হিমি পর্ব-৩৬

0
770

হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার

৩৬.

-ফোন এসেছিলো।

-কার ফোন?

-বাচ্চা ডাক্তারের।

-তোমার কথা আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে জ্যাঠুমনি।

মোজাম্মেল সাহেব হিমির ফোনটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,

-তোর ফোনে একটু আগে ‘বাচ্চা ডাক্তার’ লিখা একটা নাম্বার থেকে কল এসেছিলো। আমি ধরলাম। হ্যালো বলার আগেই একজন বললো, দেখা করবেন? আমি বললাম, কার সাথে দেখা করবো? ছেলেটা ভড়কে গেলো মনে হলো। জিজ্ঞেস করলো আমি কে? আমি বললাম, আমি মোজাম্মেল রহমান। তুমি কে? ছেলেটা ফট করে ফোন কেটে দিলো। আমার প্রশ্নের জবাব দিলো না। কে এই ছেলে?

হিমি মোবাইল অন করে কল লিস্টে ঢোকলো। তাহিরের কল এসেছে তিন মিনিট আগে। মোজাম্মেল সাহেব তাড়া দিয়ে বললেন,

-বলবি তো!

-একজন ডাক্তার।

-হ্যা সে তো আমি নাম দেখেই বুঝেছি। কিন্তু কথা হচ্ছে কিসের ডাক্তার? তোকে কেনো ফোন করছে? আর তোর ফোনে এই ডাক্তারের নাম্বার ‘বাচ্চা ডাক্তার’ নামে সেইভ করা কেনো? গলার আওয়াজ শোনে মোটেও বাচ্চা মনে হয় নি। তার উপর ডাক্তার মানুষ। ঘটনা কি?

হিমি মাথা ঝেড়ে খাটে এসে বসলো। মাথা চুলকে বললো,

-ঘটনা কিছুই না।

-কিছু তো অবশ্য‌ই। ঠিক ঠিক বল। কিসের ডাক্তার?

হিমি অলস গলায় বললো,

-সাইকিয়াট্রীস্ট। চাইল্ড স্পেশালিস্ট বলে আমি ওনাকে ওই নামে ডাকি। আর কিছু না।

-সাইকিয়াট্রীস্ট! মানে পাগলের ডাক্তার?

-উহু, মনের ডাক্তার।

-ওই এক‌ই কথা।

কয়েক সেকেন্ড থেমে হিমির দিকে কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে বললেন,

-তুই কি ওই ডাক্তারের থেকে ট্রীটমেন্ট নিচ্ছিস?

-কেনো বলোতো?

-ডাক্তারদের সঙ্গে সাধারনত তোর আত্মীয়তা থাকার কথা না। বন্ধুত্ব‌ও হতে পারে বলে মনে হয় না। তাহলে ডাক্তারের সাথে ঘনিষ্ঠতা কেনো? নিশ্চয় ট্রীটমেন্ট নিচ্ছিস! তবে লোকটা তো বাচ্চাদের ডাক্তার। তুই তো বাচ্চা নস। কৈশোর কাল‌ও পেরিয়ে গেছিস। তবুও ওই ডাক্তার তোকে ট্রীটমেন্ট দিচ্ছে!

-আমি তো ট্রীটমেন্ট নিচ্ছি না জ্যাঠুমনি। এমনি দেখা করছি, কথা বলছি।

মোজাম্মেল সাহেব থমথমে গলায় বললেন,

-কারন ছাড়া দেখা করছিস, কথা বলছিস?

-কারন ছাড়া নয়। কিছু না কিছু কারনেই দেখা করছি। কখনো ওনার দরকার কখনো বা আমার। আজ ওনার দরকার পরেছে। কাল হয়তো আমার দরকার পরবে।

-বাঃ বেশ ভালো কথা। তা আজ তার কি দরকার পরলো?

-জানতে হলে ওনার সাথে দেখা করতে হবে। আমার আজ বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে না। তাই যাবো না। যখন দেখা হবে তখন জানবো, ওনার কি দরকার ছিলো।

-তোর এখন জানতে ইচ্ছে করছে না?

-করছে।

-তাহলে ফোন করে জেনে নে। আমিও শুনি এতো রাতে কি দরকার পরলো!

-সম্ভব না।

-কেনো?

-কারন উনি ফোনে সব কথা বলেন না। কয়েক লাইনই বার বার রিপিট করেন।

-কি রিপিট করে?

