হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
৫৭.
ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে জ্যাম পাউরুটি চিবোচ্ছে হৃদি। দৃষ্টি মোবাইলের স্ক্রিনে। তাহির সোফায় বসে প্যাশেন্টের ফাইল দেখছে। মাঝে মাঝে চামচে অমলেট তুলে মুখে পুরছে। হিমির খাওয়ায় মনোযোগ নেই। কাল রাতেই খবর পেয়েছে বন্ধুমহলে অঘটন ঘটেছে। ইমন সুপ্তিকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। কারনটা এখনো অজানা তার। যার সাথে ইমনের বিয়ে ঠিক তাকে নিয়ে হঠাৎ পালানোর কি কারন থাকতে পারে বুঝে উঠতে পারছে না হিমি। বন্ধুদের সাথে দেখা করে আসল রহস্যের উন্মোচন করতে হবে। এবং এটা আজই করতে হবে। কিন্তু এ ব্যাপারে কাউকে কিছু বলাও যাচ্ছে না। হাঁসফাঁস করছে সে। হিমির অস্বস্তি চোখ এড়ায় নি মায়মুনার। খাবার খাওয়ার ফাঁকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে হিমির দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘কি সমস্যা? খাচ্ছো না কেনো?’
ভাবনায় ছন্দপতন হওয়ায় চমকালো হিমি। জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে ব্ল্যাক কফিতে চুমুক বসালো। মায়মুনা জামান খেতে খেতে বললেন,
‘হৃদি? মোবাইল বন্ধ করো এখন।’
হৃদি মাথা দুলিয়ে প্লেটের পাশেই মুঠোফোন বন্ধ করে রাখলো। হিমি অপ্রস্তুত গলায় বললো,
‘আজ একবার বন্ধুদের সাথে দেখা করতে যাবো? দরকার ছিলো।’
‘সেদিন না দেখা করলে!’
‘সেদিন তো চলে গেছে। মানে কতোদিন আগে দেখা করেছি।’
‘বিয়ের পর ঘনঘন এতো বন্ধু বন্ধু করলে চলে না। মাসে একবার দেখা করতেই পারো। তা বলে কদিন অন্তর অন্তর?’
চুপসে যাওয়া মুখ নিয়ে আবারও বললো হিমি,
‘আজকে যাই। খুব দরকার না হলে বলতাম না।’
‘কি দরকার?’
ঢোক গিললো হিমি। শাশুড়ি যদি জানেন বন্ধু মেয়ে নিয়ে পালিয়েছে তাহলে আর কখনোই ওদের সাথে সম্পর্ক রাখতে দিবেন না। একথা কিছুতেই বলা যাবে না। হিমি তাই ভেবে চিন্তে বললো,
‘ওই আসলে, আমার এক বন্ধুর বিয়ে সামনে।’
‘ওহহ আচ্ছা। যেও।’
হিমি মুখটা হাসি হাসি করলো। বললো,
‘ওনার সাথে যাই?’
মায়মুনা দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে বললেন,
‘জিজ্ঞেস করে দেখো ওর সময় হবে কি না।’
হিমি মাথা নেড়ে তাহিরের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বললো,
‘বাচ্চা ডা,,,’
সাথে সাথেই গম্ভীর গলায় মায়মুনা বলে উঠলেন,
‘উম,,মানা করেছি না?’
হিমি জিব কামড়ে শুকনো হাসলো। কি বলে ডাকবে ভাবতে ভাবতে হঠাৎই জোরে বলে উঠলো,
‘স্বামী?’
হৃদি পানি খাচ্ছিলো। হিমির ডাক শুনে বিষম খেলো সে। মুখ থেকে ছিটকে পানি বাইরে পরলো। তাহির গোল গোল চোখে পেছন ফিরে তাকালো। মায়মুনা রাগান্বিত গলায় বললেন,
‘হৃদি?’
হৃদি কাঁশতে কাঁশতে মুখ মুছে বললো,
‘সরি ফুপ্পি। ভাবির ডাক শুনে বিষম খেয়ে গেছি।’
মায়মুনা অস্থির চোখে তাকালেন। হিমি খানিকটা লজ্জা পেলো বোধ হয়। তবুও ওই একই ভাবে ডেকে বললো,
‘আপনি এখন বেরুবেন?’
ঘোর কাটলো তাহিরের। গলা পরিষ্কার করে বললো,
‘হ্যা।’
‘আমিও যাবো। বন্ধুদের সাথে দেখা করতে হবে। ওরা ভার্সিটির কাছের ক্যাফেতে থাকবে।’
তাহির ছোট্ট করে বললো,
‘আচ্ছা।’
.
