হিমি পর্ব-১৩

0
973

হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার

১৩.

হিমি এগিয়ে গিয়ে মিশ্মিকে তোলার চেষ্টা করলো। হিমির হাতের উপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালো মিশ্মি। চোখ মুখ লাল হয়ে আছে তার। চোখের জ্বল সারা মুখে ল্যাপ্টে আছে। হেঁচকি তুলতে তুলতে মিশ্মি বলে উঠলো,

‘আপু প্লীজ তুমি কাউকে এসব বলো না। কাউকে না।’

হিমি স্তম্ভিত চোখে তাকালো। বললো,

‘তুই কি বলতে চাইছিস বলতো! অথৈর বিয়ে হয়ে যাক ওই লোকের সাথে? আর তুই? তুই,,,,,’

হিমির কথার মাঝপথেই চোখ তোলে তাকালো মিশ্মি। জোড়ালো শ্বাস টেনে নিয়ে বললো,

‘আমার কিছুই না। ইয়াসির স্যার অথৈকে ভালোবাসেন। অথৈ‌ও ইয়াসির স্যারকে বিয়ে করতে চায়। মাঝখান থেকে আমার ভালোবাসার কথা শুনলে হব নষ্ট হয়ে যাবে।’

হিমির দৃঢ় গলায় জবাব,

‘আমি তোর কথা বলছি মিশু!’

‘আমি ওদের কথা বলছি আপু।’

হিমি ধাতস্থ হলো। মিশ্মি দু হাতে মুখ মোছে স্বাভাবিক গলায় বললো,

‘ইয়াসির স্যার আমাকে কেনো কোনো মেয়ের দিকেও ভালো করে তাকান নি। ভীষন রাগি শিক্ষক। তিনি জানেন কলেজের অনেক মেয়েই ওনার প্রেমে পরেছে, ওনার ব্যক্তিত্বের প্রেমে পরেছে। কিন্তু কাউকেই পাত্তা দেন নি কখনো। তিনি এও জানেন এদের মধ্যে কেউ একজন তাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। কিন্তু আফসোস, সেই মেয়েটা যে আমিই সেটা তিনি জানেন না। আর জানেন না বলেই বিষয়টা নিয়ে ঘাটাঘাটি করেন নি। ওনার বোন সেদিন বললো, অথৈকে প্রথম দেখায় ভালোবেসে ফেলেছিলেন। আর তাই এই বিয়ের প্রস্তাব!’

হিমি আশ্চর্যান্বিত হয়ে প্রশ্ন করলো,

‘উনি জানেন না তোর ফিলিংসের কথা?’

মিশ্মি ডানে বামে মাথা নাড়লো। হিমি সন্দিহান গলায় বললো,

‘তবে যে তুই বললি ওনার ভালোবাসা পেতে তুই ব্যর্থ!’

‘আসলে আমি এতোটাই পাগল হয়ে গেছিলাম যে যা তা করেছি। এমন এমন উদ্ভট কান্ড করেছি তা বলে শেষ করা যাবে না। ওই মানুষটাকে বুঝাতে চেয়েছিলাম তাকে ভালোবেসে একটা মেয়ে ক্লান্ত হয়ে পরেছে। উনি বুঝেছিলেন। কিন্তু বুঝেন নি সেই পাগল, উদ্ভ্রান্ত মেয়ে কে? আমায় খুঁজেন নি খুব একটা। ধরা দিই নি বলে নিজ থেকে আর চেষ্টাও করেন নি তাই।’

‘কি এমন করেছিলিস মিশু?’

মিশ্মি তাচ্ছিল্য হাসে। দু ফুটা জ্বল গাল বেয়ে গড়ায়। আবার‌ও মোছে মিশ্মি। হাসি মুখেই বলে,

‘ছারো না আপু। যা করার করে ফেলেছি, এখন আর সেসব শুনে লাভ নেই। এখন যা হচ্ছে হতে দাও।’

হিমি অনুরোধ করে বলে,

‘এট লিস্ট ইয়াসিরকে জানা তুই উনাকে ভালোবাসিস!’

‘কি লাভ হবে? বরং ক্ষতি হবে।’

হিমি ভ্রু কুঁচকায়। মিশ্মি আকুলতা ভরা গলায় বলে,

‘অথৈ আর আমার বয়সের পার্থক্য বেশি নাহলেও আছে। তবুও সেই ছোট্ট বেলা থেকে বড় বোন না ভেবে বন্ধু ভেবে গেছি তাকে। সেও মানা করে নি আমায়। ছোট্টবেলা থেকেই সৈ পাকিয়ে ছিলাম দুজনে। আজ ওর সুখটুকু কেড়ে নেবো? যে মেয়ে তোমার পর সব সময় আমার সুখের কথা ভেবেছে, আমার আবদার‌ও মিটিয়েছে তাকে দুঃখ দিই কি করে?’

