হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
৩৭.
সন্ধ্যের দিকে ক্লান্ত শরীরে ঘরে ঢোকে হিমি। কাপড় না পাল্টেই খাটে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পরে। হিমিকে বাড়ি ফিরতে দেখে চা রেখেই উঠে দাঁড়ান মোজাম্মেল সাহেব। ধীর পায়ে এগিয়ে হিমির ঘরে ঢোকে হালকা কাশেন তিনি। আওয়াজ পেয়ে ঘাড় কাত করে তাকায় হিমি। ঠোঁটে লম্বা হাসি ঝুলিয়ে উঠে বসে। ইশারায় মোজাম্মেল সাহেবকে খাটে বসতে বলে। তিনি এগিয়ে আসেন। খাটে বসে মৃদু হেসে বলেন,
-সারাদিন কোথায় ছিলি? ঘুম থেকে উঠে দেখাই পেলাম না তোর।
হিমি মিষ্টি করে হেসে বললো,
-দোহার বিয়ে ছিলো আজকে। সেখানেই ছিলাম।
মোজাম্মেল সাহেব কপাল কুঁচকে বললেন,
-বিয়ে কি এখন শেষ হলো? এতো দেরি করে ফিরলি!
হিমি জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো,
-হ্যা।
মোজাম্মেল সাহেব মাথা দুলিয়ে বললেন,
-ক্লান্ত লাগছে তোকে। ফ্রেশ হয়ে জামা কাপড় বদলে খেয়ে নে কিছু। তারপর কথা বলবো।
-দরকারি কথা থাকলে এখনি বলতে পারো।
মোজাম্মেল সাহেব ইতস্তত করে বললেন,
-উকিল সাহেব এসেছিলেন আজ।
-কিসের উকিল? কেনোই বা এসেছিলেন?
-কিসের উকিল নয়, ওনার নাম উকিল। উকিল মোস্তফা।
হিমি মুখ কাঁচুমাচু করে বললো,
-উকিল কারো নাম হয়?
-হয়। এই যে এই লোকের নাম উকিল। তবে উকিল সাহেব ওকালতি করেন না।
-তাহলে কি করেন?
-ঘটকালি করেন।
-ঘটকালি? মানে পাত্র পাত্রী খোঁজে বিয়ে করানো। তাই তো?
-হ্যা। জানিস, এই লোকটাই তোর বড়মা আর আমার বিয়ে করিয়েছে। তোর ছোটমা আর চাচামনির বিয়ের পেছনেও এই লোক ছিলো। শুধু তোর বাবার বিয়ে করাতে পারে নি। যতো মেয়ের ছবিই দেখিয়েছে তোর বাপ বলে উঠেছে, ‘আমি হাসিকেই বিয়ে করবো’!
হিমি খিলখিল করে হাসলো। হাসি থামিয়ে বললো,
-কিন্তু এখন ওনার কি কাজ? নিহানের বিয়ে তো ঠিক হয়েই গেছে। নতুন করে পাত্রী দেখতে হবে কেনো?
মোজাম্মেল সাহেব আদুরে গলায় বললেন,
-নিহানের জন্য তো নয় মা, তোর জন্য।
হিমি তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়ালো। কাঠ কাঠ গলায় বললো,
-আমার জন্য মানে?
-তোর বিয়ের জন্য পাত্র খোঁজা হচ্ছে। বিয়ে তো করতে হবে বল!
-আশ্চর্য! কে খোঁজতে বলেছে ওনাকে?
-তোর দাদু। বাবার মনে হচ্ছে বেশি দিন আর শ্বাস প্রশ্বাস চলবে না ওনার। তাই যাওয়ার আগে সবার গোছানো জীবন, সংসার দেখতে চান। নিহানের বউ দেখা হলো এবার তোর বর দেখার পালা।
হিমি রাগান্বিত গলায় বললো,
-সেই কবে থেকেই তো তোমার বাবার মনে হচ্ছে উনি চলে যাবেন। এখনো তো দিব্যি বেঁচে আছেন। আর এই উছিলায় একের পর এক ব্লেকমেইল করে যাচ্ছেন।
মোজাম্মেল সাহেব কপাল কুঁচকে বললেন,
-হিমি?
