“হালাল প্রেম”
পর্ব-৯
(নূর নাফিসা)
.
.
“শারমায়া, আমার কণ্ঠ কি মেয়েদের মতো শুনতে? সিরিয়াসলি আজ প্রথম মনে হচ্ছে আপুর কণ্ঠের সাথে আমার কণ্ঠের মিল রয়েছে।”
শারমায়া দাঁতে দাঁত চেপে ই… করে আছে আর সাফওয়ানা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে! সাফওয়ানার হাসি শুনতে পেয়ে ওপাশ থেকে জোভান বললো,
“শালিকা, এতো হেসো না। তোমার আপু লজ্জা পাচ্ছে।”
তা শুনে সাফওয়ানা আরো জোরে হেসে উঠলো। শারমায়া তাকে একটা লাথি মেরে চোখ পাকালো। অতপর বিড়বিড় করে জোভানের প্রশ্নের জবাব দিলো,
“মায়ের সাথে তো এতোক্ষণ আপু কথা বলছিলো। তাই ভেবেছি আপু।”
এবার জেভার কণ্ঠ ভেসে এলো,
“এইতো, আমিও আছি। আহনাফ দুষ্টুমি করছে তাই সালামের জবাব দিতে পারিনি, জয় দিয়েছে। তা কেমন আছো তুমি?”
“আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন?”
“আমিও আলহামদুলিল্লাহ। তবে তুমি করে বললে বেশি খুশি হবো।”
“চেষ্টা করবো।”
“জয়ের সাথে কথা বলো। বাচ্চাটা খুব জ্বালাচ্ছে। আমি গেলাম। আর প্রব্লেম না থাকলে তোমার ফোন নম্বর টেক্সট করে দিয়ো। জয় তো আর আন্টির কাছে কল করে বারবার তোমার সাথে কথা বলতে চাইবে না। জামাই বলে কথা।”
কথার সাথে জেভা হেসে উঠলো। দুই সেকেন্ড পর জোভানের জিজ্ঞাসা,
“কেমন আছো তুমি?”
“আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?”
“আলহামদুলিল্লাহ। আমি ফোর্স করবো না। তোমার যখন ইচ্ছে আমাকে তুমি করে ডাকতে পারো।”
শারমায়াম মনে মনে বললো,
“সম্ভব না।”
এদিকে তাকে চুপ করে থাকতে দেখে জোভান বললো,
“এক্টিভ আছো তুমি?”
“হু?”
“কথা বলছো না যে তাই জিজ্ঞেস করলাম। বাসার সবাই কেমন আছে?”
“আলহামদুলিল্লাহ।”
“এই মুহূর্তে তুমি ভালো আছো তো?”
“আলহামদুলিল্লাহ। ”
“তোমার সাথে কথা বলতে আমার ভয় লাগছে। রাখি এখন।”
আর কোনো কথা হলো না তাদের। জোভান কল কেটে দিয়েছে। এমন অদ্ভুত কাণ্ড শারমায়াকে বারবার বিস্মিত করে তোলে। কাল তাড়াহুড়ো করে কার্ডটি দিয়ে কিছু না বলেই চলে গেলো। আজ কল দিলো কথা বলার জন্য আবার দ্রুই কেটে দিলো! তার নাকি ভয় লাগে! ভয় কেন লাগবে! সে কি জন্তু জানোয়ার যে তাকে ভয় পাবে, তার সাথে কথা বলতেও ভয় লাগবে ! আজব লোক একটা!
ভাবতে ভাবতে শারমায়া মায়ের রুমে ফোন রেখে এলো। আবার নিজের রুমে ফিরে আসতেই মনে হলো জেভা বলেছিলো তার ফোন নম্বর পাঠাতে। যদি না পাঠায় তাহলে মন খারাপ করবে আর তাকে ভাবওয়ালী মনে করবে । তাই শারমায়া আবার মায়ের রুমে এলো। অতপর নামসহ ফোন নম্বর টেক্সট করলো। রুমে এসে নিজের ফোন হাতে নিতেই দেখলো মেসেজ। এই মাত্রই এসেছে…
“কতদিন আমাকে এভাবে ভয় পেতে হবে?”
বুঝতে বাকি নেই যে জোভানই পাঠিয়েছে। কিন্তু মেসেজের কোনো মর্মার্থই বুঝলো না শারমায়া! বারবার এমন কিছু জিজ্ঞেস করার মানে কি! সে কখন ভয় দেখালো জোভানকে, সেটাই ভেবে পাচ্ছে না! সে আর রিপ্লাই করলো না।
পরদিন কোচিং-এ আসতেই আশরাফ স্যার বললো যাওয়ার সময় দেখা করে যেতে। তাদের কলেজের অনেকেই স্যারের কোচিং-এ ভর্তি হয়েছে। কারণ স্যার সবার পছন্দের একজন। আজ সে ক্লাসে খুব মনযোগ দিলো। যদিও তাদের মতো এতোটা এক্টিভ না সে তবু মাথা কাজ করেছে কিছুটা। শারমায়া ক্লাস শেষ করে ফ্রেন্ডদের সাথে কথা বলতে বলতে গেইটের বাইরে চলে এসেছিলো। হঠাৎই নিধি তার হাতে তাকিয়ে বললো,
“সাদিয়া! তুই এনগেজড! নাকি এমনি পরেছিস?”