হিমি হন্তদন্ত হয়ে ক্যাফেতে ঢোকতেই চেয়ারে গা এলিয়ে রাখা সূর্য সোজা হয়ে বসলো। মেঘ সচেতন চোখে তাকালো। দোহা সোহিনীর নিজেদের মধ্যকার কথা থামালো। হিমি টেবিলে কাছাকাছি এসেই প্রশ্ন করলো,
‘ঘটনা কি? কাল যা শুনলাম তা সত্যিই?’
কেউ কোনো জবাব দিলো না। শুধু মাথা দুলিয়ে সায় জানালো। হিমি চেয়ার টেনে বসলো। চেহারায় চিন্তার ছাপ বজায় রেখে বললো,
‘কিন্তু কেনো? সব তো ঠিক ঠাকই ছিলো।’
‘কিয়ের কি ঠিক আছিল? শালারে কতো কইরা কইলাম খুইলা ক সমস্যা কি। একটা কথাও জানায় নি! হারামখোর!’
‘কি কথা জানায় নি সূর্য? বলবি তো। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
মেঘ লম্বা নিশ্বাস টেনে বললো,
‘ইমনের বড় খালা মানে সুপ্তির মা মারা গেছেন।’
হিমি মুখ হা করে বললো,
‘কি! সুপ্তির মা মারা গেছেন? কবে? কি হয়েছিলো ওনার?’
সোহিনী শোকাহত গলায় বললো,
‘দু সপ্তাহ আগে। শুক্রবার রাত আটটার দিকে। সুপ্তির মা তো অনেক দিন যাবতই অসুস্থ ছিলেন। স্ট্রোক করেছিলেন। কয়েক সপ্তাহ আগে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিলো। ইমন বলেছিলো কিছু একটা ঝামেলা হচ্ছে পরিবারে। তখন তো জানতাম না। পরে জানলাম।’
‘কি জানলি?’
‘সুপ্তির বাবা নাকি ইমন আর সুপ্তির বিয়ে মেনে নিচ্ছিলেন না। তারপর স্ত্রীর কথা ভেবে নিমরাজি হয়েছিলেন। এর মধ্যে হঠাৎ আন্টির অসুস্থতা বেড়ে যায়। মারা যান তিনি। এরপরই বেঁকে বসেন সুপ্তির বাবা। যার কথা রক্ষার্থে বিয়েতে রাজি হয়েছিলেন সেই যখন নেই তাহলে এই বিয়ের কোনো মানে নেই। উনি কিছুতেই ইমন আর সুপ্তির বিয়ে দেবেন না।’
‘এইটুকু কারনে পালিয়ে গেলো?’
হিমির কৌতুহলী প্রশ্নের জবাবে মাথা নাড়লো দোহা। বললো,
‘এটা এইটুকু কারন নয়। এই কথার প্রেক্ষিতেই ওরা পালাতে পারতো। কিন্তু ঘটনা সেখানে শেষ হয় নি। আন্টির মৃত্যুর তিন দিন পরেই সুপ্তির বাবা তার ভাইয়ের ছেলের সাথে সুপ্তির বিয়ে দেয়ার কথা তুলেন। ওনার ভাইয়ের ছেলে এক পায়ে খাড়া। সুপ্তি কেঁদে কেটে পাগল হয়ে যাচ্ছে। ইমন তার পরিবার সমেত তাদের বাড়ি গেলে সুপ্তির বাবা না কি গেইট থেকেই বিদায় করে দেন তাদের। ইমনের পরিবারের সাথে কোনো প্রকার সম্পর্ক রাখতেও তিনি ইচ্ছুক নন। কোনো এক অজ্ঞাত কারনে ইমনের বাবার সাথে আজীবনের রেশারেশি ওনার। ইমন তবুও তার বাবাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সুপ্তির বাবার সাথে কথা বলতে বলে। ছেলের কথা ভেবে আঙ্কেল ফোন করেছিলেন। সুপ্তির বাবা ফোন তুলে যাচ্ছেতাই বলে বিশেষ করে অতীতের কিছু কথা তুলে অপমান করেন। এবার আর কিছুতেই সুপ্তির বাবার সাথে যোগাযোগ করতে চান নি আঙ্কেল। বলে দিয়েছেন জোর করে কিছু হয় না। তাই ইমনের সরে আসা উচিত।’
দোহা থামতেই মেঘ বলতে লাগলো,
‘এদিকে সুপ্তির বাবা জোর জবরদস্তি করে মেয়ের বিয়ে দিতে চাইছিলেন। রাজি হচ্ছে না দেখে সুপ্তির উপর হাতও উঠিয়েছেন শুনেছি। সেই সময় তাদের কাছে একটাই রাস্তা খোলা ছিলো। পালানো। সুপ্তির মায়ের জন্য কোন এক মাজারে শিরনির ব্যবস্থা করেছিলেন ওর বাবা। গতকাল সেখান থেকেই ইমনের সাথে পালিয়েছে সুপ্তি।’
হিমির ঘাম ছুটছে। থমথমে গলায় বললো,
‘এতোকিছু ঘটে গেছে? তোরা কি করে জানলি? এক সেকেন্ড! ইমন তোদের এসব বলেছে? সামহাও তোরা তাদের পালাতে সাহায্য করিস নি তো?’
