“হালাল প্রেম”
পর্ব- ৫
(নূর নাফিসা)
.
.
চলছে এইচএসসি পরীক্ষা৷ সারাদিন বইখাতা নিয়ে পড়ালেখা৷ অবসর সময় তার কাটে না বললেই চলে। মাঝে মাঝে সাফওয়ানার সাথে দুষ্টুমি এবং ফারিয়ার সাথে একটু আধটু আড্ডা। কখনো দুপুরে ঘুমের সুযোগ হয়, কখনো বা ঘুমের ছুটি। ফ্রেন্ডদের সাথে সিএনজি রিজার্ভ করে নিয়েছে শারমায়া। প্রথমদিন বাবার সাথে গেলেও দ্বিতীয়দিন থেকে ফ্রেন্ডদের সাথে যায় এক্সাম হলে। ষষ্ঠ পরীক্ষার দিন বাড়ি ফিরে দেখতে পেল সাফওয়ানা বাড়িতে একা। মাকে না দেখতে পেয়ে শারমায়া বললো,
“আম্মু কোথায়?”
“বেড়াতে গেছে।”
“বেড়াতে! কোথায়?”
“কোথায় যেন বলছিলো, শুনি নাই।”
“বলছে অথচ শুনিসনি! কানে তুলো গুঁজে রাখছিলি?”
“উহুম। তখন মনযোগসহকারে আমি ফ্রোজেন দেখছিলাম। তাই ফ্রোজেনের কথা ছাড়া আর কিছু শুনতে পাইনি।”
“তাহলে এটা জানলি কিভাবে যে আম্মু বলে গেছে তোকে!”
“ফ্রোজেনের কথার মাঝখানে হঠাৎ আম্মুর চিৎকার শুনলাম। পেছনে ফিরে দেখলাম আম্মু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। আমার দিকে চোখ পাকিয়ে বললো, ‘কানে ঢুকছে কিছু?’ আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম ‘হ্যাঁ’। তারপর বললো, ‘শারমায়াকে বলিস, আমরা যাই। দরজা লাগিয়ে যা।’ পরে আম্মু আব্বু বেরিয়ে গেলো আমি দরজা লাগিয়ে আবার পূর্ব মনযোগী হলাম।”
“না শুনে আম্মুকে মিথ্যা বললি কেন?”
“মিথ্যা কোথায় বললাম! আম্মু জিজ্ঞেস করছে কানে ঢুকছে কি না! আমার কান যেহেতু খোলা ছিলো, সেহেতু কানে তো ঢুকছেই! শুধু ব্রেইনে আঁটেনি!”
“হিহিহি… দাড়া, আম্মু আসুক! তারপর বলে নেই তোর ভণ্ডামি!”
শারমায়া হেসে হিজাব খুলতে খুলতে নিজের রুমে চলে গেলো। সাফওয়ানা ড্রয়িংরুমে এসে টিভি অফ করে শারমায়ার কাছে গেলো। ড্রেসিং টেবিলের কোণে বসে পা ঝুলাতে ঝুলাতে বললো,
“ডিয়ার সিস, আই হেভ এন অফার ফর ইউ৷ ক্যান ইউ টেক ইট?”
“তোর অফার নিয়ে দূরে গিয়ে মর।”
সাফওয়ানা বিদ্রুপ স্বরূপ নিশ্বাস ফেলে ড্রেসিং টেবিল থেকে নেমে যেতে যেতে বললো,
“ওকে, আব্বু যে দুজনকে একশো টাকা দিয়ে গেছে সেটা আমারই থাক।”
“তুই আব্বুর কাছ থেকে টাকা নিয়েছিস কেন?”
“মজা খাওয়ার জন্য।”
“বান্দরী, আমার টাকা দে।”
“ওই ওই! তোমার টাকা এলো কোত্থেকে! আমি নিয়েছি সুতরাং আমার টাকা!”
“সাফু, আব্বু তোকে একা দেয়নি৷ সিক্সটি পার্সেন্ট আমাকে দিয়েছে আর ফোরটি তোকে। যা, দশ পার্সেন্ট মাফ করে দিলাম। এবার ভালোয় ভালোয় ফিফটি পার্সেন্ট আমাকে দে।”
“ওরে, ওরে! কি হিসাব রে! আব্বু তোমাকে কত দিতে বলছে সেটা তুমি এক্সাম হলে থেকে জানো কিভাবে! যাওয়ার পথে কি আব্বু বলে আসছে নাকি?”
