হিমি পর্ব-৮

0
1100

হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার

০৮.

ঘড়ির কাটা রাত বারোটার ঘর অতিক্রম করেছে। আকাশে বাঁকা চাঁদ, অগণিত তারাদের মেলা। চাঁদের রঙ সোনালী ঠেকছে। থমথমে পরিবেশ চারপাশে। জানালায় দাঁড়ানো মিশ্মির খোলা চুল গুলো হালকা উড়ছে। চোখের কোনে জমেছে স্বচ্ছ জ্বল। পলকহীন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চাঁদ দেখছে সে। মনে মনে কথাও বলছে প্রচুর। সে কথাগুলো বাইরের জগতের শোনা বারণ। কাউকে জানানো বারণ। বুকের ভেতরের দীর্ঘশ্বাস বুকেই নিভে যাচ্ছে। মিশ্মির গাল বেয়ে নোনা জ্বল গড়ায়। ঘাড় কাত করে সে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে কান্না আটকায়। ঘরের দরজায় টোকা পরে। মিশ্মির ধ্যান ভাঙে। ওড়নার আঁচল দিয়ে চোখ মুছে মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করে,

‘কে?’

ওপাশের ব্যক্তি জবাব না দিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে আসে। পুরো ঘর অন্ধকারে নিমজ্জিত। জানালার পাশটায় হালকা আলো। মিশ্মির অবয়ব দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। ঘরের দিকে মুখ করে থাকায় চাঁদের আলো পেছনে আঁচড়ে পরছে। চেহারা দেখা যাচ্ছে না মোটেও। হিমি ভ্রু হালকা কুঁচকে মিশ্মির দিকে তাকায়। বলে,

‘তুই ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? ঘুমাস নি?’

‘ঘুম আসছে না আপু। তাই হাঁটছিলাম।’

হিমি পকেটে দু হাত গুজে মিশ্মির দিকে এগোয়। মিশ্মি উল্টো ঘুরে আবার‌ও জানালায় হাত রাখে। হিমি বাইরে দেখে মৃদু হাসে। বলে,

‘চাঁদের সাথে গল্প করছিস না কি?’

‘হুম। তুমিই তো বলেছিলে চাঁদের সাথে গল্প করা উচিত!’

হিমি খানিকটা চমকায়। শান্ত গলায় বলে,

‘নিহানকে মনে আছে তোর? আমার মামাতো ভাই! ও নাকি তোর ভার্সিটিতেই পড়ে। দেখা হয়েছে কখনো?’

মিশ্মি মাথা উপর নিচ করে জানান দেয় ‘হ্যাঁ, হয়েছে!’ হিমি কথাটা কি করে বলবে ভেবে পায় না। এমন কোনো কথা তুলতে হবে যাতে বুঝা যায় মিশ্মি নিহানকে ভালোবাসে কি না। কিন্তু কি করে কি বলবে? হিমির অস্বস্তি চোখ এড়ায় না মিশ্মির। কপালে চিন্তার ভাজ ফেলে প্রশ্ন করে,

‘কিছু বলবে আপু?’

হিমি আর ভণিতা করে না। ঝট করে বলে বসে,

‘তুই কাউকে ভালোবাসিস?’

মিশ্মির বুক ধক করে উঠে। শ্বাস প্রশ্বাস দ্বিগুন গতিবেগে বাড়ছে। হিমির অজান্তেই ঢোক গিলে মিশ্মি। ঠোঁটে জিহ্বা চালিয়ে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে। বলে,

‘হঠাৎ এ কথা কেনো?’

‘এমনি।’

কথাটা বলে শান্ত দৃষ্টিতে বাইরে তাকালো হিমি। কিছুক্ষন পর বললো,

‘তুই যদি কাউকে ভালোবাসিস তবে আমাকে বলতে পারিস। আমি তোকে সাহায্য করবো। মামী, ছোটমামা ওরাও মেনে নেবে অবশ্য। তবুও যদি কখনো কোনো হেল্পের প্রয়োজন হয় তবে আমি আছি।’

মিশ্মি ঠোঁট চ‌ওড়া করে হাসে। নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে বলে উঠলো,

‘এমন কোনো প্রয়োজন‌ই পরবে না। আমার দ্বারা এসব হবে না জানো! প্রেম ভালোবাসা এসব বুঝা মুশকিল। আমি তো ঠিক করেই রেখেছি আব্বু, আম্মু যাকে বলবে তাকেই বিয়ে করবো। একদম নাইন্টিন্সদের মতো বিয়ে হবে। আমি ছেলেকে দেখবো না। তার সাথে কথা বলবো না। তার নামটাও জানবো না। হুট করেই বিয়েটা হবে।’

