“হালাল প্রেম”
পর্ব- ৪৭
(নূর নাফিসা)
.
.
শারমায়া রাগান্বিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতেই জোভান ঠোঁট নাড়িয়ে বললো,
“লাভ ইউ।”
শারমায়া নিচের দিকে তাকিয়ে খাওয়ায় মনযোগ দিলো। জোভানও তার পায়ের আঙুলের সাথে খেলতে খেলতে খেতে লাগলো। সে বেশ কয়েকবার তাকালেও শারমায়া একবারের জন্যও তাকায়নি। একটু পরপর এটা সেটা দিতে বলছে, শারমায়া চুপচাপ এগিয়ে দিচ্ছে। তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলো কিন্তু শারমায়া না বলায় বিরক্ত করলো না। এমনিতেই রেগে আছে, খাবার রেখে চলে গেলে আবার ফিরিয়ে আনা মুশকিল। খাওয়া শেষে শারমায়া টেবিল গুছিয়ে সোফায় এসে বসে পড়লো। জোভান ডাইনিং টেবিলের চেয়ারেই বসে আছে। তাকে রুমে পাঠানোর জন্য বললো,
“ডিয়ার, লাগেজ খুলে জ্যাকেট এনে দাও তো। প্রচন্ড ঠান্ডা লাগছে।”
শারমায়া বিরক্তির সাথে রিমোট রেখে চলে গেলে পিছু পিছু ছুটলো জোভান। রুমে এসে দরজা আটকে জোভান বললো,
“সুইটহার্ট, তুমি কি খুব বেশি রেগে আছো?”
শারমায়া কোনো প্রত্যুত্তর না করে লাগেজের কাছে এলো। জোভান তার হাত টেনে তাকে ঘুরিয়ে দাঁড় করিয়ে পেছনে রাখলো দুহাত। শারমায়া তাকে ধাক্কিয়ে সরাতে চাইলে জোভান বললো,
“প্রত্যেক ঘরে এমন দু’একটা সোয়াদ থাকেই। তাই বলে কি আমাদের ভালোবাসা থেমে থাকবে? আজ সোয়াদের চোখে আটকে যাচ্ছে, দুদিন পর আমাদের বাবুদের চোখে আটকে যাবে। তাদের ভয়ে কি আমি আমার বউকে আদর করা বন্ধ করে দিবো নাকি! ভালোবাসা বিনিময় চলছে, চলবে।”
“সরুন।”
“আবার কি হলো!”
“সবসময় আপনাকে কেন এমন করতে হবে। চাচীমার সামনে কেমন লজ্জায় পড়তে হলো আপনি জানেন না? আপনার লজ্জা না লাগতে পারে, আপনি ছেলের মতো, উনাদের কাছে থেকেছেন দীর্ঘকাল। আমিতো বউ, এসেছি বেড়াতে। আমার অবস্থাটা কেন আপনি বুঝবেন না?”
“সুইটহার্ট… তুমি ব্যাপারটা কতটা সিরিয়াসে নিয়ে যাচ্ছো! এইটুকুতেই এই অবস্থা! চাচ্চু আমাকে যেসব সাজেস্ট করে, সেসব শুনলে তো তুমি জ্ঞান হারাবে! উনারা খুব মজার মানুষ। জাস্ট ফ্রি মাইন্ডে থাকো।”
“প্রয়োজন নেই তো এতো ফ্রি হওয়ার। আপনার সাথে ফ্রি হয়েই আমার…”
“কি?”
“কিছুনা। ছাড়ুন।”
“জীবন চলে গেলেও ছাড়বো না। আচ্ছা, যাও। সোয়াদের সামনে আর কখনো কিছু করবো না তোমার সাথে। এবার তো একটু হাসো।”
শারমায়া নরম গলায় বললো,
“ছাড়ুন দেখি, জ্যাকেট নেই। এতোকিছু পরেও কাপছি আর উনি টিশার্ট, কোয়াটার প্যান্ট পরে ঘুরছে। কি হলো?”
