“হালাল প্রেম” পর্ব- ৪০

“হালাল প্রেম”
পর্ব- ৪০
(নূর নাফিসা)
.
.
খাওয়ার পর আবার ফারিয়াদের ফ্ল্যাটে গল্পগুজবে কাটলো সময়। অন্যান্য সময় ফারিয়ার কাজিনগুলোর সাথে শারমায়া গল্পসল্প ও দুষ্টুমি করলেও আজ জোভান থাকায় তা থেকে পিছিয়েই ছিলো। সারাক্ষণ জোভানের পাশেই ছিলো কেননা সে এবং সাফওয়ানা ছাড়া আর কেউ তেমনভাবে পরিচিত না। সাড়ে বারোটা বেজে গেলে জোভান বাসায় ফিরতে চাইলো। সাখাওয়াত বদরুদ্দোজা তাকে থেকে যাওয়ার জন্য বললেন কিন্তু জোভান হাসিমুখেই কাজের অযুহাতে নিষেধ করলো। শারমায়ারও ইচ্ছে করছিলো না তাকে এতো রাতে যেতে দিতে কিন্তু থাকতেও বলতে পারলো না জোভান আগেই তাকে নিষেধ করে দেওয়ায়। শুধু এইটুকু জিজ্ঞেস করেছিলো,
“এতো রাতে যেতে পারবেন?”
জোভান জবাব দিয়েছে,
“অফিস থেকে রাত তিনটা চারটা বাজেও বাসায় যাই, আর এখন যেতে পারবো না? চিন্তা করো না, শহরে ভুত নেই।”
“মানুষ ভুতকে ভয় করে না৷ ভুতের চেয়ে বেশি মানুষকেই ভয় করে।”
“কিসের ভয়? আল্লাহর উপর ভরসা থাকলেই হয়।”
জোভান বিদায় নিয়ে রাতেই বেরিয়ে গেলো৷ বাসায় ফিরে সাথে সাথেই শারমায়াকে কনফার্ম করলো। পরদিন শ্বশুর বাড়ির সবাই এসেছে। জোভানের কথামতো বিয়ের শাড়িটাও পরেছে শারমায়া। পরিয়ে দিয়েছে সুষনা আপু। জোভানটা ভারি লজ্জায় ফেলেছে তাকে। এমনিতেই শাড়ি পরলে তার লজ্জা লাগে, আজ শ্বশুর শ্বাশুড়ির সামনে তো লজ্জায় মরেই যাচ্ছে। মিরাজদের বাড়িতেও লজ্জা পেয়েছিলো তবে আজ তুলনামূলক অনেক বেশি। একে তো নিজের বাড়ি অন্যথায় বিয়ের শাড়ি। জেভা তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ! আর পাজি লোকটা যখনতখন তার দিকে তাকায়। সাথে মুখফোটা হাসি তো আছেই। তার এই হাসিমাখা চাহনি দেখলে লজ্জাহীন ভুবনে লুকিয়ে থাকার ইচ্ছে জাগে। কিন্তু সেই ভুবন যে অচেনা!
.
ফ্রেন্ডদের মধ্যে কেউ কেউ ন্যাশনাল ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে গেছে, কেউবা পাবলিক ভার্সিটিতে আর কেউ বসে আছে মেডিক্যাল চান্সের প্রত্যাশায়। এদিকে শারমায়া মেডিক্যাল এবং স্কলারশিপ সেশনে ট্রাই করে ভাগ্যক্রমে স্কলারশিপ পেয়ে গেছে। পরিবারের সকলেই বেশ খুশি। ইংল্যান্ডে সুযোগ হওয়ায় আশরাফ স্যার আরও বেশি খুশি। কেননা জোভানের ছোট চাচা সেখানে থাকে। শারমায়ার জন্য বেশ সুবিধাজনক হবে। চারিদিকে এতো আনন্দ থাকা সত্ত্বেও শারমায়ার মনে বিরাজ করছে কেবল বিষন্নতা। যদিও একসময় স্বপ্ন বুনতো সে অনেক বড় হবে, আকাশ পথে চড়বে, বিভিন্ন দেশ গমন করবে কিন্তু এখন! পরিবার ছেড়ে এতোগুলো বছর দূরে থাকবে ভাবতেই কান্না পায় তার৷ বারবারই মনে হয় তার দ্বারা সম্ভব না। কিন্তু সকলের আনন্দ দেখে তার মুখ ফুটে মনের কথাগুলো উচ্চারিত হয় না। একরকম মানসিক অস্থিরতায় ভুগছে সে। তার এই অস্থিরতা বুঝবেই বা কে?
