হিমি পর্ব-৩১

0
665

হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার

৩১.

ঘর পরিষ্কারের বাহানায় মুহিব রহমানের ঘরে ঢোকেন আমিনা বেগম। হাতের পাতলা কাপড় দিয়ে আসবাব ঝাড়তে ঝাড়তে বলেন,

-তৌসিফ ভাইকে তোমার মনে আছে মুহিব ভাই?

মুহিব রহমান বারান্দার চেয়ারে ব‌ই হাতে বসেছিলেন। আমিনা বেগমের কথায় চোখ তোলে শূণ্য দৃষ্টিতে তাকালেন। জিজ্ঞাসু গলায় বললেন,

-তৌসিফ?

আমিনা বেগম জোর গলায় বললেন,

-হ্যা তৌসিফ ভাই। তোমার সাথে কাজ করতেন। আগে তো ছেলেকে নিয়ে আমাদের বাড়িতেও আসতেন। কতো বছর কেটে গেছে। ওনার কোনো খবর পেলাম না। তোমার সাথে যোগাযোগ আছে না কি?

মুহিব রহমান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

-না ভাবি। সেই কবেকার কথা বলছো, এসব ঠিক ঠাক মনেও নেই আমার। শেষ কখন তার সাথে দেখা হয়েছে মনে করতে পারছি না। বিয়ের পর থেকেই আর দেখা সাক্ষাত হয় নি আমাদের। হঠাৎ তোমার ওর কথা মনে পরলো কেনো?

আমিনা বেগম থতমত খেয়ে গেলেন। জোরপূর্বক হেসে বললেন,

-স্টোর রুম পরিষ্কার করছিলাম তো পুরনো এলবাম পেলাম। সেখানে ওনার একটা ছবি আছে। প্রথমে চিনি নি পরে মনে পরলো। তাই ভাবলাম জিজ্ঞেস করি। হয়তো তোমাদের বন্ধুত্ব কেনো এখনো আছে!

-তৌসিফের সাথে বন্ধুত্ব কোনো কালেই ছিলো না। একে অপরের কাজে সাহায্য করা, সাথে থাকা, প্রজেক্ট সামলানো। এই যা। যদিও আমি তাকে ভাইয়ের মতো শ্রদ্ধা করতাম। এখন যে কোথায় আছে কি করছে কিছুই জানি না।

আমিনা বেগম উসখুস করে বললেন,

-ওনার আগের ফোন নাম্বার, ঠিকানা কিছুই নেই?

-উহু। কাজের সম্পর্ক ছিলো তাই কখনো সেরকম দরকার পরে নি, রাখিও নি। ও‌ই তো মাঝে মাঝে আসতো এ বাড়ি। আর তাছাড়া তৌসিফ কখনোই মোবাইল ইউজ করে নি।

আমিনা বেগম মুখ ছোট করে বললেন,

-ওহ।

বড় ভাবি কিছু বলতে পারেন ভেবে মুহিব রহমান অপেক্ষা করলেন। আমিনা বেগম কোনো কথা বললেন না। টুকটাক কাজ করে বেরিয়ে গেলেন। মুহিব রহমান ব‌ই মেলে ধরলেন মুখের সামনে। চশমা পরা চোখে তীক্ষ্ণ নজরে একের পর এক লাইন পড়তে লাগলেন। কোনো শব্দ উচ্চারণ করলেন না যদিও তবুও তার চেহারায় অন্যরকম প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছিলো। আমিনা ঘর থেকে বেরিয়েই মুখোমুখি হলেন হিমির। সে এতক্ষন দরজার বাইরে আড়ি পেতে দাঁড়িয়ে ছিলো। ভেতরের কথোপকথন কিছুটা শুনেছে সে। তবুও সন্দেহ দূর করতে ভ্রু নাচালো। আমিনা বেগম মাথা নাড়লেন। হতাশ গলায় বললেন,

-তৌসিফ ভাইয়ের সাথে শেষ কবে দেখা হয়েছে সেটাও তোর বাবার মনে নেই। ফোন নাম্বার ঠিকানা এসব‌ আগেও ছিলো না এখনো নেই। আমি আগেই বলেছিলাম, জিজ্ঞেস করে লাভ নেই।

হিমি ঠোঁট উল্টালো। শ্বশুরের ডাক কানে যেতেই আমিনা বেগম ছুট লাগালেন। হিমি কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে শোবার ঘরের দিকে গেলো। মোবাইল বের করে সময় দেখলো। এই সময় তাহির ফ্রি থাকবে? থাকতে পারে। আবার ব্যস্ত‌ও থাকতে পারে। তবে হিমির কল দেখলে নিশ্চয় রিসিভ করবে। হিমি তাহিরের নাম্বারে ডায়াল করলো। কয়েক সেকেন্ড রিং হ‌ওয়ার পর ফোন রিসিভ হলো।

ফোন কানে ঠেকিয়ে ঘন নিঃশ্বাস টানলো তাহির। বললো,

-কিছু জানতে পারলেন?