জোভান ছোট ছোট চোখ করে নিশ্চুপ তাকিয়ে আছে তার দিকে। শারমায়ার হাসি পেলো কিন্তু হাসি চাপা রেখে বললো,
“ছাড়ো। হয়েছে তো এবার।”
জোভান তাকে ঠেলে বিছানার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,
“প্রয়োজন নেই। আমরা ঘুমাবো এখন।”
“উহুম, আমি ঘুমাবো না।”
“জান, আমার অনেক ঘুম পেয়েছে। তিনদিন যাবত আমার ঘুম হচ্ছে না ঠিকমতো। এক তোমার কাছে আসবো সেই আনন্দের প্রভাব, অন্যথায় গোছগাছ, রাতে ভ্রমণ।”
“তাহলে তুমি ঘুমাও। আমার তো ঘুমের ঘাটতি ছিলো না।”
“তুমি না থাকলে ঘুম হবে না। তুমি উঠে যাওয়ার পর কত চেষ্টা করলাম, এলোই না ঘুম।”
বলতে বলতে ঠেলে খাটে তুলে দিলো তাকে। মহা যন্ত্রনায় পড়েছে শারমায়া। কে জানে, আর কত লজ্জায় পড়তে হয় তার জন্য! যদি এখন শ্বশুর বাড়ি থাকতো ঠিকই ছ্যাচা দিতো তাকে। বেড়াতে এসেছে বিধায় কিছু বললো না। জোভান টিশার্ট ছেড়ে চলে গেলো কম্বলের নিচে।
“আমাকে কি কোয়ার্টার প্যান্ট পরলে বাজে দেখায়?”
“উহুম।”
কপালে উষ্ণ ছোয়া দিয়ে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে চোখ বুজে রইলো শান্ত জোভান। শারমায়া তার মুখমন্ডলে চোখ বুলালো। অতঃপর গলার নিচে কালচে দাগ চোখে পড়তেই শারমায়া হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করে বললো,
“খুব বেশি ব্যাথা পেয়েছিলে না সেদিন?”
জোভান চোখ খুলে বললো,
“সেদিন আমার খুব প্রিয় দিন। সেদিনের মুহুর্ত গুলো নিয়েই থাকতে পেরেছি তোমাকে ছাড়া। ভাগ্যিস, লাগেজটা নিয়ে গিয়েছিলাম রাতে! তা না হলে তো জীবন থেকে বিশেষ একটা মুহূর্ত মিস হয়ে যেতো।”
“হুহ্! শুধু বেশি বেশি!”
জোভান মুচকি হেসে মাথায় নাক ঘেঁষে বললো,
“এখান থেকে যাওয়ার সময় এপাশে একটা দিয়ে দিয়ো। যেনো আবার এখানে আসা অব্দি ভালো থাকতে পারি।”
শারমায়া মৃদু হেসে তার সাথে মিশে বললো,
“আমার ভালো লাগবে না চলে গেলে।”
“না গেলে তো চলবে না। এখন উপার্জনের বয়স। তোমাকে জড়িয়ে ফেলেছি যে নিজের সাথে। তোমার স্বামীকে দায়িত্ববান হতে হবে না? কাজে ফাঁকি দেওয়া মানে বউকেও অবহেলা করা। আমি আমার বউকে অনেক ভালোবাসি।”
“তুমি কি রাগ করেছো আমার কথায়?”
“কোন কথা?”
“ওইযে, তোমার সাথে যে রেগে কথা বললাম, চাচীমা চাচ্চুর সাথে ফ্রি না হওয়ার কথা বললাম।”
“হুম, করেছি তো রাগ। তুমি কেন বলবে এসব! এখন আদর করো, নয়তো রাগ ভাঙবে না।”
জোভানের মুখভঙ্গিতে শারমায়া ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে বললো,
“আলগা ফাপর আমাকে দিয়ে লাভ নেই। এই রাগ না ভাঙলেও চলবে।”
জোভান আহ্লাদিত স্বরে বললো,
“দাও না গো একটু।”
“ফাজলামো রাখো। ঘুমাও। আসলে আমার খুব লজ্জা লেগেছে। সোয়াদটাও কেমন পাজি! এইটুকুতে তার চোখ আটকে গেছে, আবার মায়ের কাছে পৌঁছে দিয়েছে মেসেজ!”