“এমনি পরলে কি দিবি আর এনগেজড হলেই বা কি দিবি?”
“সব জায়গায় এতো মতলব খুজিস কেন? এমনি হলে কিছু দিবো না। এনগেজড হলে মাইর দিবো।”
“তুই মতলব খুজলি না-ই বা কোথায়? বাই দ্যা ওয়ে, মাইর দিবি কেন?”
“এনগেজমেন্ট এ দাওয়াত পাইনি তাই।”
“ওফ্ফ! আশরাফ স্যার আমাকে দেখা করতে বলেছিলো। তোরা যা, আমি আসছি।”
“আংটির ব্যাপারে বললি না যে?”
শারমায়া গেইটের কাছে এসে পেছনে ফিরে মুচকি হাসলো এবং বললো,
“সরি দোস্ত। ছুটি মানেই আমার কাছে সব ছুটি। ঈদের ছুটি ছিলো তাই দাওয়াত দেইনি। আই মিন দাওয়াতেরও ছুটি।”
অতপর শব্দযোগে হেসে গেইটের ভেতর প্রবেশ করলো। ওদিকে বন্ধুবান্ধবদের চেহারায় রাগ স্পষ্ট। শারমায়া স্যারের কাছে আসতেই স্যার তার হাতে ছয়টা শিট ধরিয়ে দিলেন। বলে দিলেন বাসায় বসে বসে বুঝে পড়তে। যেগুলো বুঝতে অসুবিধা হবে সেগুলো কোচিং শেষে অফিস রুমে এসে স্যারের কাছে বুঝে যেতে। এভাবে না পড়লে তাদের মতো পারদর্শী হতে পারবে না। স্যারের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো শারমায়া। তারা চলে গেছে। সে রিকশার জন্য গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে রইলো। মিনিট তিনেক পরে একটা লাল রঙের গাড়ি তার সামনে দিয়ে গেলো, একটু এগিয়ে যেতেই আবার পেছনে এসে শারমায়ার কাছে ব্রেক কষলো। শারমায়া আজ আবার সেই সানগ্লাস পরা হিরোকে দেখতে পেল। জোভান সানগ্লাস খুলে তাকে বললো,
“বাসায় যাবেন ম্যাডাম? তাহলে চলুন, আমি ওদিকেই যাচ্ছি।”
“না, আপনি যান।”
“অফকোর্সলি, আমি চাইছিলামই তোমার জান হতে। তবে এতো তারাতাড়ি হয়ে যাবো ভাবিনি। এসো…”
শারমায়া লজ্জা পেয়ে বললো,
“আমি সেটা মিন করিনি।”
“তারমানে কি এখন আমার প্রত্যাশাকে রিজেক্ট করছো?”
“না, আমি সেটাও মিন করিনি। আমি রিকশায় যাবো।”
“তাহলে কি আমি এখন গাড়ি ছেড়ে তোমার সাথে রিকশায় যাবো? কেউ তো নেই আমার সাথে, গাড়ি কার কাছে দিয়ে যাবো!”
“আমি আপনাকে আসতে বলিনি।”
“তা বলনি তবে আমি কিন্তু তোমাকে আসতে বলেছি।”
বারবার না করাটা ঠিক হবে না তাই শারমায়া আর কিছু না বলে গাড়িতে উঠলো। জোভান চুপচাপ গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। আর শারমায়া ব্যাগের চেইনে নখ ঘষছে। মনের ভেতর অজানা এক তোলপাড় চলছে। জোভানকে দেখলে কিংবা তাকে নিয়ে ভাবলেই কেন এমন হয় সে জানে না। চাইলেও সে নিজেকে স্বাভাবিক করতে পারে না। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে জোভানই প্রথম বললো,
“শারমায়া তুমি কি আমাকে ভয় পাও?”
শারমায়া মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
“ভয় কেন পাবো!”
“তাহলে আমাকে কেন ভয় দেখাও?”
“আমি আপনাকে ভয় দেখালাম কখন?”
