হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
৩৪.
মোজাম্মেল সাহেব বসার ঘরের বড় সোফার মাঝখানটায় বসে আছেন। পরনে বিদেশী পোশাক নয় বরং সাদা পাজামা পাঞ্জাবী। ভদ্রলোকের মাথার অর্ধেক টাক। মুখে দাড়ি গোঁফ নেই। শ্যামা চেহারায় সব সময়ের মতো লম্বা হাসি। যেনো তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে খুশি মানব! ওনার চেহারা আর হাস্যোজ্জ্বল গলা শুনে প্রথম দফাতেই রসিক মানুষ বলে বোধ করা যায়। যা তিনি সেই ছোটবেলা থেকেই। গম্ভীর পরিবশেকেও এক লহমায় শান্ত, শীতল করে দেয়ার ক্ষমতা ওনার আছে। যা এই মুহুর্তে হিমির মামার বাড়িতে বিরাজমান। দেশে ফিরে এক ঘন্টা মতো বিশ্রাম নিয়েই বেরিয়ে পরেছেন পরিবার নিয়ে। একমাত্র ভাতিজার বিয়ে বলে কথা! উঠে পরে না লাগলে হয়? ওনার এই যুক্তি কেউ মানুক চাই না মানুক তাতে ওনার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। বেশ স্বাভাবিক ভাবে হেসে হেসে হিমির মামুদের সাথে কথা বলছেন। মাঝখানে নেই কোনো সংকোচ।
অনাহিতা নাহার স্বামী হানিফ শরীফের কথা মেনে নিয়ে রোশন আরার সাথে মিশ্মি সম্পর্কিত কোনো কথা বলেন নি। তিনি ভেবেছিলেন, আর যাই হোক রোশন আরা কিছুতেই এই বিয়েতে মত দেবেন না। কিন্তু ওনাকে অবাক করে দিয়ে রোশন আরা পরিবার আর নিজেদের সম্মানের কথা ভেবে মেয়ের প্রেমের সম্পর্ককে বিয়ে অব্দি নিয়ে যাচ্ছেন। এসব না তিনি মানতে পারছেন আর না থামাতে পারছেন। ভেতর ভেতর ফুঁসছেন শুধু।
লাল কালোর সংমিশ্রণে সালোয়ার কামিজ পরে মাথায় ওড়না টেনে পুতুলের মতো বসে আছে মিশ্মি। ভয়ে, অভিমানে আড়ষ্ট হয়ে আছে সে। বাম হাতের চুড়িগুলো ডান হাতের নখ দিয়ে খুটছে। চোখের দৃষ্টি অস্থির তার। নিহান এসে থেকেই গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষন করছে মিশ্মিকে। এতক্ষনে নিশ্চিত তার মুখস্ত হয়ে গেছে মিশ্মির চোখের পাতা মিনিটে কয়বার পরেছে, কপালের ভাজ কতোটা প্রশস্ত, গোলাপি লিপস্টিকে রাঙা ঠোঁটের মাঝ বরাবর থাকা তিল, কানের পাশে উড়তে থাকা অবাধ্য চুল, নাকের পরিধিসহ আরো বহুবিধ ফ্যাক্ট! মোজাম্মেল সাহেব ভাতিজাকে লক্ষ করে আড়চোখে তার দৃষ্টি অনুসরণ করলেন। বাঁকা হেসে গলা খাকরি দিয়ে বললেন,
“নিহু কিছু বলবি?”
নিহান হকচকালো। আমতা আমতা করে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করলো। বললো,
“কি বলবো জ্যাঠুমনি?”
“কি বলবি সেটা তো তুই জানিস? কখন থেকে দেখছি মেহজাবিনকে দেখছিস! কিছু বলার থাকলে বল।”
নিহান বিষম খেলো। আমিনা বেগম বিরক্তি নিয়ে স্বামীকে খোঁচা দিলেন। ফিসফিস করে বললেন,
“বিয়ের তারিখ ঠিক করতে এসেছি আমরা। কিসব কথায় ঘুরপাক খাচ্ছো তুমি?”
“আমি কোথায় ঘুরপাক খেলাম? নিহুর চোখই তো মেহজাবিনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। ওকেও কিছু বলো।”
কথাটা বেশ চাপা গলাতেই বললেন মোজাম্মেল রহমান। তবুও নেহাল রহমানের কানে গেলো। তিনি কটমট করে তাকালেন ছেলের দিকে। বাবার চাহনি দেখেই চুপসে গেলো নিহান। হাত পা গুটিয়ে নিষ্পাপ বাচ্চার মতো মাথা নত করে বসলো। নেহাল রহমান হালকা হেসে বললেন,
“কারো যদি আপত্তি না থাকে তবে তারিখটা,,,,?”
রোশন আরা মাথা দুলিয়ে স্বামীকে ইশারা দিলেন। হাশিম শরীফ খুশি খুশি গলায় বললেন,
“হ্যা হ্যা। আমাদের কারো আপত্তি নেই। আল্লাহ্ যার জোর যেখানে রেখেছেন! ভাইসাব?”
হানিফ শরীফ চা খাওয়ায় মগ্ন ছিলেন। ছোট ভাইয়ের কথায় চোখ তোলে সন্দিহান চোখে তাকালেন। হাশিম শরীফ ঠোঁট নেড়ে কিছু বোঝাতেই হানিফ শরীফ ঝটপট মেরুদন্ড সোজা করে বসলেন। হাতের কাপ নিচে নামিয়ে এমন ভাব করলেন যেনো, ভুলে যাওয়া কোনো কথা হুট করে মনে পরেছে। তারপর সময় নিয়ে বললেন,
“চাচা এলে ভালো হতো। উনি সবার গুরুজন। ওনার মত জানা অতি আবশ্যক!”