দিন যাচ্ছে আর অস্থিরতা বাড়ছে। মামা বাড়ি বেড়াতে গেলো তিনদিনের জন্য। অন্যান্যরা তাকে নিয়ে উৎফুল্ল কিন্তু তার মাঝে উৎফুল্লতা নেই। বরাবরের মতো এবার কোনো মজা পেলো না মামাবাড়ি। সেখান থেকে ফেরার পর সুষনা তাকে সাথে করে নিয়ে গেলো তাদের বাড়িতে। শারমায়ার ভালো লাগছিলো না সেখানেও। পরদিনই সে চলে আসতে চাইলো কিন্তু জোরপূর্বক খালামনি আরও একদিন রেখে দিলো।
আজ জোভান নিজেদের গাড়ি নিয়ে এসেছে তাকে শপিংয়ে নিয়ে যেতে। আগামী সপ্তাহে শারমায়া দেশ ত্যাগ করবে। দিন ঘনিয়ে আসছে আর শূন্যতা যেন ঘিরে ধরছে তার পরিবারকে। শারমায়ার বাবা মায়ের সাথে জোভানেরও ভালো লাগছে না। তবুও সে আনন্দটাই প্রকাশ করছে। সাফওয়ানা স্কুলে থাকায় তাকে সাথে নিতে পারলো না জোভান। শপিংয়ে যাওয়ার পথে শারমায়া খুবই নিরব। মলিন মুখে বাইরে তাকিয়ে থাকায় জোভান বললো,
“মন খারাপ কেন? কোনো কারণে রেগে আছো নাকি আমার উপর?”
শারমায়া নিরব দৃষ্টি তার দিকে নিক্ষেপ করে তাকিয়ে রইলো। ড্রাইভিংয়ের ফাঁকে জোভান তার দিকে এক পলক তাকিয়ে বললো,
“কি হয়েছে?”
“আমি ইংল্যান্ড যাচ্ছি বলে কি আপনি খুব খুশি?”
জোভান মুচকি হেসে বললো,
“শুধু আমি কেন, সবাই ই তো খুশি।”
“আমি দূরে চলে গেলে আপনার খারাপ লাগবে না?”
“তা তো একটু লাগবেই। কিন্তু তার চেয়ে বেশি তো আনন্দটা। তুমি স্কলারশিপ পেয়েছো, এটা সিম্পল ম্যাটার নয়। আমাদের জন্য কতটা গর্বের বিষয় ভাবতে পারছো? তোমার স্যারও তোমাকে নিয়ে ভীষণ গর্বিত।”
“আমার তো একটুও আনন্দ হচ্ছে না। আমার ইচ্ছে করছে না যেতে।”
“জীবনের কিছু কিছু কাজ ইচ্ছের বিরুদ্ধে হলেও করতে হয়। তা না করলে যে সফলতা হারিয়ে ফেলবে।”
“সফলতা দিয়ে কি হবে? সময়গুলো প্রিয়জনদের সাথে কাটাতে পারলে তো মনে তৃপ্তি আসবে। যতদিন বাঁচবো প্রিয়জনদের সাথে বাঁচবো। ভালো খারাপ কাছে থেকে দেখবো। দূরে গেলে তো আমাকে সব মায়া ত্যাগ করতে হবে। মন ছটফট করবে স্বচক্ষে পরিচিত মুখগুলো একবার দেখার। এতোটা অশান্তি নিয়ে সেখানে দিন কাটাতে পারবো না আমি।”
কথা বলতে বলতে গলা ধাধিয়ে এসেছে শারমায়ার। তার কথা শুনে জোভানের চেহারায়ও বিষন্নতা প্রকাশিত হলো। তবুও সে স্বাভাবিকভাবে বলার চেষ্টা করলো,
“এতোসব ভাবলে চলবে? প্রয়োজন ভেদে কিছু কিছু ভাবনাকে ছুড়ে ফেলতে হয়। আশেপাশে দেখছো না, কত লোক উপার্জনের তাড়নায় বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ স্বজনদের কাছ থেকে দূরে কাটাচ্ছে। আর তুমি তো সৌভাগ্যক্রমে যাচ্ছো। বাবামায়ের স্বপ্ন জড়িত। যেতে হবে তোমাকে। বাবামায়ের কথা ভাববে না?”