-“আসতে পারবেন? ‌দরকার ছিলো। পরে বলবো।আসছেন তো? আসবেন না? আসুন তবে! কখন আসছেন? আগের জায়গাতেই।” এগুলোই।

মোজাম্মেল সাহেব ভয়ার্ত চোখে তাকালেন। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললেন,

-এমনটা কি রোজ বলে?

-না। মাঝে মাঝে বলেন।

-তুই দেখা করতে যাস?

-কাজ না থাকলে যাই। নয়তো অন্যদিন দেখা করি।

-দেখা করে কি কথা বলে?

-ব্যক্তিগত কিছু কথা। সেসব তোমায় বলা যাবে না।

মোজাম্মেল সাহেব এবার বিস্ফোরিত চোখে তাকালেন। হিমি তাতে পাত্তা দিলো না। খাটে বসে স্যান্ডেল খোলে রেখে পা উপরে তুললো। মোজাম্মেল সাহেব নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বললেন,

-মনের ডাক্তার তোর সাথে ব্যক্তিগত কথা বলে?

হিমি মাথা নেড়ে জবাব দিলোস

-হ্যা বলে।

-তুই বলিস?

-কখনো কখনো বলি।

-তোর সাথে কি তার কোনো সম্পর্ক আছে হিমি?

-হ্যা। দরকারের সম্পর্ক। বললাম না, দরকার ছাড়া দেখা সাক্ষাত হয় না আমাদের।

-দরকারের সম্পর্ক বলে কিছু হয়?

-হয়। পৃথিবীতে সবথেকে বেশি যদি কোনো সম্পর্ক থেকে থাকে তবে তা হলো দরকারের সম্পর্ক। জটিল ভাষায় স্বার্থের সম্পর্ক। অধিকাংশ মানুষ‌ই নিজ স্বার্থের কথা ভেবে সম্পর্ক গড়ে। আমাদের বেলাতেও তাই। স্বার্থ তথা দরকার। দরকার ফুরিয়ে গেলেই সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে।

মোজাম্মেল সাহেব শান্ত দৃষ্টিতে তাকালেন। হিমি উষ্কখুষ্ক চুল হাতিয়ে বললো,

-ছোট মা ভীষন রেগে আছে। চায়ের কথা বলার সাহস পাই নি। তুমি বলো। দিয়ে দেবে। আমার জন্য এনো না, খেতে ইচ্ছে করছে না। ঘুম পাচ্ছে। রাতের খাবারের সময় হ‌ওয়ার আগেই এক ঘুম দিয়ে উঠি। কি বলো?

মোজাম্মেল সাহেব মাথা দুলিয়ে ঘর থেকে প্রস্থান করলেন। হিমি ফোন হাতে নিয়ে আছে এখনো। বুঝতে পারছে না তাহিরকে কল করবে কি করবে না! দেখা করতে যাচ্ছে না, জানিয়ে দিবে? তাহির কি হিমির ফোনের অপেক্ষা করছে? নাও করতে পারে। হয়তো এখন তাহির রাউন্ডে আছে। একটু পর বাড়ি চলে যাবে। কি দরকার কল করে বিরক্ত করা? কাল সকালে এক দেখা দিয়ে আসবে তাহিরকে। চেম্বারে হুট করে ঢোকে সারপ্রাইজ দিবে। সারপ্রাইজ শব্দটা ভাবতেই হিমির মনে হলো জ্যাঠুমনি আজ দেশে ফিরে সবাইকে অনেক জিনিস দিলো। তাকে তো দিলো না। কেনো দিলো না? জ্যাঠুমনি কি হিমির পছন্দ অপছন্দ জানে না? না কি ইচ্ছে করেই আনে নি? হিমির নামটা নিশ্চয় জ্যাঠুমনির প্রিয় মানুষদের তালিকা থেকে বাদ পরে নি। তবে কেনো কিছু আনলো না জ্যাঠুমনি। ঘাপলা আছে কিছু।