-বাবার কাছে ওনার কোনো তথ্য নেই ডাক্তার।

তাহির মৃদু শ্বাস টেনে বললো,

-আচ্ছা।

হিমি ভেবেছিলো তার কথার পরিবর্তে তাহির হতাশ হবে। বেশি কিছু না হলেও শুকনো গলায় কথা বলবে। দুঃখ ভারাক্রান্ত হবে। কিন্তু তাহির স্বাভাবিক। যেনো এমনটাই হ‌ওয়ার ছিলো।

হিমিকে চুপ করে থাকতে দেখে তাহির সন্দিহান গলায় বললো,

-কলে আছেন?

হিমি কিছুটা থতমত খেয়ে গেলো। বললো,

-হ্যা। বলুন।

-কিছু না। রাখছি।

-আঙ্কেলকে খুঁজায় আমি কি আর কোনো সাহায্য করতে পারি?

তাহির শুকনো হেসে বললো,

-উনিশ বছর ধরে খুঁজছি। পাই নি। আদৌ কখনো পাবো কি না সন্দেহ। খুঁজার আর কোনো রাস্তা আছে কি না সেটাও অনিশ্চিত। কি করে বলি সাহায্য করতে পারবেন কি না!

-আজ না বললেও হবে। পরে যখন দরকার পরবে তখন বলবেন। বলবেন?

তাহির হাসলো। ছোট্ট করে বললো,

-হুম বলবো।

হিমি বিভ্রান্তি নিয়ে বললো,

-আমাদের আর কবে দেখা হবে?

-যখন আপনার থেকে কিছু জানার থাকবে আর আমার আপনাকে কিছু জানানোর থাকবে তখন।

হিমি বিস্ময়মাখা গলায় বললো,

-আমার থেকে কি জানার আছে আপনার?

-অনেক কিছু। এখন বলা যাবে না। সময় সময় কল করে ডেকে নেবো। তারপর কোনো এক নিরিবিলি জায়গায় বসে চা খেতে খেতে বলবো।

কথাটা বলে এক মুহুর্ত দেরি করলো না তাহির। ফট করে কল কেটে প্যাশেন্ট দেখায় ব্যস্ত হয়ে পরলো। হিমি বিস্ময় নিয়েই খাটে বসলো। কিছু একটা ভাবতে ভাবতে খাটে আধশোয়া হতেই চেঁচামেচির আওয়াজ কানে এলো। হিমি তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়ালো। এবাড়িতে চেঁচামেচি হয় না খুব একটা। সবাই শান্ত স্বভাবের। আজ হঠাৎ কি হলো বুঝলো না হিমি। দৌড়ে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। চেঁচামেচির আওয়াজ অনুসরণ করে আবিষ্কার করলো মতিউর রহমানের ঘরে পরিবারের সবাই রয়েছেন। খটকা লাগছে। দাদু কি রেগে আছে কারো উপর? কার উপর? বাবা? না কি বড় মা? নিহানের উপর‌ও রেগে থাকতে পারে। গতকাল নিহান মুখের উপর কথা বলেছিলো ওনার। এখন নিশ্চয় সে বিষয় নিয়েই চেঁচানো চলছে।