“দেখেছো, সোয়াদ তোমার কত খেয়াল রাখে! তুমি ব্যাথা পেয়েছো ভেবে চাচীমার কাছে বিচার দিয়ে আমাকে শাসানোর চেষ্টা করলো।”
“হুম, একদমই তার ভাইয়ের মতো।”
“ওপ্স! তার ভাবিমনিকেও যে নিজেদের দলে নিয়ে আসবো।”
ঘুম থেকে উঠে শারমায়া লাগেজ থেকে জোভানের কাপড়চোপড় তুলে রাখছে কাভার্ডে। জোভানও এলো তাকে সাহায্য করতে। কাভার্ডে ঝুলন্ত দুইটা শাড়ি দেখে জোভান বললো,
“সুইটহার্ট, তুমি শাড়িও নিয়ে এসেছো পরার জন্য! আমি শপিংয়ে নিয়ে যাওয়ার পর না বললে তুমি শাড়ি পরবে না!”
“নিয়ে আসিনি। চাচীমা গিফট করেছে এই দুইটা।”
“পরেছো?”
“উহুম।”
“আজ পরবে?”
“না, আমার লজ্জা লাগে।”
“আমারও তো দেখতে ইচ্ছে করে।”
“সম্ভব না। পরতে বলবে না কিন্তু। এমনিতেই আমার আনইজি লাগে। চাচ্চু, চাচীমার সামনে আমার আরও বেশি আনইজি লাগবে।”
জোভান মৃদু হেসে রেখে দিলো। দুপুরের পর তারা একত্রে বেড়াতে গেলো হলিডে পার্কে। শাড়ি পরেনি শারমায়া। জোভানও বলেনি তাকে পরতে। বাচ্চাদের নিয়ে হৈ-হুল্লোড়, বড়দের আড্ডায় বেশ ভালোই কাটলো সময়। পরদিন শারমায়াকে ক্লাসে যেতে হলো। জোভান চাচ্চুর অফিসে গিয়ে ঘুরে এলো, কিছু ফ্রেন্ডের সাথে সাক্ষাৎ করলো। অতঃপর শারমায়ার ছুটির সময় হয়ে এলে তাকে রিসিভ করতে গেলো। ঠান্ডা আবহাওয়ায়, মনোমুগ্ধকর পরিবেশে দুজন দুজনকে অনুভব করতে করতে অনেকটা সময় বাইরে কাটিয়ে নীড়ে ফিরে এলো। পরদিন শারমায়ার অফ ডে থাকায় জোভান তাকে নিয়ে একা ঘুরতে যাবে। তাই আজ চাচীমার দেওয়া নীল রঙের শাড়িটা পরতে বললো। শারমায়া শাড়ি পরে তৈরি হয়ে গেলো। একা একা পরতে সম্ভব হচ্ছিলো না বিধায় লজ্জা লেগেছে তবুও চাচীমার সাহায্য নিয়েছে। শাড়ি পরানো হয়ে গেলে চাচীমা রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর জোভান এলো রুমে। শারমায়া নাকফুল পরছিলো। সে তাকে আয়নায় দেখে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে দরজা লক করে দিলো। অতঃপর গানের সুর টানতে টানতে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো,
“তোমায় দেখলে, মনে হয়…
হাজার বছর তোমার সাথে ছিলো পরিচয়
বুঝি,
ছিলো পরিচয়… ”
শারমায়া মুচকি হেসে পেছনে হেলে শরীরের সামান্য ভার ছেড়ে দিলো জোভানের উপর। জোভানের সুর থামতেই সে বললো,
“সুন্দর লাগছে?”