“উহুম, আব্বু যায়নি। গিয়েছে বাতাস আর গিয়েছে বুলি! মাই কিউরিয়াস মাইন্ড বলে, আব্বু যখন বলছিলো তখন বাতাসে উড়ে উড়ে আমার কানে চলে গেছে আব্বুর কথা।”
“ওরে বাবা! তাই নাকি! তাহলে তোমার কিউরিয়াস মাইন্ড থেকে বলো তো কয়টা বাজে বলছিলো আব্বু সেই কথা?”
“লেখালেখিতে ব্যস্ত ছিলাম তো তাই টাইম দেখতে পারিনি।”
“চাপাবাজ! বাথরুমে গিয়ে বসে থাকো তোমার চাপা নিয়ে।”
“বান্দরী, আমি বাথরুমে গিয়ে বসবো না কোথায় বসবো দাঁড়া দেখাচ্ছি তোকে। ফ্রেশ হয়ে আসি আগে।”
“এক্সিউজমি চিকেন শর্মা! তুমি আমাকে বান্দরী বলো কোন সূত্রে? না আছে এর কোন মিনিং আর না আছে স্পিলিং!”
“ওয়েট, আমি মিনিং বের করে দিচ্ছি। আমরা কথায় কথায় সুন্দরবনের বিপরীত শব্দ হিসেবে মুখে উচ্চারণ করি বান্দরবন। তেমনিভাবে আবার সুন্দরের বিপরীত বলি বান্দর। ঠিক একই ভাবে সুন্দরীর বিপরীত শব্দ বান্দরী! সুষনা আপু, জিনিয়া ভাবি আমাকে সুন্দরী বলে ডাকে। তুই তো সবক্ষেত্রেই আমার বিপরীত পথের পথিক। সুতরাং আমি সুন্দরী হলে তুই বান্দরী। ক্লিয়ার? বান্দরী?”
শারমায়া হাসতে হাসতে বাথরুমে চলে গেলো৷ সাফওয়ানা রাগান্বিত গলায় বললো,
“শর্মা কোর্মা! এক টাকাও দিতাম না তোরে।”
“বান্দরী, আমার টাকা আমার হাতে না এলে তোরে তান্দুরী বানামু।”
এমনি কলিং বেল বেজে উঠলো। সাফওয়ানা দরজা খুলে দেখলো ফারিয়া আপু। ঘুম থেকে উঠে এসেছে মাত্র। হাই তুলে চুল খোপা করতে করতে বললো,
“শারমায়া আসেনি?”
” হুম, এসেছে।”
“কোথায়?”
“দেখো গিয়ে, কমোডের ভেতর সাতার কাটতাছে হয়তো! ”
“ঝগড়া লেগেছিস আবার!”
বলতে বলতে ফারিয়া রুমে চলে গেলো আর সাফওয়ানা দরজা লাগিয়ে টিভির রুমে চলে গেলো। শারমায়া ফ্রেশ হয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আপুর সাথে কথা বলতে লাগলো আজকের পরীক্ষা নিয়ে। ভাত খেতে ভালো লাগছে না বিধায় কথা বলতে বলতে কিচেনে এসে দু’মুঠ মুড়ি ও একটা বিস্কুট খেয়ে পানি পান করালো। অত:পর ড্রয়িংরুমে এসে সাফওয়ানার উদ্দেশ্যে বললো,
“কি তোর অফার, শুনি?”
“মটুপাতলু দেখবো আর দশ টাকার বাদাম এনে খাবো। ব্যাস, একশো টাকা উশুল।”
“ভণ্ডামির জায়গা পাও না! আমি আর আপু এখন নিচে যাবো ফুসকা কিনে আনতে। গেলে আয়।”
শারমায়া আপুকে টেনে বেরিয়ে গেলো ফ্ল্যাট থেকে। সাফওয়ানা টিভি অফ করে দৌড়ে বেরিয়ে এলো। ফারিয়া বললো,
“তোরা দুজন যা। আমি খাবো না। ভালো লাগছে না ”
“আরে চলো তো। আমরা কি রাস্তায় দাঁড়িয়ে খাবো! নিচে যাবো আবার কিনে নিয়ে চলে আসবো।”
সাফওয়ানা ফারিয়ার হাত ধরে টেনে বললো,
“হ্যাঁ আপু। চলো তো!”
শারমায়া সাফওয়ানার হাতের দিকে তাকিয়ে বললো,
“ওই, টাকা কোথায়?”
“কিসের টাকা!”