কথাগুলো আপন মনে ভেবেই মতিউর রহমানের ঘরে ঢোকলো হিমি। এই ঘরটা অন্যসব ঘর থেকে আলাদা। বেশ বড়। ঘরে অতিরিক্ত কোনো আসবাব নেই। সব‌ই নিত্য প্রয়োজনীয়। খাট, আলনা, একটা ছোট্ট কেবিনেট মতো। দু একটা ফ্লাওয়ার ভাস। তাতে ফুল নেই। এমনি সাজিয়ে রাখা। একটা সকেস আছে। প্রায় খালি। উপরের তাকে তসবি, আতর, মাথার টুপি, আর আগরবাতি রাখা। দুই নম্বর তাকে কয়েকটা পুরাতন ডিজাইনের গ্লাস, কাপ পিরিচ আর প্লেইট। তার নিচের তাকটা সম্পূর্ণ ফাঁকা। সকেসের উপরে হলদে রঙের কাপড় বিছানো। তার উপর একটা টর্চ লাইট, চার্জার, জায়নামাজ, চাদর রাখা। জানালা দরজার পর্দাগুলো সাদা রঙের। ঘরের দেয়ালেও সাদা রঙ। বিছানার চাদর হালকা, অনুজ্জ্বল রঙের। ঘরময় আগরবাতির সুবাস। স্নিগ্ধতা। এই স্নিগ্ধতাকে ম্লান করে দিচ্ছে এতো জনের গিজগিজ আর মতিউর রহমানের উত্তেজিত গলায় বলা কথা।

সকাল থেকেই সুস্থ বোধ করছিলেন না তিনি। থেকে থেকে কাঁপুনি উঠছিলো শরীর জুরে। মাথা ঝিমঝিম করছিলো। এখন শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। তীব্র শ্বাস কষ্ট। সেই সাথে হাড় কাঁপুনি শীত অনুভব হচ্ছে ওনার। কাঁথা কম্বল দিয়ে মুড়িয়ে রাখার পর‌ও উনার কাঁপুনি থামছে না। শ্বাস টানতে টানতে তবুও কথা বলছেন তিনি। ওনার মনে হচ্ছে উনি মরে যাবেন। বয়স অনেক হয়ে গেছে। এত বয়স অব্দি ওনার পরিচিত কেউ বেঁচে ছিলো না। ওনা‌র‌ও বাঁচার কথা নয়। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই হয়তো চিরতরে চোখ বোজবেন। নিঃশ্বাস আটকে যাবে। তাই এই শেষ সময়ে শেষ বারের মতো যা যা মনে এবং মুখে আসছে তাই বলে চলেছেন তিনি। জায়গা জমি তেমন নেই বলে বাড়িটাই তিন ভাইয়ের মধ্যে ভাগ করে দিচ্ছেন অর্ধ চেতন অবস্থায়। মুহিব রহমান আর নেহাল রহমান সমানে বাবাকে বুঝাচ্ছেন। ওনাকে বেঁচে থাকার আশ্বাস দিচ্ছেন। কিন্তু এতে মতিউর রহমান থামলেন না। বরং তাদেরকে উপেক্ষা করে চোখের পানি ঝরিয়ে মৃত স্ত্রীর সাথে কথা বলতে লাগলেন। আমিনা বেগমের কান্না থামছে না। রাদিবার চোখে মুখে অসহায়ত্ব, ভয়। নিহান মতিউর রহমানের পায়ের কাছটায় বসে আছে নিশ্চুপ। হিমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সবটাই দেখছে। দাদুর সামনে যাওয়া উচিত কি না বুঝছে না। এর মধ্যেই মতিউর রহমান হিমির নাম ধরে ডাকলেন। হিমি চমকালো। আমিনা বেগম উচ্চস্বরে বললেন,

-হিমি? এদিকে আয়। বাবা ডাকছেন তোকে।

হিমি গুটি গুটি পায়ে এগুলো। মতিউর রহমান কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,

-এই যে মেয়ে। এ জীবনে তোমাকে ভালো হতে দেখলাম না। সারাজীবন তো আমাকে বদ মেজাজি ভেবে গেলে। এবার চলে যাচ্ছি শান্তিতে থাকো। আল্লাহ্‌র ওয়াস্তে একটু ভালো হ‌ও। মেয়েদের মতো থাকো। বিয়ে তো দিতে হবে, না? কে জানে কার হাতে পরবে আর কি হাল হবে! আমায় বুঝলে না, এখন টের পাবে। আমি মরে গেলে একটু দোয়া করিস আমার জন্য। বুঝলি? তোর দাদীজিকে দেখতে পাচ্ছি আমি। বেশি সময় নেই। কিছু বলার থাকলে বলে ফেল। পরে চোখ বন্ধ হয়ে গেলে আর বলার সুযোগ পাবি না।

শেষের কথাটা বলে নিজেই কেঁদে উঠলেন মতিউর রহমান। হিমির বুক হু হু করে উঠলো। সত্যিই কি দাদু চলে যাবে?

চলবে,,,,,,,,

[সবাইকে ইদের অনেক অনেক শুভেচ্ছা। ইদ মোবারাক।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here