“হালাল প্রেম” পর্ব- ৪১

“হালাল প্রেম”
পর্ব- ৪১
(নূর নাফিসা)
.
.
বাসায় ফেরার পর থেকেই মেয়ের মুখটা মলিন দেখছে শারমিন। ঘুমানোর পূর্বে মেয়েদের রুমে এসে দেখলো সাফওয়ানা গেমস খেলছে আর শারমায়া অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে। তিনি সাফওয়ানার উদ্দেশ্যে বললেন,
“এখনো মোবাইল হাতে কেন? ঘুমা।”
“ঘুমাচ্ছি। আর একটু বাকি আছে।”
শারমিন শারমায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“কি রে মা, মন খারাপ কেন? হয়েছে কিছু?”
মায়ের জিজ্ঞাসায় শারমায়ার চোখে পানি এসে গেছে। সে ধাধানো গলায় বললো,
“জানো না তুমি কি হয়েছে? আমাকে ছাড়া থাকতে পারবা তোমরা? আমি তো একটুও পারবো না তোমাদের ছেড়ে থাকতে।”
কথা বলার পর শারমায়া মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই ফেললো। ভারি কষ্ট বুকে চাপা রেখে শারমিন মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন,
“দেখ, মেয়ের কাণ্ড! আমরা কি সারাজীবনের জন্য পাঠিয়ে দিচ্ছি? এমনতো নয় যে মেয়েকে বিদেশি পরিবারে বিয়ে দিয়েছি যে সারাজীবন সেখানে থাকতে হবে। মাত্র কয়েকটা দিনই তো। গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেই তো ফিরে আসবি।”
শারমায়া চুপচাপ তার মাকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলো। শারমিন মেয়েকে কিছুক্ষণ বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ঘুমাতে বলে চলে গেলেন। বুঝাতে গিয়ে মেয়ের দৃষ্টির আড়ালে চোখও মুছে নিলেন কয়েকবার।
.
আগামীকাল ফ্লাইট। গতকাল জোভানের মা বাবা এসে দেখা করে গেছেন পুত্রবধূর সাথে। গতরাতে জেভা কল করে কথা বললো কিছুক্ষণ। বারবার বলে দিয়েছে আজ অল্প সময়ের জন্য হলেও যেন তার বাসায় যায় দেখা করার জন্য। আবার কত বছর পর আসবে, তাই ঘুরে গেলেও একটু ভালো লাগবে৷ দুপুরে জোভান এসেছে তাকে আপুর বাসায় নিয়ে যেতে। এখানে লাঞ্চ করে তারা বেরিয়েছে। গাড়িতে তাদের কথা হয়েছে তবে স্বল্প। জোভান যা জিজ্ঞেস করেছে শারমায়া কেবল তার উত্তর দিয়েছে। আপুর বাসায় এসে আহনাফের সাথে দুষ্টুমিতে ও আপুর সাথে কথা বলতে শারমায়াকে একটু হাসতে দেখা গেছে। যদিও জোরপূর্বক হাসি, তবুও কিছুটা তৃপ্তি এনেছে জোভানের মনে। আপু রান্নাবান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়লে শারমায়া কিছুক্ষণ তার সাথে কাটালো অতঃপর জোভান আপুর রুমে থেকে তাকে ডাকলো। শারমায়া এলে সে দরজা চাপিয়ে তাকে পাশে বসিয়ে বললো,
“ভালো লাগছে না এখানে?”
“হুম।”
জোভান তাকে দু’হাতের বন্ধনে বেঁধে মাথায় মাথা ঠেকিয়ে বললো,
“তাহলে মুড অফ কেন? সবসময় হাসিখুশি দেখতেই তো ভালো লাগে। অলওয়েজ হ্যাপি থাকবে।”
শারমায়া তার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“এইযে আমরা সবাই কত কাছাকাছি আছি, ভালো লাগছে না? সবারই তো ভালো লাগছে। তাহলে সবসময় কাছাকাছিই থাকি না?”