বিরক্তি চোখে তাকালো সূর্য। বললো,
‘আরেহ না। এইটা ঠিক যে ওই আমাগো সব কথা কইছে। কিন্তু আমরা জানতাম না ওরা এমনে পালাইবো। কাল বিকালে ফোন দিছিলাম খবর জানতে। তখন বলে, “আমি সুপ্তিরে নিয়া যাইতাছি দোস্ত। এদিক টা সামলায় নিছ। ফোন দিলে পাবি না। সিম ফালায় দিতাছি। সুযোগ বুইঝা আমি যোগাযোগ করমু তোগো লগে।” এখন আবার ওর বাপ মায় ফোন দিয়া জ্বালাইতাছে। কই আছে? কি করে? কবে আইবো? বিয়া করছে নি? এমন সব প্রশ্ন কইরা কইরা মাথা খারাপ কইরা দিতাছে। সুপ্তির বাপও তাদের গালমন্দ করতাছে।’
এটুকুতে থেমে অস্ফুট স্বরে সূর্য বললো,
‘শালা গেলোটা কই?’
হিমি মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলো। মনে হলো পরিবার ছেড়ে এভাবে শুধু ভালোবাসা পাওয়ার আশায় পালানো উচিত নয়। পরিবারের উপর ছেলে মেয়ে পালানোর ভয়াবহ প্রভাব পরে। তখনই তার অনুশোচনা হলো। তাহিরের হবু বউকে ভাগিয়ে দেয়ার অনুশোচনা। তাকে পালানোতে সাহায্য করার অনুশোচনা। ইমন যেখানে তাদের বন্ধু সেখানে সামিয়া তাহিরের হবু বউ ছিলো। ইমন পালানোয় তাদের যতোটা টেনশন হচ্ছে তার থেকে কয়েক গুন বেশি টেনশন হচ্ছে তার পরিবারের। ঠিক তেমন ভাবেই টেনশন হচ্ছিলো সামিয়ার বাবা মায়ের। সন্তানদের থেকে এসব তো কখনোই প্রাপ্য নয় বাবা মায়ের। ভুল করে ফেলেছে হিমি। ইমন সুপ্তিরাও ভুল করেছে। যে করেই হোক তাদের ফেরাতে হবে। কিন্তু কি করে ফিরাবে? ওরা কোথায় আছে সেটাই তো জানে না কেউ। আর যদি ইমনদের দেখা পায় তাদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় তবে কি সব ঠিক হয়ে যাবে? না তো। উল্টো আরো ঘোলাটে হবে। সুপ্তির বাবার রাগ সপ্তম আসমান পেরিয়ে যাবে। ইমনের বাবা মায়েরও লজ্জার, অপমানের শেষ থাকবে না। উফ, কি করলো ইমন? একটা বার পরিবারের মানুষগুলোর কথা ভাবলো না? হাত পা কাঁপতে থাকে হিমির। সেই সাথে বন্ধুদের ভয় বাড়তে থাকে। কষ্ট হতে থাকে। সুপ্তির বাবা পুলিশ কেইস করে দেবে না তো? কোনোভাবে কি ওরাও জড়িয়ে যাবে এসবে? মাথা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে তাদের। এই মুহুর্তে ইমনের উপর ভয়ানক রাগ লাগছে। সবাই এক সাথে বসে কথা বললে হয়তো কোনো না কোনো রাস্তা পেতো। সেসবের সময় না দিয়েই উড়াল দিলো সে। পড়াশোনা, ক্যারিয়ার, ভবিষ্যত সবকিছুই ছুড়ে ফেলে দিলো ইমন। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিলো না!