হিমি জিব কাটলো। ছেলের সামনে বাবার মৃত্যু বিষয়ক কথা বলা মোটেও উচিত না। বাবা যতোই বলুক অন্য কেউ বললে ছেলের রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক। হিমি জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো,
-সরি।
তারপর মোজাম্মেল সাহেবের পাশে বসে অভিমানী গলায় বললো,
-কিন্তু দাদু কি এটা ঠিক করছে বলো? যখন তখন যা তা করতে নির্দেশ করছে। না করতে চাইলেই ‘আমি তো মরেই যাবো’ এই ধরনের ইমোশনাল কথা বলে তার কথা মানতে বাধ্য করছে। বাড়ির সবাই মাথা দুলিয়ে ওনার কথায় উঠবসও করছে। তবে আমি করবো না। কিছুতেই না।
-সেটা বললে তো হবে না। অলরেডি ঘটককে তোর ছবি আর বায়োড্যাটা দেয়া হয়েছে। আমার ধারনা ভুল না হলে কালকের মধ্যে এক গাদা সিভি নিয়ে হাজির হবে।
-তুমি ওই ঘটক ফটককে কল করে বলে দাও আসার দরকার নেই। আমি বিয়ে করছি না।
-কেনো করছিস না?
-করতে চাই না তাই করছি না। ব্যস!
মোজাম্মেল সাহেব হাসি হাসি মুখে বললেন,
-জানিস তো, অধিকাংশ মেয়েই বিয়ে করতে চায় না। কিন্তু তারা বিয়ে করে। তুইও করবি। যখন করবিই তখন মানা করে লাভ নেই। তবে বিয়ে করলে তোর লাভ আছে।
-কি লাভ?
সন্দিহান গলায় প্রশ্ন করলো হিমি। মোজাম্মেল সাহেব বললেন,
-এখন যেমন দু বাড়িতে থাকতে তোর হিমশিম খেতে হয় বিয়ের পর হবে না। কারন বিয়ের পর তুই তোর শ্বশুরবাড়ি থাকবি। তোর নিজের ঘর, নিজের বাড়ি, নিজের সংসার। সব কিছু তোর। কারো থেকে কোনো পারমিশন নিতে হবে না তোকে। ভয়ও পেতে হবে না। এবাড়ি ওবাড়ি দৌড়তে হবে না। আর কোনো কাজে রেস্ট্রিকশনও থাকবে না।
কয়েক সেকেন্ড থেমে তিনি আবার বললেন,
-আমি ভাবছি তোকে আমরা পাত্রী দেখাবো না বরং তোর জন্য পাত্র দেখবো।
হিমি মুখ বাকিয়ে বললো,
-কি যা তা কথা বলছো! বুঝতেই পারছি না।
-শোন, প্রত্যেক মেয়েকেই ছেলের বাড়ির লোকেরা দেখতে আসে। তারপর পছন্দ করে। এবার হবে উল্টো। সম্পূর্ণ বিপরীত। মানে, আমরা যাবো পাত্র দেখতে। তুই সোফায় আরাম করে বসবি। আমরা কথা বার্তা বলবো। কিছুক্ষনের মধ্যে পাত্র আসবে। মাথা নুইয়ে বসে থাকবে। আমরা যার যার মতো প্রশ্ন করবো। তোর কিছু জানার থাকলে তুইও জিজ্ঞেস করবি। তারপর ছেলে পছন্দ হলে বিয়ে হবে নয়তো আরো ছেলে দেখবো। ব্যাপারটা কেমন হবে?
হিমি অবাক হয়ে সবটাই ইমাজিন করলো। উচ্ছল হেসে বললো,
-দারুণ বললে তো!
-তবে! এবার আরো একটা কথা জানার আছে।
হিমি ভ্রু নাচালো। মোজাম্মেল সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন,
-তোর কেমন ছেলে পছন্দ? না মানে, পাত্র দেখার আগে তো ঘটককে জানাতে হবে কেমন ছেলেকে বিয়ে করবি তুই। বল দেখি।
হিমি মাথা দুলালো। যেনো মোজাম্মেল সাহেব শতভাগ সত্যি বলেছেন। কিছুক্ষন ভাবার পর হিমি মুখ ফুলিয়ে বললো,
-বুঝতে পারছি না। কখনো সেভাবে ভাবি নি তো!