জোভান তার কপালে উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে বললো,
“কাছাকাছিই তো থাকবো। তুমি গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করো আগে, এরপর থেকে আমরা প্রতি মুহুর্ত কাছাকাছি থাকবো। কিছু সময়েরই তো ব্যাপার। দেখতে দেখতে সময় চলে যাবে।”
“একটুও কাটবে না আমার সময়৷ আমি সেখানে গেলে আমার মন পড়ে থাকবে এখানে। তার চেয়ে ভালো নয় আমি সকলের কাছাকাছি থেকেই গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করি? এখানেও তো গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করা যাবে। তুমি একটু বুঝিয়ে বলো আব্বুকে, স্যারকে। আই হোপ উনারা বুঝবে আমি সেখানে যেতে চাইছি না। একটু বলো, তুমি বললেই উনারা মানবে, ডিসিশন চেঞ্জ করবে।”
জোভান তার মুখখানা দু’হাতে ধরে বললো,
“কি বলছো এসব, হুম? শেষ মুহুর্তে পাগল করে দিয়ো না আমাকে। এখন কোনো সেশনেই তোমার ভর্তি হওয়ার সুযোগ নেই এখানে। একটা বছর এভাবে নষ্ট হতে দেই কিভাবে? তাছাড়া আগামীতে ভালো কোনো সুযোগ হবে তারই বা নিশ্চয়তা কি? তোমার যদি এতোই সমস্যা তাহলে এক্সাম দিলে কেন? তখন যদি এমন কিছু বলতে আংকেল তো দেওয়াতেন না এক্সাম। বাঁধতেন না স্বপ্ন মেয়েকে নিয়ে এতো দূর পর্যন্ত। বাবাও তো এতোসব ব্যবস্থা করতেন না। এখন ওসব ভেবে নিজের মনও খারাপ করো না, অন্যকেও হতাশ করো না। তুমি খুশি থাকলে তোমার জন্য সবাই খুশি থাকবে। যে সুবর্ণ সুযোগটা আছে তোমার কাছে সেটা উপেক্ষা করো না এভাবে। ডিয়ার, কাজে লাগাও।”
শারমায়া ভেজা চোখ মুছে নিয়ে জোভানের হাত সরিয়ে দিতে চাইলো। কিন্তু জোভান ছাড়লো না। জোভানের দেখাদেখি আহনাফও অন্যপাশ থেকে শারমায়াকে জড়িয়ে ধরেছে। তা দেখে জোভান মৃদু হাসলো তবে তেমনভাবে প্রকাশ পেলো না হাসি। হঠাৎই ফোনটা বেজে উঠায় জোভান এক হাত সরিয়ে নিলো ফোন রিসিভ করার জন্য। সুযোগ পেয়ে শারমায়া অন্যহাত সরিয়ে আহনাফকে নিয়েই উঠে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো। জোভান ফোন রিসিভ করতে করতে শুধু তাকিয়ে রইলো তার যাওয়ার দিকে। শারমায়া তার দিকে ফিরেও তাকায়নি। সে জেভার কাছে চলে এসেছে। একটু পরেই জোভান এসে বললো,
“শারমায়া, ইফাজ তোমার সাথে কথা বলতে চায়।”
জেভা বললো,
“ইফাজের আবার ভাবির সাথে এমন কি কথা জরুরী হয়ে পড়লো শুনি? আমি বড় বোন, আমার কাছেও তো বলতে পারে। বিয়ে টিয়ে করলে তো আমিই ব্যবস্থা করে দিতে পারি। বলে না কেন?”
জোভান ঠোঁটের এক কোণে হাসি ফুটিয়ে বললো,
“ওসব কিছু না। কাল তো চলে যাচ্ছে, দেখা তো আর হলো না তাই কথা বলতে চাইছে।”
“ওহ্, বল এখানে চলে আসতে।”
ফোনের ওপাশ থেকে মিরাজের চেচানো কন্ঠ ভেসে এলো,
“আপু, চলে আসবো? নাকি শুধু ইফাজকেই দাওয়াত করছো?”