হিমি বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। মিশ্মি এমন বিয়ে করতে চায়? বিশ্বাস হয় না তার। পৃথিবীতে কিছুই অসম্ভব নয়। মানুষের মনে তো অসম্ভব সব কিছুই সম্ভব। যখন তখন যা তা মন চাইতেই পারে। আর চাওয়াটাকে পাওয়ার অদম্য চেষ্টাও করা যেতে পারে। সুতরাং মিশ্মির চাওয়াটাকেও পাওয়াতে রুপান্তর করতে হবে। হিমি আর কথা বলে না। কথা বলে না মিশ্মিও। বেশ অনেকক্ষন নিরবতায় ছেয়ে থাকে ঘর। পিনপতন নিরবতাকে বজায় রেখেই হিমি বেরিয়ে যায়। মিশ্মি লম্বা শ্বাস টেনে নেয়। বুকের ভেতরের পাথরটা ভারি হচ্ছে। চোখে অশ্রুরা ঝরে পরার চেষ্টায় আছে। মিশ্মি সে সুযোগ না দিয়েই জানালা বন্ধ করে দিলো। ওয়াশরুমে ঢোকে বেসিনের নল ছাড়লো। দুহাতে পানির ঝাপটা মারতে লাগলো চোখে মুখে। নোনা জ্বলগুলো পানিতেই মিশে গেছে। মিশ্মি লাল হয়ে যাওয়া চোখ মুছে হাসলো। বাইরে এসে সটান শুয়ে পরলো খাটে। মুখের পানি মুছলো না। ফ্যানের বাতাসে পানি শুকাতে লাগলো। ঘরের দরজা হাট করে খোলা রেখে হিমি বেরিয়েছিলো। এখনো তাই আছে। মিশ্মির খেয়াল নেই তাতে। ঘুমের অপেক্ষা করতে হলো না অবশ্য‌। মেডিসিনের প্রভাবে চোখ লাগা মাত্র ঘুমের শহরে পারি জমালো মিশ্মি।
.
.
.
ব্রীজের উপর গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়ালো তাহির। হিমির সাথে দেখা করতেই এখানে আসা তার। গায়ে ধূসর শার্ট, কালো জিন্স। এই মাঝরাতেও চুল পরিপাটি তার। পরনের পোশাকও ফিটফাট। ব্রীজে গাড়ির চলাচল কম নয়। বরং অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি। এতো রাতেও গাড়ি চলে? প্রশ্নের উত্তর খুঁজে না তাহির। ব্যস্ত রাস্তার দিকে তাকায়। বেশ অনেকক্ষন পরেও হিমির দেখা না পেয়ে ফুটপাতে গিয়ে বসে। নিজের কাজে নিজেই হতভম্ব সে। একটা মেয়েকে সরি বলতে এতোদূর ছুটে এসেছে? সরি! এই একটা শব্দ বলতে এতো হন্নে কেনো তাহির। তাও সেই মেয়েকে যার নাম ছাড়া আর কিছুই জানে না। তার এই কাজ ঠিক হচ্ছে কি? মা যদি জানতে পারে তবে নিশ্চয় কষ্ট পাবে! তাহিরের মুখ চুপসে যায়। আর অপেক্ষা করে লাভ নেই। হিমির সাথে হয়তো দেখা হবে না কোনোদিন। না হ‌ওয়াটাই ভালো। কিছু মানুষ অজ্ঞাত‌ই থাকে। তাদের সাথে চলার পথে হুট হাট দেখা হয়, কোনো কারন বশত মনে তাদের ছাপ থেকে যায় কখনো থাকে না। কিন্তু তাদের নিয়ে ভাবলে চলবে না। কোনো একদিন হুট করেই হয়তো দেখা হয়ে যাবে। তখন না হয় সরি বলা হবে, জানা হবে কিছু কথা। তাহিরের কি কিছু জানার আছে হিমির থাকে? এই প্রশ্নটা নিজের কাছেই অদ্ভুত ঠেকে তার। নিজের মনেই হাসে তাহির। মাথা চুলকে ড্রাইভিং সিটে বসে সিটবেল্ট পরে নেয়। সাথে সাথে বেজে উঠে মুঠোফোন। পাশের সিট থেকে ফোন তুলে রিসিভ করে তাহির। মায়ের চিন্তিত কন্ঠস্বর কানে আসে,

‘কোথায় তুমি তাহির? কখন আসছো?’