কয়েক সেকেন্ড থেমে হিমির হাত ধরে বলে উঠে,

‘অথৈ যেনো কিছুতেই এসব না জানে আপু। ও মেনে নিতে পারবে না। সারাজীবন বিয়ে নিয়ে স্বপ্ন দেখা মেয়েটার সব স্বপ্ন শেষ হয়ে যাবে। ইয়াসির স্যার‌ও যেনো কিছুই না জানতে পারেন। যা ওনার এতোদিন জানা হয় নি তা বাকি জীবনে না জানলেও ক্ষতি হবে না। ওদের ভালো থাকতে দেয়া উচিত।’

‘তা বলে অনুভুতিগুলো ভেতরে দাবিয়ে রাখবি?’

হিমির প্রশ্নের উত্তরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিশ্মি। উদ্দেশ্যহীন তাকিয়ে বলে,

‘যে অনুভুতির কারো কোনো পরোয়াই নেই সে অনুভুতি দাবিয়ে রাখতে হয়। কিছু ভালোবাসা প্রকাশ করার প্রয়োজন পরে না। বরং লুকিয়ে রাখতে হয়। লোকচক্ষুর আড়ালে। কিছু ভালোবাসার বদলে এক ঝাঁক দীর্ঘশ্বাস পাওয়া‌ও জরুরী।’

ঢোক গিললো হিমি। শুকনো গলায় বললো,

‘বাড়ি যা তুই।’

মিশ্মি কোনো প্রশ্ন করলো না আর। রাস্তার পাশের কল ছেড়ে দুহাতে পানির ঝাপটা মারলো চোখে মুখে। হাত দিয়ে অতিরিক্ত পানি ঝেড়ে ফেলে মৃদু হাসি ফুটালো ঠোঁটে। বার কয়েক লম্বা শ্বাস টেনে এগিয়ে গেলো বাড়ির দিকে। হিমি মাথার চুল খামচে ধরে গাল ফুলিয়ে শ্বাস ছাড়লো। বড় রাস্তার দিকে একপলক দেখে দৌড়তে লাগলো হিমি। ছুটতে ছুটতে হাঁপিয়ে উঠলো একপর্যায়ে। ল্যাম্পপোস্টে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে শ্বাস নিলো। দম নিয়ে আবার‌ও দৌড় লাগালো। কিছুক্ষন আগে অব্দি হিমির গন্তব্য জানা ছিলো। এখন নেই। কোথায় যাচ্ছে বা যেতে হবে সেটা ভাবছে না হিমি। শুধু দৌড়াচ্ছে।

__________________

দুপুর একটা বাজে। শহরের সনামধন্য এক রেস্টুরেন্টে বসে আছে সামিয়া আর তাহির। পেস্ট কালার থ্রি পিস পরনে সামিয়ার। তাহিরের ব্লেজারের রঙটাও পেস্ট। তাহির ভেবে পাচ্ছে না দুজনের পোশাকের কালার ম্যাচ করলো কিভাবে। এটা কি শুধুই কাকতালীয়? দীর্ঘসময়ের নিরবতা ভেঙে সামিয়া বললো,

‘আপনার এই সময় আসতে কোনো অসুবিধা হয় নি? না মানে, প্যাশেন্ট!’

‘আমি সকাল নটা থেকে বারোটা আর বিকেল তিনটে থেকে রাত আটটা অব্দি চেম্বারে প্যাশেন্ট দেখি। বাকি সময় হাসপাতালের প্যাশেন্টদের এটেন্ড করি। আমার কাজ অন্য একজনকে হস্তান্তর করে এসেছি তাই অসুবিধা হয় নি।’

সামিয়া মৃদু হাসলো। তাহির গলা কেশে বললো,

‘কিছু বলতে চেয়েছিলেন বোধ হয়!’

সামিয়া চমকায়। এদিক ওদিক চোখ ঘুরিয়ে গ্লাসের পানি টুকু এক চুমুকে শেষ করে। হাসার চেষ্টা করে বলে,

‘হ্যা, আসলে আপনাকেই বলতে চাইছি। অন্য কারো সাথে কথা বলার ভরসা পাচ্ছি না। আই হোপ আপনি বুঝবেন!’