এবার শারমায়া কেঁদেই ফেললো। জোভান বিস্মিত তার কর্মে! সে রাস্তার একপাশে গাড়ি পার্ক করে বললো,
“এসময়ে কিসব শুরু করেছো? যাবো না শপিংয়ে?”
শারমায়া কান্না থামানোর চেষ্টায় দীর্ঘ শ্বাস নিলো কয়েকবার। অতঃপর চোখ মুছে বললো,
“চলুন।”
তবুও জোভান নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো তার দিকে। এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে শারমায়া বললো,
“বললাম তো, যাবো শপিংয়ে।”
জোভান হাত বাড়িয়ে বৃদ্ধা আঙ্গুলে তার ভেজা গাল স্পর্শ করে বললো,
“এগুলো কি?”
শারমায়া সামনে রাখা টিস্যু বক্স থেকে টিস্যু নিয়ে চোখ ও ভেজা গাল মুছে বললো,
“হয়েছে এবার?”
জোভান ঠোঁটের এক কোণে হাসি ফুটিয়ে আবার চলতে লাগলো। বসুন্ধরায় এসে শপিং করলো, শারমায়ার হাত ধরে অযথা বেশ কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরিও করলো। বাসা থেকে বের হওয়ার পূর্বে লাঞ্চ করে এসেছে, শপিং শেষে সন্ধ্যায় এখানে রেস্টুরেন্টে খেয়েছে। যদিও বাসা থেকে হাসিমুখে বেরিয়েছিলো, শারমায়া কান্না করার পর থেকে জোভান কিছুটা মুড অফে চলে গেছে। সেইরকম হাসি আর দেখা যায়নি তার মুখে। তবে শারমায়ার সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে এবং শারমায়াকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে। দৃষ্টির আড়ালে থাকা, দেহে চাপা, বিষন্ন দুটি মন বেশ কিছুক্ষণ নিরবে পথ চলেছে অন্ধকার শহরে। কোলাহলপূর্ণ পরিবেশেও নিবিড়ভাবে অনুভব করেছে একে অপরকে। রাত নয়টার দিকে তারা বাড়ি ফিরেছে। গাড়ি থেকে নামার পূর্বে জোভান শারমায়ার কপালে চুমু একে দিয়েছে। শারমায়ার চোখের কোণে পানি জমে উঠেছিলো। গাড়ি থেকে নামতে নামতে জোভানের দৃষ্টির আড়ালে সে তা মুছে নিলো। ফ্ল্যাটে এসে আংকেল আন্টির সাথে দেখা করে জোভান বাসায় চলে গেলো। জোভান যাওয়ার পরপরই সাফওয়ানা প্যাকেট নিয়ে বসে গেছে শপিং দেখার জন্য। সাফওয়ানাকে গিফটস্বরূপ দুইটা রঙিন ঘুড়ি ও একটা ড্রেস কিনে দিয়েছে। ড্রেস পেয়ে যতটা না খুশি, তার চেয়েও কয়েক গুন বেশি খুশি ঘুড়ি পেয়ে। ফুয়াদ ভাইয়ার কিনে দেওয়া পাঁচটাসহ তার এখন সাতটা ঘুড়ি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here