“ফুসকা কিনবো, টাকা লাগবে না? ফুসকাওয়ালা কি তোর জামাই লাগে যে আমাদের ফ্রী তে খাওয়াবে! আব্বু যে টাকা দিয়ে গেছে সেই টাকা নিয়ে আয়!”
“না, আমার দুলাভাই লাগে। এমনিতেই খাওয়াবে।”
সাফওয়ানা শারমায়াকে ইঙ্গিত করলেও শারমায়া ফারিয়ার দিকে মোর ঘুরিয়ে দিলো।
“দুলাভাই! ফারিয়াপুর হাসব্যান্ড নাকি?”
কথা বলে উভয়েই হেসে উঠলো। আর ফারিয়া বললো,
“যা, শয়তানের দল! শেষমেষ ফুসকাওয়ালাকে পছন্দ করলি দুলাভাই ডাকার জন্য! দাঁড়া, আমি টাকা নিয়ে আসি।”
শারমায়া তাকে বাঁধা দিয়ে বললো,
“আরে না। সাফু দিবে টাকা। আব্বু টাকা দিয়ে গেছে মজা খাওয়ার জন্য। সেই টাকা আদায় করে নেই আগে। ওইটার হাক ছাড়বো নাকি আমি!”
অবশেষে সাফওয়ানার টাকাতেই হলো তাদের ফুসকা খাওয়া। গেইটের বাইরে থেকে ফুসকা কিনে তারা ফ্ল্যাটে চলে এলো। তারপর এই সন্ধ্যায় আড্ডা দিতে দিতে ফুসকার স্বাদ উপভোগ করলো।
একের পর এক শেষ হলো এক্সাম। যেদিন এক্সাম শেষ হয়েছে সেদিনই বিকেলে সাফওয়ানাকে নিয়ে রিজার্ভ সিএনজি দিয়ে চলে গেলো খালামনির বাড়ি। নানা বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো কিন্তু সামনে ঈদ হওয়ায় ঈদের পরই যাবে সেখানে। হাসব্যান্ড জার্মান চলে যাওয়ার পর খালাতো বোন সুষনা এখন বাবার বাড়িতেই থাকছে। মেডিক্যালে পড়া শেষ করতেই পরবর্তী বছর তাকে জার্মান নিয়ে যাবে আরিফ। আপু বাড়িতে হওয়ায় তারা দুই বোন চলে এলো এখানে। হাতমুখ ধুয়ে একসাথে ইফতার করলো। অত:পর খালামনি, ভাইয়া, ভাবি ও আপুর সাথে গল্পগুজব। এসেছিলো সপ্তাহের ছুটি কাটাতে কিন্তু তৃতীয়দিনই ডাক পড়লো মায়ের! সন্ধ্যায় মেহমান আসবে। বিকেলের আগে আগেই যেন বাড়িতে হাজির হয়। এই রমজান মাসেও মেহমানদের আসতে হবে! আর মেহমান এলে তাদেরই বা কি করণীয়! মা কি পারতো না আপ্যায়ন করতে! তা ভেবে বিরক্তবোধ করলো শারমায়া! যেতে ইচ্ছে করেনি তবুও খালামনির ধাক্কাধাক্কিতে চলে যেতে হলো। খালামনি যাওয়ার কথা বলায় সাফওয়ানা রেগে বলে এসেছে,
“ডেকে এনে আবার তাড়িয়ে দিচ্ছো না তুমি? আর জীবনেও আসবো না তোমার বাড়ি।”
খালামনিও উপহাস করে বললো,
“আচ্ছা, জীবনেও আসতে হবে না। ঈদের পরে আসিস।”
জীবনেও না আবার ঈদের পরে! ঈদ কি জীবনের মধ্যে পড়ে না! তা ভেবে আরও রেগে গেলো খালামনির উপর! তাই আর কোনো কথাই বললো না সাফওয়ানা।
সন্ধ্যায় বাড়িতে ইফতারের মোটামুটি বিশাল আয়োজন। মেহমানদের সম্পর্কে মায়ের কাছে জিজ্ঞাসা করতেই জানতে পারলো আশরাফ স্যার ও তার পরিবার আসছে। কেন আসছে তা আর জানতে চাইলো না। কারণ পরপর দুবার পরিবার নিয়ে আসার কারণ শারমায়া আন্দাজ করতে পেরেছে। নিশ্চয়ই তার জন্য কোনো পাত্রের খোঁজ নিয়ে এসেছে আশরাফ স্যার। আর সেই পাত্র নিশ্চয়ই স্যারের খুব ঘনিষ্ঠ আত্মীয়।