে বললো,
“তাহলে এখানে প্লাস্টার করা কেন? ছিলে গেলে তো প্লাস্টার থাকবে না।”
জোভান ব্যাথায় হাত গুটিয়ে নিয়ে “ওফ্ফ!” শব্দ করে উঠলো। অতঃপর বললো,
“ডাক্তাররা একটু বেশিই বুঝে। দেখছো না, আমি পুরোপুরি সুস্থ।”
“চুপ! একদম মিথ্যে বলার চেষ্টা করবেন না। কি ভেবেছেন, আমি জানি না কিছু?”
শারমায়ার কণ্ঠ ধাঁধিয়ে আসায় জোভান খুবই শান্ত গলায় বললো,
“কাঁদছো কেন? মরে যাইনি তো আমি।”
জোভানের কথায় শারমায়া স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। বেদনাগ্রস্ত দুচোখ টলমল করছে। জোভান আবারও শান্ত গলায় বললো,
“আন্টি কি খুব জোরে মেরেছে আমার জানটাকে? কষ্ট নিয়ো না। মায়ের হাতের মাইর সন্তানের জন্য দোয়া হয়ে থাকে। মা-বাবা তো আমাদের ভালোটাই চান। সাফওয়ানার কাছে শুনেছি আমি। তোমার কথা শুনে আন্টি রেগে গেছেন মাত্র। আন্টি কি আর জানে আমার উপর তোমার অভিমান ছিলো।”
শারমায়ার কান্না পাচ্ছে ভীষণ। কিন্তু সে যথেষ্ট চাপা রাখার চেষ্টা করছে। তবে তার মুখভঙ্গি ও কম্পিত ঠোঁট ঠিকই প্রকাশ করে দিচ্ছে জোভানের কাছে। কান্না পেলে তার ঠোঁট কাঁপা দেখে আজ নতুন করে প্রেমে পড়লো জোভান। সে ডান হাতটা বাড়িয়ে বললো,
“আমার মনে খুব ব্যাথা লাগছে, একটু বুকে এসো তো। এসো? আমার এই হাতটা তো নাড়াতে পারছি না। কিভাবে টানবো দু’হাতে?”
শারমায়া তাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠলো,
“আমি খুব খারাপ। অনেক বাজে কথা বলি। আরও অনেকগুলো মাইর প্রাপ্য ছিলাম। একটুও ভালো না আমি।”
আরও অনেক কথাই বলছে সে, কিন্তু কান্নার শব্দে বুঝা যাচ্ছে না। জোভানের বুকে মুখ লুকানো না থাকলে হয়তো কেবিনের বাইরে চলে যেতো কান্নার আওয়াজ। জোভান তার মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।
“আরে! হচ্ছে কি! শারমায়া, চুপ করো৷ এই, দেখো আমার হয়েছে কিছু? তুমি সুন্দর করে কথা বলো আমার সাথে। আমি ভালো আছি, আমরা ভালো আছি। চুপ করতে বলেছি না? টুকটুকির আম্মু, চুপ চুপ চুপ!”
শারমায়া তাকে ঝাপটে ধরে কেঁদেই যাচ্ছে। জোভান তার মাথায় চুমু দিয়ে চেপে রেখেছে। এরই মাঝে জেভা এসেছিলো। তাদের ভাব বিনিময় দেখে আবার দরজা চাপিয়ে চলে গেছে৷ জোভান দেখলেও শারমায়া মুখ লুকিয়ে কান্না করায় টেরই পায়নি। দু’মিনিট যেতেই জোভান আবার বললো,
“আর ভালো লাগছে না কিন্তু।”
“আপনি কেন আমার কোনো কথা শুনেন না? আমার কথার কোনো মূল্য নেই আপনার কাছে?”
“লাভ ইউ, ডিয়ার। আর কখনো মোটরসাইকেল চালাবো না, প্রমিজ। বাবা মায়ের কাছেও প্রমিজ করেছি। এই, প্রমিজ করলাম তো।”
শারমায়া তাকে ছেড়ে দিয়ে বললো,
“না, প্রমিজ করতে হবে না। চালাবেন না কেন? আরও বেশি বেশি চালাবেন। স্যারকে বলবেন মোটরসাইকেল কিনে দিতে, প্রয়োজনে আমি সুপারিশ করবো। আর নয়তো বলুন, আব্বুকে বলি উনার জামাইকে একটা মোটরসাইকেল গিফট করতে। বিয়ের সময় তো এমনিতেই কোনো যৌতুক দাবি করেনি উনাদের জামাই।”
“আন্টি তো এজন্যই তোমাকে মাইর দেয়। একটায় কম পড়ে গেছে। আরও বেশি দেওয়ার প্রয়োজন ছিলো।”
“বাকিগুলো দিয়ে দিন আপনি।”
জোভান তার মাথা টেনে এনে গালে আলতো কামড় বসিয়ে দিয়ে বললো,
“তুমি পুরোপুরিভাবে এসো আগে আমার অধিনে, এরপর নিয়মিত মাইর দিবো। আর সেই মাইরে অতৃপ্ত হয়ে সারাদিন অপেক্ষায় বসে থাকবে পরবর্তী মাইরের জন্য।”
“আমি যে হাতে পায়ে মেরেছি, বেশি ব্যাথা পেয়েছেন?”
“কখন মারলে?”
“এমন ভয়াবহ অবস্থায় আপনি এতোটা ইজি আছেন কিভাবে?”