তাহির শান্ত গলায় জবাব দেয়,

‘অন দ্যা ওয়ে আছি মা। চিন্তা করো না। এক্ষুনি বাড়ি ফিরছি।’

মায়মুনা জামান স্বস্তি পান। হাতের তসবি ঠোঁটে ছুঁয়ান। ছেলের ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে আত্মা কেঁপে উঠেছিলো তার। কোনো বিপদ আপদ হলো কি না ভেবেই বুক ফেটে যাচ্ছিলো মায়ের। তসবি হাতে নিয়েই জপতে লাগলেন আল্লাহর নাম। সহীহ সালামত যেনো ফিরে আসে তার একমাত্র সন্তান। ছেলের গলার স্বর শোনে মন তৃপ্তি পেলেও ভয় কাটে নি। কখন বাড়ি ফিরবে এই চিন্তায় সদর দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন তিনি। তসবি পড়া থামে নি যদিও।
.
.
.
ব্রেকফাস্ট টেবিলে গোগ্রাসে খাবার গিলছে নিহান। মুহিব রহমান ভাতিজাকে পর্যবেক্ষন করে বললেন,

‘কোথাও যাবি না কি?’

নিহান খাবার মুখে পুরতে পুরতে মাথা নাড়ে। মুহিব মাথা দুলিয়ে চায়ে চুমুক দিলেন। চিনি বেশি হয়ে যাওয়ায় চা শরবতে পরিণত হয়েছে। চোখ মুখ কুঁচকে চায়ের কাপ সরিয়ে রাখলেন তিনি। রুটি ছিড়ে তরকারিতে লাগিয়ে মুখে পুরে বললেন,

‘নিহান? আস্তে খাও! এমন ভাবে খাচ্ছো যেনো অনেক দিনের অভুক্ত।’

নিহান খাবার চিবোতে চিবোতে বললো,

‘চাচ্চু, ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। তাড়াহুড়া করে না খেলে লেইট হয়ে যাবো!’

মুহিব গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

‘ক্লাসের এতো চিন্তা থাকলে ভোরে উঠা উচিত ছিলো। রাতভর বন্ধুদের সাথে জেগে আড্ডা দিয়ে ভোরসকালে ঘুমালে লেইট তো হবেই!’

নিহান কিছুটা লজ্জা পেলো। মাথাটা নুইয়ে রাখলো সে। মুহিব রহমানের বাবা মতিউর রহমান বিরক্তি গলায় বললেন,

‘আহ! ছেলেটা খাচ্ছে খেতে দাও। এভাবে খাওয়ার মাঝখানে ধমকে ধামকে তাকে লজ্জা দিচ্ছো সাথে কষ্ট‌‌ও! দেরি তো যা হ‌ওয়ার হয়েছেই। এখন পেট ভরে খেয়ে যাক।’

রাদিবা শ্বশুরের কথায় ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটালেন। নিহানের বাবা জনাব নেহাল রহমান মুখ ভার করলেন। আজীবন খাবার তাড়াতাড়ি খান বলেই বাবা তাকে বকেছেন প্রচুর। অথচ নাতিকে একটখ টু শব্দ‌ও বলেন না। ব্যাপারটা ওনার কাছে ভালো লাগে না। ভালো লাগে না আমিনার‌ও! মুহিব রহমান তাচ্ছিল্য হেসে খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। পাঞ্জাবী ঠিক করে বাবার উদ্দেশ্যে বললেন,

‘হিমিও সেদিন তাড়াতাড়ি খাওয়ার চেষ্টায় ছিলো। হাফসার বড় ভাবি তথা হিমির মামানি ডেকে পাঠিয়েছিলেন। শুনলাম ওর এই অপরাধে প্লেট ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে?’

মতিউর রহমান থমকান। তবে কিছুক্ষনের জন্য। খাওয়ায় মনোযোগী হয়ে বলেন,

‘মেয়েদের একটু শাসনে রাখতে হয়!’

‘ওবাড়ি থেকে এবাড়ি আসতে দু ঘন্টা মতো লাগে বাবা। শুনলাম সেদিন ফিরতে দেরি হয়েছে বলে ঘরে ঢোকতে দেয়া হয় নি?’

মুহিব রহমান তীক্ষ্ণ গলায় বলেন। মতিউর রহমান কঠোর গলায় বললেন,

‘তুমি কোথায় শুনলে? কে দেয় এসব খবর?’

‘সেটা জরুরি নয়। জরুরি হলো মেয়েদের শাসনে রাখতে হবে বলে মাঝরাতে ঘরের বাইরে বের করে দিতে হয়? ‌ওতো রাতে এখান থেকে বেরিয়ে ও বাড়ি যেতে যেতেও প্রচুর সময় লেগেছে। সে রাতে তার এক্সিডেন্ট হয়েছিলো। জানেন?’

মতিউর রহমান ফুঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলেন,

‘মেয়ে বাইক চালায় কেনো?’

মুহিব হাসেন। ধীর পায়ে সে স্থান থেকে প্রস্থান করেন। মতিউর রহমান পুরু ভ্রু জোড়া নিক্ষেপ করেন ব‌ড় ব‌উমার দিকে। আমিনা মাথা নত করে রান্নাঘরে গিয়ে ঢোকেন। এসব খবর যে উনিই দিয়েছেন মুহিব রহমানকে তা বুঝতে কারো বাকি নেই।

চলবে,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here