“যখনই আমার সান্নিধ্যে অনুভব করি তখনই।”
“বুঝলাম না।”
“প্রথম শ্বশুরবাড়ি গেলাম, প্রথম তোমার দর্শন পেলাম, প্রথম একটা অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছিলো তোমাকে নিয়ে। যাওয়ার পূর্বে নানান প্রস্তুতিও নিয়ে গিয়েছিলাম তোমার বাসায়। কিন্তু তোমার কন্ডিশন দেখে আমি ভয় পেয়ে গেছি। যখন আংটি পরাচ্ছিলাম, তুমি থরথর করে কাপছিলে। যখন এককভাবে একটু কথা বলতে তোমার রুমে গেলাম, তখনও তুমি কাপছিলে। আমি প্রচুর ভয় পেয়েছি, এই বুঝি তুমি অসুস্থ হয়ে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়বে! তাই আমাকে উক্তস্থান দ্রুত ত্যাগ করতে হলো। কাল ফোনে কথা বলতে চাইলাম, সেখানেও তোমার কণ্ঠ কাপছিলো। কোথায় তুমি আর কোথায় আমি, এতো দূরে অবস্থান করেও তোমার এই অবস্থা! আমি ভয়ে কলই কেটে দিলাম। এমন হলে তো তুমি আমি কখনো কাপলই হতে পারবো না, সারাজীবন সংসার করবো কিভাবে! দেখো, তুমি এখনো হাত কিভাবে ব্যাগের মধ্যে নাড়াচ্ছো!”
শারমায়া ঝটপট দু হাত স্থিরভাবে ব্যাগের উপর রেখে বাইরে তাকিয়ে রইলো। খুব বড়সড় একটা নিশ্বাস ফেলে নিচু স্বরে বললো,
“আমি মোটেও ভয় পাই না।”
“জোভান তার দিকে এক পলক তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো,
“সিরিয়াসলি?”
“অফকোর্সলি।”
“ওফ্ফ! বাচালে আমায়। এরপর থেকে তাহলে আমিও কিন্তু আর ভয় পাবো না। বিপরীতে তুমি জ্ঞান হারালে আমি দায়ী নয়।”
শারমায়া মুখ চেপে হাসলো। তার মুখে হাসি উপলব্ধি করতে পেরে জোভানও হাসলো এবং ওয়ালেট থেকে একটা রেড রোজ কার্ড এগিয়ে দিলো তার সামনে। শারমায়া তার দিকে এক পলক তাকিয়ে কার্ডটি হাতে নিলো। জোভান ড্রাইভিং করতে করতে বললো,
“খুলে দেখো।”
তার কথায় শারমায়া কার্ডটি খোলার জন্য ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখলো। কিন্তু এটার মধ্যে তো খোলার কোনো উপায়ই খুঁজে পাচ্ছে না! তাকে এভাবে কার্ড ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখে জোভান বললো,
“শারমায়া, তুমি সেদিনের কার্ডটি খুলে দেখোনি?”
এমন উক্তিতে শারমায়া হতবাক! জোভানের কণ্ঠটা যেনো হতাশাগ্রস্ত মনে হলো তার কাছে! ইশ! সে তো হতাশ করতে চায়নি তাকে। এমনটা কেন হলো! ওই কার্ডটি যে খোলা যায়, সে তো জানতোই না! সে লজ্জিত কণ্ঠে বললো,
“এটা কিভাবে খোলা যায়, আমি জানি না।”
“তুমি জানো, আমি অপেক্ষায় ছিলাম তুমি কিছু রিপ্লাই করবে।”
“আমি সত্যিই জানি না এটা কিভাবে খোলে।”
“আমি শিখিয়ে দিচ্ছি, গোলাপের পাপড়ি গুলো ধাপে ধাপে নুয়িয়ে দিলে কিংবা উপরের কভারটা একটু মোচড় দিলেই দেখবে পাপড়িগুলো ভেতরে দেবে খুলে গেছে কার্ড। ওইটাও সেইম সিস্টেম। উপরের কভারটা মোচড় দিলেই লাভের লোমগুলো ভেতরে চলে যাবে। আবার উল্টো মোচড় দিলে পূর্বাবস্থায় ফিরে লক হয়ে যাবে।”
শারমায়া কথামতো কার্ডখুলে চিরকুট পেলো।
“প্রেমগীত বেজে উঠেছে মনের আঙিনায়,
চাইলেই তুমি সাড়া দিবো মনের সীমানায়।
বসে আছি তোমার সাড়ার অপেক্ষায়…♥”
চিরকুট পড়ে শারমায়া হাসিমুখে খুশিমনে বাইরে তাকিয়ে রইলো। জোভানও নিশ্চুপ। বাড়ির সামনে গাড়ি থামতেই শারমায়া নেমে গেলো। জোভান বললো,
“কিছু বলবে না?”
“বাসায় আসুন? আম্মুর সাথে দেখা করে যান।”
“উহুম, অন্য একদিন। এখন এক জায়গায় যেতে হবে। আমার প্রত্যাশার রিপ্লাই করবে না?”
শারমায়া বাড়ির দিকে দুই কদম এগিয়ে আবার পেছনে ফিরে বললো,
“বিয়ের আগে প্রেম হারাম।”
জবাবের সাথে সাথেই জোভানের চেহারা বিস্ময়কর হয়ে উঠলো! শারমায়া মৃদু হেসে চলে গেলো। বিস্মিত মনোভাব নিয়ে জোভানও চলে গেলো তার পথে।