“মাশাআল্লাহ।”
নাকে একটা, আবার টেবিলে রাখা বক্সে তিনটা দেখে জোভান বললো,
“নোজ পিন এতোগুলো কেন?”
“দুই মা দিয়েছে দুইটা, খালামনি দিয়েছে একটা, সুষনা আপু দিয়েছে একটা। সবগুলোই নিয়ে এসেছি, ঘুরেফিরে সবার ভালোবাসাই মাখবো গায়ে।”
“আমার কাছ থেকেও তো পাবে একটা। তবে এখন দিবো না৷ ইনশাআল্লাহ, আমি দিবো সেকেন্ড ওয়েডিং নাইটে। যখন তুমি আমি থাকবো আমাদের রুমে, মিষ্টি সুবাসে আচ্ছাদিত থাকবে রুম। কথা হবে মনে মনে, কেটে যাবে রাত নির্ঘুম।”
“চুপ।”
জোভান মুচকি হেসে বললো,
“তখন পরিয়ে দিবো নিজ হাতে। নাক ফুটানোর আগে জানালে আগেই দিতাম, কিন্তু জানাওনি তাই ডিসিশন চেঞ্জ। রিপ্লেস টু বাসর রাত।”
পাজি লোকটাকে থামাতে শারমায়া কথার মোড় ঘুরিয়ে নিয়ে বললো,
“সারাদিন তো এই প্যান্ট পরেই ঘুরলে। এখনও কি কোয়ার্টার প্যান্ট পরেই বাইরে যাবে? মানুষ ঠান্ডায় কুকড়ে যাচ্ছে, আর উনি এটা পরে ঘুরে বেড়ায়।”
“এটা উইন্টার সিজনের আউটস্ট্যান্ডিং পারফরম্যান্স।”
“স্ট্যান্ডিং যেমনই হোক, এটা পরা যাবে না। আমি শাড়ি পরেছি আর উনি কোয়ার্টার প্যান্ট পরবে। পায়ে ঠান্ডা লাগে না!”
“তোমার মাথা খারাপ, আমি তোমাকে নিয়ে বেড়াতে যাবো এভাবে!”
“তো রেডি হচ্ছো না কেন! আমি বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে পারবো না শাড়ি পরে।”
“হাতমুখ ধুয়ে আসছি। আমার ড্রেস বের করো।”
শারমায়া কাভার্ড থেকে কাপড়চোপড় ঘেটে লাল টিশার্ট হাতে নিয়ে মুচকি হাসলো। কেননা এটা সেই টিশার্ট, যেটাতে সে জোভানকে প্রথম দেখেছিলো ভার্সিটিতে। প্যান্ট কোনটা ছিলো তা তো খেয়াল নেই। তাই ডার্ক ব্লু জ্যাকেটের সাথে ম্যাচিং করে ডার্ক ব্লু জিন্স নির্বাচন করলো। জোভান লাল টিশার্ট দেখে বললো,
“বেশ রোমান্টিক মুডে আছো মনে হচ্ছে। লালই বের করতে হলো! লাল প্রিয় তবে ভেবেছিলাম তোমার সাথে ম্যাচ করে স্কাই ব্লু সিলেক্ট করবে।”
“এই টিশার্টটা আমার খুব পছন্দ।”
“আমারও।”
“জিজ্ঞেস করবে না কেন?”
“মেবি আমার পছন্দ তাই। তবুও কেন?”
“কারণ আমার একটা গল্প আছে। সেই গল্পে একটা রাজা আছে। সেই রাজাকে আমি খুব পছন্দ করি। আর তাই আমি সেই রাজার রানি। আর সেই রানি যখন তার রাজাকে প্রথমবার দেখেছিলো, তখন রাজা এই টিশার্টটা পরেছিলো। রাজা তার হবে, না জেনেও রাজাকে যেহেতু প্রথম দেখেই পছন্দ হয়েছিলো তার সাথে এই টিশার্টটাও পছন্দের তালিকায় জড়িয়ে গেছে। এটা স্মৃতিচিহ্নও বটে।”