হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
৩২.
সন্ধ্যা সাতটা বাজে। খাটে আধশোয়া হয়ে বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে বসেছিলেন মতিউর রহমান। ঘরে ছেলেরা আছেন এখনো। সারাদিন ধরেই তারা এ ঘরে ছিলেন। মাঝে মাঝে নিজেদের ঘরে গেছেন আবারও ফিরে এসেছেন। মতিউর রহমান আপাতত সুস্থ বোধ করছেন। বিকেলে একবার জ্ঞান হারিয়েছিলেন। আবার জেগে উঠবেন তা তিনি ভাবেন নি। তবে জেগে উঠেছেন দেখে অন্যরকম শান্তি অনুভব হচ্ছে ওনার মনে। অস্বস্তিভাবটাও কেটেছে কিছু। একটু আগেই জাউ ভাত খেয়ে ঔষধ খেয়েছেন। এখন আবারও শোবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমিনা বেগম ঘরে ঢোকে কাউকে ভেতরে আসতে ডাকলেন। মতিউর রহমান কপাল কুঁচকে ঘাড় উচালেন। ঘরে ঢোকলেন দুজন মাঝবয়সী মহিলা আর পুরুষ। মতিউর রহমান এদেরকে চেনেন। গত দিন দেখাও হয়েছিলো। হাশিম শরীফ আর ওনার স্ত্রী রোশন আরা। পেছন পেছন ঢোকলো গোলগাল চেহারার পিচ্চি করে দেখতে এক মেয়ে। গায়ে তার খয়েরি রঙের জামা। দেখতে ভারি মিষ্টি। মতিউর রহমান কৌতুহলী দৃষ্টিতে দেখলেন মেয়েটিকে। হাশিম শরীফ আর ওনার স্ত্রীর বলা কথা কিছুই কর্ণগোচর হয় নি মতিউর রহমানের। হাশিম শরীফ মেয়েটিকে ইশারা করতেই সে নম্র গলায় সালাম জানালো মতিউর রহমানকে। মেয়েটির শুদ্ধ উচ্চারণে মতিউর রহমানের চোখ উজ্জল হয়ে উঠলো। মৃদু হেসে সালামের জবাব দিয়ে ছেলে মুহিবের দিকে তাকালেন। মুহিব রহমান হাসি হাসি মুখে বললেন,
-হাশিম ভাইয়ের মেয়ে। মিশ্মি।
মতিউর রহমান মাথা দুলালেন। ঘাড় হালকা উচিয়ে বাইরে দৃষ্টি রেখে বললেন,
-হানিফ শরীফ আসেন নি?
হাশিম শরীফ অপ্রস্তুত হাসলেন। বললেন,
-আমরা যে আসছি, ভাইসাবকে জানাই নি।
-ওহ, তা কেনো এলে?
মতিউর রহমান বেশ স্বাভাবিক গলাতেই প্রশ্ন করলেন। হাশিম শরীফ মৃদু গলায় বললেন,
-আপনি অসুস্থ শুনলাম। তাই দেখতে এলাম। কুশলাদি করেই চলে যাবো।
-যাবে কেনো? বসো বসো। খেয়ে দেয়ে যেও! তা তোমার ছেলে মেয়ে কজন?
হাশিম শরীফ ঠোঁট চওড়া করে বললেন,
-আল্লাহ্র রহমতে এক মেয়ে।
-শুধু এক মেয়ে?
-জি আলহামদুলিল্লাহ, একজনই!
হাশিম শরীফের কথায় মতিউর রহমানের মন প্রফুল্লিত হলো। ভদ্রলোক অতিশয় ভদ্র। আল্লাহ্ ভীরু। মেয়েটাও নিশ্চিত এমন হবে। রোশন আরা মতিউর রহমানের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,
-চাচার শরীর এখন কেমন?
-ভালো। এখন ভালোই। এই মেয়ে তোমাদের। না?
হাশিম শরীফ আর রোশন আরা দুজনেই মাথা নাড়লেন। মতিউর রহমান মাথা দুলিয়ে বললেন,
-নাম কি?
-মেহজাবিন জাহান মিশ্মি।
মতিউর রহমান হাতের ইশারায় মিশ্মিকে কাছে ডাকলেন। সে এগিয়ে এসে খাটের কোনায় দাঁড়ালো। মতিউর রহমান গলা কেশে বললেন,
-কিসে পড়ো?
-অনার্স সেকেন্ড ইয়ার।
-ওহ।
মিশ্মি নিজ থেকেই বললো,
-আপনি বিশ্রাম করুন দাদু। আমরা বরং বাইরে বসি!