তাহির ভ্রু কুঁচকালো। কি বলবে এই মেয়ে? বিয়ে ভাঙার আবদার নিয়ে আসে নি তো? আসতেও পারে। নিশ্চয় প্রেমিক আছে তার। মান অভিমান হয়েছিলো হয়তো তাই বিয়েতে সায় দিয়েছিলো। অথবা পরিবারের জোরাজোরিতে অমত করে নি। এখন প্রেমিকের কথা মনে পরেছে বিধায় বিয়ে থেকে মুক্তি চাইছে। কিন্তু তাহির কি করবে? ওর কি করা উচিত? ‌মেয়েটা বিয়ে না করতে চাইলে সবাইকে বলে দিক। তা না করে তাহিরের সময় নষ্ট করছে কেনো? রাগ লাগে তাহিরের। অপমানিত বোধ হয় তার। এয়েটার টেবিলে অর্ডারকৃত খাবার দিয়ে যায়। সামিয়া অস্ফুট স্বরে বলে,

‘বিয়েটা পিছিয়ে দিন!’

তাহির বুঝে নি সামিয়ার কথা। টেবিলের দিকে ঝুঁকে স্মিত গলায় বলে,

‘সরি?’

‘আমি এক্ষুনি বিয়ে করতে চাইছি না। প্লিজ বিয়েটা পিছিয়ে দিন!’

কাতর সুরে বলে উঠে সামিয়া। তাহির মেরুদন্ড সোজা করে বসে। এদিক ওদিক তাকায়। সামিয়ার প্রেমিককে খোঁজার চেষ্টা করে। সামিয়া সন্দিহান গলায় বলে,

‘কাকে খুঁজছেন?’

‘আপনি বিয়েটা পিছিয়ে নিতে বলছেন কেনো?’

তাহিরের প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় সামিয়া। এমন প্রশ্নের কথা তো সে ভাবে নি। ভেবেছিলো সামিয়ার কথা শুনে তাহির আশ্বাস দিবে তাকে। মেনে নেবে তার কথা। সামিয়া তো উত্তর তৈরি করে আনেনি। শুধু আবদারটাই তৈরি ছিলো তার। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলে,

‘একটু প্রবলেম আছে।’

‘কি প্রবলেম?’

তাহিরের প্রশ্নের উত্তর খুঁজে সামিয়া। কিছুক্ষন ভেবে নিয়ে বলে,

‘প্রবলেম টা বিয়ের পর বলবো। কিন্তু প্লিজ বিয়েটা পিছিয়ে দিন। আমার কথা কেউ শুনবে না। আপনি বললে শুনবে অবশ্য‌ই।’

তাহির স্বস্তি পায়। যাক মেয়েটা তবে বিয়ে করবে। শুধু কয়েকদিন পিছাতে চাচ্ছে। এতে দোষের কিছু নেই। ব্যক্তিগত প্রবলেম থাকতেই পারে সেসব বিয়ের পর জানা যাবে। তাহির প্লেইটে খাবার নিয়ে এগিয়ে দেয় সামিয়ার দিকে। সামিয়া জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাহিরের দিকে। তাহির ধীর স্থিরে এক চামচ খাবার মুখে নিয়ে বললো,

‘কতোদিন পর বিয়ে করতে ইচ্ছুক।’

‘দু মাস।’

‘দু মাস?’

অবাক হয়ে বললো তাহির। সামিয়া জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো,

‘দু মাস সময় আমার খুব প্রয়োজন। আমি আর কাউকে বলতে পারছি না এ বিষয়ে। তাই আপনাকেই বলছি। প্লিজ রিকুয়েস্ট ফেলবেন না!’

তাহির ছোট্ট নিঃশ্বাস টেনে মাথা দুলিয়ে সায় জানায়। চশমা চোখে ঠেলে দিয়ে বলে,

‘খেয়ে নিন।’

সামিয়া খাওয়ায় মনোযোগী হয়। বাকি সময়টুকু কেউ কোনো কথা বলে নি আর। খাওয়া শেষে বিল পে করে বিদায় নিয়ে যার যার গন্তব্যেও চলে গেলো তারা। সামিয়াকে ড্রপ করে দিতে চাইলেও সে রাজি হয় নি। রিকশায় উঠে একাই চলে গেলো। তাহির নিজ গাড়িতে করেই হাসপাতালে চললো আবার। পথিমধ্যে মায়ের ফোন পেয়ে হতাশ হলো তাহির। মাকে ফোনের মধ্যে এসব বলা যাবে না। তিনি বুঝবেন না। তাহির‌ও বুঝাতে পারবে না। তাই ফোন উঠিয়ে বলে দিলো,