।
নিজ কেবিনে টেবিলের উল্টো দিকে বসা তাহিরের দৃষ্টি মুখোমুখি চেয়ারে বসা হিমির দিকে। তার এই অসময়ে হাসপাতালে আসার পেছনে বিশাল গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে বলেই জানিয়েছে হিমি। কিন্তু এখনো বলছে না সেই কথা। তাহির বার বার ঘড়ি দেখছে। বাইরে প্যাশেন্টরা বসে আছেন। কাজ ফেলে অহেতুক বসে থাকতে তার মোটেও ভালো লাগছে না। থাকতে হচ্ছে তবুও। হিমি কিছু একটা বলতে গিয়েও চুপ করে যাচ্ছে। মাথা নুইয়ে রেখে ডান হাতের নখ দিয়ে টেবিলে খট খট শব্দ তুলছে। তাহির ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
‘আপনার দরকারি কথা বাড়ি গিয়ে শুনলে হয় না?’
হিমি ডানে বামে মাথা নাড়লো। তাহির আরো কিছুক্ষন অপেক্ষা করে গম্ভীর গলায় বললো,
‘আপনি কি সত্যিই কিছু বলবেন? না বলার থাকলে আসুন। সময় নষ্ট হচ্ছে আমার। আমি টাইম ওয়েস্ট করতে আর প্যাশেন্টসদের অপেক্ষা করিয়ে রাখতে পছন্দ করি না।’
হিমি শুকনো ঢোক গিলে বললো,
‘সরি।’
‘কি বলবেন সেটা বলুন।’
‘সরিই তো বলতে চাইছিলাম।’
ভ্রু কুঁচকালো তাহির। বললো,
‘কেনো? সরি বলার মতো এমন কোনো কাজ করেছেন না কি?’
‘হুম।’
মাথা উপর নিচ করলো হিমি। গাল দুটো ফুলে আছে। সেই সাথে বিষন্নতা গ্রাস করছে তাকে। তাহির জানতে চাইলো কি এমন করেছে যার জন্য এক্ষুনি সরি বলতে হচ্ছে তাকে। হিমি নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে বললো,
‘সামিয়া নিজে থেকে পালায় নি বাচ্চা ডাক্তার। আমি ওকে পালাতে বলেছি।’
প্রথমদফায় কিছু বুঝলো না তাহির। হিমির কথাগুলো বুঝার চেষ্টা করলো। যখনই বুঝলো তখনই চোখ বড় বড় হয়ে গেলো তার। হিমি নিজ থেকেই বললো,
‘খুব খুব সরি। আসলে আমি চাই নি আপনার বিয়ে হোক। তাই এটা করে ফেলেছি। ইচ্ছে করেই করেছি। তখন বুঝিনি কি ভুল করছি এখন বুঝেছি। প্লিজ, সরি।’
মুখটা কাঁদো কাঁদো করে ফেললো হিমি। তাহির উঠে দাঁড়ালো। কোমরে হাত রেখে শব্দ করে শ্বাস ফেলে বললো,
‘আপনার এই কাজটা করা উচিত হয় নি হিমি। আই অ্যাম ট্রুলি ডিজাপয়েন্টেড।’
হিমি কাঁদো কাঁদো চেহারায় উঠে দাঁড়ালো। টেবিলে দু হাত রেখে বললো,
‘আসলে আমি না ওই সময়,,,,,’
হিমিকে আর কিছু বলতে দিলো না তাহির। হাতের ইশারায় বেরিয়ে যেতে বললো। হিমি তাহিরের ইশারা বুঝেও নড়লো না। ভ্রু কুঁচকে ঠোঁট ফুলিয়ে কিছু বলবে তার আগেই তাহির গমগমে ভরাট গলায় বললো,
‘বাড়ি যান। কাজ আছে আমার।’
হিমি আর কিছু বলার সাহস করলো না। তাহিরের মুখ দেখে মনে হচ্ছে হিমির উপর তীব্র রেগে আছে সে। ভয়ঙ্কর কিছু করে দিতে পারে। বাধ্য মেয়ের মতো হিমি কেবিনের বাইরে বেরুলো। নিজের উপর ভীষন অসন্তুষ্ট সে। তাহিরের মনটাও খারাপ করে দিলো। হিমি ধিক্কার জানালো নিজেকে। কি দরকার ছিলো এসব করার? আর করলেই বা বললো কেনো এখন? কেউ তো জানতে চায় নি। জ্যাঠুমনিও বলেছিলো যেনো কাউকে কিছু না জানায়। তবুও অনুশোচনার ভারে নুইয়ে পরছিলো কি না, সাধু সেজে দোষ স্বীকার করতে এসে আরো সব বিগড়ে দিলো।
চলবে,,,,,,,,,