হাশিম শরীফ মাথা নেড়ে সায় জানালেন। মুহিব রহমান তাদের নিয়ে বাইরে এলেন। আমিনা মতিউর রহমানকে খাটে শুইয়ে কাঁথা গায়ে জড়িয়ে দিতেই তিনি ফিসফিস করে বললেন,
-এই সেই মেয়ে? তোমার ভাতিজা যাকে চিঠি দিতো?
আমিনা বেগম অপ্রস্তুত ভঙ্গীতে মাথা নাড়লেন। মতিউর রহমান খানিক দম নিয়ে বললেন,
-মেয়ে তো দেখতে শুনতে ভালোই। বেশি ছোটও নয়, না?
আমিনা বেগম এবারও মাথা নাড়লেন। মতিউর রহমান আবারও কিছু জানতে চাইবেন তার আগে আমিনা আটকে দিলেন। বললেন,
-বাবা এখন আপনি ঘুমান। আর কথা না। বাকি কথা কাল সকালে হবে। কোনো দরকার হলে ডাক দিবেন। আমি এখানেই থাকবো।
মতিউর রহমান অনিচ্ছা সত্ত্বেও চোখ বুজলেন।
___________________
জায়নামাজ হাতে উঠে দাঁড়িয়েই ভাইঝি হৃদির হাতের দিকে দৃষ্টি গেলো মায়মুনা জামানের। রাগান্বিত স্বরে বললেন,
-নখে নেইলপলিস কেনো?
হৃদি থতমত খেয়ে যায়। মোবাইল বন্ধ করে হাতের মুঠোয় রেখে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে। মায়মুনা কর্কশ গলায় বলেন,
-হাসার কথা বলি নি আমি। নামাজ পড়িস না কেনো তুই?
হৃদি জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজালো। আমতা আমতা করে বললো,
-আসলে ফুপি, ওই আমার না,,,,,
-অজুহাত দেবে না একদম। নখ পরিষ্কার করে এসে নামাজে বসো। যাও। কালকেও তোমাকে দেখেছি নামাজের সময় মুখে কিসব মাখছো। এসেছো থেকে সারাদিন তো এসবই করতে দেখি। নামাজ পড়তে দেখি না কেনো? পারো না? পড়ো নি কখনো?
-পড়েছি ফুপি। আমি নামাজ পড়তে পারি।
-পারো তবে পড়ো না কেনো?
-সরি।
-সরি আমায় বলছো কেনো? যাও নামাজ পড়ে আল্লাহ্র কাছে মাফ চাও। এখন থেকে রোজ নামাজ পড়বে। এক ওয়াক্তও যেনো বাদ না যায়। আর গায়ের ওড়না এতো ছোট কেনো? বড় ওড়না পরবে এখন থেকে। মনে থাকে যেনো!
হৃদি মাথা দুলালো। মায়মুনা জামান বেরিয়ে যেতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে শোবার ঘরে ঢোকলো। ড্রেসিং টেবিল থেকে নেইল পলিস রিমুভার নিয়ে নখে ঘষলো। ঘুম পাচ্ছে হৃদির। বিদেশে কেউ তাকে নামাজ পড়তে জোর করে নি বলেই সে পড়ে নি। কিন্তু এখানে পড়তে হচ্ছে। ব্যাপারটা মন্দ নয়। তবে মাঝে মাঝে ভীষন বিরক্তের মনে হয়।
সোফায় বসে কোলের উপর ল্যাপটপ রেখে কাজ করছিলো তাহির। মায়মুনা তসবি পড়তে পড়তে ঘরে ঢোকলেন। তাহির চোখ তুলে তাকালো না। মায়মুনা তাহিরের পাশেই বসে পরলেন। এবার কিছুটা নড়েচড়ে উঠলো তাহির। পাশে একপলক তাকিয়েই বললো,
-কিছু বলবে মা?
মায়মুনা তসবি পড়া শেষ করলেন। তারপর কথা পাড়লেন,
-তোমার কাজ কি বেড়ে গেছে?