‘লাঞ্চ করেছি মা। বাড়ি এসে বলছি সব।’

মায়মুনা জামান মৃদু গলায় বললেন,

‘ঠিক আছে।’

___________________

রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে মুখোমুখি দুটো বেঞ্চে বসে আছে হিমি, দোহা, ইমন, সূর্য, সোহিনী আর মেঘ। সবার চেহারায় বিষন্নতা। হাতে ধোয়া উঠা চায়ের কাপ। ঘর্মাক্ত শরীরে ল্যাপ্টে আছে গায়ের পোশাক। দৃষ্টি তাদের অস্থির। সূর্য চায়ের কাপে কালচে ঠোঁট ছুঁইয়ে বললো,

‘এই প্রেম ভালোবাসা বহুত প্যারা। এর লাইগ্গাই আমি এসবে জড়াই না বুঝছোত?’

ইমন ঠোঁটে হাসি চেপে বললো,

‘তোর সাথে কেউ প্রেম করতে চাইলে তো করবি। একটা মেয়েও তো ফিরে তাকায় না।’

‘হেগো চোখ খারাপ। ন‌ইলে আমার মতো সুদর্শন পোলার দিকে না তাকাইয়া রোজ রোজ এই এলাকা দিয়া যাওয়া আসা করে? আমি বাজি ধ‌ইরা বলতে পারি আমারে ঠিক মতো দেখলে কোনো মাইয়াই আর চোউখ ফিরাইতে পারবো না।’

মেঘ বিরক্তি প্রকাশ করলো। বললো,

‘শালা চুপ কর। যে কথায় আছি সেটা শেষ করি পরে তোর ফাউল প্যাচাল পারিস। হিমি? কি করবি এখন?’

হিমি চায়ে চুমুক বসালো। ঠোঁট উল্টে বললো,

‘আমার তো কিছু করার নেই। করার থাকলে ঠিক করতাম। মিশ্মি নিজেই সব বন্ধ করে দিয়েছে।’

সবাই দীর্ঘশ্বাস ফেললো। দোহা হাতের ব্যাগটা ছুড়ে ফেললো সূর্যের উপর। সূর্য কাপ এক হাতে সরিয়ে নিয়ে ব্যাগটা লুফে নিলো। সন্দিহান গলায় বললো,

‘তোর কি হ‌ইছে হারামী? যখন তখন যা তা ছুড়াছুড়ি করিস কেনো?’

‘আহাম্মক একটা। তোকে হিমি কি করতে বলেছিলো? ওই ইয়াসিরের ঠিকুজি গোষ্ঠী বের করতে বলেছিলো না? তাইলে মিশ্মির কথাটা জানলি না কেমনে তুই?’

সূর্য গর্জে উঠে বললো,

‘হিমি ক‌ইছিলো ওই ব্যাটা কারো লগে ইটিশ পিটিশ করে কি না সেইটা জানতে। তার জিন্দেগীতে কোনো মাইয়া আছিলো কিনা সেইটার খবর‌ও জানতে চাইছিলো। ক‌ইছিলো নি, কোন কোন মাইয়ার বুকের ভেতর ব্যাটার চিত্র আঁকা সেটা খোঁজ করতে? জাতীয় পর্যায়ের বেক্কল তুই!’

দোহা চোখ মুখ ফুলালো। সোহিনী কাপ ভর্তি চা বেঞ্চে রেখে দিয়ে উদাসী গলায় বললো,

‘মিশ্মি নিজেকে সামলাতে পারবে তো?’

হিমি বেঞ্চ থেকে উঠে পকেটে দু হাত গুজে রেখে বললো,

‘পারবে। ওর কথায় মনে হলো নিজেকে সামলানোর যথা সম্ভব চেষ্টা করবে সে।’

সবাই মাথা ঝাঁকালো। রোদের তাপ বাড়ছে। ছায়ায় বসা উচিত তাদের। সূর্য, ইমন, মেঘ নিজেদের চা শেষ করে উঠলো। দোহা অর্ধেক খাওয়া চাই রেখে দিলো। ছয়জন একসাথে ফুটপাত ধরে এগুতে লাগলো। হিমি তার জীবনে ঘটে যাওয়া কোনো কথাই লুকায় না এদের থেকে। লুকোতে পারে না সে। আর কেউ জানুক বা না জানুক এই পাঁচটি প্রাণকে জানাতেই হয় তার। অতি ক্ষুদ্র বিষয়‌ও ভীষন প্রয়োজনীয় আলোচনা হয়ে উঠে তাদের আড্ডায়।

চলবে,,,,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here