মোজাম্মেল সাহেব আশ্বস্ত গলায় বললেন,
“অসুস্থ না হলে বাবা আসতেন। আর আমরা যে এখানে এসেছি সেটাও বাবার মত নিয়ে। উনিই বলেছেন যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে হোক। আপনারা চিন্তা করবেন না। যে তারিখে আপনাদের সুবিধা বলুন। আমরা এক পায়ে খাড়া!”
আমিনা স্বামীর কথা শেষ হতেই বললেন,
“ছেলে মেয়ের বাবা মাও বলুক তাদের ইচ্ছে।”
নেহাল রহমান ইতস্তত গলায় বললেন,
“বাবার কথাই শেষ কথা আমাদের জন্য। রাদিবারও অমত নেই। বেয়াই বেয়ানদের কথা শুনি!”
“আমাদেরও অমত নেই।”
রোশন আরার কথা শুনে বিরক্তির শীষ বাজালেন মোজাম্মেল রহমান। বললেন,
“অমত নেই জেনেই এতোদূর আসা আমাদের। সেই কখন থেকেই অমত নেই অমত নেই শুনছি। এবার সিদ্ধান্ত নিন। নয়তো কারো মতের পরোয়া না করেই মেয়েকে ঘরে তুলছি আমরা। নিহু আর মেহজাবিন দুজনেই ভালো পোশাকে আছে। কাবিন করিয়ে দেই চলো তো। তোমাদের বাপ মায়েদের মত বিনিময় শেষ হলে পরে অনুষ্ঠান হবে। চলো!”
দু পরিবারের সদস্যরা হেসে ফেললেন এতে। মিশ্মি ভড়কে যাওয়া চোখ দুটোয় রাজ্যের জল জমা হয়েছে। নিহান চমকে উঠলো। তবে তার কথাটা মন্দ লাগে নি। বেশ ভালোই লেগেছে।
___________________
বাসন্তী রঙের শাড়ি গায়ে খোঁপায় বকুল ফুলের মালা জড়িয়েছে সোহিনী। দোহাকে বসিয়ে রাখা স্টেজে কেক নিয়ে উঠলো সে। টেবিলে কেক রেখে দোহার শাড়ির কুচি ঠিক করে দিয়ে দোহার পাশে বসলো। দোহার চোখ দুটো অসম্ভব লাল হয়ে আছে। সোহিনী এক হাতে পাশ থেকে দোহাকে জড়িয়ে ধরে ক্যামেরার দিকে তাকালো। ক্ষীণ গলায় বললো,
“হিমি আসতে পারবে না।”
দোহার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। ঝটপট ঘাড় ঘুরিয়ে সোহিনীর দিকে তাকালো। সোহিনী হাতের টিস্যু দিয়ে দোহার ঘেটে যাওয়া কাজল মুছে দিলো। দোহা মুখ ফুলিয়ে বললো,
“ও আমার উপর রেগে আছে?”
“আহা,,, তা কেনো হতে যাবে?”
“তাহলে এলো না কেনো?”
“জ্যাঠুমনি দেশে ফিরেছেন।”
“কার জ্যাঠুমনি?”
“গাধী। হিমির জ্যাঠুমনি। আজ আবার নিহান আর মিশ্মির বিয়ের পাকা কথা বলতে গেছেন। বেচারি আসতে চেয়েছিলো কিন্তু পারে নি। কাল আসবে বলেছে। ইন ফ্যাক্ট আমাদের সবার আগেই চলে আসবে।”
দোহা ঠোঁট উল্টালো। সোহিনী চোখ রাঙিয়ে বললো,
“ন্যাকামো করবি না একদম। হলুদের ফাংকশন এতো ইম্পোর্টেন্ট নয়, বিয়েটা ইম্পোর্টেন্ট। চুপ চাপ বসে থাক। আজ তোর দিন জানু, জি লে!”
দোহা শুকনো হেসে ঘন নিঃশ্বাস টানলো। সোহিনী দোহার শাড়ি মেক আপ ঠিক করে দিয়ে নিচে নামলো। গলার কাঠের গহনা নাড়তে নাড়তে অন্যমনস্ক চোখে এদিক ওদিক তাকালো। চোখে পরলো তার থেকেই কয়েক হাত দূরে দাঁড়ানো সুন্দর দেখতে ছেলেটাকে। বাসন্তী রঙের পাঞ্জাবী গায়ে অন্যদিনের তুলনায় অধিক সুদর্শন লাগছে তাকে। চুলগুলো খাড়া করে রেখেছে। অযত্নে বেড়ে উঠা দাঁড়িতে পুরুষালি ভাব ভঙ্গী বেশ মানিয়েছে। ছেলেটার হাতের পশম গুলোও অভিনব লাগছে সোহিনীর কাছে। হঠাৎ ছেলেটা ফিরে তাকালো। সোহিনীর সাথে চোখাচোখি হলো। সোহিনী চমকে উঠলেও চোখ ফেরালো না। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো অসম্ভব সুন্দর ছেলেটির দিকে। ছেলেটা তীক্ষ্ণ নজরে দেখলো সোহিনীকে। পা থেকে মাথা অব্দি চোখ বুলিয়ে অন্যদিকে ফিরে আড্ডায় মনোযোগী হলো। সোহিনীর হঠাৎই মনে হলো সে হ্যাংলা হয়ে যাচ্ছে। যা তার নয় তার দিকে তাকানো উচিত নয়। লোভ হয়। লোভ করা ভালোও নয়। সোহিনীর ক্ষেত্রে তো কখনোই নয়!
চলবে,,,,,,,,,,