তাহির মৃদু হাসলো। বললো,
-ডাক্তারদের কাজ সব সময় বেশিই থাকে।
-আজকাল একটু বেশিই করতে দেখছি তাই জিজ্ঞেস করলাম।
তাহির ল্যাপটপ বন্ধ করে টেবিলে রেখে মায়ের দিকে ঘুরে বসলো। শান্ত গলায় বললো,
-কোথায় বেশি? প্রতিদিনের মতোই চেম্বার, হাসপাতাল, প্যাশেন্ট্স। এক্সট্রা কিছু তো না।
মায়মুনা মুখ কালো করে বললেন,
-যদি তাই হয়ে থাকে তবে মাঝরাতে থাকো কোথায় তুমি? তোমার ফিরতে দেরি হচ্ছিলো তাই রেজাকে ফোন দিয়েছিলাম কাল। বললো তুমি তাড়াতাড়িই বেরিয়ে গেছো। অথচ বাড়ি ফিরেছো রাত একটায়। কি করছিলে, কোথায় ছিলে কিছুই তো বললে না।
তাহির জবাব দিলো না। চুল পরিপাটি করে চশমা খোললো। নীল টি শার্টে চশমার কাঁচ মুছে চোখ রগরালো। মায়মুনা জামান অভিমানী গলায় বললেন,
-তুমি কি আমার উপর বিরক্ত তাহির?
তাহির চমকালো। বললো,
-এসব কি বলছো মা? বিরক্ত কেনো হতে যাবো?
-কেনো হবে না? আমি তোমার কাজের সময় বার বার ফোন করি, বাড়ি ফেরার পর তোমার ঘরে এসে বসে থাকি, বার বার একই প্রশ্ন করি। তুমি বিরক্ত হও না?
-না। আমার ভালো লাগে।
-কি ভালো লাগে?
-তোমার কল দেয়া, কথা বলা, প্রশ্ন করা। সবই ভালো লাগে।
-তুমি আবার মিথ্যে বলছো?
তাহির ধীর স্থীর গলায় বলে,
-আমি মিথ্যে বলছি না মা।
মায়মুনা জামান তাহিরের কথা না শুনেই বলে উঠেন,
-তুমি তোমার বাবার মতো হয়ে যাচ্ছো। মিথ্যেবাদী।
তাহির কন্ঠ স্বাভাবিক রেখে প্রশ্ন করে,
-বাবা মিথ্যেবাদী ছিলেন?
-হ্যা। তোমার বাবা ঘন ঘন মিথ্যে বলতেন। যে প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানাতে চাইতেন না সে প্রশ্নের জবাবে মিথ্যে বলতেন। কখনো আবার সত্য আড়াল করতে মিথ্যে বলতেন।
-তোমার কি মনে হয় আমি বাবার মতোই মিথ্যে বলি?
মায়মুনা ফিচেল গলায় বললেন,
-তোমার বাবার মিথ্যে কথা বলার পেছনের কারন আমি ধরতে পারতাম না। আর তোমার বলা মিথ্যে কথাটাই আমি বুঝতে পারি না। সব কেমন অগোছালো হয়ে যায়। আচ্ছা, তুমি কি তোমার বাবাকে পেয়েছো?
তাহির দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলে,
-তুমি মানা করেছিলে খুঁজতে।
-খুঁজো নি তার মানে।
-খুঁজবো?
মায়মুনার ভেতরটা কেঁপে উঠে। চেহারায় স্বাভাবিকতা প্রস্ফুটিত করে বলেন,
-খুঁজে কি হবে? না তোমার বাবা ফিরবে আর না তুমি ফেরাতে পারবে। যে চলে যাওয়ার ছিলো চলে গেছে। শুধু শুধু তার সাথে জড়িয়ে গিয়ে ভবিষ্যত ধ্বংস হবে। বাদ দাও।
কথা বলতে বলতেই উঠে দাঁড়ালেন মায়মুনা। দরজার কাছে গিয়েও ফিরে তাকালেন তিনি। গম্ভীর গলায় বললেন,
-মৃত্তিকার সাথে যোগাযোগ আছে তোমার?
তাহির যেনো হোঁচট খেলো। টেবিল থেকে চশমাটা উঠিয়ে নাকে বসিয়ে চোখের দিকে ঠেলে দিয়ে বললো,
-কে মৃত্তিকা? চিনলাম না!
তারপর ল্যাপটপ কোলে তোলে নিয়ে ব্যস্ততা দেখিয়ে কাজে লেগে পরলো। মায়মুনা কাঠ কাঠ গলায় বললেন,
-মিতাকে মনে আছে? তার মেয়ে। তোমার তো চেনার কথা!
তাহির প্রত্যুত্তর করলো না। কাঁপা কাঁপা হাতেই কি বোর্ড চাপতে লাগলো। মায়মুনা কিছুক্ষন সময় নিয়ে ছেলেকে দেখলেন। বুক ভরে নিশ্বাস টেনে বেরিয়ে গেলেন তারপর। তাহির এখনো কাজে ব্যস্ত। মায়ের প্রশ্নের বান থেকে বাঁচতে কাজই সম্বল তার।
চলবে,,,,,,,,