“ইফাজ আর মিরাজ কি? চলে আয়। সবার পাত্রীই ঠিক করে দিবো।”
“না, না। আমার পাত্রীর প্রয়োজন নেই। আমার পাত্রী আছে।”
জেভা হেসে বললো,
“আসবি নাকি? এলে একসাথে খাওয়াদাওয়া করবো।”
“আসছি তাহলে।”
তারা এখানে আসবে তাই জোভান আর ফোন দিলো না শারমায়ার হাতে। সে সাদাতকেও কল করে বলে দিলো আপুর বাসায় আসতে। সন্ধ্যায় জোভান মাগরিবের নামাজ পড়তে গেলো মসজিদে। বাসায় ফিরলো ইফাজ, মিরাজ ও সাদাতের সাথে। শারমায়া ও জোভান আসায় আজ নিলয়ও তারাতাড়ি ফিরেছে বাসায়। অতঃপর গল্পগুজবে মেতেছে সবাই। মিরাজ শারমায়ার উদ্দেশ্যে বললো,
“ভাবি, আপনি ইংল্যান্ড চলে যাচ্ছেন তাই আমি তো চাইছিলাম একটা পার্টি এরেঞ্জ করবো। জোভান করতে দিলো না। বলছি, তোর টাকা দিতে হবে না তা-ও না।”
জেভা বললো,
“কিসের পার্টি? পার্টিতে কি করতি?”
“কি আর? একটু নাচ-গান , খাওয়াদাওয়া এইতো।”
“নামাজের খবর থাকে না, শুধু নাচানাচি?”
“পড়িতো নামাজ।”
“পড়লে আবার নাচানাচি কেন?”
শারমায়া বললো,
“থাক, ভাইয়া। আপনাদের নাচ দেখেছি আর নাচতে হবে না।”
“আমরা নাচবো নাকি! আপনারা কাপল, আপনাদের নাচের কথা বলেছি।”
“আপনার আর ইফাজ ভাইয়ার কাপল নাচটা সুন্দর ছিলো।”
মিরাজ বিস্মিত হয়ে বললো,
“কাপল নাচ! কোথায় দেখলেন?”
“ফোনে।”
ইফাজ জিভ কেটে জোভানের দিকে তাকিয়ে বললো,
“মান সম্মান আর রাখলি না কিছু? তোর গুলো দেখিয়েছিস সব? নাকি পর্দার আড়ালে লুকিয়ে রেখেছিস? দেখিয়ে দিবো?”
জোভান মাথা সামান্য হেলিয়ে অনুমতি দিয়ে দিলো এবং মুখে বললো,
“আমি চাইও না আমার বউয়ের কাছে আমি সম্পর্কিত কিছু গোপন থাকুক। তবে লিমিট ক্রস করিস না। যতটুকু বাস্তব ততটুকুই প্রকাশ করিস। এডিটিং করলে তোর কপাল খারাপ।”
“ভাবি, এখন তো সম্ভব হচ্ছে না। আপনি ইংল্যান্ড যাওয়ার পর জোভানের পর্দা ফাঁস করতে আমি সব মেইল করবো।”
শারমায়া মুচকি হাসলো শুধু। জেভা বললো,
“তোদের মধ্যে কে যেন কার বউ? মিরাজ সাদাতের বউ নাকি?”
সাদাত বললো,
“না আপু। আমি এসব রিলেশন ফিলেশনে নাই। মিরাজ ইফাজের বউ।”
ইফাজ মিরাজের কাধ চাপড়ে বললো,
“হুম, এটা আমার হাফ লেডিস বউ।”
মিরাজ একটু ভাব নিয়ে বললো,
“আমার চেহারা সুন্দর বলে অপমান করিস না। মাশাআল্লাহ বল। সুন্দরের অপমান করলে গুনাহ হয়।”
সাদাত তার প্রত্যুত্তরে বললো,
“ও… তুমি যখন লেডি সেজে নাচো তখন গুনাহ হয় না?”
নিলয় বললো,
“তখন সওয়াব হয়। তাই না মিরাজ?”
মিরাজ অসহায় ভঙ্গিতে বললো,
“ভাইয়া, কি করবো বলেন? নাচের সময় লেডির অভাব পড়ে যায় তাই বাধ্য হয়ে আমাকেই যেতে হয়।”
সকলে একজোটে হেসে উঠলো। তার মুখভঙ্গিটাই যেন হাস্যকর!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here