মোজাম্মেল সাহেব কৌতুহল চোখে তাকিয়ে বললেন,
-মনের ডাক্তার দেখতে কেমন?
-ভালোই।
-ডিটেইলসে বল। এই যেমন ধর, গায়ের রঙ, চোখ, চুল, উচ্চতা, ব্যবহার। এইসব!
-গায়ের রঙ তোমার মতোই। চো,,,,,খ! (মনে করার চেষ্টা করে বললো)চশমা পরা থাকেন, খেয়াল করি নি কখনো। মাথা ভর্তি পাতলা চুল, চাপ দাঁড়ি, লম্বা আনুমানিক ছয় ফুট, ব্যবহার ভালো। তবে রহস্যময়। কেনো বলোতো?
মোজাম্মেল সাহেব মনে মনে কিছু একটা ভেবে বললেন,
-ফ্রেশ হতে যাবি তো।
হিমি ভ্রু কুঁচকে একপলক তাকালো জ্যাঠুমনির দিকে। তারপর মাথা নেড়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ঢোকলো। মোজাম্মেল সাহেব গাঢ় শ্বাস টেনে ঘরের বাইরে বেরুলেন। বড় বড় পা ফেলে মুহিব রহমানের ঘরে উকি দিলেন। গলা খাকরি দিতেই বুক শেল্ফে বই রেখে ঘুরে দাঁড়ালেন মুহিব রহমান। চেহারা খুশি খুশি রেখে বললেন,
-ভিতরে আসো বড় ভাই।
মোজাম্মেল সাহেব ঘরে ঢোকলেন। মুহিব রহমান চেয়ার এগিয়ে দিলেও তাতে বসলেন না তিনি। থমথমে গলায় বললেন,
-হিমির সাথে কথা হয়েছে আমার। তবে বাবা হিসেবে তোরও কিছু কর্তব্য রয়েছে। এতো গুলো বছর পালন করিস না বলে আজও এড়িয়ে যাবি তা তো হয় না। আশা করছি কি বলতে চাইছি বুঝেছিস।
মুহিব রহমান শান্ত গলায় বললেন,
-কিন্তু বাবার কথার অমান্য করা হল,,,,,,,,
-তুই নিজের ভালোবাসার কথা ভেবে বাবার কথা অমান্য করেছিস। মেয়ের কথা ভেবে করতে পারবি না তা আমি বিশ্বাস করি না। আর তাছাড়া হিমির কথা উঠলে আমিও বাবার অবাধ্য হতে পারি। সেটা অবশ্য তুই জানিস। তবে আমি চাই এবার তুই হিমিকে বোঝ।
-দীর্ঘ বাইশ বছর যে সম্পর্কের সুতো ঠিক করতে পারি নি তা দু একদিনে পারবো বলে মনে হয় না।
-দু একদিনে পারতে হবে বলি নি। শুধু বলেছি পারতে হবে। সময় লাগবে, লাগুক। চেষ্টা করতে থাক।
কথা শেষ করে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে গিয়েও পেছন ফিরলেন মোজাম্মেল সাহেব। শক্ত গলায় বললেন,
-সকালে অন্তত বাবার সাথে এই বিষয়ে কথা বলিস। আমি চাই না হিমির উপর কোনো জোরাজোরি হোক।
-তুমি ওকে সবটা বলো নি?
-না। আমার মনে হয় নি ওকে এই বিষয়ে জানাতে হবে। যতটুকু জানানোর প্রয়োজন ছিলো জানিয়েছি। আর জানতে হবে না হিমির। বাড়ির কেউই হিমিকে কিছু বলবে না। আমি মানা করেছি।
মুহিব রহমান চমকে উঠা গলায় বললেন,
-বড় ভাই হিমি যখন পরে কথাটা জানবে তখন?
-জানবে না। ও যখন জানবে তখন পরিস্থিতি অন্যরকম হবে। শি উইল বি ওকে বাই দ্যান!
-কি করে?
-তোরা বাপ মেয়ে একরকম! খালি প্রশ্ন করিস। যখন হবে তখন তো দেখতেই পাবি। এখন শান্ত হো, আর বাবাকে কি বলবি সেসব প্র্যাকটিস কর। বাবার সামনে গেলে কথা না বন্ধ হয়ে যায়!
চলবে,,,,,,,,