……………………………

মানুষের সমাগমে ভীষন ভীড় হয়ে গেছে। চারদিকে হৈ হৈ আওয়াজ। জমকালো আসর। হিমি সেন্টারের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে। মাঝখানে জটলা হয়ে আছে। কোনদিকে ব‌উ বসে আছে সেটা সে জানে না। বিয়ে হয়ে গেছে কিনা সেটাও অজানা তার। পুরুষ মহলে খাওয়া দাওয়ার পর্ব চলছে। বন্ধুদের দেখা পাওয়াও দুষ্কর ঠেকছে হিমির কাছে। তাড়াহুড়ায় মোবাইল আনতে ভুলে যাওয়ায় এই মুহুর্তে কারো সাথে যোগাযোগ‌ও করতে পারছে না। ব্যাপক অস্বস্তিতে পরে গেছে সে। এর মধ্যেই আবার কয়েকজন আড় চোখে তো কয়েকজন বিরক্ত চোখে দেখছেন হিমিকে। হিমি মাথা উচিয়ে দূর দূরান্তে চোখ বুলিয়ে ব্যর্থ চেহারায় দাঁড়িয়ে র‌ইলো। মানুষের গিজগিজে এসির ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগছে না। উত্তপ্ত শরীর আরো উত্তপ্ত হয়ে যাচ্ছে। হিমির কপাল থেকে ঘাম গালে গড়াচ্ছে। তীব্র বিরক্ত হয়ে সেন্টার থেকে বেরুতেই সূর্যের মুখোমুখি হলো হিমি। তার দু হাতে অনেকগুলো আইস্ক্রিম। হিমিকে বেরুতে দেখে গোল গোল চোখ করে সূর্য বলে উঠলো,

-তুই কখন এলি? দেখলাম না তো!

হিমি মুখটা হাসি হাসি করে তাকালো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো,

-এক্ষুনি এসেছি।

-তাহলে চলে যাচ্ছিস যে!

-কাউকেই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তাই ভাবলাম দাঁড়িয়ে না থেকে বাড়ি যাওয়াই উত্তম।

সূর্য কপাল কুঁচকে ভেতরে উকি দিলো। গমগমে গলায় বললো,

-আজাইরা কথা। ভেতরে এতো মানুষ আর তুই কাউকে চোখে দেখলি না!

-চোখে দেখি নি বলি নি তো। বলেছি খুঁজে পাই নি। ভেতরে এতো মানুষ বলেই তোদের কাউকে খুঁজে পাই নি। দোহা কোথায় আছে সেটাও জানি না। কেমন অস্বস্তি হচ্ছিলো!

সূর্য গাল ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে বললো,

-আমার হাত থেকে দুটো আইস্ক্রিম নে তো। হাত বরফ হয়ে যাচ্ছে।

-এগুলো কার জন্য?

-কার জন্য আবার! দোহার কাজিনদের জন্য। চল চল আয়। দোহা সেই কখন থেকে তোর কথা বলে বলে অস্থির হচ্ছে। দেখা গেলো তোর দেখা না পেয়ে কেঁদে কেটে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিলো!

হিমি কৌতুহলী গলায় বললো,

-বিয়ে এখনো হয় নি?

-আপাতত বর যাত্রী খাচ্ছে। তাদের খাওয়া শেষ হলেই কাজি সাহেব বিয়ে পড়াবেন। আর দাঁড়ানো যাবে না দোস্ত, আইস্ক্রিম গলে যাচ্ছে। পরে আবার আমার টাকা দিয়ে খাওয়াতে হবে রাক্ষসগুলোকে! চল না!

হিমি মুচকি হেসে সূর্যের হাত থেকে কয়েকটা আইস্ক্রিম নিয়ে তার পেছনে চললো। সূর্য ভেতরে ঢোকে ভীড় ঠেলে উল্টো দিকের লনে চলে এলো। সেখানে জড়ো হয়েছিলো দোহার কাজিনরা। সূর্য এগিয়ে গিয়ে তাদের হাতে আইস্ক্রিম তুলে দিয়ে হিমিকে নিয়ে ডানদিকে চলে গেলো। কয়েক কদম যাওয়ার পর‌ই হিমির চোখে পরলো স্টেজে সিঙ্গেল সোফায় বসে থাকা কনের সাজে দোহাকে। বেগুনি রঙের বেনারসি গায়ে। গা ভর্তি সোনার গহনা। ঠোঁটে হাসির রেখা নেই। হয়তো বিয়েতে খুশির চেয়ে দুঃখটাই বেশি গ্রাস করে! তবে হিমিকে তার দিকে আসতে দেখেই সে চমৎকার এক হাসি দিলো। যেনো এটাই তার প্রাপ্তি। হিমিও হাসলো তার দিকে তাকিয়ে। দোহার চোখে মুখে অন্যরকম এক ঝলক দেখা যাচ্ছে এখন। হিমিকে দেখেই বুঝি? হিমি বুঝে না এই পাঁচটা প্রাণ তাকে এতো ভালোবাসে কেনো। কিসের এতো টান তাদের? কেনো এতো শাসন, আদর, আবদার, মান-অভিমান? তবে তাদের এহেন কাজগুলোয় শান্তি পায় হিমি। ভালো লাগে তার। মনে হয় বন্ধুত্বের চেয়ে সুন্দর এই পৃথিবীতে কিছু নেই। থাকতে পারে না।

চলবে,,,,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here