জোভান মুচকি হেসে বললো,
“এসব তো কিছুই না। মনের ব্যাথা হচ্ছে সবচেয়ে বড় ব্যাথা। মন ফ্রেশ থাকলে আমি সবদিক থেকেই ফ্রেশ। আর যদি আশেপাশে এতো এতো ভালোবাসা ছড়িয়ে থাকে তাহলে মন ফ্রেশ না হয়ে থাকতে পারে?”
“আর কোথায় ব্যাথা পেয়েছেন? সত্যি করে বলবেন। লুকাবেন না কিন্তু। তা না হলে এই হাত আর এই পা ও ভেঙে ফেলবো এখন।”
জোভান ডান পা টা কাত করে দেখালো গোড়ালিতেও সামান্য কেটে গেছে, তবে সেখানে কোনো ব্যান্ডেজ নেই, অয়েন্টমেন্ট লাগানো। শারমায়া তার ডান পায়ের হাটুতে সজোরে মেরে বললো,
“সব শেষ করে এসেছে একেবারে।”
জোভান মাথাটা নিচু করে বললো,
“মাথায় কিছু হয়নি। তুমি মাথায় মারতে পারো।”
শারমায়া ফোপাঁতে লাগলে জোভান বললো,
“এখন কান্না করলে ভালো হবে না কিন্তু।”
শারমায়া তার শার্টের কলার মুঠোয় ধরে বললো,
“কি ভালো হবে না? কি করবেন আপনি?”
“সব ব্যান্ডেজ খুলে ফেলবো।”
“খুলুন দেখি, সাহস কত বড়?”
জোভান নরম গলায় বললো,
“এমন করছো কেন? আমরা স্বাভাবিকভাবে একটু কথা বলি।”
শারমায়া নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টায় নিশ্চুপ হয়ে গেলে জোভান বললো,
“শরীরটা একটু দুর্বল লাগছে। দেখোতো, জ্বর আসছে কি না? যখন পড়ে গিয়েছিলাম, তখন খুব ভয় পেয়েছিলাম। এই বুঝি আমি শেষ! ছোটবেলায় মাত্রাতিরিক্ত ভয় পেলে আমার জ্বর এসে যেতো।”
শারমায়া তার কপালে গলায় হাত দিয়ে বললো,
“আছেই তো একটু একটু। ওষুধ খেয়েছেন?”
“হুম।”
“ইফাজ ভাইয়ারা কেউ দেখতে আসেনি?”
“হুম, দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত এখানেই ছিলো। কতক্ষণ ফাজলামো করে গেলো। মিরাজ চলে গেছে তার মোটরসাইকেল ঠিক করতে। বাকিরা যার যার কাজে।”
“মোটরসাইকেল সেখানেই ফেলে এসেছেন?”
“ঘটনাস্থলের পাশে পরিচিত দোকান ছিলো, সেখানে রেখে এসেছি।”
শারমায়া বারবার হাত ও পায়ে তাকাচ্ছে বিধায় জোভান বললো,
“টেনশন করছো কেন? এভাবে তো তুমি নিজের ঘুমও হারাম করবে, আমার ঘুমও কেড়ে নিবে।”
“আমি থেকে যাবো এখানে।”
“উহুম, একদম না। বাসায় গিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাবে।”
“কেন, থাকলে কি হবে?”
“কারোই ঘুম হবে না।”
“হুহ্! আপু না সিজারিয়ান সেকশনের? তাহলে আপনার চিকিৎসা করলো যে?”
“পরিবারের জন্য ডাক্তাররা সব সেকশনেই কাজ করে। দেখো না, আমাকে মা ও শিশুর কেবিনে ঠাঁই দিয়েছে। জেনারেল ওয়ার্ডে রাখলে কি এভাবে জড়িয়ে ধরে বসে থাকতে পারতে? সবাই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে সিনেমা উপভোগ করতো।”
জেভা কেবিনে এসে বললো,
“মিস, ওহ্ নো! মিসেস, রোগী দেখা হয়েছে? আংকেল আন্টি বসে আছেন। বাসায় চলে যাবে।”
“উনার সাথে এখানে কে থাকবে? আমি থেকে যাবো, আপু?”
“বাবারে, কি মহব্বত! কাউকে থাকতে হবে না। মাকেও বাসায় পাঠিয়ে দিবো৷ আমার ডিউটি আমিই ভালো করতে পারি। ইনশাআল্লাহ, আগামীকাল বাসায় পাঠিয়ে দিবো।”
“তুমি বাসায় যাবে না আজ?”
“উহুম, একটা সিজারিয়ান রোগী আছে। কিছুক্ষণ পর অপারেশন করতে হবে। তাছাড়া এই ভদ্রলোক তো আছেনই, সুস্থরোগী।”
“তাহলে আহনাফ?”
“আহনাফের সমস্যা নেই। তার ঘুমানোর ব্যবস্থা আছে এখানে। সমস্যা শুধু তোমার ভাইয়াকে নিয়ে। রাতে ডিউটিতে থাকা সে পছন্দ করে না। আমিও থাকি না। এমনই আর্জেন্ট কিছু হলে থাকতে হয়। আর সে যে কাউকে পরামর্শ দিবে যেন ডাক্তার মেয়ে বিয়ে না করে৷ দিনে তো পাবেই না, রাতেও দূরে দূরে। জয়কেও তো বলেছিলো।”
জোভান বললো,
“ভাইয়ার কথাই রাখলাম। করিনি ডাক্তার মেয়ে বিয়ে। তবে বউ ডাক্তার হওয়ার সম্ভাবনা আছে।”
জেভা হাসলো তার কথায়৷ শারমায়া তার দিকে তাকালো শুধু। অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও লোকটার দুষ্টুমির অন্ত নেই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here